দর্পহরন #পর্ব-৩৮

0
224

#দর্পহরন
#পর্ব-৩৮

“আব্বা, আপনারা ওনাকে মেরে ফেলতে চান? ওনার সাথে যে আপনার নিজের মেয়ের জীবন জড়িয়ে আছে সেটাও কি ভুলে গেছেন?”
শুভ্রার কথা শুনে সালিম সাহেব চমকে গেলেন। তাহলে কি রণ শুভ্রাকে সব বলে দিলো? তিনি মেয়েকে কি বলে বুঝ দেবেন সেটা ভাবলো কয়েকমুহুর্ত। আমতা আমতা করে বললো-“আম্মা, এইটা কি বললেন? আপনের আব্বাজানকে চিনেন না আপনে? এমুন কাম আমি করুম আপনে ভাবলেন কেমনে? আমি খুব কষ্ট পাইলাম আম্মাজান। আপনের আব্বারে আপনে বিশ্বাস করেন না। এই দুঃখ কই রাখমু?”
সালিম সাহেবের নাকি কান্না দেখে শুভ্রা বিচলিত হলো না। সে এবার কন্ঠ খানিকটা নরম করে বললো-“আমি সোহেল ভাইয়ের ভিডিও দেখছি আব্বা। ভাই ওনার উপর গুলি চালাইতে গেছে তখনই ভাইকে পুলিশ গুলি করছে। এখন বলেন চোখের দেখা অবিশ্বাস করি কেমনে?”
সালিম সাহেব মেয়েকে তাকিয়ে দেখলো। শুভ্রাকে কেমন ধীরস্থির দেখাচ্ছে। সালিম সাহেব বোঝার চেষ্টা করলো মেয়ের মনে কি চলছে। তিনি মেয়ের হাত ধরে সামনের চেয়ারে বসিয়ে দিলো-“অবিশ্বাস তো করতে কই নাই আম্মাজান। তাই বইলা এইটাও বিশ্বাস কইরেন না আমি এমুন কাম করাইছি। সোহেল সবসময়ই একটু তার ছিঁড়া এইটা তো জানেনই। এইজন্য ওরে আমি এখন সবকিছু থিকা দূরে রাখি। কালই কেমনে কেমনে সমাবেশে আইছে আমি জানিও না। আপনে এইটা ভাবেব তো, আপা ছিলো কালকের অনুষ্ঠানে। আমি কি এমুন কোন কাম করুম যেইটাতে আপা রাগ করবো? আপনেই বলেন দেখি?”
শুভ্রাকে সাথে সাথে মাথা নাড়তে দেখে সালিম সাহেব স্বস্তি পেলো-“আম্মাজান, কালকের ঘটনার পরে দল থিকা আমাকে বহিস্কার করতে পারে। নিজের এতোদিনের গড়া মানসম্মান নিয়ে টানাটানি হইতেছে। আপার সামনে লজ্জায় দাঁড়াইতেই পারুম না। এই সোহেইল্লারে নিয়া কিযে করুম ভাইবা পাই না। আমারে শেষ কইরা দিলো এই পোলা।”
সালিম সাহেবের কন্ঠ আর্দ্র হলো। চোখ দুটো মুছে নিলো আলতো হাতে। বাবার ভেজা চোখ শুভ্রার হৃদয় আন্দোলিত করে। সে বাবার পিঠের উপর হাত রাখলো-“ডাক্তার কি বলে আব্বা? ভাইয়া ভালো হয়ে যাবে?”
সালিম সাহেব মাথা নাড়লো-“কালইকা পর্যন্ত দেখবো। জ্ঞান না ফিরলে…”
সালিম সাহেব ঝরঝর করে কাঁদেন। শুভ্রা মন খারাপ করে মাথা নিচু করে বসে রইলো। সালিম সাহেব ভেজা কন্ঠে বললো-“আপনেরা যে যাই বলেন আমার সোহেলের আমার জন্য অনেক ভালোবাসা। শুধু আমাকে সঙ্গ দিব দেইখা আমার খিতা দূরে যাইবোনা বইলা বেশিদূর পড়ালেখা করলোনা। এখন পোলা আমার বাঁচা মরার মাঝখানে। কেন এমুন করলো সোহেলে? আম্মাজান, কনতো কেন এমুন করলো?”
এবার শুভ্রার চোখদুটোও ভিজে যায়। সালিম সাহেবের কথা সত্য। সোহেল বাস্তবিক বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে। শুভ্রা বাবাকে শান্তনা দিলো-“নিজেকে সামলান আব্বা। ভাইয়া ঠিক হয়ে যাবে।”
কিছুটা সময় দু’জন চুপ করে রইলো। শুভ্রা উঠে দাঁড়ায়-“বাসায় যাই আব্বা। আম্মার কি হাল দেখি। আমি আছি কয়েকদিন।”
সালিম সাহেব ধীরলয়ে মাথা দুলালেন।

*****

ইব্রাহিম নিবাস ভুতুড়ে বাড়ির মতো নিস্তব্ধ। সবসময় জমজমাট হয়ে থাকা বাড়িটা আজ মৃতপ্রায়। শুভ্রা অন্যমনস্ক হয়ে কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরলো। বাড়িতে আজ প্রায় সবাই আছে তবুও কোন আওয়াজ নেই। মায়ের কাছে বসলে খুনখুন করে কাঁদে। শুভ্রা কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে এসেছে। শরীফ বাবার সাথে হাসপাতালে। শুভ্রা ছোট চাচার ঘরে উঁকি দিলো। তাহের শুয়ে শুয়ে মোবাইল কিছু একটা দেখছিলো। শুভ্রাকে দেখে অবাক হলো-“তুই কখন এলি?”
শুভ্রা ভেতরে ঢুকে হাসলো-“দুপুরের আগেই এসেছি। হাসপাতাল ঘুরে এলাম তাই দেরি হলো।”
তাহেরের মুখটা অন্ধকার হলো-“তুই তাহলে সব জেনেই এসেছিস। তোর বর আসতে দিলো?”
শুভ্রা হেঁটে এসে চাচার বিছানায় বসলো। তাহের উঠে বসেছে ততক্ষণে। শুভ্রা মাথা নাড়লো-“আসতে দিতে চায়নি। ক্যাওয়াজ করে আসতে হয়েছে।”
তাহের ভাগ্নিকে মন দিয়ে জড়িপ করলো-“ছেলেটা কিন্তু ভালো। শুধু শুধু ওর সাথে ঝামেলা করিস না।”
শুভ্রা ভাবুক হয়ে চাচার পানে চাইলো-“সত্যি বলছো? তোমার মনেহয় সে ভালো মানুষ?”
তাহের হাসলো-“এই পরিবার ওমন জামাই পাওয়ার যোগ্য না। তোরা হচ্ছিল ডাকাবুকো, সে ভদ্রলোকের ছেলে। কোনভাবেই ম্যাচ হয় না।”
শুভ্রা খিলখিল করে হাসলো কিছুক্ষণ-“তোরা বলছো কেনো? তুমি এমনভাবে বলছো যেন তুমি এ পরিবারের কেউ না। তাছাড়া নিজের পরিবারকে ডাকাবুকো বলছো। বাবা চাচ্চু কি করেছে বলো তো?”
তাহের গুম হয়ে বসে রইলো। শুভ্রা চাচাকে দেখছে চুপচাপ। তাহের ওদের চোখে ভীষণ রহস্যময় একজন। বিয়ে থা করেনি কখনো, বাড়ির কেউ বলেওনা। নির্ঝন্ঝাট থাকতে পছন্দ করে। শুভ্রা হঠাৎ করে জানতে চাইলো-“চাচ্চু, একটা সত্যি কথা বলবে?”
তাহের অবাক চেয়ে মাথা নাড়লো। শুভ্রা বললো-“তুমি বিয়ে করলে না কেন? কাউকে পছন্দ করতে?”
তাহের চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিলো। ধীর স্বরে বললো-“ঘর সংসারের ঝামেলা ভালো লাগে না। বিয়ে মানেই ঝামেলা। একা একা বেশ আছি। কোন পিছুটান নেই ঘ্যানঘ্যানানি নেই।”
শুভ্রা কথা বাড়ায় না। জানে চাচার কথাগুলো সত্য না। কিন্তু কথা বাড়াতে মন চাইলো না বলে নিজের কামড়ায় ফিরে এলো।

সোহেলের অবস্থা পরিবর্তন হয়নি। সালিম সাহেব কাল থেকে হাসপাতালেই আছেন। রিমা ক্ষণেক্ষণে ছেলের কথা বলে মুর্ছা যাচ্ছে। বড় চাচী তাকে সামলাতে ব্যস্ত। একমাত্র তুলতুল খুব বেশি স্বাভাবিক। সে তিনবেলা নিয়ম করে খাবার খাচ্ছে। নিজের রুমে ঘুমাচ্ছে। তাকে বেশ সুখী দেখায়। সকাল সকাল শুভ্রাকে দেখে বললো-“আপা, যদি কিছু মনে না করেন আপনার ফোনটা আমাকে দেবেন? মার সাথে একটু কথা বলতাম।”
শুভ্রা অবাক হলেও সাথে সাথে ফোন বের করে দিলো। তুলতুল দ্রুত হাতে মায়ের নাম্বারে ফোন দিলো। কয়েকবার চেষ্টা করার পর ওপাশ থেকে যখন কেউ ফোন তুললো তুলতুল হড়বরিয়ে উঠলো। কথা বলতে বলতে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে যা বললো তাতে শুভ্রার চোখ কপালে উঠলো। দশ মিনিট কথা বলে লজ্জিত মুখে শুভ্রাকে ফোন ফিরিয়ে দিলো। শুভ্রা হতচকিত হয়ে ফোন হাতে নিয়ে বললো-“ভাবি, ভাইয়া হাসপাতালে থাকার পরেও তুমি এতো স্বাভাবিক? ভাইয়া কি তোমাকে জোর করে তুলে এনেছে? প্লিজ ভাবি, আজ কোন মিছে কথা বলো না।”
তুলতুল অসহায় হাসলো-“বেশি কিছু বলবো না। শুধু বলবো, আপনার ভাইকে আমি আমার জীবনের চাইতে বেশি ঘৃনা করি। এতোটাই ঘৃনা করি যে সে মারা গেলে আমি একটুও দুঃখ পাবো না। বাকীটা আপনি বুঝে নেন আপা।”
শুভ্রা হতবুদ্ধি হয়ে তুলতুলের দিকে তাকিয়ে রইলো। রণর কথাগুলো তাহলে সত্যি? সে কি করে এতোটা অবুঝ হয়ে থাকে? আব্বা কি তাহলে এই কারনেই ওকে সারাজীবন দূরে দূরে রেখেছে? ও যাতে কিছু টের না পায়? শুভ্রা নিজের কামরায় ফিরে এলো ধীর পায়ে।

সন্ধ্যা নাগাদ সোহেলের কোমায় চলে যাওয়ার খবর এলো। বাড়ির পরিবেশ আরও ভারী হয়ে উঠলো। আত্মীয়স্বজনরা ভীড় করতে শুরু করলো। সালিম সাহেব বিদ্ধস্ত চেহারা নিয়ে ঘরে ফিরে এলো। তাকে হতবিহ্বল লাগে। শুভ্রার হাসফাস লাগছে এমন গুমোট পরিস্থিতি। মন চাইছে ঢাকায় ফিরে যেতে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে ঢাকায় যাওয়া খারাপ দেখায়। আসলে তার বাবাকে এরকম অবস্থায় আগে কখনো দেখেনি সে। তাই কোথায় যেন হাহাকার টের পায়। সোহেল যত খারাপ হোক তার ভাই হয়।রক্তের সম্পর্ককে অস্বীকার করা যায় না কিছুতেই। সবকিছু মিলিয়ে ভীষন হিজিবিজি পরিস্থিতি। এমন অবস্থায় হুট করে রণর ফোন-“শুভ্রা, কি অবস্থা সোহেল ভাইয়ের?”
শুভ্রা ফিসফিস করলো-“ভাইয়া কোমায় চলে গেছে মিস্টার রণ। এবার আপনি খুশি তো?”
রণ চুপ করে থেকে বললো-“কারো দুঃখে দুঃখবিলাস করার মতো মানুষ আমি না এটা আপনার জানা উচিত। যা হোক আপনাকে এসব বলা অর্থহীন। কাজের কথা বলি। আপনার বাবাকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করার দাবী উঠেছে। কালকের মধ্যে হয়তো ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। আফটারঅল উনি আমার শশুর তাই কথাটা আপনাকে জানানো। ধাক্কাটা ওনার জন্য বেশি হতে পারে। ভাবলান আগেভাগে জানিয়ে রাখলে আঘাত কম পাবে।”
শুভ্রা দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করলো-“এই মহান কাজটা নিশ্চয়ই আপনি করছেন?”
রণ প্রথম অবাক তারপর উচ্চস্বরে হো হো করে হাসলো-“সত্যি মাথা খারাপ আপনার। নিজের বাপ ভাইয়ের আগে কিছু দেখেন না দেখছি। কোথায় আপনাদের ভালো ভাবলাম বলে কৃতজ্ঞতা দেখাবেন তা না সবসময়ের মতো আমাকেই দোষী বানানোর পায়তারা।”
রণর কথা শুনতে শুনতে শুভ্রা দ্রুত বাবাকে দেখলো। চুপচাপ শুয়ে আছে বিছানায়। মানুষটা এমনিতেই ছেলের দুঃখে কাতর। এমন অবস্থায় পার্টির খবর শুনলে কি হতে পারে ভেবে ভয় পেলো শুভ্রা। মাথায় জট পাকিয়ে যাচ্ছে সব ভাবনারা। শুভ্রা দ্রুত গতিতে ভেবে চলেছে-“শুনুন, বাবাকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করার ব্যাপারটা আপনি দেখুন। এই মুহুর্তে এমন কিছু হলে বাবাকে কিছুতেই সহ্য করতে পারবেন না।”
রণর গম্ভীর স্বর শোনা গেলো-“আর এসব আমি কেন করবো? কি লাভ আমার?”
“লাভ!” শুভ্রা যেন স্বগতোক্তি করলো।
“হ্যা, আমার কি লাভ এসব করে। কেনইবা করবো?”
রণ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো। শুভ্রা ঠোঁট কামড়ে ধরলো। রণ এমন কিছু বলবে আগে বোঝেনি। সে কিছু একটা ভেবে নিলো-“আপনার শর্ত মেনে নেব। পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছেদ করবো আমি। আপনি বাবাকে এবারের মতো বাঁচিয়ে নিন আমি আমার পরিবারের সাথে সব সম্পর্ক ত্যাগ করবো।”
রণর কন্ঠস্বর ভারী হলো-“ভেবে বলছেন তো?”
শুভ্রা ঠোঁট দু’টো চেপে ধরে রাখলো তিরিশ সেকেন্ড। তারপর মাথা দুলায়-“হ্যা, ভেবে বলছি।”
“ঠিক আছে। ঠেকিয়ে নেব এবারের মতো। আপনি কাল সকাল সকাল চলে আসবেন এ বাড়ি। মা আপনার কথা বলছিল আজ। আপনাকে কাল বাসায় দেখতে চাই।”
একবার মানা করতে যেয়ে থমকে গেলো শুভ্রা, বললো-“ঠিক আছে। কাল চলে আসছি।”
রণ শেষ বারের মতো জানতে চাইলো-“ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তো শুভ্রা? পরে আবার নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে যাবেন নাতো?”
“একদম না। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকবো। আপনি ভাববেন না। আর যদি না থাকতে পারি তাহলে আপনার যা সাজা দেবেন মাথা পেতে নেব।”
রণ অবাক গলায় বললো-“সত্যি তো!”
“সত্যি সত্যি সত্যি। তিনবার বললাম। চলবে?”
শুভ্রার কথায় চুপ করে গেলো রণ। খানিকক্ষণ বাদে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-“রাখছি।”

★বই ‘অন্ধকারে জলের কোলাহল’ এর প্রি অর্ডার চলছে। জানেন তো? ৫০% ছাড়ে অর্ডার করতে পারেন বেনজিন প্রকাশন এর পেজে কিংবা আপনার পছন্দের বুকশপে। না হলে রকমারিতে। লিংকঃ https://www.rokomari.com/book/369119/ondhokare-joler-kolahol

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here