#দর্পহরন
#পর্ব-২২
ঢাকার অনুষ্ঠানে সত্যি সত্যি শুভ্রা ভদ্র বউ হয়ে রইলো। পুরো অনুষ্ঠানে হাসি মুখে সবার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করলো, ছবি তুললো। প্রচুর প্রচুর ছবি তোলা হলো ওদের। বেশিরভাগই গন্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে গ্রুপ ছবি। অনেকের অনুরোধে কাপল ছবিও তোলা হলো কয়েকটা যাতে রণ আর শুভ্রা দুজনাই ভীষণ আনইজি ফইল করলো। ভালোয় ভালোয় অনুষ্ঠান শেষ হয়ে পরদিন নির্বাচনী এলাকায় চলে গেলো ওরা। এবারই প্রথম পুরো পরিবার নিয়ে এলাকায় এলো রণ। হাসিখুশি মা সবাই এসেছে। এলাকার সবাই দাওয়াত পেয়েছে। রাতে অনুষ্ঠানের আয়োজন দেখতে নেমেছিলো রণ এমন সময় মিহির এলো একজনকে নিয়ে-“ভাই, ও ফাহিম। আপনার সাথে কথা বলতে আসছে।”
ফাহিম সালাম দিলো। রণ উত্তর দিয়ে আন্তরিক হেসে জানতে চাইলো-“ফাহিম, কি বিষয়ে কথা বলবে?”
“ভাইয়া, একটু আলাদা কথা বলা যাবে? বিষয়টা ব্যক্তিগত।”
রণ মিহিরের দিকে তাকালে সে আশ্বস্ত করলো। রণ ফাহিমকে নিয়ে উপরে উঠে এলো। নিজের জন্য বরাদ্দ ঘরে ঘুরে গেট আঁটকে বসলো। ফাহিমের দিকে তাকিয়ে বললো-“এবার বলো কি বলবে? তার আগে বলো তুমি কে?”
ফাহিমের চেহারা গম্ভীর হলো-“আমি তুলতুলের ভাই। সালিম সাহেব মানে আপনার শশুরের বড় ছেলে সোহেল আমার বড় বোনকে তুলে এনে শ্লীলতাহানি করেছিল। পরে বাধ্য হয়ে বিয়ের নাটক করেছে।”
শুনতে শুনতে রণর চেহারায় অসন্তোষ ফুটে উঠলো-“তুমি আমার কাছে কেন এসেছ ফাহিম?”
ফাহিম কেমন যেন বাঁকা হাসলো-“আপনি এই এলাকার নতুন এমপি, মন্ত্রীও হয়েছেন। সালিম সাহেবকে সরিয়ে যখন আপনি এলেন ভেবেছিলাম এবার বুঝি আমরা এই দানবের হাত থেকে রক্ষা পাবো। এটাও ভেবেছি আপনার কাছে এসে আমার বোনের ব্যাপারে সাহায্য চাইবো। কিন্তু তারপরে শুনলাম আপনি নিজেই এখন সালিম সাহেবের একমাত্র মেয়ের জামাই।”
রণ হেসে দিলো-“সব জানার পরও এলে কেন তবে?”
ফাহিমের চোখ ছলছল হলো-“আপুকে শেষ দেখেছি তিনমাস আগে। নামের বিয়ে হয়েছে ওই বদমাশটার সাথে কিন্তু ওই জেলখানা থেকে ছাড়া পায়নি আমার বোন। ফোন নেই ওর কাছে, মাঝে মাঝে ও নিজ থেকে অন্য কারো ফোন থেকে কথা বলে। এছাড়া কারো সাথে কোন যোগাযোগ করতে দেয় না। আমার মা তার মেয়েকে দেখতে না পেয়ে অসুস্থ হয়ে গেছে। আপনার কাছে একটা অনুরোধ করি, প্লিজ আমার বোনটাকে একবার দেখার ব্যবস্থা করে দিন। কোনভাবে একবার বোনটাকে এই অনুষ্ঠানে আনতে পারলে আমরা একটু কাছ থেকে বোনটাকে দেখতাম। ও কেমন আছে জানতে পারতাম। প্লিজ স্যার, একটু দয়া করেন আমার মায়ের উপর। আপনার তো নিকট আত্মীয় হয় ওরা আসতে বললে নিশ্চয়ই মানা করবে না?”
ফাহিম হাত জোর করে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখ দুটো ভেঁজা-“বোনটা কেমন করে বেঁচে আছে সেটা একটু নিজ চোখে দেখতাম স্যার। অনেক আদরের বোন আমার। কত ভালো ছাত্রী ছিলো। অনার্সে ফার্ ক্লাস পেয়েছে। সেই মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ। কি থেকে কি হয়ে গেলো স্যার। একটু দেখা করিয়ে দিন না স্যার। আমার মা অনেক অসুস্থ, হয়তো বাঁচবে না বেশিদিন।”
রণ হতভম্ব হয়ে গেলো। পুরো ঘটনা বুঝো উঠতে যা সময় লাগলো। সে ফাহিমের হাত ধরে বসিয়ে দিলো। ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরতেই হু হু করে কাঁদলো-“ভাইয়া, বেশি কিছু না একটাবার শুধু বোনটাকে দেখতে চাই।”
রণর চোয়াল শক্ত হয়, হাত মুঠো করে ধরে। সালিমের নিষ্ঠুরতার আর কতো গল্প শুনবে? একটা মানুষ কি করে এতটা জঘন্য হয়? রণ ফাহিমকে ভরসা দিলো-“তুমি কাল তোমার মাকে নিয়ে এসো ফাহিম। আমি কথা দিচ্ছি কাল তোমরা তোমার বোনের সাথে দেখা এবং কথা দু’টোই বলতে পারবে।”
ফাহিমের চোখ চকচক করে উঠলো-“সত্যি ভাইয়া?”
রণ মাথা নাড়লো-“সত্যি। আমি এখনো মিথ্যে বলতে শিখিনি ফাহিম। ভরসা করতে পারো আমাকে। এখন যাও, কাল সময়মতো চলে এসো।”
ফাহিমকে বিদায় দিয়ে চিন্তিত মুখায়বর নিয়ে বসে ছিলো রণ। মিহির এগিয়ে এলো-“ভাই, ফাহিম কি বললো?”
রণ হাসলো-“তুই তো জেনেশুনেই ওকে আমার কাছে পাঠিয়েছিস মিহির। আমি কিছু জানি না ভেবেছিস?”
মিহির আলতো হাসলো-“ছেলেটা অনেক কান্দে ভাই। মায়া লাগে দেখে।”
“ভালো কাজ করেছিস মিহির। এতোদিনে মনেহচ্ছে সালিম সাহেবের মেয়ে বিয়ে করে একটা কাজের কাজ করেছি।”
রণকে মুচকি হাসতে দেখে মিহির অবাক হলো-“আপনে কি করতে চান ভাই?”
“কি করবো তা তো জানি না। তবে কালকের অনুষ্ঠানে মেয়েটা থাকবে এটা জানি।”
বলেই উঠে গেলো রণ।
শুভ্রা হাসিখুশির সাথে বসে গল্প করছিল। রণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলো ভেতরে যাবে কিনা। অনেকক্ষণ পরে হাসিখুশির নজর পড়লো ওর উপর-“আরে ভাইয়া, বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসো ভেতরে এসো। আমরা শাহরুখ খানের মুভি দেখছি। দিলওয়ালে দুলহানিয়া।”
ঘরে ঢুকে হাসি মাথায় গাট্টা মারে রণ-“আর কতোবার দেখবি? তিরিশ বারের বেশি দেখে ফেলেছিস।”
“রাজের মতো একজনকে না পাওয়া পর্যন্ত দেখতে থাকবো ভাইয়া।”
খুশি নিচু স্বরে কথাটা বলেই দাঁতে জিভ কাটে। রণ হো হো করে হাসলো-“ইউনিভার্সিটিতে টপার না হলে তোদের দুটোকেই রিকশাওয়ালা ধরে বিয়ে দেব। বুঝতে পেরেছিস? কাজেই বিয়ের ভুত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পড়ালেখায় মন দে। আর আপনি একটু আসুন তো। কথা আছে।”
শুভ্রা হা করে তাকিয়ে আছে রণর মুখপানে-“জ্বি! আমি?”
রণ গম্ভীর হলো-“তো আর কে? জরুরি কথা আছে তাড়াতাড়ি আসুন।”
বলেই রুম থেকে বেরিয়ে এলো। হাসিখুশি মুখ টিপে হাসছে। শুভ্রা তবুও বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। এই লোকের হুট করে কি হলো? তাকে কেন ডাকছে? শুভ্রাকে বসে থাকতে দেখে হাসিখুশি ওকে তাড়া দিলো-“ভাবি, বসে আছো কেন? ভাইয়া ডাকলোনা তোমাকে? যাও যাও তাড়াতাড়ি যাও।”
শুভ্রা গুটিগুটি পায়ে তার জন্য বরাদ্দকৃত কামরায় এলো। রণ তখনও দাঁড়িয়ে। তার মনে নানারকম ভাবনা। কিভাবে কি বলবে শুভ্রাকে তাই ভাবছে।
শুভ্রা ডাকলো-“বলুন কি জন্য ডেকেছেন আমাকে?”
রণ শুভ্রাকে দেখলো এক নজর। ঢোলাঢালা গেঞ্জি আর প্যান্ট পরে আছে। গলায় একটা ওড়না ঝুলছে। রণ ধীরস্থির কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো-“যে ভাইকে ছাড়াতে এতো হম্বিতম্বি করলেন সে তো গতকালের অনুষ্ঠানে এলো না। না সে এলো না তার বউ এলো। কেমন ধারা ভাই ভাবি আপনার, একটুও কৃতজ্ঞতা নেই বোন কিংবা বোনজামাই এর প্রতি?”
শুভ্রার ভ্রু কুঁচকে গেলো। রণর কোন পরিকল্পনা আছে কিনা আন্দাজ করতে চাইছে সে। রণকে স্বাভাবিক দেখালো। শুভ্রা ঠান্ডা গলায় জবাব দিলো-“আপনি তো চাইছিলেন ওরা না আসুক। এখন হঠাৎ করে ওদের নিয়ে এতো ইন্টারেস্ট কেন?”
“ইন্টারেস্ট এর কি আছে? একটা ভাই বিবাহিত তার মানে তার বউ আছে। কিন্তু সেই বউকে কোথাও দেখতে পেলাম না। না বিয়ের দিন আপনাদের বাসায় না গতদিনের অনুষ্ঠানে। আজব একটা পরিবার।”
রণর কথাগুলো সত্যি বলেই শুভ্রা চুপ করে রইলো। এই প্রশ্নগুলো শুভ্রাও করেছিল ওর মাকে। মা বলেছে অনুষ্ঠান হয়নি তাই বউকে কারো সামনে নেই না। তোর অনুষ্ঠান হলো এরকম দেখি সোহেলের বিয়ে উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠান করবো। বউকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। তারপর বউকে সব জায়গায় নেওয়া যাবে শুভ্রাকে চুপ থাকতে দেখে রণ খোঁচায়-“কি এখন কথা নেই কেন মুখে?”
শুভ্রা ভ্রু কুঁচকে বললো-“ভাবছি হুট করে আমার ভাইয়ের জন্য এতো দরদী হয়ে উঠলেন কেন? কি প্ল্যান আপনার বলুন তো?”
রণ হেসে দিলো-“কি প্ল্যান থাকতে পারে বলে মনেহয় আপনার? আমার সম্বন্ধী আছে সে বলে আবার বিবাহিত। তো তাদের কারো সাথেই তো পরিচয় হলো না আমার। তাই বলছিলাম আর কি। আচ্ছা বাদ দিন। না আসলে নেই।”
শুভ্রা তখনো সন্দিহান-“আপনি চাইছেন ওরা আসুক?”
রণ অবাক হওয়ার ভান করলো-“আমি কেন চাইবো? লোকে কানাকানি করে সেটাই বলেছি।”
“লোকের কানাকানি আপনি পাত্তা দেন! আমার কেন যেন মনেহচ্ছে আপনি চান ভাইয়া আর ভাবি আসুক। ভাইয়াকে নিয়ে নিশ্চয়ই কোন প্ল্যান আছে আপনার।”
রণ বিমোহিত হাসি দিলো-“কোন প্ল্যান নেই। শুনুন, আমি ভুলে আপনার ভাইয়ের কথা বলে ফেলেছি। তার এখানে আসার দরকার নেই। একজন অপরাধী আমার কোন অনুষ্ঠানে না আসাই ভালো।”
শুভ্রা রেগে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“খবরদার ভাইয়াকে অপরাধী বলবেন না। তার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমান হয়েছে কি? তাহলে সে কিভাবে অপরাধী হয়? কালকে আসতে বলবো ভাইয়াকে। সে অবশ্যই আসবে।”
“আপনি বললেন আর আপনার ভাই নাচতে নাচতে চলে আসবে এটা বিশ্বাস করতে বলছেন আমাকে? এতোই যদি ভালোবাসতো আপনাকে তাহলে কাল ঠিকই আসতো। আপনি তো তাকে ছাড়াতেই আমাকে বিয়ে করেছিলেন। আর সে কিনা আপনার বিয়ের অনুষ্ঠানে এলো না। ওসব দেখা আছে আমার।”
শুভ্রা নিচু স্বরে গর্জন করে উঠলো-“সে অবশ্যই আসবে। তার বউকে নিয়েই আসবে। দেখবেন কাল।”
রণ অটল কন্ঠে বলে উঠলো-“কোনদিন আসবে না। আপনিও দেখে নেবেন।”
“ভাইয়া যদি ভাবীকে নিয়ে আসে তাহলে কি করবেন আপনি?”
রণ মুচকি হাসলো-“আসবেই না। তবুও যদি এসে যায় তাহলে আপনি যা বলবেন তাই করবো।”
শুভ্রার চেহারায় ক্রুর হাসি খেলে গেলো-“আর ইউ শিওর?”
“আমি কথা দিয়ে কথা রাখি এটা নিশ্চয়ই নতুন করে প্রমান করতে হবে না?”
রণর কথায় শুভ্রা দাঁত বের দিলখোলা হাসি দিলো-“ঠিক আছে। তাহলে ওই কথাই রইলো। ভাইয়া যদি ভাবিকে নিয়ে আসে তাহলে আমি যা বলবো তাই করতে হবে আপনাকে। ডান?”
“ডান।” শুভ্রার চোখে চোখ রেখে জবাব দিলো রণ।
চলবে—
©Farhana_Yesmin