দর্পহরন #পর্ব-৩৪

0
285

#দর্পহরন
#পর্ব-৩৪

“আপা, আমি খুব রাগ করলাম। আপনি আমাকে একদমই ভুলে গেছেন। আগে সকাল বিকাল ফোন দিয়ে এটা সেটা আবদার করতেন আর এখন তিনমাস পার হয়ে যায় আপনি আমার একটা খবর নেন না। আমি কি পুরনো মানুষ হয়ে ভুল করেছি?”
সালিম সাহেব প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় আকুতি জানায়। প্রধানমন্ত্রী মৃদুস্বরে হাসে-“সালিম, তুমি শুধু শুধু আমাকে ভুল বুঝতেছ। তোমার উপর আমি কেন রুষ্ট হবো? যদি রুষ্ট হইতাম তাহলে কি তোমাকে পাশে বসাইতাম?”
সালিম সাহেব কথা খুঁজে পায় না। নেত্রী থেমে থেকে বললো-“কিন্তু এটাও ঠিক আমি তোমার কাজে রুষ্ট হয়েছি। এতো বেশি অভিযোগ ছিল তোমার বিরুদ্ধে। সবাই বলতো আমার আশকারায় নাকি তুমি এতো সাহস পেয়েছ। তাই বাধ্য হয়ে নতুন কাউকে তোমার জায়গায় দিয়েছি। কি জানো, বর্তমানে তরুণ প্রজন্ম হিংস্রতা পছন্দ করে না। অতিরিক্ত দূর্নীতি, ক্ষমতায়ন এসবে তাদের এলার্জি আছে। সেই মতো চলার চেষ্টা করো।”
সালিম সাহেব খুশি হয়ে গেলো-“আপা, আপনি একদম চিন্তা করবেন না। দেখবেন আপনাকে অভিযোগের কোন সুযোগ দেব না।”
“সুযোগ না দিলে ভালো সালিম। রাগীব ছেলেটা অল্প বয়স হলেও বেশ গুছিয়ে কাজ করে। সবচেয়ে বড় কথা ও ক্লান্ত হয় না। দেখোনা এতো বড় সম্মেলন গেলো কোন ধরনের কোন অনু্যোগের সু্যোগ রাখেনি। আর এই তিনমাসে একটা অভিযোগ আসেনি তাকে নিয়ে। কাউকে সু্যোগই দিচ্ছে না।”
প্রধানমন্ত্রী মুগ্ধ চোখে রণকে দেখলো। সে তখন মাইকে ঝাঁঝালো বক্তব্য দিচ্ছে। লোকের তুমুল করতালিতে কান তালা লেগে যায় সালিম সাহেবের।
“এখান থেকে ঢাকায় যাওয়ার জন্য এক্সপ্রেসওয়ে নির্মান হবে সালিম। আর এটা কোন বিদেশি কোম্পানি করবে না। চন্দ্রানীকে তো দেখেছ। ও এসব নিয়ে পড়ালেখা করেছে। ভাবছি ওকে আর রাগীবকে এ কাজের জন্য কনসাল্টেন্ট নিয়োগ দেব। দু’জনেরই প্রচুর এনার্জি। ভালো ভাবে পরিদর্শন করে কাজ করাতে পারবে।”
“জ্বি আপা।”
ক্ষীনকন্ঠে উত্তর দিলো সালিম সাহেব। বক্তব্য দেওয়ার জন্য নাম ঘোষণা হতেই নেত্রী উঠে গেলো। সালিম সাহেব টের পেলো কিছুক্ষণ পর একের পর ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে নেত্রী ওরফে প্রধানমন্ত্রী। বারবার আকারে ইঙ্গিতে এটাই পরিস্কার করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন এলাকায় নেতা হিসেবে রণর জুরি মেলা ভার। সামনে একপ্রেসওয়ে নির্মান হবে তারপর বন্দরকে আর্ন্তজাতিক মানের বন্দর হিসেবে তৈরি করা হবে, একটা আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানি এখানে ইনভেস্ট করতে চায়। এসবের পুরো কৃতিত্ব রাগীবের। সে এলাকার যোগ্য নেতা হিসেবে নিজেকে প্রমান করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

প্রশংসা বানী শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা সালিম সাহেবের। এলাকার লোকের উচ্ছ্বাস দেখার মতো। প্রাবনের মতো লোক আসছে। সালিম সাহেব শুকনো চোখে জনস্রোতে তাকালো৷ সোহেল সামনের দিকেই দাঁড়িয়ে আছে। বাবাকে তাকাতে দেখে হাত নাড়লো। সালিম সাহেব সে হাত দেখতে পেলো কিনা বোঝা গেলোনা। পাশ থেকে বিভিন্ন মন্তব্য কানে আসছে তার। মেজাজ খারাপ হচ্ছে। গত তিন মেয়াদে ইব্রাহিম পরিবার কি কি জুলুম করেছে সে বিষয়ে টুকরো টুকরো সংলাপ কানে আসছে। কেউ কেউ বলেই দিলো নেত্রী আর ইব্রাহিম পরিবারের কাউকে নমিনেশন দেবে না। নতুন মন্ত্রী ভালো কাজ করতেছে তাকেই রাখবে। মেয়র হিসেবেও নতুন কাউকে দেবে। সালিম সাহেবের পর আর কেউ নাইও যে ভালো নেতৃত্ব দেবে। কাজেই ইব্রাহিম পরিবার শেষ, ওদের রাজনৈতিক জীবন শেষ। এসব শুনে সোহেলের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধছিল সোহেলের মধ্যে।

পরের আধাঘন্টায় নেত্রী যখন ব্যবসায়ীদের সাথে মিটিং করলো তাতে রণ এলাকার নেতা হিসেবে নিরঙ্কুশ সাপোর্ট পেয়ে গেলো তখন সালিম সাহেবও চমকে গেলো। তাকে কথা দেওয়া মানুষগুলোও যখন রণর দিকে ঝুঁকে গেলো তখন সে সত্যিই হতাশ হয়ে গেলো। ভ্যাবাচ্যাকা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো। বাপের নাজেহাল অবস্থা দেখে সোহেল ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিলো। ওর ইচ্ছে করছে এখনই ছুটে গিয়ে রণর মাথা ফাঁটিয়ে দিতে। এর জন্য সব ঝামেলা পাকছে। ওদের ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে রণ। আজ ওর একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। অদূরে বসে থাকা বাবাকে দেখে নিলো চোরা চোখে। চারপাশে তাকায়, তারপর ধীরে ধীরে মিটিং স্থল থেকে বেড়িয়ে গেলো।

*****

শুভ্রা হতবিহ্বল অবস্থায় আছে। জলির অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে তখনই চেচামেচি করে তন্ময়কে বিদায় করেছে। হাসিখুশিকে কাছের হাসপাতালে ফোন করে এম্বুলেন্স পাঠানোর কথা বলে নিজেকে রণর নাম্বারে ফোন দিচ্ছে। কিন্তু তার নাম্বার বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। মিহির কিংবা রাজীবের নাম্বার নেই তার কাছে। ছুটে এসে হাসিখুশির কাছে জানতে চাইলো, মিহির বা রাজীবের নাম্বার আছে কিনা। মিহিরের নাম্বার পাওয়া গেলো। কিন্তু মিহিরও ফোন ধরছে না। মাঝে মাঝে তার নাম্বারও আনরিচেবল বলছে। হাসিখুশি এরইমধ্যে ওদের মামাকে খবর দিয়েছে। জলিকে দ্রুত কাছেরই এক হাসপাতালে নেওয়া হলো। প্রতিমন্ত্রীর মা বলেই হয়তো দ্রুত চিকিৎসা পেলো জলি। আপাতত আইসিইউতে রাখা হয়েছে তাকে।

এদিকে একঘন্টায় রণ আর মিহিরকে ফোন দিতে দিতে মাথা নষ্ট হয়ে গেছে শুভ্রা। মাঝে বাবার নাম্বারেও চেষ্টা করেছে কিন্তু পায়নি। হঠাৎ কি ভেবে শরীফকে ফোন লাগায় শুভ্রা-“ভাইয়া, আব্বা কই?”
শুভ্রার ভয়ার্ত কন্ঠ শুনে শরীর উদ্বিগ্ন হয়ে বললো-“আব্বা সমাবেশে গেছে। কি হইছে শুভ্রা? এমন লাগছে কেন তোর গলা?”
“ভাইয়া, সর্বনাশ হয়ে গেছে। তন্ময় ভাই বাসায় আসছিল। উল্টা পাল্টা বলে গেছে আব্বার নামে। আজকে বলে আব্বা ওর কিছু করবে।”
শরীফের কিছুটা সময় লাগলো শুভ্রার কথা বুঝতে। ও অবাক হয়ে বললো-“কাকে কি করবে?”
শুভ্রা অস্থির হয়ে চেচিয়ে উঠলো-“তোমাদের বোন জামাইকে।”
শরীফ হেসে দিলো-“ধ্যাত, তুই এইসব বিশ্বাস করছিস কেন? আব্বা এইসব কিছু কেন করবে? তন্ময় নির্ঘাত তোকে ভয় দেখিয়েছে। কিন্তু ও তোর বাসায় গেছে কেন?”
“সে অনেক কথা ভাইয়া। তন্ময় ভাইয়া যে কি করেছে আজ। আমার শাশুড়ী এখন আইসিইউতে।”
শরীফ আঁতকে উঠলো-“কি বলছিস এসব? কি করে কি হলো?”
“সে অনেক কথা ভাইয়া। আমি ভাবছি উনি জানলে কি হবে। আমার খুব ভয় করছে ভাইয়া। কি করবো বুঝতে পারছি না। এদিকে ওনাকে অনেকক্ষণ ধরে ফোন দিয়ে বন্ধ পাচ্ছি। কোনভাবেই যোগাযোগ করতে পারছি না। ভাইয়া, তুমি কি একটু দেখবে কি অবস্থা?”
শুভ্রা হড়বড়িয়ে কথা বলে গেলো। শরীফ তাকে আশ্বস্ত করলো-“আমি দেখছি শুভ্রা। কোন প্রয়োজন হলে আমাকে বলিস। এখন কে আছে হাসপাতালে? আমি আসবো?”
“তুমি আমাকে ওর খবরটা দাও ভাইয়া। আন্টির জ্ঞান ফিরলেই ছেলেকে দেখতে চাইবে।”
“আচ্ছা, দেখছি আমি। তোকে জানাব।”
তবুও শুভ্রার মনটা খচখচ করছে। আজ হলো তাতে তার একদম মাঝ দরিয়ায় হাবুডুবু খাওয়ার মতো অবস্থা। তন্ময়ের ঘটনা রণ জানতে পারলে কি করবে সে জানেনা। মায়ের এমন অবস্থা দেখলে রণর কি প্রতিক্রিয়া হবে ভাবতেই গায়ে জ্বর চলে আসতে চাইছে শুভ্রার। আবার তন্ময়ের কিছু হলে জলি তাকে কি করবে সে জানেনা। জলির কাছে বিয়ের আর্জি নিয়ে এসেছিল একদিন। মানুষটা তার আর্জি মন্জুর করেছিল। আজ যদি তার কারণে তার ছেলেটার কিছু হয়ে যায় তাহলে জলির সাথে নজর মেলাতে পারবেনা আজীবন। ভীষণ অস্থিরতায় ডুবে রইলো শুভ্রা। পুরোটা সময় সে আনমনে পায়চারি করে গেলো।

*****

অঘটনটা ঘটলো নেত্রী গাড়িতে চড়ার মুহূর্তে। মুখে কাপড় বেঁধে কেউ একজন এগিয়ে আসলো। নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে অস্থিরতা তৈরির জন্য কয়েকটা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটালো। হুট করে একটা হুড়োহুড়ি শুরু হলো। নেত্রীকে তার নিরাপত্তা বহর ঘিরে ধরে গাড়িতে তুলে রওনা দিয়ে দিল। রণ ছিলো ঠিক তাদের পেছনে। পরের গাড়ি বহরে ঢাকা থেকে আগত মন্ত্রী আর দেশি বিদেশি আমলারা যাবে। সবার মধ্যে একটা অস্থিরতা শুরু হয়ে গেলো। রণ পরিস্থিতি বুঝে নিতে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। মিহির সহ কয়েকজন ওকে ঘিরে আছে। মিহির ফিসফিস করলো-“ভাই, তাড়াতাড়ি গাড়িতে ওঠেন।”
রণ মাথ দুলিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দিলশাদ সাবধান করার পরেও আক্রমনের লক্ষ যে সে হতে পারে সেটা তার মাথায় ছিলো না। নেত্রীকে নিয়ে বিচলিত হয়ে ছিলো রণ। তার অসাবধানতার সু্যোগ নিলো সোহেল। ছোট একনলা স্বয়ংক্রিয় পিস্তলটি লোড করে খানিকটা আড়াল বেছে নিয়ে রণ বরাবর তাক করলো। তারপর চুক চুক করে আফসোস করলো-“বোনটার জন্য কষ্ট লাগতেছে। কিন্তু বাপের উপরে কিছু নাই। ক্ষমতার উপরে কোন সম্পর্ক নাই। আমার ভবিষ্যতের জন্য তোমার মরা জরুরি। টাটা বাইবাই।”
কিছুক্ষণ বাদে পরপর দু’টো গুলির আওয়াজ এলো।

★মনে আছে তো, আমার প্রথম মৌলিক থ্রিলারের প্রি অর্ডার চলছে। আপনি অর্ডার করেছেন তো?

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here