#দর্পহরন
#পর্ব-২৬
“মিহির, প্রতিবার এই লোক কিভাবে খবর পায়? একটাবার সফল হতে পারতেছি না কেন?”
মিহিরের মুখ কাচুমাচু-“আমি জানি না ভাই। কিভাবে জেনে যায় সত্যিই জানি না।”
“এই মিটিং এ উপস্থিত প্রত্যেকের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক কর মিহির। কে এই খবর পাস করেছ তাকে খুঁজে বের কর। তুই আবার একটা মিটিং এ্যারেন্জ কর। এবার যেন কেউ টের না পায়। কেউ না মানে কেউ না।”
রণর রণমুর্তি দেখে মিহির চুপসে গেলো। ফোনের এপাশ থেকে কিছু বলার সাহস হলো না। রণ ফোন কেটে দিয়েছে ততক্ষণে। তার মেজাজ আসলেই বেশ খারাপ। গুছিয়ে আনা কাজ শেষ করতে না পারলে ভীষণ মেজাজ খারাপ হয় বইকি। সে আরামকেদারায় হেলান দিলো।
আজ নেত্রীর সাথে মিটিং ছিলো। সামনে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে নদীবন্দরকে ঘিরে। রণকে নিজের এলাকার উন্নয়নে নজরে দিতে বলেছে নেত্রী। সেই সাথে এলাকায় দলীয় শৃঙ্খলা বজায় যেন বজায় থাকে সে ব্যাপারে কড়া দৃষ্টি দিতে বলেছে। কিন্তু রণ যেন বারবার হোঁচট খেয়ে যাচ্ছে। নিজ থেকে যাই করতে যাচ্ছে বারবার ভেস্তে যাচ্ছে তার চেষ্টা। অনেক ভেবে দিলশাদকে ফোন দিলো-“দিলশাদ, একটা সাহায্য করবি?”
“কে কে সালিম সাহেবের পক্ষে কাজ করে এর একটা লিস্ট আমি আপনাকে দেব ভাই। কয়েকটা দিন সময় দেন।”
রণ হেসে দিলো-“তুই কিভাবে জানলি আমি এটাই বলতাম তোকে?”
দিলশাদ হাসলো-“আপনার মিটিং এর ব্যাপারটা আমার কানে এসেছে। আপনি নতুন মানুষ, রাজনীতি এখনো বুঝে উঠতে পারেননি। আর সালিম তো অনেক পুরনো লোক আর সে লোকও ভালো না তাই কেউ কেউ তাকে পছন্দ না করলেও ভয়েই খবর জানায়। আপনার কাজে দূর্বল চিত্তের কাউকে রাখবেন না ভাই। তাতে আপনি কিছু করতে চাইলেও সফল হবেন না। আর এরপর মিটিং করলে আমাকে জানায়েন। আশাকরি এসব সমস্যা হবে না।”
“থ্যাংক ইউ দিলশাদ। মনে থাকবে।”
দিলশাদের ফোন কেটে পুনরায় মিহিরকে ফেন দিলো রণ। ওপাশ থেকে মিহির হ্যালো বলতেই রণ বললো-“সবুর চাচা আর ইমাদ ভাইয়ের সাথে কালকে ঢাকায় একটা মিটিং ফিক্সড কর। ওদের বলবি কেউ যেন না জানে। শুধু ওরা দুইজন। কারণ যতটুকু জানি ওদের দুইজনের সাথেই সালিম সাহেবের গন্ডগোল আছে। ওরা কেউ সালিম সাহেবকে পছন্দ করে না। বুঝেছিস?”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি কোন চিন্তা করবেন না ভাই। মিটিং ঠিক করে আমি আপনাকে সময় জানিয়ে দেব ভাই।”
“আচ্ছা।”
*****
“ভাবি, তোমাদের বিয়ে হলো কি করে? তোমার পরিবারের কেউ আসে ন কেন বাসায়? তুমিও তো তোমার বাবার বাড়ি যাওনা কোনদিন। ভাইয়ার সাথে কোথাও বেড়াতেও যাওনা কেন? তুমি সবসময় এমন মনমরা হয়ে থাকো কেন?”
শুভ্রা তুলতুলকে সকাল বিকাল প্রশ্ন করে যাচ্ছে। তুলতুল প্রতিবার নিরব থাকছে। শেষমেষ না পেরে তুলতুল সেদিন বলে ফেললো-“আপা, এইসব প্রশ্ন আমাকে আর কইরেন না। আমি উত্তর দিবো না। আপনার যদি কিছু জানার থাকে আপনার পরিবারের লোকদের জিজ্ঞেস করেন।”
শুভ্রা ভীষণ অবাক হয়ে বললো-“তুমি কিছু বলবে না কেন? কি সমস্যা বলো তো?”
তুলতুল জবাব দিলো না। শুভ্রা কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে উঠে গেলো। সে বুঝতে পেরেছে কোন একটা ঘোলাটে ব্যাপার আছে এখানে। ব্যাপারটা কি হতে পারে সেটা জানার জন্য মনটা উশখুশ করছে তার। মায়ের খোঁজে বের হলো সে।
রিমা আর মিনু ভিডিও কলে কথা বলছিল কারো সাথে। শুভ্রা মাকে ইশারা দিচ্ছিলো কিন্তু রিমা গা করলোনা। শুভ্রা অপেক্ষা করলো ওদের কথা শেষ হওয়ার। কথা শেষ হওয়া মাত্র রিমা মেজাজ দেখিয়ে জানতে চাইলো-“কি হইছে? দেখতেছিস যে কথা বলতেছি তাও এমন করতেছিলি কেন?”
শুভ্রা ব্যস্ত গলায় বললো-“ভাবি তার মায়ের বাড়ি যায় না কেন মা? ওর মাও আসে না? শুনছি যে ওর মা আর ভাই আছে একটা। ওরা আসে না কেন?”
রিমা সন্দিহান নজরে মেয়েকে দেখলো-“তুই শশুরবাড়ি কবে যাবি শুভ্রা? জামাই ফালাইয়া আর কয়দিন বাপের বাড়ি থাকবি? বিয়া তো নিজ থিকা করছোস এখন যাস না কেন? বাপের বাড়ি আইসা নানা ব্যাপারে মাথা ঘামানি তোরে মানায়?”
শুভ্রা হতবাক হয়ে গেলো। সে দুঃখী চেহারায় মাকে বললো-“এসেছি সাতদিনও হয়নি তুমি এভাবে বলতে পারলে মা? আমি তোমাদের সব খেয়ে ফেলছি?”
রিমা রেগে গেলো-“তোরে খাওয়ার কথা কইছি আমি? এতো বেশি বোঝোস কেন তুই? বিয়া হইলে এতোদিন স্বামী ফালায়া বাপের বাড়ি থাকতে নাই। এই সহজ কথা তুই কবে বুঝবি শুভ্রা?”
শুভ্রা জবাব দিলো না। সে তীব্র অভিমানে মাকে দেখলো কয়েকপলক তারপর দৌড়ে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করলো। মিনু পুরো দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে বললো-“এমনে না কইলেও পারতি রিমা। মাইয়া কষ্ট পাইছে।”
“পাইলে পাক বুবু। আমি কোনদিকে যাব? ও কি জানতে চাইছে শুনছেন? ওরে এইসব কইলে ওর বাপ আমাকে আস্ত রাখবে বলেন? মেয়েরে কিছু জানাইব না বইলাইনা মেয়েরে সারাজীবন বাইরে বাইরে রাখলো। আমার হইছে যত জ্বালা। আর ভালো লাগে না এইসব।”
মিনু তীব্র চোখে রিমাকে দেখছে। এই মেয়ে সবসময় নরম। কিছু একটা হলেই ওলটপালট বকতে শুরু করে। সালিমের বউ হিসেবে এই মেয়েকে সবসময় অযোগ্য মনেহয়েছে তার কাছে। কিন্তু সালিমের একেই বিয়ের যোগ্য মনেহয়েছে। মিনু বিরক্ত হয়ে উঠে গেলো।
রাতে সালিম সাহেব বাড়ি ফিরে শুনলো শুভ্রা সারাদিন কিছু খায়নি। দোর আঁটকে শুয়ে আছে। সালিম সাহেব মেয়ের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন-“আম্মা, খাবেন না আপনি? আব্বাও কিন্তু খায় নাই এখনো।”
শুভ্রা কান্না জড়িত গলায় জবাব দিলো-“খাবো না আমি। মা আমাকে খাওয়া নিয়ে কথা শুনিয়েছে।”
সালিম সাহেব কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললো-“আচ্ছা ঠিক আছে। না খাইলেন দরজাটা অন্তত খুলেন আম্মা। সারাদিন আপনাকে দেখি নাই।”
শুভ্রা কিছুক্ষন পর দরজা খুলে দিলো। সালিম সাহেব মেয়ের ঘরে ঢুকলো। শুভ্রা মন খারাপ করে বিছানায় বসে আছে। পাশে বসে মেয়ের মাথায় হাত রাখে সালিম সাহেব-“মায়ের কথায় মন খারাপ করতে আছে? মা তো একটু এমনই।”
“তাই বলে বাপের বাড়ি আসার খোঁটা দিবে? এইটা কেমন কথা আব্বা? বিয়ে হয়েছে বলে কি আর এই বাড়ি আসতে পারবোনা আমি?”
“তা কেন পারবেন না। এই বাড়ি সবসময় আপনের ছিল আপনারই থাকবে। আপনি যখন খুশি আসবেন যাবেন। কিন্তু একটা কথা সত্যি আম্মা। আপনের তো নতুন বিয়া হইছে এইভাবে আইসা থাকলে লোকে নানা কথা বলবে। মা এইটা মিথ্যা বলে নাই।”
“আব্বা আপনিও?”
শুভ্রার চেহারায় বিষাদ নামে। সালিম সাহেব নরম গলায় শুধালো-“ভুল বুইঝেন না আম্মা। একটা প্রশ্নের উত্তর দেন তো। আপনি কি আব্বাকে ভালেবাসেন?”
শুভ্রা চমকে বাবার মুখ পানে চায়-“এটা কেমন কথা আব্বা? আপনাকে আমি ভালোবাসি এটা প্রমানের দরকার আছে আপনের?”
সালিম সাহেব মৃদু হাসলো-“আচ্ছা বেশ। আমার জন্যই না হয় আপনি ফিরে যান। এখন আপনার এই বাবার জন্যই আপনার ওই বাসায় থাকা বেশি জরুরি। জামাই বাবা কি করতে চাইতেছে তার কিছুই বুুঝতে পারতেছি না। আপনি থাকলে আমি অন্তত কিছু খবর সবর পাবো। বুঝছেন তো কি বলতে চাইতেছি?”
শুভ্রা ঠোঁট দু’টো দাঁতে চেপে আছে-“আপনার জামাই আমাকে না নিতে আসলে আমি ওই বাসায় ফেরত যাব না আব্বা। মানসম্মান না পেলে কোথাও থাকা কষ্টকর।”
“আপনি বুঝতেছেন না আম্মা। আপনি না থাকাতে অনেক সমস্যা হইতেছে আমার। খবর পাইছি জামাই বাবা মিটিং করতেছে আমার এন্টি মানুষের লগে। কিসের মিটিং করে তা জানি নাই। আপনি কি আপনার বাপের অসম্মান দেখতে পারবেন আম্মা? আপনার জামাই আপনার বাপকে অসম্মান করতে চাইতেছে। আমি কি করবো কিছুই বুঝতেছি না। আপনি ওই বাড়ি ফিরে যান আম্মা। খবর সংগ্রহ করে আমাকে জানান।”
শুভ্রা বাবার কথায় নিরবে মাথা নাড়ে-“সব বুঝতেছি আব্বা তবুও সে না নিতে আসলে আমার যাওয়া সম্ভব না।”
“মাঝে মাঝে জেতার জন্য হারা লাগে আম্মা। জিদ না করে ফিরা যান।”
শুভ্রা তবুও অটল গলায় বললো-“এই কাজটা পারবোনা আব্বা। আমাকে মাফ করেন। সে না নিতে আসলে আমি কিছুতেই যাব না।”
সালিম সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুসময়। মেয়ের অটল মনোভাবের কারন অনুসন্ধান করছে হয়তো। ভেবে নিয়ে মুখ খুললো-“আচ্ছা বেশ, সে নিতে আসলে যাবেন তো?”
শুভ্রা মাথা নাড়ে। সালিম সাহেব হাসলো-“ঠিক আছে। সে নিতে আসলেই যাইয়েন। কিন্তু এইবারের মতো হুটহাট আর আসবেন এই বাড়িতে। আব্বা না বলা পর্যন্ত তার সাথে ভাব জমায় থাকার চেষ্টা করবেন। কি পারবেননা?”
শুভ্রা চকিতে বাবার দিকে তাকায়। কি বলতে চাইছে বাবা সেটা জানতে বাবার চোখে চোখ রাখে। সালিম সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করলো-“আপনে এইটুক না করতে পারলে আপনের জামাই আপনের আব্বাকে দুনিয়ার সামনে ছোট করবে আম্মা। আমার রাজনৈতিক জীবন নিঃশেষ করে দিবে নিজের স্বার্থে। আপনি কি তা সইতে পারবেন?”
শুভ্রা মাথ নাড়লো। সালিম সাহেব কন্ঠে আদ্রতা ঢেলে বললো-“আমি জানতাম পারবেন না। তাই যতদিন আমি না বলবো ততদিন আর এ বাড়ি মুখ হবেন না। কেমন? আর সব খবরাখবর আমাকে দিতে থাকবেন। ঠিক আছে?”
শুভ্রা ঘাড় হেলায়। সালিম সাহেব মুচকি হাসলো-“তাইলে চলেন এখন খেয়ে নেই। আমার খুব খিদা লাগছে আম্মা।”
রণ শুভ্রাকে নিতে এলো তারও কয়েকদিন পরে। জলি রণকে বলে বলে ক্লান্ত হয়ে গেছে তবুও বউ আনার কথাটা কানে তোলেনি রণ। কিন্তু শেষমেষ বাধ্য হয়ে আসতেই হলো। একটা রাস্ট্রিয় অনুষ্ঠানে স্বস্ত্রীক আমন্ত্রণ পাওয়ায় কারণে। শশুর বাড়ি আসার পথেই বুদ্ধিটা মাথায় এলো রণর। সে মিহিরকে বললো-“ফাহিমকে একটু খবর দেতো মিহির। ওর সাথে জরুরি কথা আছে আমার।”
“ও হয়তো অফিসেই আছে। ডাকলেই পাওয়া যাবে।”
বলেই মাথা চুলকায় মিহির। রণ খানিকটা অবাক হলো-“ও কি আসে নাকি অফিসে?”
মিহির ঘাড় নাড়ে-“আসে। প্রায়ই এসে বসে থাকে। বোনের খবর পাওয়ার আশায়।”
রণ হাসলো। তার ভাবনা তাহলে ঠিক দিকেই আছে। মিহিরের দিকে তাকালো সে-“ওকে কিছু কাজ দিয়ে দে। ওর ক্যাপাবিলিটি কেমন যাচাই করি। আমি ওকে কাজে লাগাতে চাই।”
“কিন্তু সালিম সাহেব জানলে?” মিহিরের কন্ঠে দ্বিধা।
“যাতে না জানে সেইরকম কাজ দে।”
রণ মিহিরের দিকে তাকায়। মিহির বুঝে গেলো রণ কি চায়। সে মৃদু হেসে মাথা দুলায়।
চলবে—
©Farhana_Yesmin