#দর্পহরন
#পর্ব-২৪
“তোর ভাই আর মায়ের সাথে দেখা হইছে?”
সোহেলের কথায় তুলতুল আমুলে কেঁপে উঠলো। সোহেল জানলো কিভাবে? সে চকিতে ভয়ে ভীত নয়নে সোহেলের দিকে তাকায়। সোহেলের মুখ জুড়ে হাসি, চোখে ক্রুরতা-“কি ভাবছিলি জানুম না? মা ভাইকে সাথে নিয়া আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবি আর আমি জানুম না?”
তুলতুল আঁতকে উঠে পিছিয়ে গেলো-“কি বলতেছেন এইসব?”
সোহেল খাট থেকে উঠে এলো-“মিছা কতা কইছি? ভাই আর মায়ের লগে দেখা করছ নাই? ক?”
তুলতুল বুঝলো মানা করে লাভ নেই কোন। সে মাথা দুলালো-“আমি তো জানতাম না ওইখানে মা আর ভাই আসবে। দুলাভাই দাওয়াত দিছে তাই আসছে। এইখানে আমার কি দোষ? আর সত্যি বলতেছি কোন ষড়যন্ত্র করি নাই। আপনি তো আমার স্বামী, স্বামীকে নিয়ে কি ষড়যন্ত্র করবো?”
সোহেল মুচকি হেসে তুলতুলের দিকে এগিয়ে যেতেই তুলতুল পিছাতে শুরু করে। শেষ মেষ দেওয়ালে পিঠ ঠেকে বুঝলো আর পেছানোর সুযোগ নেই। সোহেল ওর দুপাশে হাত রেখে মুখোমুখি দাঁড়ায়-“তুই তো আমাকে স্বামী মানোস না।”
“আপনিও তো আমাকে বউ মানেন না।”
তুলতুলের উত্তর শুনে সোহেল হাসলো-“খুব চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বাইর হইতেছে তোর মুখ দিয়া। একদিন দেখা কইরাই এতো সাহস? তোর ভাইটা তোরে এই বন্দীদশা থেকে মুক্ত করতে চায় তাই না?”
তুলতুল দ্রুত মাথা নাড়লো-“কেউ কিছু চায় না।”
সোহেলের মুখ থেকে হাসি গায়েব হলো-“যেইদিন বুঝমু একটু উল্টা পাল্টা করার চেষ্টা করতেছোস সেইদিন তোর ভাইরে শেষ করুম আগে তারপর তোরে। আমাকে তো চিনছোস এতোদিনে, নাকি? যা কই তার নড়চড় হয় না বুঝছোস তো?”
তুলতুলের শরীর কাঁপছে, গলা শুকনো। সে ঢোক গিলে নিল-“আপনে ভুল বুঝতেছেন। আমাদের মধ্যে আমার ভাইকে টাইতেছেন কেন? ওর কোন দোষ নাই। ও কিছু জানে না। সত্যি বলতেছি।”
“আমি ঠিক বুঝতেছি। এতো বোকা ভাইবো না আমারে চান্দু।”
তুলতুলের হঠাৎ কি হলো জানেনা সে সোহেলকে জড়িয়ে ধরলো-“আমার সাথে সবসময় এইরকম কু*ত্তার মতো ব্যবহার করেন কেন? কিসের এতো রাগ আমার উপর?”
সোহেল থতমত খেয়ে গেলো। বোকার মতো তুলতুলকে দেখছে। তার চোখ দুটোতে বিস্ময়। তুলতুলের এমন আচমকা পরিবর্তন সে গিলতে পারছে না। তুলতুলকে নিজের থেকে ছাড়াতে চাইলো কিন্তু পারলো না। তুলতুল সোহেলের বুকে মাথা রেখে ফিসফিস করলো-“কি চান আপনি? আমি নিজ থেকে আপনার কাছে আসি? মেয়ে মানুষকে এইরকম ছে ছে করলে তারা নিজ থেকে কাছে আসে না জানেন না। মেয়েদের কাছে চাইলে তাদের আদর সোহাগের সাথে নরম গলায় ডাকবেন, দেখবেন আপনার জন্য জা*ন দিব।”
সোহেল হতবিহ্বল, কি হচ্ছে সব মাথার উপর দিয়ে গেলো। সে দু’হাতে তুলতুলকে দূরে ঠেলে দেয়-“এই যা সর এইখান থিকা। নতুন নাটক লাগাইছে। এইগুলা কইরা সত্য লুকানো যাইবো না বুঝছোস?”
তুলতুল অভিমানী কন্ঠে মৃদুস্বরে অভিযোগ জানায়-“ভালো করলেও দোষ খারাপ করলেও দোষ। কি যে চায় মানুষ।”
সোহেল সন্দিহান নজরে তাকিয়ে দেখলো তুলতুলকে তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। তুলতুলের আচরণ সন্দেহজনক, নিশ্চয়ই কোন মতলব আছে তার। এদিকে সোহেল বেরিয়ে যাওয়ার পরই তুলতুল মুখ গম্ভীর করলো। মনে মনে বিশ্রী করেকটা গালি দিলো সোহেলকে। গা ঝাড়া দিলো কয়েকবার। সোহেলের কাছাকাছি আসলেই গা ঘিনঘিন করে তুলতুলের। কিন্তু সোহেল কি করে জানলো ওর মা ভাইয়ের কথা? দুলাভাইকে জানাতে হবে কথাটা।
★★★
সারারাত মুখ আর বুকের জ্বলুনিতে তরপেছে রণ। চোখ থেকে ঘুম গায়েব হয়েছে। প্রচন্ড কষ্টে পায়চারি চলছে অবিরত। ভোর থেকে শুরু হলো পেটের গন্ডগোল আর বমি। আজ বিশেষ মিটিং আছে এলাকার জনগণের সাথে কিন্তু মনেহয় না মিটিং এ যেতে পারবে। বাথরুমে দৌড়াতে দৌড়াতে গায়ে জ্বর চলে এলো রণর। বমি আর বাথরুমের চাপে সকাল দশটা নাগাত নিস্তেজ হয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়লো রণ। মিহির রণকে ডাকতে এসে ওর অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে বাধ্য হয়ে দোতলা থেকে জলিকে ডেকে নিয়ে গেলো, ডাক্তারকে খবর দিলো। রণকে দেখে হাউমাউ করে উঠলো জলি। একবেলার মধ্যে মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে। জ্বর আর পেটের ব্যাথায় কিছুক্ষণ পর পর আর্তনাদ করে উঠছে। রণ বড়ই শক্ত ছেলে। সে কোকাচ্ছে মানে শরীর বেশিই খারাপ। জলি মিহিরকে আদেশ করলেন রণকে ধরে দোতলায় নিয়ে যেতে। তার চোখের সামনে থাকবে ছেলে পরিচর্যা হবে।
শুভ্রা হাসিখুশির সাথে গল্পে মশগুল। হাসি বললো-“ভাবি তোমাদের বাড়ি যাবে না?”
শুভ্রা অবাক গলায় বললো-“যাবো না কেন? আব্বা কালকে যেতে বলছে তোমার ভাইকে নিয়ে। আজকে কিবা কাজ আছে তোমার ভাইয়ের।”
হাসি অবাক গলায় জানতে চাইলো-“ভাইয়া যাবে বলেছে?”
“হ্যা। বাবাকে তো বলেছে যাবে। কেন?”
শুভ্রা সন্দিহান গলায় জানতে চাইলো। হাসি হাসলো-“কিছুনা। এমনিতেই জানতে চাইলাম।”
খুশি প্রসঙ্গ পাল্টে বললো-“ভাবি, তোমার ভাবীটা কিন্তু দেখতে সুন্দর। আমার খুব ভালো লেগেছে। ওনার নাম তুলতুল দেখতেও তুলতুলা। তাই না হাসি?”
“হ্যা, ভাবি। কিন্তু ওনার বাড়ির কেউ এলো না কেন? কেউ নেই ওনার? বাবা মা ভাই বোন?”
হাসির কথায় মনটা খচখচ করে ওঠে শুভ্রার। আরে তাইতো! কথাটা ভুলে গেলো কি করে? ভাবি তার মা আর ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেছিল না? তাদের সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিলো না কেন? রণ বলেছিল পরে সব বলবে কিন্তু সে কেন রণর কাছে জানতে চাইলো না ঘটনাটা? জিজ্ঞেস করতে হবে রণকে। সে কি বাইরে বেরিয়ে গেছে নাকি বাসায়?
“আমি একটু আসছি।”
বলে বেরুতে যেয়ে জলির মুখোমুখি পড়ে গেলো শুভ্রা। জলি ভ্রুকুটি করে শুভ্রাকে দেখলো-“যাচ্ছ কোথায়?”
শুভ্রা থমকে গেলো। জলিকে গম্ভীর দেখাচ্ছে-“কাল কি খেয়েছে রণ?”
জলির প্রশ্ন শুনে শুভ্রা মনে মনে চমকে গেলো-“কেন? কি হয়েছে?”
“ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পরেছে। জ্বর, বমি, পেট ব্যাথা আর ঘনঘন বাথরুম যাচ্ছে। জানো তুমি?”
শুভ্রা ঢোক গিলে নিলো-“না, জানি না তো।”
“তা জানবে কি করে? তোমরা জেদি মেয়ে যা চাও তা পেতে হবে। পেয়ে গেলে আর সেই জিনিসের কদর নেই। বলি বিয়েটা তো জোর করে করেছ এখন সম্পর্কটা জোর করে এগিয়ে নিচ্ছ না কেন? দু’জন দুই রুমে থেকে কি প্রমান করতে চাইছো সেটাই বুঝতে পারছি না। জামাই অসুস্থ হয়ে তিনতলায় পড়ে আছে বউ জানেই না। কেমন ধারা মেয়ে তুমি?”
শুভ্রা বোকার মতো মুখ করে তাকিয়ে আছে জলির দিকে। হাসিখুশি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। জলি পাত্তা দিলো না মেয়েদের। শুভ্রার দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললো-“যাও যেয়ে রণর কাছে বসো। দেখো ওর কি লাগবে।”
শুভ্রা মাথা দুলালেও জলি দেখলো না। হনহন করে চলে গেলো। শুভ্রার লজ্জা লাগছিল ভীষণ হাসিখুশির সামনে। সে ওদের দিকে না তাকিয়েই চলে এলো।
শুভ্রা ঘরে ঢুকে দেখলো রণ চোখ বুজে শুয়ে আছে। রণর মুখটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। ফর্সা চেহারা হলদেটে হয়ে গেছে। শুভ্রা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উচ্চস্বরে হেসে দিলো। রণ চমকে উঠে বসলো-“কি হয়েছে?”
শুভ্রা মুখে হাত চাপা দিয়ে বললো-“কিছু না। সরি, আপনার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম।”
রণ কিছু না বললেও চোখে মুখে বিরক্তি ফুটে উঠলো। আবার শুয়ে পড়লো সে। শুভ্রা ওর সামনে এসে দাঁড়ায়-“শুনুন, আপনি নিজে যেটা সহ্য করতে পারছেন না সেটা করতে আমাকে বাধ্য করেছিলেন। এখন কি ভাবতে পারছেন কি অবস্থা হয়েছিল আমার? কতোটা কষ্ট পেয়েছিলাম? তারউপর দেখুন আপনার মতো এতো সেবা পাইনি আমি। একা একাই পড়ে ছিলাম কয়েকদিন। অথচ আপনি ভিআইপি ট্রিটমেন্ট পাচ্ছেন। মানুষ কতটা হিপোক্রেট হতে পারে সেটা ভেবেই হাসি পেয়ে যাচ্ছে।”
শুভ্রার কথায় চোখ মেলে তাকিয়ে ওকে দেখলো রণ। চাপা অসন্তোষ ফুটে উঠলো ওর চোখে মুখে। উঠে বসে বললো-“এখন কি করতে হবে আমাকে? আমাকেও তাহলে আঁটকে রাখুন। খাবার পানি কিছু দেবেন না। ঘরের আলো বন্ধ করে সাতদিন আঁটকে রাখুন। আপনার মন শান্তি হবে তাতে?”
শুভ্রা দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“দুই মাসের শাস্তি আপনি চালাকি করে সাতদিনে শেষ করতে চাইছেন?”
“তারমানে আপনি দুইমাস আঁটকে রাখতে চাইছেন আমাকে? আমার থাকতে কোন আপত্তি নেই। সত্যি বলছি। আমার অভ্যাস আছে। কিন্তু আমার পক্ষে তো সম্ভব হবে না বন্দী থাকা। রাস্ট্রের গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব পালন করার জন্য। বিনিময়ে কি করা যাবে বলুন। যতটুকু বুঝতে পারছি আপনি আমাকে সেম টু সেম শাস্তি না দিলে শান্তি পাবেন না।”
শুভ্রা জবাব না দিয়ে তাকিয়ে থাকলো। প্রচন্ত পেটব্যাথায় রণর মুখেচোখ কুঁচকে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। সে হাত বাড়িয়ে স্যালাইন পানির গ্লাসটা নিয়ে দুটো চুমুক দিলো। সেই পানি পেটে যাওয়া মাত্রই পেটের মধ্যে উথালপাতাল শুরু হলো। গা গুলিয়ে বমি উঠে এলো। নিজেকে আঁটকাতে না পেরে ঘর ভাসিয়ে বমি করলো রণ। গলা জ্বলে যাচ্ছে রণর। সে চেচিয়ে উঠলো সইতে না পেরে-“আহহহ।”
জলি দৌড়ে এলো-“কি হয়েছে?”
শুভ্রা ভালোমানুষের মতো মুখ করে বললো-“কিছু না আন্টি। বমি করেছে আমি পরিস্কার করে দিচ্ছি। আপনি যান।”
রণ অবাক হওয়ার মতো অবস্থায় নেই তবুও অবাক হলো শুভ্রার কথায়। জলি চলে গেলে শুভ্রা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। রণ মেজাজ খারাপ করে বললো-“কি?”
“কিছু না।”
“এখন আমার বমি পরিস্কার করতে হবে। তাই তো?”
শুভ্রার ঠোঁটের হাসি ছড়িয়ে পড়লো সারা মুখে-“বাহ! মন্ত্রী মশাইয়ের বুদ্ধি আছে দেখা যাচ্ছে।”
রণ দূর্বল শরীর নিয়ে বিছানা ছাড়লো-“আপনার মনস্তত্ত্ব বুঝতে আইনস্টাইন হতে হবে না। আমেরিকায় পড়ালেখা করলে কি হবে আপনার ঘটে সেই চিরাচরিত বাঙালি ব্রেন। এর বেশি কিছু ভাবতে পারবেন না।”
শুভ্রা চিড়বিড়িয়ে উঠলো। আঙুল উঁচিয়ে শাসালো-“আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন।”
রণ পাত্তা দিলো না, বাথরুম থেকে বালতি নিয়ে এলো টলতে টলতে-“আপনি প্লিজ ভাবুন দুই মাসের বন্দীত্বের বদলে কি শাস্তি দেওয়া যায়। ভেবে বলুন আমাকে। আমি যত দ্রুত সম্ভব শাস্তির কোটা শেষ করতে চাই। এটাই আমাদের দু’জনার জন্য মঙ্গলজনক হবে।”
“কেন? আমাকে বউয়ের রোলে দেখতে চাইছেন?”
শুভ্রার কন্ঠে কৌতুক। রণ মব ধরে দাঁড়িয়ে গেলো। দৃষ্টি ক্ষীন করে শুভ্রাকে দেখলো-“আপনার তাই মনেহচ্ছে? আপনার কি মনেহয় আপনি আমার বউ হওয়ার যোগ্য?”
শুভ্রার ভ্রু কুঁচকে গেলো, কর্কশ কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো-“কি বলতে চাইছেন আপনি?”
রণর গভীর দৃষ্টি শুভ্রাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিলো। রণ শান্ত গলায় বললো-“আমার মাকে ব্লাকমেল করে খুব সহজে আমার বউ হতে পেরেছেন। অন্যথায় আপনি কখনোই আমার বউ হওয়ার যোগ্য ছিলেন না। আপনার মতো মেয়েকে এই রণ তাকিয়েও দেখতো না। বুঝতে পেরেছেন?”
শুভ্রা জবাব দিলো না। অপমানে ওর গা ফুটন্ত উনুন। চোখ দুটো আগ্নেয়গিরির লাভা। রণ তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো-“আপনার ভাগ্য আমি আপনাকে অপহরণ করেছিলাম। আমার সেই ভুলের কথা বলে আমাকে আর আমার মাকে ব্লাকমেল করেছেন। তা না হলে আপনার মতো মাসে মাসে বয়ফ্রেন্ড বদল করা কোন মেয়ে এই রণর বউ হতো না কখনোই।”
চলবে—
©Farhana_Yesmin