দর্পহরন #পর্ব-২

0
514

#দর্পহরন
#পর্ব-২

শুভ্রার ঠিক বিপরীতে বসে আছে সে। গম্ভীর মুখ নিবন্ধিত আছে মোবাইলে। টমক্রজের স্টাইলে কাটা চুলগুলো মাঝে মাঝে হাত দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে শুভ্রাকে দেখে নিচ্ছিল। এরইমধ্যে ওকে নড়তে দেখে হাতের মোবাইলটা প্যান্টের পকেটে চালান করে সোজা হয়ে বসলো।

আধো আধো বোজা চোখ মেলতেই সুদর্শন যুবা পুরুষটিকে দেখে হচকে গেলো শুভ্রা। ঘোর ভেঙে গেল সহসাই। চোখ দুটো বিস্ফোরিত। ছেলেটার সাপের মতো শীতল দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে থাকতে দেখে ভয়ের শীতল একটা অনুভূতি শুভ্রার পিঠ বেয়ে নেমে যাচ্ছে। কোথায় আছে সেই প্রশ্ন মাথায় উঁকি দেওয়ার আগেই তলপেটে তীব্র চাপ টের পেয়ে ছটফটিয়ে উঠলো শুভ্রা। আওয়াজ করতে যেয়ে বুঝলো তার মুখ স্কচটেপ দিয়ে আঁটকানো। নড়তে যেয়ে তীব্র ব্যাথা টের পেলো কাঁধ আর হাতে। মাথা ঘুরিয়ে দেখলো হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। পায়ের থাই এর অংশটা দড়ি দিয়ে চেয়ারের সাথে কষে পেঁচানো বিধায় শুভ্রার নড়বারও কোনো উপায় নেই। বৃথা জেনেও নিজের সমস্ত শক্তি ব্যায় করে শরীরটা নাড়াবার চেষ্টা করলো একবার। না পেরে পা দুটো মেঝেতে দাপালো কয়েকবার। তাতেও সামনের মানুষটার কোন ভ্রুক্ষেপ হলো না। অসহায় বোধ হচ্ছে শুভ্রার। অনুভূতি কাজ করছে না ঠিকঠাক। তার কি রাগ হওয়া উচিত? কি হচ্ছে তার সাথে ধারণা নেই কোন। তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে কিন্তু কেন? তার অপরাধ কি? জানতে চাওয়ার উপায় নেই।

শুভ্রা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো সামনে বসে থাকা ছেলেটা ওর পুরো কর্মকান্ড বেশ আয়েশ করে উপভোগ করছে। মুখটা হাসি হাসি করে তাকিয়ে আছে শুভ্রার দিকে। তলপেটের চাপ বাড়ছে বলে থাকতে না পেরে আবারও মেঝেতে পা দাপালো শুভ্রা। ছেলেটা এবার দন্ত বিকশিত হাসি দিলো যা দেখে তীব্র জলীয় নিষ্কাশনের চাপ নিয়েও শুভ্রা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো ছেলেটার দিকে। মনে হচ্ছে বাইশ বছরের এক দীপ্তমান তরুন। শুভ্রার চাহুনি টের পেয়েই মনেহয় নিজেকে সামলে নিলো ছেলেটা। গম্ভীর স্বরে জানতে চাইলো-“ওয়াশরুম যেতে চান?”
স্বজোরে মাথা দুলায় শুভ্রা। তবুও জায়গা থেকে উঠতে দেখা গেল না তাকে। স্থির চোখে চেয়ে থেকে বললো-“আমি আপনার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেব যদি আপনি লক্ষী মেয়ের মতো আমার সব কথা শোনের।”
উপায় না পেয়ে তড়িৎগতিতে মাথা দুলায় শুভ্রা। ছেলেটা এগিয়ে এসে ওর হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিলো-“দাঁড়াবেন না। আপনার বামে ওয়াশরুম।”
দীর্ঘ সময় বাঁধা থাকার কারনে হাত পা অসার হয়ে আছে। চাইলেও নড়তে পারছে না শুভ্রা। ওকে হতচকিত করে ছেলেটা প্রায় চ্যাংদোলা করে ওকে ওয়াশরুমের ভেতর পৌঁছে দিয়ে বললো-“কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসুন। দেরি হলে আমি ভেতরে ঢুকে যাব কিন্তু। আর হ্যা মুখের স্কচটেপ খোলার চেষ্টা করবেন না নিজেই আহত হবেন।”
প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েই বেরিয়ে গেলো ছেলেটা। তলপেটের চাপে বেশি কিছু ভাববার সুযোগ পেল না শুভ্রা। দ্রুত নিজের কাজ শেষ করে খুড়িয়ে খুড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। ও বেরুনো মাত্রই ছেলেটা ওর হাত দুটো পিছমোড়া করে বেঁধে ফেললো। ওকে ঠেলে চেয়ারে বসিয়ে পা বেঁধে দিয়ে ওর সামনে চেয়ার টেনে বসলো-“আপনি নিশ্চয়ই এতোক্ষণে বুঝতে পারছেন আপনাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে?”
শুভ্রা মাথা দুলায়।
“আপনার সুবিধার জন্য কিছু কথা বলে দিতে চাই আপনাকে। যতই চেষ্টা করেন না কেন এখান থেকে আপাতত মুক্তি পাচ্ছেন না আপনি। বিশেষ উদ্দ্যেশে আপনাকে অপহরণ করেছি। কাজ শেষ হলে স্বসম্মানে ছেড়ে দেওয়া হবে আপনাকে। আপনার অন্য কোন ক্ষতি করার ইচ্ছে নেই আমাদের যদি না আপনি বাধ্য করেন। শুধু কিছুদিন অতিথি হয়ে বন্দী থাকতে হবে এখানে। সেই থাকাটা কতটা ভালো হবে সেটা আপনার আচরণের উপর নির্ভর করছে। আপনি যেমন আচরণ করবেন তেমন অতিথি আপ্যায়ন হবে। আর হ্যা, রুমটা সাউন্ড প্রুফ কাজেই চিৎকার চেচামেচি করে লাভ হবে না। এখন আপনি ঠিক করুন কি করবেন।”
শুভ্র মুখে কিছু বলার চেষ্টা করলো কিন্তু সেটা গো গো শব্দ ছাড়া আর কিছু মনে হলোনা।
“কিডন্যাপের কারন জানতে চান?”
শুভা মাথা নাড়তেই হাসলো ছেলেটা-“কারণটা আপনার না জানলেও চলবে। এখানে আপনি যত কম জানবেন তত মঙ্গল আপনার জন্য। সেটা অবশ্য এখন বুঝবেন না। ভবিষ্যতে ভালো টের পাবেন।”
কথার মাঝে ছেলেটার ফোন বেজে উঠলো। প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে কেটে দিয়ে শুভ্রাকে দেখলো-“আজকের মতো যাচ্ছি। কষ্ট করে আজ রাতটা না খেয়ে থাকতে হবে আপনাকে। কাল যদি সম্ভব হয় খেতে দেব আপনাকে।”
শুভ্রা তীব্র বেগে মাথা নাড়ে, মেঝেতে পা দাপায়। খিদের তার পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে। সর্বশেষ দুইদিন আগে ভরপেট খেয়ে প্লেনে চড়েছিল। কাল পুরোটা দিন জার্নিতে কেটেছে বলে ঠিকমতো খাওয়া হয়নি। যতদূর মনে পড়ে সকাল দশটায় বেড়িয়েছিল এয়ারপোর্ট থেকে। ছেলেটা আবারও মুচকি হাসলো-“একদিন দুইদিন না খেয়ে থাকাটা এমন কঠিন কোন ব্যাপার না মিস শুভ্রা। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে তবে ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে। আসছি কেমন? ঘুমিয়ে পড়ুন। আরে আরে অবাক হচ্ছেন কেন? হ্যা হ্যা এভাবেই ঘুমাতে হবে আপনাকে। দেখবেন এটাও অভ্যাস হয়ে যাবে একসময়।”
বলতে বলতে চোয়াল শক্ত হলো ছেলেটার-“নরম বিছানায় ঘুম আর যা ইচ্ছা তা খাওয়া তো হলো অনেক। অনেকদিন তো আকাশে উড়লেন এবার একটু মাটিতে থেকে দেখুন কেমন লাগে। চলি কেমন? গুড নাইট।”
লোকটা বেরিয়ে যাওয়া মাত্রই রুমের বাতি নিভে গেল। অন্ধকারে ডুবে গেল শুভ্রা। অসহ্য খিদেয় ছটফট করতে করতে শুভ্রা ভেবেই পেল না এই ছেলেটার কি ক্ষতি করেছে সে। কখনো দেখেছে বলেও মনেহয় না। তাহলে? কেন তাকে এখানে আটকে রেখেছে? কি অপরাধে? আর ছোট চাচা তো জানতো তার আসার খবর। তাকে না পেয়ে কি বাবাকে জানায়নি ছোট চাচা? আর বাবা জেনে চুপচাপ বসে থাকবে এও কি সম্ভব? ভাবনারা ডালপালা ছড়ায় কিন্তু কুল না পেয়ে আবারও একই জায়গায় ফেরত আসে। খিদেয় কাতর শুভ্রা একসময় ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে।

★★★

গাড়ি এলাকায় ঢুকতেই সিটে সোজা হয়ে বসলেন ইব্রাহিম সালিম। গাড়িতে ঘুমিয়ে গেছিলেন। এখন ঘুম থেকে উঠে বেশ আরাম বোধ হচ্ছে। ঝিমঝিম ভাব কেটে গিয়ে মাথাটা একটু একটু করে কাজ করতে শুরু করেছে। একবার ঘড়ি দেখার চেষ্টা করলেন। অন্ধকার বলে পারলেন না। গাড়ির বাতি জ্বালানোর ইচ্ছে করছে না। তিনি গলা খাকরানি দিলেন-“তুহিন, কয়টা বাজে রে?”
“সাড়ে বারোটা বাজে স্যার।”

ইব্রাহিম সালিম পাল্টা জবাব না দিয়ে বাইরে তাকালেন। রাত হয়েছে বলেই রাস্তা অন্ধকার। দু’পাশের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে, জনমানব শুন্য রাস্তা। মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ি চলছে অবশ্য। সালিম সাহেব ফোঁস করে শ্বাস ফেললেন। তার এলাকায় লোকেরা রাত তো দূরে থাক সন্ধ্যা থেকে ঘর থেকে বের হয় না। কারনটা কি ইব্রাহিম পরিবার নয়?

চিন্তাধারা পরিবর্তন হতে দেখে নিজের উপর বিরক্ত হলেন সালিম সাহেব। ভ্রু কুঁচকে ভাবলেন তিনি কি বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন? এরকম দূর্বল চিন্তা আসছে কেন তার মাথায়? নেত্রী একবার পিছিয়ে যেতে বললেই কি হাত পা গুটিয়ে নেবেন? একবার নির্বাচন করতে না পারলেই কি জীবন শেষ হয়ে যাবে? তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা হলো সব শেষ হয়ে গেছে এমন ভাবনা ভাবছেন কেন তিনি? হতে পারে এটা অপজিশনের ষড়যন্ত্র। কে এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে তা জানতে হবে তো? আজকাল প্রচুর শত্রু বেড়েছে তার। নেত্রীর সাথে তার আন্তরিক সম্পর্কটাও অনেকে সহ্য করছে না। কেউ হয়তো নেত্রীর কানে বিষ ঢেলেছে তার নামে।
তা না হলে নেত্রী কেন তাকে সরে দাঁড়াতে বলবে? আর বললেই সরে যেতে হবে নাকি? শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবেন পদ পাওয়ার।
“স্যার, চলে আসছি।”
তুহিনের ডাকে বাস্তবে ফেরে ইব্রাহিম সালিম। তাকিয়ে দেখলেন তুহিন দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। ক্লান্ত পায়ে নেমে বাড়ির ভেতর ঢুকলেন সালিম সাহেব। ড্রয়িংরুমে এসে বসতেই স্ত্রী রিমা একগ্লাস জল নিয়ে এলো। তিনি নিঃশব্দে জল পান করলেন। রিমা মৃদুস্বরে বললো-“আপার শরীর ভালো আছে?”
সালিম সাহেব চোখ বুঁজে মাথা দুলালেন। রিমা তবুও দাঁড়িয়ে রইলো। দু’টো জরুরি খবর দিতে হবে মানুষটাকে। সে মানুষটার মেজাজ বুঝতে চাইছেন। সালিম সাহেব রিমার অস্তিত্ব টের পেয়ে চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন-“কিছু বলবা?”
রিমা মাথা নাড়লো। সালিম সাহেব গর্জে উঠলেন-“তো খাম্বার মতো খাড়াই আছে কেন? কয়া ফালাও।”
তুমুল গর্জনে রিমার শরীর কেঁপে উঠলো। এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন তিনি। রিমার মুখে যেন তালা লেগে লেগো। বলার সাহস করে উঠতে পারছেন না। সালিম সাহেব রক্তচক্ষু নিয়ে চাইলেন-“কি হইলো? কথা কও ন কেন?”
“শারমিন দুইদিন ধইরা ফোন করে না। আইজ আমি ফোন দিছিলাম ওয় ধরে নাই।”
মেয়ের কথা শুনে কিছুটা নরম হলেন ইব্রাহিম সালিম। মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নাড়েন-“পড়ালেখা নিয়া ব্যস্ত মনেহয়। আর ও না ধরলে মালিহাকে ফোন দাও।”
রিমা ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলো-“দিছিলাম। ও কইলো কিছু জানে না। ওয় জামাই নিয়া বেড়াইতে গেছে অন্য শহরে।”
রিমার জবাবে অসন্তুষ্ট হলেন সালিম সাহেব-“তুহিনকে কইছিলা? সারাদিন পরে এই খবর দিলা? আচ্ছা সকাল দেখতেছি কি করা যায়।”
“আরেক খান কথা।”
রিমার বুক কাঁপছে দুরুদুরু। এই খবর পেয়ে কি করবেন সালিম সাহেব সে জানে না তবে এটা খুব জরুরি।
“আর কি কইবা? এই মাঝরাইতে বাড়িত আইসাও শান্তি নাই দেখতেছি।”
“সোহেল মাইয়্যা তুইলা আনছে আইজকা।”
রিমার কথা না বুঝে সালিম সাহেব পুনরায় জানতে চাইলো-“কি কইলা?”
রিমাকে আতঙ্কিত দেখায়-“সোহেল বিকালে এক মাইয়া তুইলা আনছে। আঁটকায়া রাখছে টং বাড়িতে। কয় ওই মাইয়াকে বিয়া করবো।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here