#দর্পহরন
#পর্ব-৬
“রণ হোয়াট?”
শুভ্রা ধমকে উঠলো-“আগে পরে কিছু নেই? আমি কি আপনাকে চিনি? আমাকে তুলে এনেছেন কেন? আমার সাথে কি শত্রুতা? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন আপনি জানলেন কি করে আমি সেদিন দেশে এসেছি?”
একের পর এক প্রশ্ন শুনে রণ হেসে দিলো। তার সেই প্রানখোলা হাসি দেখে শুভ্রা থমকালো। মুগ্ধ দৃষ্টিতে রণর দিকে চাইলো। আজ খেয়াল করলো হাসলে ছেলেটার বা গালে টোল পড়ে, চোখ দুটো তারার মতো জ্বলজ্বল করে। কত উচ্চতা হবে ছেলেটার? পাঁচ এগারোর কম না। একটু নড়াচড়া করলেই শার্টের উপর দিয়ে সুগঠিত দেহের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। হাতের ঘড়ি আর পায়ের জুতোজোড়ায় সৌখিনতা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। রণ অবশ্য শুভ্রার মুগ্ধতা আমলে নিলো না। সে হাসতে হাসতেই বলে-“কিডন্যাপ আপনি হয়েছেন না আমি? আচ্ছা বেশ, আপনার প্রশ্নের উত্তরগুলো ধীরে ধীরে দেব আমি। তবে তারজন্য শর্ত আছে আমার। শর্ত যাইহোক যদি রাজি থাকেন তাহলে উত্তর পাবেন।”
শুভ্রা আগের মতোই তেজদীপ্ত ভঙ্গিতে জানতে চাইলো-“কিসের শর্ত? কোন শর্ত টর্ত মানতে পারবোনা।”
রণ গম্ভীর হলো-“ভেবে বলুন। চারদিনের বেশি হলো পেটে দানা পড়েনি। আর কয়দিন না খেয়ে থাকতে পারবেন?”
শুভ্রা ঢোক গিললো। সত্যিই তার খিদে পেয়েছে। পেট এতোটাই ফাঁকা যে ‘খেতে দে’ বলে রীতিমতো হুমকি দিচ্ছে। শুভ্রার অবস্থা দেখে রণ মুচকি হাসে-“তাছাড়া এই যে ওষুধ খেয়ে গলার ব্যাথা টের পাচ্ছেন না কথা না শুনলে সে সুবিধাও কেড়ে নেব। আমার সুন্দর কথায় পটে যাবেন না। কাজের বেলায় আমি কতোটা নিষ্ঠুর সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে বাকী নেই?”
কথাটা যেন মরিচের ঝাল গেলার মতো কষ্ট দিলো শুভ্রাকে। তার গালের রং পরিবর্তন হলো দ্রুত। রণ আজ প্রথমবারের মতো মাথা নিচু করে থাকা মেয়েটাকে ভালোমতো দেখলো। ফর্সা গায়ের রং এ নিটোল মুখ। খাঁড়া নাক আর পাতলা ঠোঁট নিখুঁত হলেও চোখদুটো খানিকটা চাকমাদের মতো বলে অন্যদের চাইতে আলাদা লাগে। মাথা জুড়ে এলোমেলো একহারা চুল। আঁটোসাটো পোশাকে মেয়েলি শরীরের খাঁজগুলো একেবারে স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে। ও মেয়েটাকে দেখছে বুঝতে পেরে নিজের নজর সরিয়ে নিলো দ্রুত। শুভ্রার মন খারাপ বুঝেই কোমল কন্ঠে বললো-“শুনুন, আপনাকে আবারও বলছি আপনার সাথে কোনরকম খারাপ ব্যবহারের কোন ইচ্ছে আমার নেই। যে কারনে আপনাকে তুলে এনেছি সেই প্রয়োজন মিটে গেলে আপনাকে স্বসম্মানে ফিরিয়ে দেব। প্লিজ কোঅপারেট করুন।”
শুভ্রাও নিজেকে সামলে নিয়েছে ততক্ষণে। মুখরা মেয়ের মতো বলে উঠলো-“কতটা ভালো ব্যবহার করবেন সে দেখা হয়ে গেছে আমার।”
রণ কৌফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো-“কালকের ঘটনায় আপনি একশোভাগ দোষী। ইচ্ছে করে প্ররোচিত করেছেন আমাকে। খারাপ ব্যবহারে বাধ্য করেছেন।”
রণর কথায় দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরে শুভ্রা। শরীরে হাজার সুই ফুটলো। ছোট বেলা থেকেই ঝাল খেতে পারে না সে। এইজন্য কত মজার মজার বাঙালি খাবার সে খায় না। ভাইবোনগুলো এ নিয়ে তাকে কত খেপায়। কিন্তু আসলেই সে পারে না ঝাল খেতে। আর এই লোক কিনা তাকে আস্ত এক বাটি মরিচ খাইয়েছে। অপমানে কানটা গরম হয়ে উঠলো তার। পরক্ষণেই দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো। এই ছেলেকে কিছু বুঝতে দেবে না সে। সব মনে রাখবে শুভ্রা, কিছুই ভুলবে না। হিসেব তোলা থাকলো। সময়মতো জবাব দেবে শুধু। গম্ভীর মুখে রণর দিকে তাকিয়ে বললো-“কি করতে হবে আমাকে?”
শুভ্রার মুখ দেখে মনোভাব পড়তে ব্যর্থ হলো রণ। তবে মুখের কথায় সন্তুষ্ট হলো। চেহারার স্বাভাবিক হাসি ফিরে এলো-“এইতো গুড গার্লের মতো কথা বললেন। তাহলে কাজে নেমে পড়ুন। দেখি শর্ত কতটুকু পূরণ করতে পারেন।”
শুভ্রা গম্ভীর হলো-“শুনুন, আমি হোষ্টেলে থেকে বড় হওয়া মেয়ে। প্রয়োজনে সব কাজ করতে পারি।”
“রিয়েলি! আচ্ছা তাহলে প্রথম চ্যালেন্জ দিয়ে দেই আপনাকে। দেখি ফিলআপ করতে পারেন কিনা।”
শুভ্রা সন্দিহান দৃষ্টি নিয়ে চাইলো। রণ মুখটা হাসি হাসি করে বললো-“তিনঘণ্টা সময় আপনার হাতে। পুরো বাড়ি পরিস্কার করতে হবে।”
শুভ্রা একইরকম ভাবে তাকিয়ে থেকে বললো-“বিনিময়ে আমি কি পাবো?”
“একটা প্রশ্নের উত্তর।”
শুভ্রা মাথা নাচালো-“উহু, পোষাবে না। আরও কিছু চাই আমার।”
রণ ভ্রুকুটি হেনে জানতে চাইলো-“আর কি চাই?”
“পেট পুরে খেতে চাই। ভাত খাওয়াতে হবে নিজের হাতে রান্না করে।”
শুভ্রার আবদার শুনে মানা করে না রণ-“ঠিক আছে। আপনাকে ভাত খাওয়াবো। কাজ শুরু করুন।”
শুভ্রা সাবধানে পা ফেলে উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এলো রণর কাছে-“এখন রাত না দিন? বাসায় ঘড়ি নেই সময় বোঝার উপায় নেই।”
রণ গম্ভীর হলো-“সময় জানার দরকার কি আপনার?”
শুভ্রা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চলে গেলো। এই ছেলেটা আচ্ছা ত্যাদর। যেটা বলবে না সেটা নিয়ে প্রশ্ন করাই বৃথা।
★★★
গতকাল মা আর চাচা চলে যাওয়ার পর তুলতুলের আশ্রয় হয়েছে ভেতর বাড়িতে সোহেলের কামরায়। অবাক ব্যাপার হলো সোহেলকে সারারাতে একবারও দেখা যায়নি এ রুমে। তুলতুল অবশ্য অপেক্ষাও করেনি তার জন্য। আসলে অপেক্ষা করার মতো পরিস্থিতি ছিল না ওর। সোহেলের উপর্যুক্ত অত্যাচারে তুলতুলের শরীরের অবস্থা নাজুক। জ্বর আর ব্যাথায় প্রান ওষ্ঠাগত। তাই রাতে সে ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে গেছিল। সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। ঘুম ভেঙেছে কাজের মেয়ের ডাকে।
“আম্মা আপনাকে ডাকে।”
সদ্য ঘুম ভাঙা তুলতুল না বুঝে জানতে চাইলো-“কে আম্মা? কে ডাকে?”
কাজের মেয়েটা কিঞ্চিত বিরক্ত হলো-“আপনার শাশুড়ী ডাকে। তাড়াতাড়ি আসেন। আর বলছে ভালোমতো তৈরি হয়ে আসতে। মেকাপ কইরা আপনের মুখের দাগ ঢাকতে কইছে। বাইরে মেহমান আছে হেরা জানি কিছু না বোঝে। এই যে কাপড় রাইখা গেলাম।”
তুলতুল দেখলো একটা দামী শাড়ী সাথে গহনার বক্স রাখা। তুলতুলের ইচ্ছে হলো সব ছুড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে কানতে। দু’দিন আগেও তার জীবনটা কতটা আনন্দে পূর্ণ ছিলো আর আজ মনে হচ্ছে অভিশপ্ত জীবন তার। কি থেকে কি হয়ে গেলো। সমাজের চোখে তার পরিচয় শুরুতে ধর্ষিতা তারপর এখন একজন ধ/র্ষ/ক আর খুনীর স্ত্রী। ঘৃনায় শরীর রি রি করে ওঠে। নিজের শরীরটাকে ভীষণ অচ্ছুৎ লাগে। কোনভাবে যদি সোহেলের স্পর্শ মুছে দেওয়া যেত। তুলতুলের বুকটা হুহু করে ওঠে। কান্নার দমকে হিঁচকি ওঠে।
পরক্ষনেই কালকে ইব্রাহিম সালিমের বলা কথাগুলো কানে বাজলো। লোকটা সোজাসাপ্টা হুমকি দিয়েছে কালকে-“ভালোয় ভালোয় বিয়ে করে এই বাড়ির ভদ্র বউ হয়ে থাকো। বাপকে আগেই হারাইছো এখন তোমার কারনে তোমার মা ভাই আর চাচার জীবন সংকট হবে। তোমার ভাগ্য ভালো যে তোমার সাথে আমার পোলার বিয়া দিতাছি নাইলে এতোক্ষণে গাঙে ভাসতা।”
ভয়ে তুলতুলের শরীর কাঁপে। দ্রুত বিছানা থেকে নামে। বাথরুম থেকে পরিস্কার হয়ে এসে কাপড় পরে নিলো। গায়ে গহনা চরিয়ে চুলগুলো হাতখোপা করে মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে দিল। বাইরে পা বাড়াবে এমন সময় সোহেল ঘরে ঢুকলো। চোখ দুটো টকটকে লাল। মাথার চুল উসকোখুসকো। ভয়ে তুলতুলের হাত পা কাঁপে, মাথা থেকে কাপড় খসে পড়ে। তুলতুল কয়েক কদম পিছিয়ে গেল। সোহেল তুলতুলকে এক পলক দেখলো। মাথায় আগুন ধরে গেল তার তুলতুলকে দেখে। এই ফকিন্নিকে কিনা বিয়ে করা লাগলো শেষমেষ। যাকে একবার ঘেটে ফেলছে তাকে প্রতিদিন দেখবে চোখের সামনে এটা ভাবলেই তার মুখ বিস্বাদ হয়ে ওঠে। তুলতুলকে তাই মুখ খিচিয়ে গালি দিলো-“ওই মা/গী শোন, বাইরে যাইয়া যদি কিছু উল্টা পাল্টা কিছু কইছোস তাইলে আইজকাই তোর জীবনের শেষ দিন। বুঝছোস?”
তুলতুল কাঁপছে ঠকঠক করে। এরমধ্যেই সে কিছু না বুঝে মাথা দুলালো। সোহেল রণমুর্তি হয়ে এগিয়ে এলো ওর দিক-“কেউ কিছু জিগাইলে কবি তুই খুব ভালা আছোস এইখানে। ঠিক আছে?”
তুলতুল আবারও মাথা দুলালো। ওর মাথা দুলানো দেখেই মনেহয় সোহেলের মেজাজ আরও খারাপ হলো-“মাথা নাড়োছ কেন হুদাই? বা/ড়ি দিয়া মাথা ফা/টা/য় দিমু কইলাম।”
তুলতুল ভয়ে মুর্তি বনে গেল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেখে সোহেলের মেজাজ আরও খারাপ হলো-“আবার খাম্বার মতো খারায় রইছে। যা বাইরে যা।”
তুলতুল কাঁপা হাতে মাথায় ঘোমটা টানে। এগুতে গিয়ে বাঁধা পেল-“এই শোন, মুখে হাসি আন। এমন ম/রা মানুষের মতন মুখ কইরা রাখছোস কেন? হাস, হাসি মুখে যা।”
তুলতুল হাসার চেষ্টা করলে মুখের আদল কান্নার চাইতেও খারাপ দেখালো। সোহেল বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
বড় ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসা হলো তুলতুলকে। রিমা ওকে নিয়ে এলো। কয়েকজন লোক বসে আছে ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন হাতে। ইব্রাহিম সালিমও বসে আছেন ওখানে। তুলতুলকে রিমা নিচু স্বরে কিছু বলতেই তুলতুল সালিম সাহেবকে সালাম দিলো।
“বসো বউমা। এনারা বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিক। যা যা জানতে চায় বলো এনাদের।”
তুলতুল আগা মাথা কিছু না বুঝে মাথা দুলায়। ও বসা মাত্রই একজন প্রশ্ন করলো-“মিসেস তুলি, বিয়েটা কি আপনার ইচ্ছায় হয়েছে নাকি জোর করে তুলে এনে বিয়ে করেছে? আপনারা কি পূর্ব পরিচিত? যে ভিডিও ফুটেজ লিক হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে আপনাকে জোর করে তুলে নেওয়া হচ্ছে। কোনটা সত্যি?”
তুলির হাত পা ঘামতে শুরু করেছে। সে হতবিহ্বল হয়ে একবার রিমা আর একবার সালিম সাহেবের দিকে তাকাচ্ছে। কি বলবে কি বলবে না সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে তার। গরম লাগছে ভীষণ। তুলতুলের মনেহলো তার মাথা দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। ঠিক সেই সময় সোহেলকে দেখা গেলো। ধবধবে সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরে মুখে হাসি নিয়ে সে তুলতুলের পাশে বসলো। ওকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে গদগদ কন্ঠে বললো-“আরে, তুমি চুপ করে আছো কেন বউ? সাংবাদিক ভাইয়েরা যা জানতে চায় তা বলো। বলো কেন আমি তোমাকে তুলে আনলাম। বলো সত্যিটা। তোমার সাথে যে আমার সম্পর্ক আছে আর সেটা তোমার পরিবার মানবে না তা বলে দাও। তোমার আম্মা অন্য জায়গায় তোমার বিয়া দিয়ে দিবে। আমি গুন্ডা মাস্তান তাই আমার সাথে বিয়া দিবে না। তুমিও মায়ের কথা মেনে নিয়ে আরেক জায়গায় বিয়ে করতে রাজি হইছো। এইটা কি প্রেমিক হয়ে আমি মেনে নিতে পারি না নেওয়া উচিত? তাই বাধ্য হয়ে আমাকে এই কাজ করতে হইছে। বলো ঠিক কিনা? বলো বলো।”
তুলি সোহেলের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। একটা মানুষ এতো সুন্দর করে মিথ্যা গল্প সাজাতে পারে সেটা সোহেলকে না দেখলে বিশ্বাস করতো না কিছুতেই। আর এতো নিখুঁত অভিনয় কিভাবে পারে? এরকম নিখুঁত অভিনয় আর মিথ্যে গল্প সাজিয়েই কি এই গুন্ডা আর ওর বাবাটা দিনকে রাত আর রাতকে দিন প্রমান করে? এভাবেই কি সত্যকে অন্ধকার প্রকোস্ঠে পাঠিয়ে মিথ্যেকে প্রজ্জলিত করে?
চলবে—
© Farhana_Yesmin