#দর্পহরন
#পর্ব-৪৯
মৃত্যু জীবন থামিয়ে দেয় না। পৃথিবী আপন গতিতে চলতে থাকে। ছেলের মৃত্যুতে কিছুটা স্থবির সালিম সাহেবের জীবন। বেশিরভাগ সময় বাসায় মাঝে মাঝে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চুপচাপ বসে থাকেন। আগে বেশিরভাগ কাজ সোহেল সামলে নিত এখন তুহিন দেখে। এই বসে থাকার মাঝেই অনেকরকম খবর কানে আসে। ক’দিন চুপচাপ সব শুনলেন, সত্য যাচাই করলেন। তারপর আজ
সালিম সাহেব নেত্রীর সাথে দেখা করতে এসেছেন। ভয়ে ভয়ে ছিলেন নেত্রী তার সাথে দেখা করবেন কিনা। কিন্তু নেত্রী তাকে অবাক করে দিয়ে দেখা দিলেন।
“সালিম, কেমন আছো?”
“কেমন আছি তা আপনার থেকে ভালো কেউ বুঝবে না আপা। আমার যেমন থাকার আমি তেমনই আছি।”
নেত্রী খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলো। সালিম সাহেব বেশ শান্ত মেজাজে বসে রইলো। নেত্রীই জানতে চাইলো-“হঠাৎ দেখা করতে আসলা? কোন জরুরি দরকার?”
একটু সময় নিলো সালিম সাহেব। মনে মনে কথা গুছিয়ে মুখ খুললো-“আপা, আপনার সাথে আছি কত বছর তা কি জানা আছে আপনের?”
হুট করে এমন প্রশ্ন শুনে নেত্রী কিছুটা বিস্ময় নিয়ে সালিম সাহেবকে দেখলো। সালিম সাহেব ম্লান হাসলো-“বেয়াদবী নিয়েন না আপা। প্রশ্নটা করলাম এই কারনে যে মাঝে মাঝে সবারই অতীত মনে করা দরকার তাতে হয় কি আপনার বিপদে কে পাশে ছিলো তা নতুন করে মনে পড়ে। আমরা বর্তমানে বাঁচি এটা যেমন সত্য তেমন বিপদের বন্ধু কে হয় তাদেরও চিনে রাখা দরকার। আপা, আপনে আমার উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন নানা কাজে। আমার যে ছেলে এইসব কাজে জড়িত ছিলো আল্লহ তাকে নিজের কাছে ডেকে নিছে। এখন নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে আপনার কোন সমস্যা নাই?”
নেত্রীর চেহারা খানিকটা পরিবর্তন হলো। যদিও চেহারা দেখে মনোভাব আন্দাজ করা যায় না। নেত্রী জানতে চাইলো-“তুমি আসলে কি বলতে চাও সালিম সরাসরি বলে ফেলো।”
“আপা, আপনি বলছিলেন সংসদ নির্বাচন থেকে সরে যাইতে। আমাকে মেয়র পদে নমিনেশন দিবেন। এখন কানাঘুষা শুনতেছি আব্দুস সবুরকে নমিনেশন দিবেন। আপা, আমি আপনার বাবার সাথে কাজ করছি। এখন আমাকে এমন কোনঠাসা করা মানে অপমান করা। এই অপমান আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারতেছি না। মানলাম আমার অনেক ভুল আছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করছি কিন্তু আপা আপনার জন্য অনেক কিছু করছি। যখন যা বলছেন আমি জান দিয়া চেষ্টা করছি। এখন আমার এই অপমানে যদি আপনি সায় দেন তাইলে আমি কষ্ট পাবো আপা। এমনিতেই ছেলের শোকে কাতর হয়ে আছি তার উপর যদি এমন ঘটনা ঘটে তাহলে আমার দ্বারা নতুন করে ভুল হয়ে যাইতে পারে।”
নেত্রীর চোয়াল শক্ত হলো। সাথে সাথে আবার নিজেকে সামলে নিয়ে হাসলো-“রাজনীতিতে ইমোশনাল হলে চলে না সালিম। এইবার সাংসদ হইতে পারো নাই বলে কি জীবন শেষ হয়ে যাবে? আগামীবারের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলেই তো পারো। এখন যদি তোমাকে মেয়র পদে নমিনেশন দেই তাহলে আগামী বারের ইলেকশন করতে পারবা না। আর তুমি ভালো মতোই জানো সংসদ নির্বাচন মেয়রের চাইতে অনেক বেশি কাজের। ক্ষমতার দাপট বেশি।”
সালিম সাহেব মাথা নাড়েন-“না আপা, পাঁচ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা অনেক কঠিন। তাছাড়া আমি যদি পাতি নেতা হতাম মেনে নিতাম। আমি পুরনো মানুষ নতুনদের নেতৃত্ব মেনে নেওয়া কষ্টকর আমার জন্য।”
“তোমার নিজেকে শোধরাবার কথা বলেছিলাম সালিম। পাঁচ বছর ধৈর্য্য ধরে নিজেকে শোধরাও তারপর ফিরে আসো।কিন্তু তুমি দেখি কোন কথা শুনতেছ না। এমনিতেই তোমাকে নিয়ে বিতর্কের শেষ নাই। এরকম করলে তো আমি টিকতে পারবোনা।”
নেত্রীর কথায় সালিম সাহেব প্রচন্ড অপমান হলেন। নিজেকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে হাতের শেষ অস্ত্র ব্যবহার করে বসলো-“আপা, আমি তাহলে মাজহার ভাইয়ের সাথে দেখা করি। সে কি বলে শুনি।”
নেত্রীর চেহারা বদলে গেলো। মুখটা ক্রমশ লাল হয়ে গেলো-“সীমা অতিক্রম করে ফেললে সালিম। আমি তোমার ভালো চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি বুঝলে না।”
সালিম নত না হয়ে বললো-“আপনি আর কোন উপায় রাখেন নাই আপা। আমি বাধ্য হয়ে কথাগুলো বললাম। আমি মেয়র নির্বাচনে মনোনয়ন চাই আপা। সংসদ নির্বাচন আসুক তখন দেখা যাবে। আজ আসি আপা। আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য মাফ করবেন।”
সালিম সাহেব দাঁড়ালেন না ঝটপট রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন। থমথমে মুখ নিয়ে নেত্রী তখন চেয়ারে বসে আছেন।
*****
“দিলশাদ, তন্ময়টা খুব বাড়াবাড়ি করতেছে। কি করি বলতো?”
দিলশাদ হাসলো-“সোহেলের মতো ফিনিশ করে দিব ভাই?”
ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা রণ হাসলো না-“পাগল হইছিস? সালিম সাহেব শান্ত আছে মানে যা খুশি তাই করা যাবে না। এই লোককে বিশ্বাস নাই কোন। অন্য কোন উপায় বল।”
দিলশাদ অভয় দেওয়া গলায় বললো-“তাহলে সিভিল ড্রেসে তুলে নেওয়া যায় ভাই। তারপর দিন কতোক আঁটকে রেখে রগরে দিলে ঠিক হয়ে যাবে।”
“একটাকে আঁটকে রেখে এখন পস্তাচ্ছি আবার আরেকটাকে আঁটকাবো? মাফ চাই।”
আঁতকে উঠে বিরবির করলো রণ। দিলশাদ বললো-“কিছু বললেন ভাই?”
রণ সাথে সাথে জবাব দিলো-“বলছি এটাও না অন্য কোন বুদ্ধি বল।”
“আর কি বলবো? এরা সহজ মানুষ না তাই সোজা আঙুলে ঘি তুলতে পারবেন না। এরা বেকা মানুষ এদের সাথে তেড়ামি না করলে হবে না। তন্ময় ছেলেটা খুব একটা সহজ না। ছোট বেলায় সোহেলদের সাথে থাকতো, স্কুলে মেলা কিছু করছে। কলেজে একবার মেয়েঘটিত একটা ব্যাপার ঘটাইছিল। তারপরই তড়িঘড়ি করে দেশের বাইরে গেলো। এইবারও হঠাৎ দেশে আসছে। খোঁজ নিতে পারেন কোন ঘাপলা করছে নাকি।”
“আচ্ছা, দেখছি। কিছু পেলে জানাবো তোকে।”
“ঠিক আছে ভাই।”
ফোনটা কাটতেই শুভ্রার ফোন ঢুকলো। রণ মুচকি হাসলো। আজকাল খুব ভালো বউ হওয়ার চেষ্টা করছে শুভ্রা। সকালের নাস্তা না করে বের হতে দেবে না রণকে। খুব ভোরে যেদিন বের হবে সেদিন একদম খেতে মন চায় না রণর কিন্তু শুভ্রার জেদের কারনে পেরে ওঠে না। তারপর বেলায় বেলায় ফোন তো আছেই। বারবার চন্দ্রানীর কথা জানতে চায়। রণ হাজার বার বলেও বোঝাতে পারেনি চন্দ্রানীর সাথে কাজ করে সে। এর বাইরে কোন সম্পর্ক নেই। শ্বাস ফেলে ফোন ধরলো রণ-
“হ্যালো।”
“কি করছেন?”
“বসে বসে চন্দ্রানীর সাথে গল্প করছি।”
ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো না। রণ মিটমিটিয়ে হাসছে নিঃশব্দে-“এটাই ভাবছো তো? আরে বাবা নিজের ভাবনার লাগাম টানো। জরুরি কাজ করছিলাম। ফোন করেছ কেন? দরকার কোন?”
শুভ্রার কন্ঠে অভিমান ঝরে পড়ে-“বাহ! এমনিতে ফোন দিতে পারি না? আপনি নিজে তো ফোন দেনই না আমি দিলেও খুশি হন না।”
“মিথ্যে অভিযোগ।”
শুভ্রা তেতে উঠলো-“সত্য মিথ্যা জানি না। শুনুন, তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবেন। আজ বিশেষ কিছু আছে। আপনার তো কিছু মনে থাকে না। কাজ করে দেশ উদ্ধার করছেন। রাখছি।”
রণকে কথা বলার কোন সুযোগ না দিয়ে শুভ্রা সাথে সাথে ফোন কেটে দিলো। রণ ভারি ভাবনায় ডুবে গেলো। আজ বিশেষ দিন কেন? আজ কি শুভ্রার জন্মদিন? উহু, জন্মদিন আসতে দেরি আছে। তাহলে? হাসি খুশির কিংবা মায়ের জন্মদিন? আজ তারিখ কতো? পরি মড়ি করে ক্যালেন্ডার দেখলো রণ। সাত তারিখ? আজ সাত তারিখ! লাফিয়ে উঠলো রণ। এতো বড় ভুল সে কিভাবে করলো? দ্রুত হাতের কাছের জিনিস গুছিয়ে নিলো।
*****
তুলতুল বই পড়ছে আর হিহি করে হাসছে। মাঝে মাঝে লাজুকলতা হয়ে যাচ্ছে। গাল দু’টো উত্তাপ ছড়াচ্ছে। আবার মাঝে মাঝে উদাস হয়ে বই বন্ধ করে উদাস হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকছে। মালা ওকে আড়চোখে দেখছে আর বিরবির করে গালি দিচ্ছে। হঠাৎ দরজা আওয়াজ হলো। মালা দরজা খুলতেই শরীফকে দেখা গেলো-“তুলতুল আমি কি ভিতরে আসবো?”
তুলতুল অবাক হলো। ত্রস্ত হরিণীর মতো দ্রুততায় নিজেকে ফিটফাট করলো-“হ্যা,আসেন।”
শরীফ ঘরে ঢুকে একবার তুলতুলকে দেখে মুখ নিচু করলো। চেয়ার টেনে দূরত্ব রেখে বসলো। মালাকে বললো-“আমাদের জন্য দুইকাপ চা বানিয়ে আনতো মালা।”
মালা বেরিয়ে গেলে শরীফ তুলতুলের দিকে তাকালো। বেশ ফ্রেশ দেখাচ্ছে তুলতুলকে। শরীফ বললো-“বই পড়ে কেমন লাগছে?”
“অনেক ভালো লাগতেছে। আপনাকে ধন্যবাদ। মনটা শান্তি পাইতেছে।”
শরীফ মাথা নেড়ে চুপ করে বসে রইলো। তুলতুল এবার অবাক হলো কিছুটা। মানুষটা এভাবে বসে আছে কেন? তুলতুল বলেই ফেললো-“আপনি কি কিছু বলবেন?”
শরীফ মাথা দুলায়। সে দ্বিধা নিয়ে এদিক সেদিক তাকায়। চঞ্চল চোখদুটো লুকিয়ে বললো-“আব্বা আম্মা একটা প্রস্তাব রাখছে আমার কাছে।”
তুলতুল না বুঝে জানতে চাইলো-“কিসের প্রস্তাব।”
“তারা চায় আমি তোমাকে বিয়ে করি।”
তুলতুল হা করে শরীফের দিকে তাকিয়ে রইলো।
★অমর একুশে বইমেলা ২০২৪ উপলক্ষে আমার দু’টো বই এসেছে। একটা পলিটিকাল মার্ডার মিস্ট্রি থ্রিলার ‘অন্ধকারে জলের কোলাহল’ পাবেন ৩৫৬ নং স্টলে। অন্যটা সমকালীন রোমান্টিক জনরার ‘আমি ডুবতে রাজি আছি’ পাবেন উপকথার ৫৬৪ নং স্টলে। চমৎকার বইদুটো ঘরে বসে অর্ডার করতে পারবেন রকমারিসহ আপনার পছন্দের বুকশপেও। আমার লেখা ভালো লাগলে বইদুটো সংগ্রহ করুন। আশা করছি বই পড়ে নিরাশ হবেন না।★
চলবে—
©Farhana_Yesmin