#দর্পহরন
#পর্ব-২০
সারাদিন ছোটাছুটির উপর আছে রণ। এরমধ্যেই মিহিরের ফোন-“ভাই, একটা খারাপ খবর আছে।”
রণ দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। এই মেয়েটাকে বিয়ে করার পর থেকে সব খারাপ খবরই পাচ্ছে। সে ম্রিয়মান কন্ঠে বললো-“কি হয়েছে বল।”
“খাদেমের বউ আর বাচ্চাকে সালিম সাহেব খুঁজে পেয়ে নিজের ডোরায় তুলে নিছিলো। ওর বাচ্চাকে আঁটকায়া রাখছে। বউকে বলছে মামলা তুলে নিতে। তাইলে বাচ্চাকে দিবে।”
খবরটা শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো তার। চেচিয়ে উঠে বললো-“ওদের কিভাবে খুঁজে পেলো মিহির? কোথায় রেখেছিলি ওদের?”
মিহির মিনমিন করলো-“ভাই, কিভাবে খুঁজে পেলো জানি না। আমি নিজেও আশ্চর্য হয়ে গেছি। কেউ হয়তো ফাঁস করছে নাহলে তো খোঁজ পাওয়ার কথা না। এইদিকে নান্টুকেও পাওয়া যাইতেছে না।”
রণ গর্জন করে উঠলো-“কেমন লোক দিয়ে কাজ করাচ্ছিস মিহির? কে এমন কাজ করেছে খুঁজে বের কর। বিশ্বাসঘাতককে চিনে রাখতে হবে।”
“আচ্ছা ভাই। আমি দেখতেছি।”
রণ বিরবির করলো-“ইব্রাহিম সালিম, এই লোক কোনদিন ভালো হবে না। আর আমি ঘরের মধ্যে এই লোকের ছাও পুষতেছি। আচ্ছা রাখলাম। ব্যস্ত আছি এখন পরে কথা বলবো।”
মিহির চুপ করে রইলো। নিজেকে অপরাধী লাগছে তার। রণ ভাই কত ভরসা করে কাজ করতে দিয়েছিল।
দিলশাদের মেজাজ চরম খারাপ হয়ে আছে। রিমান্ডের পাঁচদিন পেরিয়ে গেছে অথচ সোহেলের কাছ থেকে একটা কথা বের করা যায়নি। কথা আদায়ের নানারকম পদ্ধতি ব্যবহার করা যায় কিন্তু দিলশাদ দ্বিধান্বিত। চাইলে সোহেলকে শেষ করে দিতে পারে অন্তত ওর মনেপ্রাণে এমনই ইচ্ছা কিন্তু এখনও সময় হয়নি। কেবলই এখানে এসেছে, একটু পাকাপোক্ত ভাবে বসতে হবে। জাল ফেলে সুতো ছাড়ার সময় এখন। বড় বড় মাছ জালে এলেই কেবল সুতো গোটানো শুরু করবে। এখন ধৈর্য্য ধরে থাকতে হবে, কোন উপায় নেই। ফোন বাজছে। দিলশাদ বিরক্ত হয়ে মোবাইল স্ক্রিনে চোখ রাখে। রণর ফোন দেখে তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ায়-“ভাই, আপনি হঠাৎ?”
“দিলশাদ, একটা বিপদ হয়ে গেছে রে।”
“কি হয়েছে ভাই?”
“খাদেমের বউয়ের খবর পেয়ে গেছে সালিম সাহেব। বউটা হয়তো যে কোন সময় তোর কাছে যাবে মামলা তুলে নিতে। সোহেল নিশ্চয়ই কিছু বলেনি এখনো?”
দিলশাদ অবাক হলো না। সে জানতো এমন কিছুই হবে। স্বাভাবিক গলায় জানতে চাইলো-“কিছু বলেনি ভাই। কি করবো তাহলে?”
রণ হাসলো-“আমাকে বিশ্বাস করিস তো দিলশাদ?”
“একশোভাগ। হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন ভাই?”
“এমনিতেই। শত্রুর সাথে আত্মীয়তা করেছি সবাই ভুল বুঝতে পারে সেজন্যই জানতে চাইছি। আচ্ছা শোন, আপাতত সোহেলকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা কর।”
দিলশাদ হাসলো-“খাদেমের বউ চলে আসছে ভাই। মামলা ডিশমিশ হলে তো ছেড়ে দিতেই হবে। আপনি চিন্তা করবেন না।”
রণ গম্ভীর হলো-“আপাতত বলেছি দিলশাদ। আপাতত ও খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিক। পরে দেখবো কি করা যায় ওকে নিয়ে।”
“ঠিক আছে ভাই। দেখছি আমি।”
রণ ফোন নামিয়ে রেখে চেয়ারে হেলান দিলো। আরেকটা হারের মালা গলায় চড়লো। সামনের পরিস্থিতি আরো কঠিন হবে বুঝতে পারছে। কিভাবে সব গোছাবে বুঝতে পারছে না। চোখ বুঁজে রকিং চেয়ারে দোল খেতে লাগলো চোখ বুঁজে।
★★★
“আব্বা! আইছোস তুই?”
সালিম সোহেলকে বুকে জড়িয়ে নিলো। সোহেল বাবার বুকে মাথা গুঁজে অভিমানী কন্ঠে বললো-“দশদিন আব্বা। দশদিন জেলে থাকা লাগলো। কত কষ্ট হইছে বুঝতে পারছেন?”
সালিম অতি কষ্টে নিজের আবেগ দমন করলো। ছেলের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললো-“যে অবস্থা ছিলো আব্বা। আমি ভাবছি তোকে আর দেখতে পাবো না। আল্লাহর শোকর, আমার শুভ্রা এইবার আমার দায়িত্ব তার কাঁধে তুলে নিছে।”
সোহেল বাবার বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে বিস্ময় নিয়ে বললো-“শুভ্রা! ও কেমনে কি করলো?”
সালিম গর্বিত হাসি দিলো-“দেখতে হইবো না কার মাইয়া? আমার মাইয়া আমার মতোই সাহসী। প্রতিমন্ত্রীরে তোর দুলাই বানাইছে। বুঝছোস কিছু?”
সোহেল হতবাক-“বিয়া হইছে শুভ্রার? আমারে ছাড়া?”
“তোর লাইগা আব্বা। শুভ্রা তোর লাইগা তোরে ছাড়া বিয়া করছে। তোরে মুক্ত করার লাইগা। পরশু দিন জামাইবাবা পার্টি রাখছে। শুভ্রা চাইছে আমরা পুরা পরিবার সেই পার্টিতে উপস্থিত থাকি। তাই তো তোরে মুক্ত করতে পারছি।”
“সত্যি আব্বা! আমার ছোট বোন এতো বড় হইলো কবে?”
সোহেল আপ্লুত হয়, কেঁদে দিলো আবেগে। রিমা নরম কন্ঠে ধমক দিলো-“কি শুরু করছেন আপনেরা বাপ পোলা? ওয় কত্তদিন পর আইছে ওরে গোসল করতে দেন, খাইতে দেন।”
সালিম চোখ মুছলেন-“হহহ আব্বা, তুই যা। গোসল কইরা আয় আমরা একলগে খামু।”
সোহেল মাথা নাড়ে। জেলের মধ্যে এইবার খাতিরদারি হয় নাই। খুব কষ্ট গেছে। সেসব মনে করে মনটা তেতো হলো। আনমনা হয়ে নিজের রুমে ঢুকতেই তুলতুলের উপর নজর গেলো। মেয়েটা হঠাৎ ওকে ঢুকতে দেখে ভীষণ চমকে গেছে। এরপর ওর চোখে দেখা গেলো ভয়। ভয়ে ভীত হয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে মেয়েটা। সোহেল কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই সোহেলের চেহারা থেকে বিরক্তি মিলিয়ে গেলো। ক্রুর একটা হাসি দিয়ে বললো-“আমাকে ছাড়া কয়দিন খুব ভালো আছিলা মনেহয়? চেহারা তো খুব খোলতাই হইছে দেখাযায়?”
তুলতুল ঢোক গিললো। আসলেই কয়দিন সে খুব আনন্দে ছিলো। একদম নিশ্চিত নির্ভাবনায়। হুট করে সোহেলকে দেখে মনে মনে ভীষণ ঘাবড়ে গেছে। সোহেলকে দেখে তুলতুলের গা গুলিয়ে বমি পেলো। ওর গা থেকে ভুরভুর করে গন্ধ আসছে। সোহেল ওর নিশ্চুপতা দেখে কয়েকপা এগিয়ে এলো। তুলতুল পিছিয়ে গেলো দেখে সোহেল হাসলো-“পালাইয়া যাইবা কই? বউ লাগো না তুমি আমার? ভাবছিলাম তোমারে আর ধরুম না। সোহেল একবার ফেলা জিনিস ধরে না। কিন্তু আজই মনে হইতেছে ভুল কইছিলাম।”
সোহেল ঠোঁট চাটলো। তুলতুলের বুক ধুকপুক করছে। পালাতে মন চাইছে। কিন্তু কিভাবে পালাবে? সোহেল কি ভেবে বললো-“দাঁড়াও গোসল দিয়া আসি। ঘুপচি জেলের মধ্যে থাইকা খুব খারাপ অবশ্য হইছে। গায়ে গন্ধ করে।”
নিজের গায়ের গন্ধ শুকে নাকমুখ কুঁচকে গেলো সোহেলের। সে বাথরুম ঢুকে যেতেই তুলতুল ছুটে রুম থেকে বেরুলো।
★★★
জলি প্রতিদিন রাতে ছেলের অপেক্ষায় বসে থাকে। রণ খেতে খেতে মায়ের সাথে সারাদিনের গল্প করে। তারপর মা ঘুমিয়ে গেলে নিচে নেমে আসে। আজও জলি অপেক্ষা করছিল। শুভ্রা পানি খেতে এসে জলিকে দেখে দাঁড়ালো-“আন্টি, আপনার না শরীর খারাপ ছিলো?”
“রণর সাথে একটু জরুরি কথা আছে তাই জেগে আছি।”
“আপনি চাইলে শুয়ে পড়তে পারেন। উনি এলে আমি ডেকে দেব আপনাকে।”
জলি অবাক হয়ে তাকিয়ে শুভ্রাকে দেখলো। মেয়েটাকে ছেলের বউ বানিয়ে এনেছেন ঠিকই কিন্তু মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না। মেয়ের মুখের দিকে তাকালেই বিশ্রী অতীত চোখের সামনে চলে আসে। সহ্য না হলেও দাঁতে দাঁত চেপে থাকে। শুভ্রাকে কোনক্রমেই বুঝতে দেয় না কিছু। তবে বিশেষ কথাও বলে না। ছেলের জন্য কষ্ট হয় তার।
তিনি বুঝতে পারেন রণ কতটা কষ্টে এই তেতো করলাকে সহ্য করছে। মনে মনে হয়তো মাকে বকাও দেয়। কিন্তু তিনি বড়ই অসহায় মা। সন্তানের জীবনের মায়া বড় মায়া একজন মায়ের কাছে। রণ যদি কখনো বোঝে তাহলে হয়তো তাকে মাফ করতে পারবে।
“তুমি সত্যিই জেগে থাকবে তো?”
শুভ্রা হাসলো-“আমি তো অনেক রাত অবধি জেগে থাকি। অভ্যাস আছে আমার।”
“কিন্তু কাল তো অনুষ্ঠান আজ এতো রাত পর্যন্ত জেগে থাকলে কাল সমস্যা হবে তো। থাকগে, তুমি যাও ঘুমিয়ে পড়ো।”
শুভ্রা খানিকটা জোর খাটালো-“কোন সমস্যা হবে না। আপনি যেয়ে শুয়ে পড়ুন প্লিজ।”
অগত্যা জলি উঠলো। নিজের কামরায় গিয়েও ফিরে এলো। শুভ্রা তাকালো তার দিকে-“কিছু বলবেন?”
জলিকে দ্বিধান্বিত দেখায়-“আমি জানি বিয়েটা তুমি জেদ করেই করেছ। ওকেও বাধ্য করেছ আমায় দিয়ে। তোমার দিক থেকে তুমি হয়তো ঠিক আছো। কিন্তু একটা কথা মনে রেখ, বিয়ে যেভাবেই হোক স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র সম্পর্ক। বাবার পরে মেয়েদের একমাত্র আশ্রয়, ভরসার জায়গা হচ্ছে স্বামী। তাই বলছি সম্পর্কটা ঠিক করার চেষ্টা করো।”
জলি দাঁড়ায় না। ধীর পায়ে ঘরে ফিরে গেলো। শুভ্রা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো। জলি হুট করে তাকে এতো কথা বললো কেন? সে নিজেও তো খুব একটা পছন্দ করে না শুভ্রাকে। তবে?
রণ দোতলায় এসে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে তারপর খেতে আসে। তাও শুধুমাত্র মা খাবার নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করে সেজন্য। ইদানীং ব্যস্ততা বেড়েছে তাছাড়া রাতে দোতলায় থাকছে বলে বোনদের সাথে দেখা হচ্ছে না। কাল শুক্রবার তার উপর আবার অনুষ্ঠান। সেজন্য দুইদিনের ছুটি নিয়েছে রণ। কাজ গুছিয়ে দিতে যেয়ে আজ তাই ফিরতে রাত হলো। খুব ধীরে ধীরে দরজায় আওয়াজ করলো। খোলা দরজার ওপাশে শুভ্রার মুখ দেখে চমকে উঠলো সে। সেদিনের পর থেকে শুভ্রার সাথে না দেখা হয়েছে না কথা। আজ হঠাৎ কি মনে করে এই মেয়ে তার সামনে এলো। নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীর মুখে ডাইনিং এ বসলো-“মা, ওমা তুমি কোথায়?”
“আন্টির শরীর খারাপ ছিলো একটু তাই আমি শুয়ে পড়তে বলেছি।”
শুভ্রাকে মোলায়েম কন্ঠে কথা বলতে দেখে রণ অবাক হলো। প্লেট টেনে ভাত বেড়ে নিতে নিতে বললো-“তা আপনি জেগে আছেন কেন?”
শুভ্রা মুচকি হাসলো-“আপনাকে ধন্যবাদ দিতে। আমার মুখ দেখার গিফটটা দিয়েছেন সেজন্য ধন্যবাদ।”
রণর ভ্রু কুঁচকে গেলো। কথার সারমর্ম বুঝতে খানিকটা সময় লাগলো। জবাব না দিয়ে পাতে তরকারি নেওয়ায় মনোযোগ দিলো।
“কাল দয়া করে ভরা মজলিসে আমার বাবাকে অপমান করবেন না। তাকে শশুরের মর্যাদা দেবেন। আপনার তো বাবা নেই, আমার বাবাকে বাবা মনে করুন তাহলেই হবে।”
রণর খাওয়া বন্ধ হলো। রক্তচক্ষু নিয়ে শুভ্রার পানে চাইলো। তার তাকানোর ভঙ্গি শুভ্রাকে বিবশ করে দিলো। সত্যি বলতে এবারই প্রথম রণর এমন রুপ দেখলো শুভ্রা। সে ভয় পেয়ে আঁতকে উঠলো। রণ কিছু না বলে খাবার থেকে হাত ঝেড়ে উঠে গেলো। এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে দোতলায় নেমে গেলো। কিছুই না বুঝতে পেরে শুভ্রা বোকাবোকা মুখ করে বসে রইলো।
চলবে—
©Farhana_Yesmin