#দর্পহরন
#পর্ব-৩৯
“রাগীব, তুমি এতো রাতে? কোন বিশেষ দরকার?”
নেত্রী অবাক কন্ঠ শুনে রণ চুপ করে রইলো। উনি সাধারণ ঘরোয়া পোশাকে দাঁড়িয়ে। রণ খানিকটা নার্ভাস হলো-“ফুপু, একটা বিষয়ে কথা ছিলো।”
নেত্রী বুঝলেন রণ কোন বিষয় নিয়ে কথা বলবে। উনি সোফায় বসে রণকে হাতের ইশারায় ডাকলেন-“বসো। কি বলবে বলো।”
“ইব্রাহিম সালিমের বহিস্কারের চিন্তা বাদ দেওয়া যায় না ফুপু? উনি দীর্ঘদিন আপনার সাথে আছে। তাছাড়া ওনার ছেলে সোহেল তো কোমায় চলে গেলো। মনেহয় না সে বেঁচে ফিরবে। আর ছেলেকে হারাতে হলে এটাই ওনার জন্য বড় শাস্তি হবে। এরচেয়ে বড় কোন শাস্তি হয় না আর।”
নেত্রী চুপ করে রইলো কিছু সময় তারপর বললো-“আমি তো তোমার জন্য ওকে শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবছিলাম। আজ মারার জন্য হামলা করেছে কাল হয়তো মেরেই ফেলবে। ও সাংঘাতিক মানুষ, ওর কাছে সম্পর্কের কোন ভ্যালু নেই। নিজের প্রয়োজনে ছেলেমেয়েকেও তুচ্ছ করতে পারে। তবুও তুমি যখন বলছো তখন বিষয়টা আপাতত মুলতবি রাখবো। ওর এ্যাকটিভিটি দেখবো। খারাপ কিছু পেলে এ্যাকশন নেব। তখন কিন্তু কিছু বলা যাবে না?”
রণর মুখে হাসি ফুটলো-“থ্যাংক ইউ ফুপু।”
নেত্রী হাসলেন। হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন-“চন্দ্রের কাজ কেমন লাগছে? ও কি পারছে প্রজেক্ট হ্যান্ডল করতে?”
“পারছে ফুপু, বেশ ভালো ভাবেই পারছে। এ ব্যাপারে চন্দ্রর দক্ষতা আছে।”
রণর কথা শুনে নেত্রীর মুখ পরিতৃপ্তির হাসি দেখা গেলো-“ও তোমার কথা খুব বলছে। তুমি যে ভীষণ ধৈর্য্য নিয়ে ওকে সব শিখিয়ে দিচ্ছ সেটাও বলেছে ও।”
রণ লাজুক হাসলো-“আমি শুধু আমার কর্তব্য করেছি ফুপু। চন্দ্র এমনিতেই সব পারছে।”
“ওটা তোমার বড়ত্ব। তারপর বলো বউ কেমন আছে? বউয়ের সাথে সব ঠিক আছে তো?”
হুট করে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ আসায় রণ সংকোচ বোধ করে। কি বলবে ভেবে পেলো না। নেত্রী বললেন-“বেশি সমস্যা মনে করলে সমস্যা সমুলে উপরে ফেলো। এসব বিষয়ে মায়া করতে নেই। মায়া করলে সারাজীবন ধরে পস্তাতে হয়। না বনলে জোর করে ধরে রাখবে কেন? সব ছেড়ে নতুন করে সব শুরু করো।”
“আর কিছুদিন দেখবো ফুপু৷ তারপর একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারবো আশাকরি। আপনি তো জানেন সবই। সালিম সাহেবকে আমি আসলে কোনভাবেই সহ্য করতে পারি না। কিন্তু কি আর করা।”
নেত্রী আশ্বস্ত হলেন-“বেশ ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছ।”
রণ বিদায় নিতে উঠে দাঁড়ায়-“আজ আসি ফুপু। আপনাকে এতো রাতে বিরক্ত করলাম বলে দুঃখিত।”
“এর শাস্তি পেতে হবে তাহলে। শুধু দুঃখ প্রকাশ করলে হবে না।”
“জ্বি ফুপু। যা বলবেন করবো।”
“ভেবে বলছো তো? না হলে কিন্তু এই কথা দেওয়ার জন্য বিপদে পড়বে।”
নেত্রীর কন্ঠে কৌতুক। রণকে কিছুটা বিভ্রান্ত লাগে। তা দেখে নেত্রী হাসলো-“বাড়ি যাও। না হলে মা টেনশন করবে আবার।”
রণ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সে প্রায় পালিয়ে এলো তার ফুপুর কাছ থেকে।
*****
সকাল হতেই শুভ্রার তৈরি হয়ে বাবার সামনে দাঁড়ায়-“আব্বা, আমি যাচ্ছি।”
সালিম সাহেব ঘোলা চোখে তাকায় মেয়ের দিকে-“কই জান আম্মা?”
“বাসায় যেতে হবে আব্বা। ওনার কোথাও যাওয়ার কথা আছে। আমাকে ডেকেছেন উনি।”
ভ্রু কুঁচকে শুভ্রার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সালিম সাহেব। কথা বুঝতে পেরে স্তিমিত কন্ঠে বললো-“আব্বাকে এই অবস্থায় ফেলে চলে যাবেন?”
বলে থেমে গেলেন সালিম সাহেব। তারপর কি ভেবে বললেন-“যান। কারো জন্য তো জীবন থাইমা থাকো না। তবে আপনি কাছে থাকলে আপনার আব্বা সাহস পায়।”
শুভ্রা কম্পিত গলায় জবাব দিলো-“শরীফ ভাই আছে, চাচা আছে। আপনি চিন্তা করবেন না আব্বা। তাহের চাচা বললো সোহেল ভাইকে সিঙ্গাপুর নেওয়ার ব্যবস্থা করছে। ভাই ভালো হয়ে যাবে।”
সালিম সাহেব চুপ করে থাকলেন। তার মাথা নিচে ঝুঁকে আছে। বাবাকে ওরকম অসহায় অবস্থায় দেখে বুকটা হুহু করে উঠলো শুভ্রার। নিজেকে অতি দ্রুত সামলে নিয়ে বাবার নিকটে এসে দাঁড়ায়-“আমি যাই আব্বা। দোয়া করবেন আমার জন্য।”
“আব্বাকে মাঝে মাঝে দেখতে আইসেন আম্মা। এই বুড়া সন্তানকে ভুলে যাইয়েন না।”
শুভ্রা অনেক কষ্টে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আঁটকালো। তার কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছে। বাড়ির মানুষদের চাইলেও আর দেখতে পাবে না সেই কষ্টে নাকি আর কোনদিন এ বাড়ি আসতে পারবে সেই কষ্টে কান্না আসছে সেটা সে জানে না। শুভ্রা বাবার পা ছুঁয়ে উঠে দাঁড়ায়-“আব্বা, আপনার মেয়ে খুব ভালোবাসে আপনাকে। যত দূরেই থাকি না কেন আপনার কথা সবসময় স্মরনে থাকে। আপনি আমার জন্মদাতা, নিজেকে ভোলা গেলেও আপনাকে ভোলা সম্ভব না৷ আসি আব্বা।”
শুভ্রা ছুটে বেড়িয়ে এলো বাপের রুম থেকে। কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা নিচে নেমে গাড়িতে উঠে বসলো। তার চোখ থেকে টপটপ করে জল ঝরছে। না পেরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো সে।
*****
শুভ্রাকে দেখে মোটেও খুশি হলো না জলি। মুখে অন্ধকার নেমে এলো। ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করা দূর শুভ্রার সালামের উত্তরও দিলো না। মুখ ফিরিয়ে নাস্তা করায় মন দিলো। শুভ্রা বাসা থেকে নাস্তা না করেই বেরিয়েছিল। এখন খাবার দেখে ওর খিদে পেয়ে গেলো। কাপড় না পাল্টেই ডাইনিং এ বসলো। প্লেট টেনে পরোটা আর আলুভাজি নিয়ে খেতে শুরু করলো। জলি ওকে খেতে দেখে মুখ বাঁকাল। অন্য সময় হলে নিজ থেকেই ওকে খেতে দিত। শুভ্রার খটকা লাগলেও পাত্তা দিলো না। হঠাৎ জলি বললো-“তা এবার কি পরিকল্পনা করে এলো?”
“জ্বি!”
জলির কথার মানে না বুঝতে পেরে শুভ্রা অবাক হয়ে তাকায়। জলি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো-“একেবারে নাদান। এমন ভাব করছো যেন কিছু বোঝ না?”
শুভ্রা মুখ হা করে জানতে চাইলো-“মানে কি? কি বুঝবো? আমি সত্যি কিছু বুঝতে পারছি না।”
জলি কঠিন মুখ করে তাকিয়ে থেকে বললো-“বলছি বাবা ভাইদের সাথে বসে কি পরিকল্পনা করে এলে? গুলি করে মারবে নাকি তুমি নিজে খাবারে বিষ মিশিয়ে মারবে আমার ছেলেকে?”
শুভ্রা হতভম্ব, ও চোখ গোল করে তাকিয়ে আছে-“এসব কি বলছেন উল্টো পাল্টা?”
“কেন? ভুল কিছু বলেছি? আমার ছেলেকে মেরে ফেলতে চাও না তোমরা?”
শুভ্রা কি বলবে ভেবে পেলো না। শান্তশিষ্ট জলির এমন কঠিন রুপ সে আগে দেখেনি। সে হতবিহ্বল হয়ে বললো-“আন্টি, এসব কি বলছেন? উনাকে কেন মেরে ফেলতে চাইবো আমি? আপনার কোথাও বুঝতে ভুল হয়েছে।”
জলি তীক্ষ্ণ নজরে শুভ্রার পানে চেয়ে থেকে বললো-“এতোদিন ভুল বুঝলেও এখন ঠিকঠাক বুঝতে পারছি তোমাকে। জোর করে কান্নাকাটি করে নিজেকে অসহায় প্রমান করে কেন আমার ছেলেকে বিয়ে করেছিলে তা এখন আয়নার মতো পরিস্কার আমার কাছে। আমি ভেবেছিলাম, হাজার হোক মেয়ে তুমি। বাবা ভাইদের মতো হবে না। নিজের স্বামীকে আগলে রাখবে, ভালোবাসবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। আমার রণ কিছুতেই বিয়ে করতে চায়নি তোমাকে। কি কুক্ষণে তোমার মায়ায় পড়েছিলাম। ছেলেটাকে বাধ্য করলাম বিয়ে করতে। ছেলেকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে তোমার সাথে বিয়ে দিলাম এখন ঘরের মধ্যে শত্রুর বাস। আমার ছেলেটার জীবন আমি নিজ হাতে আরেকজনের হাতে সঁপে দিয়েছি। মা হয়ে এই দুঃখ কোথায় রাখি।”
শুভ্রা নিশ্চুপ বসে থাকে। সে এতোটাই অবাক জলির আচরণে যে কোন কথাই মাথায় আসছে না। নিজেকে কেমম বোকা বোকা লাগে। জলি হঠাৎ পাল্টে গেলো কেন? সেদিন পর্যম্ত তো ঠিকই ছিলো। আজ শুভ্রাকে বিশ্বাস করছে না কেন? শুভ্রা নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলো-“আন্টি, আপনি কেন এসব উল্টোপাল্টা বলছেন? কি করেছি আমি?”
জলি প্লেট ঠেলে উঠে দাঁড়ায়-“আর সাধু সেজো না মেয়ে। তোমার ভাইয়ের কীর্তি দেখে ফেলেছি আমি। এবার নিশ্চয়ই তোমার বাবা তোমার উপর দায়িত্ব দিয়েছে আমার ছেলেকে মেরে ফেলার? জেনে রাখো এমনটা করার সুযোগ তুমি কিছুতেই পাবে না। আমি যেমন নিজ থেকে তোমাকে আমার ছেলের জীবনে এনেছিলাম ঠিক তেমন করে তোমাকে ওর জীবন থেকে দূরে ঠেলে দেব। আমার ছেলের জীবন নিয়ে আর কাউকে খেলার সুযোগ দেব না। বুঝলে মেয়ে?”
জলি উঠে চলে গেলো। শুভ্রা ঠায় বসে রইলো টেবিলে। এসব কি কি বলে গেলো আন্টি ওকে! নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। পেটে খিদে থাকলেও মুখে রুচি নেই। নাস্তা করার ইচ্ছেই উবে গেছে। শুভ্রা প্লেট ঠেলে উঠে দাঁড়ায়। মাথা ফাঁকা লাগছে। বুক ঠেলে কান্না উগলে আসছে। রণর শর্ত মেনে মনে মনে বাবার বাড়ি থেকে চিরবিদায় নিয়ে এখানে এসেছে। এখন এখানে এমন উল্টো পাল্টা শুনে মাথা ঘুরছে ওর। কি হচ্ছে ওর সাথে এসব? কোন গোলকধাঁধার চক্করে পড়ে গেছে সে? ভালো লাগছে না কিচ্ছু। শুভ্রার হঠাৎ উথালপাথাল কান্না এলো। সে ছুটে রুমে ঢুকে বিছানায় আছড়ে পড়ে হুহু কান্নায় ভেঙে পড়লো।
রণ আজ অন্যদিনের চেয়ে কিছুটা আগেভাগেই বাড়ি ফিরেছে। মনে ক্ষীন আশা আজ শুভ্রাকে দেখতে পাবে। মেয়েটার সাথে খুনসুটি বেশ মজা লাগে রণর। কিন্তু বাসায় ঢুকে মনে হলো শত্রু শিবিরের দূর্গে ঢুকেছে। এতো নিরব হয়ে আছে বাড়ি। সাধারণত শুভ্রা বাসায় থাকলে হাসিখুশিও আনন্দে থাকে। কিন্তু আজ যেন সবাই চুপচাপ। মায়ের সাথে দেখা করে নিজের কামরায় ফিরলো রণ। ঘর অন্ধকার হয়ে আছে। বাতি জ্বালাতেই দেখলো শুভ্রা গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। হাতটা চোখের উপর রাখা। পুরো মুখটা দেখা যাচ্ছে না। রণ বিস্মিত হলো। শুভ্রা ইদানীং তার জন্য জেগে থাকত। আর আজ তো আরও ঘুমানোর কথা না। কেন ঘুমিয়ে পড়লো। রণর মন চাইলো ওকে ডেকে তুলতে। কিন্তু শুভ্রা যদি আবার রাগ করে এই ভয়ে ডাকলো না। উল্টো পায়ের কাছে রাখা চাদরটা ওর গায়ের উপর টেনে দিয়ে দীর্ঘশ্বাষ ফেলে উঠে দাঁড়ায়। কোথায় ভেবেছিল আজ শুভ্রাকে জ্বালাবে কিন্তু না ম্যাডাম ঘুমিয়ে গেছেন।
শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসতেই দেখলো শুভ্রা বিছানায় উঠে বসেছে। ওকে দেখে ঘুমঘুম চোখে একবার তাকালেও কোন কথা বললো না। রণর ভ্রু কুঁচকে গেলো। কিছু কি হয়েছে শুভ্রার? কথা বলছে না কেন ওর সাথে? রণ এগিয়ে শুভ্রার কাছাকাছি দাঁড়ায়-“কখন এসেছেন?”
তবুও জবাব দেয় না শুভ্রা। ঘোলাটে দৃষ্টিতে রণর দেখছে যেন ওকে চিনতে পারছে না। রণ টের পেলো শুভ্রার গালে শুকনো জলের রেখা। মেয়েটা ঘুমানোর আগে কাঁদছিল নাকি? শর্ত অনুযায়ী আর বাড়ি যাওয়া হবে না শুভ্রার এই ভেবেই কাঁদছিল কি? মন বিগলীত হলো রণর, শুভ্রার কাছাকাছি এসে বসলো-“কি হয়েছে শুভ্রা? কথা বলছেন না কেন?”
শুভ্রা কিছু না বলে মাথা নাড়লো। রণ অস্থির হয়ে উঠলো-“আরে হলো কি আপনার? কথা বলছেন না কেন? সারাদিন কাজ করে বাসায় এসে কি একটু শান্তি পাবো না? কি চাইছেনটা কি আপনি? কি হয়েছে বলবেন তো?”
“আন্টি আন্টি আজকে…”
শুভ্রার গলা কেঁপে উঠলো। আবারও কান্না পাচ্ছে তার, কথা আঁটকে আসছে। জলির বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেলো। কেন ওসব বললো আন্টি? রণ শুভ্রাকে দেখে বিস্মিত হয়ে-“মা! মা কি করেছে? সে তো ঠিক আছে দেখলাম।”
শুভ্রার চোখ ছলছল হয়। সে রণর মুখের দিকে তাকায়। ঠোঁট দু’টো চেপে আছে। রণ বিরক্ত হয়ে বললো-“কাঁদছেন কেন? বাড়ি ছেড়ে আসার প্রথমদিনই এই অবস্থা? তাহলে বাকী দিনগুলো কিভাবে কাটাবেন?”
বলতে বলতে হেসে দিলো রণ। শুভ্রা এবার অদ্ভুত একটা কাজ করলো। রণকে ভীষণ রকম চমকে দিয়ে আচমকা ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো।
★আমার দু’টো বইয়ের প্রি অর্ডার চলছে রকমারিসহ অন্যান্য বুকশপে। আমার লেখা পড়তে ভালো লাগলে আমার বই দুটো সংগ্রহ করার অনুরোধ রইলো। বুকশপের লিষ্ট ও রকমারি লিংক কমেন্টে দিয়ে দিলাম। ভালো বই কিনুন ভালো লেখা প্রমোট করুন।★
চলবে—
©Farhana_Yesmin