.#দর্পহরন
#পর্ব-৪৭
দীর্ঘ দিন পরে তুলতুলকে নিজেদের বাড়িতে দেখে সবাই বিস্ময়ে বিস্মিত। তুলতুলের চাচা গোলাম রাব্বানীর মেয়ে হিমি তুলতুলকে দেখে খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো-“তুলতুলি! তুমি এসেছ? মা, চাচী দেখো তুলতুলি এসেছে।”
বলেই ছুটে এসে তুলতুলকে জাপ্টে ধরে হিমি। মিতা আর তহুরা ছুটে এসে তুলতুলকে দেখে চমকে যায়। তারা খুশি হবে না ভীত হবে তাই বুঝতে পারছে না। তুলতুল হঠাৎ কি করে এলো? ওরা এতো সহজে ওকে আসতে দিলো? নাকি তুলতুল পালিয়ে এসেছে? নানা প্রশ্ন মনকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। মেয়েকে এতো কাছে পেয়েও কাছে টানতে দ্বিধা। তুলতুলের বিরক্ত লাগছিল। বেশ কিছু সময় পরে তহুরা কম্পিত কন্ঠে বললো-“ও তুলতুল, তুই সত্যি আসছিস নাকি আমি স্বপ্ন দেখতেছি?”
তুলতুল প্রায় ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে-“সত্যি আসছি মা।”
মিতা পাশ থেকে বললো-‘ওরা আসতে দিলো নাকি তুই…”
তুলতুল হেসে দেয়-“কি বলো চাচী? একা কিভাবে আসবো? উনি নিয়ে আসছে।”
এবার পেছনে দাঁড়ানো মানুষটাকে নজরে পড়ে সবার। শরীফ সংকোচ নিয়ে হাসলো সালাম দিলো তুলতুলের মা আর চাচীকে-“আসলে ডাক্তার দেখাতে আসছিলাম। উনি আপনার কাছে আসার জন্য জেদ করতেছিল তাই আমি নিয়ে আসছি।”
তহুরার চোখ ছলছল, মুখজুড়ে কৃতজ্ঞতার ছায়া-“বাবাজী, কিযে খুশি দিলা এই মাকে। মেয়েটাকে আজকে আট দশ মাস পরে নিজের কাছে পাইলাম।”
তহুরার গলা কাঁপে। তুলতুল মাকে তাড়া দেয়-“মা এইসব আলাপ বাদ দেও তো। তুমি আমাকে তাড়াতাড়ি ঝালঝাল করে শুঁটকির ভর্তা আর ইলিশ মাছ ভাজা খাওয়াও। অনেক খাইতে মন চাইছে।”
তহুরা মেয়ের আবদার শুনে হতবিহ্বল বোধ করেন। মিতার দিকে চাইতেই মিতা আশ্বস্ত করলো-“ভাবি, রান্নাঘরে চ্যাপার শুটকি আর ফ্রিজে ইলিশ মাছ আছে বাইর করেন। আমি তাড়াতাড়ি হিমির আব্বা আর ফাহিমকে ফোন দিয়ে ডাকি। ওরা খুশি হবে।”
তহুরা ছুটে গিয়ে ফ্রিজ থেকে ইলিশ মাছ বের করে রান্নাঘরের দিকে গেলো। হিমি তুলতুলের গা ঘেঁষে জড়িয়ে আছে-তুলতুলি চলো ঘরে যাই। অনেক গল্প করবো তোমার সাথে।”
তুলতুল অনুমতির আসায় শরীফের দিকে তাকালে শরীফ হাসলো-“যান যান গল্প করুন। কিন্তু শরীরের দিকে খেয়াল রাখবেন। আব্বা আম্মার আমানত যেন ঠিকঠাক থাকে না হলে কিন্তু আমার উপর খড়গ নামবে।”
তুলতুল খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। বোনের হাত ধরে ভেতর ঘরে চলে গেলো। ও জানলো না ওর এই প্রানখোলা হাসি দেখে কি পরিমান চমকে গেছে শরীফ। চমকের সাথে সাথে মুগ্ধতাও জায়গা করে নিলো ওর মনে। মেয়েটা এতো সুন্দর করে হাসতে পারে? কই বাড়িতে তো কোনদিন এভাবে হাসতে দেখেনি তুলতুলকে? শরীফ অনেকটা মোহগ্রস্তের মতন একা একা বসে রইলো সোফায়।
পরবর্তী একটা ঘন্টা চমৎকার সময় কাটলো তুলতুলের। তুলতুলের ভাই ফাহিম আর চাচা রাব্বী তুলতুলের আসার খবর শুনে ছুটে চলে এলো। ভাই আর চাচাকে পেয়ে কেঁদে দিলো তুলতুল। এক হৃদয় বিদারক পরিস্থিতি তৈরি হলো। সবার চোখে পানি মাঝে শরীফের নিজেকে ক্লাউন মনেহচ্ছিল। সেই সাথে তীব্র অপরাধবোধ মনে বাসা বাঁধছিল। মেয়েটাকে এভাবে আঁটকে রাখার মানেই হয় না। সে বুঝলো তার বাবা মা খুব অন্যায় একটা কাজ করছে মেয়েটাকে তার পরিবার থেকে দূরে রেখে। কিন্তু কিভাবে তুলতুলকে ওই বন্দীদশা থেকে মুক্ত করবে? সোহেলের বাচ্চা মেয়েটার জঠরে বড় হচ্ছে। সে পৃথিবীতে এলে মেয়েটার দায়িত্ব বাড়বে, মায়ের মমতার শেকলে বন্দী হবে। সব ভেবেই মনটা ভারী চঞ্চল হলো শরীফের।
তুলতুল পেটপুরে খেলো। শরীফ অবাক হয়ে তুলতুলকে অনাহারে থাকা মানুষের মতো খেতে দেখলো। তহুরাও মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। হুট করে চারপাশে তাকাতেই তুলতুলের খাওয়া থেমে যায়-“কি হইছে মা? তোমরা এমনভাবে তাকায় আছো কেন? আমি কি করছি?”
তহুরার চোখের কোনে পানি তবুও সে মিষ্টি করে হাসলো-“তুই কিছু করিস নাই তুলতুল। অনেকদিন পরে তো তাই তোকে দেখতেছি। আরেকটু ভাত নেরে মা। চ্যাপার ভর্তাটা নে।”
তুলতুল আঁতকে উঠলো-“আর না মা। পেট ফেটে যাবে এমন মনে হইতেছে। অনেক শান্তি করে ভাত খাইছি আজকে।”
তহুরা কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে শরীফের দিকে তাকায়-“সবই বাবাজীর কল্যানে।”
তুলতুলও দেখলো শরীফকে। ভারী লজ্জা লাগে শরীফের। সে তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ায়-“আমাদের যেতে হবে। বেশি দেরি করলে আব্বা অস্থির হয়ে যাবে।”
রাব্বী মাথা দুলায়-“হ্যা হ্যা যাও। সুযোগ পেলে মেয়েটাকে আবার নিয়ে আসিও। খুব খুশি হবো আমরা।”
শরীফ মাথা দুলায়। সুযোগ পেলে সে সত্যি সত্যি তুলতুলকে নিয়ে আসবে মাঝে মাঝে, এটা সে ভেবে রেখেছে।
*****
নেত্রীর বিশেষ অনুমতি নিয়ে রণ আরও দু’দিন আমেরিকা থেকে গেলো। শুভ্রা ভীষণ খুশি হয়ে গেলো। এতোটা সে আশাই করেনি অথচ রণ করে ফেললো। কৃতজ্ঞতায় মনটা আরেকটু দ্রবীভুত হয়ে যায় শুভ্রার। রণর প্রতি মুগ্ধতার পারদ বাড়লো আরেকপ্রস্ত। ভারী চমৎকার সময় কাটাচ্ছে তারা। বিয়ের এতোগুলো দিন পরে যেন সত্যিকার অর্থেই সে বিয়ের আমেজ পাচ্ছে। রণ পুরোটা সময় একজন সাধারণ স্বামীর মতো শুভ্রার সাথে সেটে রইলো। একসাথে খাওয়া, ঘুরে বেড়ানো, শপিং সব মিলিয়ে জীবনের মধুরতম সময়টা কাটছে শুভ্রার।
“ম্যাডাম, কোথায় হারিয়ে গেলেন? গোছগাছ শেষ?”
শুভ্রার সম্বিত ফেরে। তাকিয়ে দেখলো রণ দাঁড়িয়ে আছে। ওর দিকে তাকিয়ে রণ হাসলো-“আমার গোছগাছ কিন্তু শেষ।”
শুভ্রা নিজের হাতের দিকে তাকালো। ব্র্যান্ডেড ব্যাগ দুই ননদের জন্য। নতুন লাগেজটাতে জায়গা হচ্ছে না। শুভ্রা অসহায় চোখে তাকিয়ে চোখ নাচালো-“আপনি কি এই দু’টো আপনার লাগেজে নেবেন? এটা ফুল হয়ে গেছে।”
শুভ্রা নতুন লাগেজটা দেখালো ইশারায়। রণর মুখে দুষ্ট হাসি খেলে গেলো। গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বললো-“নেব কিন্তু ফিস দিতে হবে।”
রণর মতলব বুঝে শুভ্রার গাল লাল হলো-“হাসিখুশির জিনিস এগুলো। এরজন্য ফিস দিতে পারবোনা।”
রণ শুভ্রার কাছাকাছি চলে এলো। হাত থেকে ব্যাগ দু’টো নিয়ে বললো-“আমি ফিস ছাড়া কাজ করি না। এগুলো রেখে আসছি ফিস নিতে। আমাদের বেরুতে হবে আর দু’ঘন্টার মধ্যে। তাড়াতাড়ি সব ক্লোজ করো।”
বলেই টুপ করে চুমু দিলো শুভ্রার গালে। গালে হাত দিয়ে শুভ্রা ফিক করে হেসে দেয়। মন্ত্রী মশায় এর আচরণগুলো জনগণ টের পেলে বেশ হতো। দায়িত্ববান মানুষটাও যে এমন দুষ্ট মিষ্টি হতে পারে তা কে জানতো? গত দু’দিনের কথা ভেবে শুভ্রার রঙিন গাল আরও রঙিন হলো।
ওরা দেশে ফিরতেই ছেলে আর বউকে দেখেই জলি সব বুঝে গেছে। মেয়েটা হয়তো এ কারনেই আমেরিকা গেছিল। রণকে দখল করতে। জলির মনোভাব নিশ্চয়ই বুঝেছে শুভ্রা। এ বাড়িতে নিজের অবস্থান পোক্ত করতে তাই উঠেপড়ে লেগেছে শুভ্রা। কিন্তু যত যাই করুক জলি শুভ্রাকে কিছুতেই সুযোগ দেবে না। রণকে কারো হাতের পুতুল হতে দেবে না কিছুতেই। তাইতো শুভ্রা যখন জলিকে গিফট দিলো জলি মুখ কালো করে থাকলো-“ছেলের এতোগুলা টাকা নষ্ট করার কি দরকার ছিলো?”
শুভ্রা সহসা জবাব দিতে পারে না। বুঝলো জলির অপছন্দের মানুষের তালিকায় তার নাম উঠে গেছে। এখন হাজার চেষ্টা করলেও কিছু হবে না। তবুও চেষ্টা করে যেতে হবে। এটাই হয়তো তার নিয়নি।
এসে পড় থেকে রণ ভীষণ ব্যস্ত। দেখা হওয়াই দুষ্কর হয়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় সফর করতে হচ্ছে। এরমধ্যে সামনে আবার একটা সম্মেলন বলে বেশ জমজমাট সিডিউল মেইনটেন করতে হচ্ছে। শুভ্রা জেগে থাকার চেষ্টা করলেও বেশিরভাগ দিন ঘুমিয়ে যায়। সকালে ঘুম ভাঙার পরে ভীষণ আফসোস হয়। আজ একটু আগেই বাসায় ফিরে এলো রণ। শুভ্রা তখন কিচেনে কাজ করছিল। রণ এসেই ওকে ডাকলো। শুভ্রা কাছে যেতেই ফিসফিস করলো-“ঘুমিয়ে যেয় না। আমি মায়ের সাথে আলাপ সেরে আসতেছি।”
প্রতক্ষ্য প্রস্তাব, অস্বীকার করার কোন কারণই নেই। শুভ্রা বরং পুলকিত হয়। নিজেকে মনেমনে প্রস্তুত করে। কিন্তু রণ ফিরে এসেই ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। বের হয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো-“এখনো বসে আছো? খেতে দাও প্লিজ। চরম খিদে পেয়েছে।”
শুভ্রা বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তাতে রণর ধমক খেতে হলো-“আরে, এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? খাবার চেয়ে অন্যায় করলাম?”
শুভ্রা বুঝতে পারছে না হঠাৎ করে কি হলো রণর? মা কি কিছু বলেছে? আজকের ঘটনার ব্যাপারে?
★অমর একুশে বইমেলা ২০২৪ উপলক্ষে আমার দু’টো বই এসেছে। একটা পলিটিকাল মার্ডার মিস্ট্রি থ্রিলার ‘অন্ধকারে জলের কোলাহল’ পাবেন ৩৫৬ নং স্টলে। অন্যটা সমকালীন রোমান্টিক জনরার ‘আমি ডুবতে রাজি আছি’ পাবেন উপকথার ৫৬৪ নং স্টলে। চমৎকার বইদুটো ঘরে বসে অর্ডার করতে পারবেন রকমারিসহ আপনার পছন্দের বুকশপেও। আমার লেখা ভালো লাগলো বইদুটো সংগ্রহ করুন। আশা করছি বই পড়ে নিরাশ হবেন না।★
চলবে—
©Farhana_Yesmin