দর্পহরন #পর্ব-৩০

0
235

#দর্পহরন
#পর্ব-৩০

“হাসিখুশিকে নিজের বোন মনে করি। আর আন্টিকে মা। ওদের ক্ষতি করার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবি না। অথচ আপনি আমাকে কতবড় অভিযোগ দিয়ে দিলেন। একবারও ভাবলেন না আমি কষ্ট পাবো কিনা।”
শুভ্রার কান্না জড়ানো গলায় বলা কথাগুলো শুনে কিছুটা সময় স্থির হয়ে রইলো রণ। তারপর শুভ্রাকে ধরে নিজের সামনে নিয়ে এলো। শুভ্রার কান্না ভেজা মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ। ফর্সা মুখটা কান্নার দমকে কেমন রক্তলাল হয়ে আছে। রণর বুকের কোথাও যেন রক্ত ক্ষরন হয়। শুভ্রা মুখ নিচু করে কেঁদে যাচ্ছে। রণ ওর চিবুক তুলে ডাকলো-“শুনুন, আপনি কি সত্যিই এতো ইনোসেন্ট? মানে কিছুই জানেন না বোঝেন না?”
শুভ্রার ফোঁপানি কমলো কিছুটা। চোখের গড়িয়ে পড়া জল মুছে অবাক হয়ে বললো-“কি জানবো? আমার কি কিছু জানা উচিত?”
রণর এবার দুঃখে হাসি পেলো। সে মাথার চুল হাতালো কয়েকবার তারপর দ্বিধা নিয়ে বললো-“আপনার পরিবারের লোকগুলো কেমন সেসব কিছুই কি আপনি জানেন না? আপনার ভাই, আপনার বাবা, চাচা, তন্ময় ওদের সম্পর্কে কিছু জানেন না কিভাবে সেটা ভেবেই অবাক হচ্ছি। আপনি এ যুগের মেয়ে। ইন্টারনেট ব্যবহারে দক্ষ। তবুও এরকম অন্ধকারে আছেন কি করে সেটাই আমার বুঝে আসছে না।”
শুভ্রা এবার ভালো করে চোখের জল মুছে নিলো। বিরক্ত স্বরে বললো-“আপনি এতো হেয়ালি করছেন কেন? যেটা বলবার বলে ফেললেই তো হয়? আমার পরিবারের লোকজন কেমন বলুন দেখি? পত্রিকায় কিংবা ওয়েবে অনেক কিছুই দেখি তাই বলে সব কি সত্যি? আমরা কয়েক পুরুষ ধরে বনেদী। দাদা সাংসদ ও মন্ত্রী ছিলেন, চাচাও তাই তারপর বাবা। দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক ভাবে ক্ষমতায় থাকা খুব সহজ কাজ নয়। বন্ধুর চেয়ে শত্রু হবে বেশি, শুভাকাঙ্ক্ষী জমে যাবে, প্রশংসার চাইতে বদনাম বেশি হবে। আমাদের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। আমি কিছু কিছু ব্যাপার দেখেছি নিউজে কিন্তু এটাও ভালোমতো জানি এসব সত্যি না। আমার পরিবার কখনো এতোটা খারাপ হবে না হতে পারে না।”
রণ হাল ছেড়ে দিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল-“তাহলে তো আপনাকে কিছু বলা বৃথা। সব জেনেশুনে যখন অন্ধ সেজে বসে আছেন তখন আপনাকে জ্ঞান দিয়ে আলো ফোটানোর চেষ্টা করা অনর্থক।”
শুভ্রা রণর চোখে চোখ রাখে-“দেখুন, বাবা যখন থেকে আমাকে বুঝিয়েছে আমি এসব নিউজ, পোর্টাল এসব দেখা একদমই বন্ধ করে দিয়েছি। তাছাড়া আমি থেকেছি বাইরে বাইরে। জীবন কেটেছে ব্যস্ততায়। আপনি হয়ত জানেন না আমি নিজের খরচ নিজে চালানোর চেষ্টা করেছি সর্বদা। আমার অতো সময় কোথায় পরিবারে কোথায় কি হচ্ছে সেসব নিয়ে খোঁজ রাখবো।”
“এখন তো অঢেল সময় এখন খোঁজ রাখছেন না কেন?”
রণর কন্ঠে কৌতুক। শুভ্রা ভ্রুকুটি করলো-“টোন কাটছেন? আপনার অন্ন ধ্বংস করছি বলে?”
রণ জিভ কামড়ে বলে-“ছি ছি, এতো মিন মাইন্ড মনেহচ্ছে আমাকে?”
শুভ্রা ঠোঁট ওল্টায়-“বুঝিনা বাপু, আপনি কি বলতে চান তাই বুঝতে পারলাম না আজ অবধি।”
“চেষ্টা করলে ঠিকই পারতেন।” বিরবির করে রণ।
“কিভাবে পারতাম? সুযোগ না দিলে কিভাবে পারতাম?”
রণ রহস্য করে হাসলো। কৌতূহলে জানতে চাইলো-“তা কেমন সুযোগ চাচ্ছেন বলুন তো? আমিও আসলে বুঝতে পারছি না।”
“আপনাকে বুঝতে কি কি করতে হবে সেটা আগে বলুন। ভোর সকালে বেরিয়ে গভীর রাতে বাসায় ঢুকলে বউ কি বুঝবে আপনাকে?”
শুভ্রা ফিরে যাচ্ছিল রণ তার হাত ধরে কাছে টানলো। মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করলো-“তো আপনি কি চাইছেন দেশের জরুরি কাজ বাদ দিয়ে আপনার কাছে বসে থাকি? আপনাকে দেখি সারাদিন?”
শুভ্রা থতমত খেলো-“আমি কখন একথা বললাম?”
রণ ঠোঁটের কোনের হাসিটা গিলে নিলো-“মুখে না বললেও মনে মনে বলছেন নিশ্চয়ই। তা নয়তো আমি শুনতে পেলাম কি করে?”
শুভ্রা মুখ হা করে তাকিয়ে আছে। ওর বোকা কান্ড দেখে রণ হো হো করে হেসে দিলো-“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? ভুল কিছু বলেছি?”
“আমার মন কি বলছে তা আপনি শুনতে পেলেন কি করে? খুব মন বিশারদ হয়েছেন দেখা যাচ্ছে। এইজন্যই বুঝি চন্দ্রানীর সাথে ঘুরে বেড়ানো হচ্ছে আজকাল? ওর মনের কথা খুব বুঝছেন তাই না?”
রণ বেশ মজা পেলো শুভ্রার কথায়। শুভ্রাকে আরেকটু রাগিয়ে দিতেই বললো-“তা একটু একটু পারছি বলতে পারেন। মেয়েটা বেশ ভালো। দেখেছেন দেশের বাইরে থাকার পরও কতো সুন্দর করে শাড়ী পরে থাকে।”
শরীরটা জ্বলে উঠলো শুভ্রার। সে হুট করে রণর খুব কাছে চলে এলো। ওর গেঞ্জির কলার মুচরে ধরে বললো-“চন্দ্রানী খুব সুন্দর শাড়ী পরে তাই না? তাতে তার শরীরের বাঁকগুলো স্পষ্ট বোঝা যায়। আপনার দেখতে সুবিধা হয়?”
রণ মোটেও ঘাবড়ে গেলোনা। তার চেহারা জুড়ে অস্পষ্ট হাসির রেখা ধরে রেখে বললো-“তা একটু সুবিধা হয় বইকি। কি আর করা নিজের বউয়েরটা যখন দেখার সুযোগ নেই তখন না হয় অন্যেরটাই দেখি।”
শুভ্রার সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে রণর কথা শুনে। ইচ্ছে করছে রণর টুটি চেপে ধরতে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“এতো শখ বউয়ের টা দেখার তো দেখুন না। কে মানা করেছে আপনাকে? দেখুন চাইলে ছুঁয়ে দিন। ঢং করে ভদ্রলোক সেজে থাকা হচ্ছে তাই না?”
রণ মুগ্ধ চোখে শুভ্রাকে দেখছে। মেয়েটা রেগে টং হয়ে আছে। নাকের ডগা বেদানার মতো রং ধারণ করেছে। রাগের বশে কতটা কাছাকাছি এসেছে মেয়েটা টেরই পাচ্ছে না। রণ হুট করে শুভ্রাকে দু’হাতে জড়িয়ে নিলো-“আমি মোটেও ভদ্রলোক সেজে থাকছি না। আমি আসলেও ভদ্রলোক। বউয়ের অনুমতি ব্যাতীত তাকে দেখা তো দূর ছুঁয়ে দেওয়ারও কোন ইচ্ছে আমার নেই। বুঝলেন অবুঝ মেয়ে?”
বলেই ওর নাকে নিজের নাকটা ঘষে দিয়ে টুপ করে চুমো একে দিলো মেয়েটার নাকে। শুভ্রা হতচকিত রণর কান্ডে। এই লোক হুটহাট এমম এমন কাজ করে যে অবাক না হয়ে পারে না। লোকটার হাতের বাঁধনে বাঁধা পড়ে কেমন যেন লাগছে তার। বুকটা অকারণে ধুকপুক করছে। শুভ্রা কম্পিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো-“কি করছেন?”
রণ মদিরাসাক্ত গলায় বললো-“আমি কি করলাম? আপনিই তো বললেন আপনাকে কাছে টানতে।”
শুভ্রা মাথা নাড়ে-“দেখতে বলেছি জড়িয়ে ধরতে বলিনি।”
রণ সাথে সাথে ছেড়ে দিলো শুভ্রাকে-“সরি, ভুল শুনেছি।”
শুভ্রার মনেহলো কি যেন হারিয়ে যাচ্ছে ওর কাছ থেকে। মন চাইলো রণকে জাপ্টে ধরতে। কিন্তু নিজের আত্মসম্মান বাঁধা দিলো। এর চেয়ে বেশি আগানো তার পক্ষে সম্ভব না। এতোটা নিচে নিজেকে নামাতে পারবে না। তাই অনেকটা মনখুন্ন হয়েই বিছানায় নিজের জায়গায় যেয়ে চুপটি করে শুয়ে পড়লো। রণ চুপচাপ ওকে দেখলো তারপর নিজেও শুয়ে পড়লো। ঘুমানোর আগ মুহুর্তে বললো-“আগামী কয়েকটা সপ্তাহ ভীষন ব্যস্ত থাকবো আমি। মা আর হাসিখুশির খেয়াল রাখার দায়িত্ব তাই আপনার উপর দিলাম। বাসায় যেন অযাচিত কেউ না আসে সেটা দেখভালের দায়িত্ব আপনার উপর। আশাকরছি আপনি আপনার দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করবেন।”
শুভ্রা চুপ করে রইলো। ঝগড়া করার মুড নেই তার।

*****

“ভাইয়া, তুমি আর এসো না এখানে। ও পছন্দ করছে না।”
শুভ্রার মুখে কথাটা শুনে অবাক তন্ময়-“আমি তোর ভাই শুভ্রা। আমি আসলে কি সমস্যা হবে?”
“আমি জানি না। ও বললো বাসায় পুরুষ আসা ঠিক না। আমরা মেয়েরা থাকি এইজন্য আর কি।”
তন্ময় মুখ নিচু করে বসে আছে। কিছু একটা ভাবলো তারপর বললো-“তাহলে তোকে সরাসরি বলি, তোর ননদটাকে পছন্দ হয়েছে শুভ্রা।”
শুভ্রা বিস্ময় নিয়ে ভাইকে দেখলো। ভাইয়ের চেহারা দেখে ওর শরীর কাঁপতে লাগলো। এ কি সর্বনাশা বিপদ আসতে চলেছে তার কাঁধে। সে নিচু স্বরে চেচিয়ে উঠলো-“ননদটাকে? কাকে?”
তন্ময় হাসলো-“খুশিকে। সি ইজ আ নাইস গার্ল।”
শুভ্রা ঢোক গিললো-“এসব ভুলে যাও ভাইয়া। ও শুনলে জানে মেরে ফেলবে আমাকে।”
তন্ময় তাকিয়ে রইলো-“এ কেমন কথা শুভ্রা। তোর ননদকে পছন্দ করেছি চাইলে বিয়ে করবো। এখানে মেরে ফেলার মতো কি হয়েছে?”
শুভ্রা আঁতকে উঠে বললো-“তোমার মাথা নষ্ট হয়েছে ভাইয়া। এটা কখনো সম্ভব হবে না। প্লিজ তুমি আর এসো না। এমনিতেই ঝামেলার শেষ নেই জীবনে। নতুন করে কোন ঝামেলা চাই না আর।”
তন্ময় অনড়ভাবে বসে রইলো-“তুই আমার বোন শুভ্রা। আমাকে জানিস আমি কেমন। তোর বরকে বরং বলিস আমার প্রস্তাব ভেবে দেখতে।”
শুভ্রা এবার হাতজোড় করলো-“প্লিজ ভাইয়া, এমন কিছু করো না। ও ওর বোনদের খুব ভালোবাসে। ওরা এখনো ছোট বিয়ের কথা মাথায় আনাও পাপ ওদের জন্য। আমি কিছুতেই এ কথা বলতে পারবোনা ওকে। প্লিজ ভুলে যাও এসব।”
তন্ময় উঠে দাঁড়ায়। ক্ষনকাল শুভ্রার দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর স্মিত কন্ঠে বললো-“আজ আসছি।
প্রয়োজন হলে আবার আসবো। তোর ভাই নিজের মর্জির বাইরে একপাও নড়ে না। জানিস তো? ভালো থাকিস।”
শুভ্রা উদভ্রান্ত দৃষ্টি মেলে তন্ময়ের চলে যাওয়া দেখলো। এইজন্যই বুঝি লোকটা মানা করেছিল। ভেবে ভয়ে বুক হিম হয়ে গেলো শুভ্রার। তার বুকের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে। মনেহচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই। বড় কোন অঘটন না ঘটে যায়। খুব ঘামতে লাগলো শুভ্রা।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here