#দর্পহরন
#পর্ব-৬৩
“আম্মা, আপনে আমার হইয়া প্রচারনা করবেন। নির্বাচনে জিতা ওই মা পোলারে শায়েস্তা করুম। গতবার আপনাকে আটকাইয়া থুইয়া আমারে নির্বাচন করতে দেয় নাই। এইবারও আমারে হারাইতে আপনারে ব্যবহার করতেছে। ডিভোর্স লেটার পাঠাইছে যাতে আমি নির্বাচনে প্রচারনা না করি। আপনে কি চান আম্মা? আমি হাইড়া যাই?
বলেন আম্মা, বাপের জন্য করবেন না এইটুক?”
শুভ্রা গাঁট হয়ে বসে ছিলো। মুহুর্তের জন্য একবার বাপের মুখ দেখলো। সালিম সাহেব থামলেন না-“আমার সোহেলকে ইচ্ছা কইরা গুলি কইরা মারছে। তবুও আপনের কথা ভাইবা চুপ কইরা আছিলাম। কিন্তু সেই আপনেই যদি সুখে না থাকেন তাইলে আমি চুপ থাকুম কেন? গতবার আপনের লাইগা নির্বাচন করি নাই এইবার আপনে আমারে নির্বাচনে জিতাইবেন আম্মা। আমার হারানো গৌরব ফেরত আনবেন।”
শুভ্রা চুপচাপ বসে ছিলো। চমকে বাবাকে দেখে ধীরে সুস্থে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো-“ঠিক আছে আব্বা। আপনে যা চান তাই হবে। তবে আমার শর্ত আছে একটা।”
সালিম অবাক হয়ে বললো-“নিজের বাপকে শর্ত দিতেছেন আম্মা?”
শুভ্রা জবাব দিলো না। সালিম সাহেব শ্বাস ফেলেন-“কি শর্ত?”
শুভ্রা শান্ত ধীরস্থির ভাবে নিজের শর্ত বললো। সালিম সাহেব মাথা নাড়েন-“ভুল করতেছেন আম্মা। এইরকম কাম আমি করবো না কিছুতেই।”
“নিজের মেয়ের জন্য এতোটুকু পারবেন না আব্বা? আর আপনে দাবি করেন আমাকে ভালোবাসেন। আপনে আসলে নিজেরে ছাড়া কাউরে ভালোবাসেন না। আপনের কাছে আপনের মানসম্মানই বড়।”
সালিম সাহেব চুপ করে যান। মেয়ের এই রুপ দেখা হয়নি আগে। তার সহজ সরল মেয়েটা এতোটা পাল্টে গেলো কবে?
*****
সুমনা আর সালিম সাহেবের প্রচারনা যুদ্ধ খুব খারাপ পর্যায়ে চলে গেলো যখন সুমনার কিছু ব্যক্তিগত ছবি মিডিয়ায় তোলপাড় হলো। ইউনিভার্সিটি জীবনের বিশেষ মানুষের সাথে তোলা ছবি নিয়ে সুমনার চরিত্র তুলোধুনো করা হলো। সেই সাথে তার বিবাহিত জীবন প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো। এমন একজন মানুষ যার ব্যক্তিজীবন ঠিক নেই সে কি করে একজন যোগ্য জনপ্রতিনিধি হতে পারে সে প্রশ্ম তোলা হলো সমাবেশগুলোতে।
সালিম সাহেবের উপর পাল্টা আঘাত এলো। শুভ্রার বিদেশ জীবনের কিছু ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেলো। ছেলে বন্ধুদের সাথে বারে নাচানাচি, শর্ট ড্রেস পরে ছবি। সালিম সাহেবের দূর্নিতীর কিছু চিত্র। কিভাবে সোহেল মেয়েদের তুলে নিতো যত্রতত্র তার নানা তথ্য। বলা যায় রনাঙ্গন গরম হয়ে গেলো। তবে যেটা হলো শুভ্রা কান্ডে রণ ভীষণ আপসেট হলো। সে এমনিতেই মানসিক ভাবে লো ছিল৷ তারউপর এসব দেখে ভীষণ রেগে গেলো। সরাসরি সুমনাকে চার্জ করে বসলো-“এসব কি সুমনা আপা? আপনাকে তো ভালো ভেবেছিলাম। নেত্রীর কাছে আপনার নাম আমিই রেকমেন্ড করেছিলাম আর আপনি কিনা আমার ব্যক্তিজীবন নিয়ে টানা হেচরা করছেন?”
সুমনাকে বিচলিত দেখালো-“সত্যি বলছি রণ, আমি এসব করিনি। কিভাবে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।”
রণর মেজাজ চড়া-“কিভাবে বিশ্বাস করি আপা? আপনি না করালে কে করাবে এসব। শুভ্রাকে নিয়ে তো কারো ব্যক্তিগত আগ্রহ থাকার কথা না।”
“রণ, সত্যি বলছি এসব আমি করিনি। আমার কি মনেহয় জানো, সালিম সাহেব নিজেই এসব করছেন। উনি এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চান। এক নির্বাচনে জিততে চান দুই তোমার আর শুভ্রার ডিভোর্স চান। তুমিই বলো, আমি এসব কেন করবো যেখানে তুমি আমাকে সবরকম সাহায্য করলে নির্বাচন করতে। চাইলে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো। তাহলে হয়তো বিশ্বাস হবে।”
রণর মাথা দিপদিপ করছে। সে জানে শুভ্রার অতীত কেমন তবুও কেন যেন এসব মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। আফটারঅল শুভ্রা এখন তার বউহয়। রণর বুকে চিনচিনে ব্যথা হয়৷ এই মেয়েটার জন্য আর কতো ভুগতে হবে কে জানে।
নিজের ছবি আর ভিডিও ফাঁস হওয়ার ঘটনা নিয়ে টিভি মিডিয়ায় একের পর এক তথ্য বিশ্লেষণ চলছে। শুভ্রা মন দিয়ে সেসব দেখে। রণর বক্তব্য চাওয়া হয়েছে অনেকবার। প্রতিবার সে নো কমেন্ট বলে এড়িয়ে গেছে। শুভ্রা সেসবও দেখে চুপচাপ। তাকে যেন আর কিছুই ছুঁয়ে যায় না।
*****
“ভাবি, আপনে ডিভোর্স পেপারে সাইন কইরেন না।”
শুভ্রা চমকে তাকায়। দেখলো সামনে ফাহিম দাঁড়িয়ে। ফাহিম আড়চোখে আসপাশ তাকিয়ে দেখলো। শুভ্রা ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে আছে-“কি বলছেন বুঝতে পারছি না। আপনি ভাবির ভাই না?”
ফাহিম মাথা দুলায়-“আপনে ডিভোর্স পেপারে সাইন দিয়েন না। ভাই খুব কষ্ট পাবে।”
শুভ্রার মেজাজ খারাপ হলো। নিজে না পেরে চামচা পাঠিয়েছে রণ। সে রুঢ় ভাষায় বললো-
“সেটা আপনার ভাই এসে বলছে না কেন?”
ফাহিম ফিসফিস করলো-“বলার অবস্থা নাই। তাছাড়া ডিভোর্স পেপার তো সে পাঠায় নাই। তাকে ভুল বুঝে আপনি কাগজে সাইন দিয়েন না।”
“তাহলে কে পাঠিয়েছে?”
শুভ্রার বিস্মিত নজর। ফাহিম আরও একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে ফিসফিস করলো-“এইসব আপনাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। আপনাদের ডিভোর্স নিয়ে বেশ বড় ডিল হইছে।”
“কি বলছেন এসব? মাথা ঠিক আছে আপনার? কিসের ডিল কার সাথে ডিল?”
ফাহিম মাথা নাড়ে, কিছু বলবে তার আগেই তুহিন এলো। সন্দিহান নজরে তাকিয়ে রইলো ফাহিমের দিকে-“তুমি এইখানে কি করো?”
ফাহিম শুকনো ঠোঁট চেটে নিলো জিভ দিয়ে-“বোনটাকে একটু দেখতে আসছিলাম। মা খাবার রান্না করে পাঠাইছে।”
তুহিনের চোখ থেকে সন্দেহ গেলোনা। তবে কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে বললো-“খাবার রেখে যাও। বউমা তো শরীফের সাথে ডাক্তারের কাছে গেছে।”
“আচ্ছা।”
ফাহিম স্বাভাবিক ভাবেই ফিরে গেলো। ওর যেটা কাজ ছিলো সেটা করা হয়েছে বলে খানিকটা সন্তুষ্ট দেখালো ওকে। বোনকে নিয়ে তার অতোটা ভাবনা নেই। কেন যেন শরীফকে ভরসা করছে মন। শরীফ মোটেও সোহেলের মতো নয়। সে ঠিক সামলে নেবে তুলতুলকে। তার চিন্তা সালিম সাহেবকে নিয়ে। এই লোকটাকে কিছুতেই পুনরায় ক্ষমতায় আসতে দেবে না সে।
*****
“চাচা, দিলশাদকে চিনছেন?”
“কার কথা কছ? ওই ওসি?”
সালিম সাহেব তুহিনকে দেখলো। তুহিন মাথা দুলিয়ে বললো-“সোহেলরে গুলি করছিল।”
সালিম সাহেবের চোয়াল শক্ত হলো। তুহিন বুঝেই বললো-“আপনের জামাই এর সহচর। ওর মা টা পাগল। শিকলে বাইন্ধা রাখতে হয়।”
“বাপ কেডা?”
“চিনি না।”
“হুমমম। তুই হঠাৎ ওরে নিয়া পড়লি কেন? হইছেটা কি?”
“কালকা সতন্ত্র দলের সাথে গন্ডগোল হইছে আমাগো পোলাগো। ওসির নির্দেশে আমাগো পাঁচ ছয়জনকে তুইলা নিছে পুলিশ। আপনের পোস্টার ছিড়া ফালাইছে। কয়, আচরণবিধি লংঘন হইছে।
সুমনার হইয়া কাজ করতাছে সরাসরি।”
“কস কি? ওসির সাহস তো ভালোই।”
তুহিন একটু মাথা চুলকায়-“আপনের মনে নাই মনেহয়, ওয় সোহেলরে গ্রেফতার করছিল ছাড়তে চায় নাই। লাগে নিজের ব্যক্তিগত আক্রোশ দেখায়।”
সালিম সাহেবকে চিন্তিত দেখায়। তুহিন গলার স্বর আরও একটু নিচু করলো-“আমাগো ব্যবসায় কড়া নজর রাখছে। কোন বেতাল পাইলেই ধইরা ফালায়। বেচাবিক্রি মেলা কম।”
“আইজকা রাতে দেখা করতে যামু ওসির লগে ওর বাসায়। ব্যবস্থা কর।”
“আরেকটা কথা চাচা। ফাহিমকে শুভ্রার লগে কথা কইতে দেখছি। কেন জানি মনে হইলো, ফাহিম ওরে গোপনে কিছু কইছে।”
চমকে তুহিনকে দেখলো-“তুই কইতে চাস ফাহিম আমার হইয়া কাজ করতেছে এইটা আইওয়াশ?”
“শিওর না। তবে হইতে পারে। ও হঠাৎ কইরা আপনের লাইগা কাজ করতে চাইছে এইটা তো স্বাভাবিক না।”
সালিম সাহেব হাসলেন। উঠে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পর্দা সরিয়ে বাইরেটা দেখলেন। আনমনা হয়ে বিরবির করলো-“সবাই দেখি আমার লগে খেলা শুরু করছে? আচ্ছা, ক দেখি তুহিন আমি কেমন আছিলাম? সবাই কি ভুইলা গেছে আমি কি করতে পারি? মনে হইতেছে অতীতের সালিমকে ফিরায় আনা লাগবে। এই নির্বাচনে জয়ের লাইগা দরকার হইলে তাই করুম।”
তুহিন সালিম সাহেবকে দেখলো ভয়ে ভয়ে। আবছা আলোয় তাকে দেখে তুহিনের ভয় লাগে।
*****
আজ বাড়ি ফিরতে একটু বেশি রাত হয়ে গেলো দিলশাদের। নির্বাচনের চক্করে ব্যস্ততা বেড়েছে। নির্বাচন না হওয়া অবধি এই ব্যস্ততা থাকবে। এমনিতেই ডিউটি দিতে তার কোন সমস্যা নেই কিন্তু মায়ের জন্য চিন্তা হয়। সে খাবার না দিলে মায়ের খাওয়া হয় না। দুপুরে আজ খাবার খাইয়ে দিয়ে গেছিল। এখন রাত সাড়ে বারোটা। নিশ্চয়ই মানুষটা খিদের জ্বালায় ছটফট করছে? অস্থির হয়ে গাড়ি থেকে নামে দিলশাদ। কলিংবেল বাজাতে গিয়ে টের পেলো দরজা ভেজানো। ভ্রু কুঁচকে গেলো তার। কাজের খালাটা কি নেই? দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই গো গো আওয়াজটা কানে এলো। এরকম আওয়াজ তো মা ভয় পেলে বা বাথরুম এলে করে। দিলশাদ ছুটে মায়ের ঘরে আসতেই ওর পা জোড়া থমকে গেলো। ঘরের মধ্যে দু’জন মানুষকে দেখে। ওর মায়ের মুখটা যন্ত্রণায় কালচে হয়ে আছে। সামনের মানুষটা কুৎসিত হাসি দিচ্ছে। মাথার বাঁকা রগটা চিনচিন করে উঠলো। দিলশান চেচিয়ে উঠলো-“আপনি! আমার বাসায়? ঢুকলেন কি করে?”
চমকে দিলশাদের দিকে ফিরলো সালিম। মুখের কুৎসিত হাসি ফিরে এলো-“আরে! আইসা পড়ছো? তোমারে খুব চেনা চেনা লাগতেছিল কিন্তু কই দেখছি মনে করতে পারতেছিলাম না। তাই ভাবলাম তোমার পরিবারকে দেইখা যদি কিছু মনে আসে। এখন তোমার মাকে দেইখা মনে পড়লো। চুকচুক, তোমার মাকে দেইখা খুব কষ্ট পাইলাম। কবে হইছে এমন কও তো? তোমার বাপ ভাই মরার পর? খুবই দুঃখজনক ঘটনা। তোমার জীবন তো বহুত কষ্ট কাটছে দেখা যায়।”
দিলশাদ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। রাগে দিগবিদিক শুন্য লাগছে তার। সে দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“আমার মায়ের কাছ থেকে উঠে আসেন। কি চান আপনে? কেন আসছেন? আর বিনা অনুমতিতে একজন পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় ঢোকা গর্হিত অপরাধ।”
সালিম শয়তানের মতো হো হো করে হাসতে লাগলো। তার উচ্চ কন্ঠের হাসি শুনে দিলশাদের মা কেঁপে উঠলো। কো কো করে কাঁদতে লাগলো। দিলশাদের খুব মন চাইলো সালিম সাহেবের কপাল বরাবর গুলি করে মাথা ফাটিয়ে দিতে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালো। সালিম সাহেব বললো-“আমার এলাকায় আমিই আইন এইটা তুমি ভালো মতোই জানো ওসি। শুধু তুমি না তোমার পাগল মাও জানে। দেখো কেমনে কাঁপতেছে। আমাকে দেইখা মুইতা দিছে তোমার মা৷ দেওয়ারই কথা, আমি মানুষটাই এমন ভয়ংকর।”
দিলশাদের হাত পা কাঁপে, শরীর থরথর করে। কথা বলতে চাইলেও পারলো না অতি রাগে। সালিম উঠে এসে দিলশাদের সামনে দাঁড়ায়। তার মুখ থেকে হাসি মুছে গেছে। হিংস্র মুখটায় নিষ্ঠুরতার চিন্হ স্পষ্ট-“তোর ভাইটা বাড়াবাড়ি করছিল তার ফল সে পাইছিল। তোর বাপ মা বাড়াবাড়ি করছিল। অনেকবার ভদ্র ভাষায় মানা করার পরও শোনে নাই। বাধ্য হইয়া তোর মাকে সমাজের সামনে নেংটা করছিলাম। সেই অপমানে তোর বাপ মরছে। সব মনে আছে না তোর? তুই জানোস আমি কি করতে পারি। তুই কি ভাবছেস, আমারে শেষ করবি? এই সালিমরে শেষ করবি? আমার পোলার বুকে গুলি চালাইছোস না তুই? তোর দিন গুনতে থাক। যেদিন আমার মন চাইবো সেই দিন এই দুনিয়ায় তোর শেষ দিন হইবো। তারপর তোরে হারায়া তোর পাগল মা নেংটা হইয়া রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো। হাহাহা।”
★প্রিয় পাঠক, বইমেলা শেষ। তবুও বই সংগ্রহ চলবে। আমার নতুন বইসহ তিনটে বই ঘরে বসে অর্ডার করতে পারবেন রকমারিসহ আপনার পছন্দের বুকশপে। আমার লেখা ছয়টি ই-বুক পড়তে পারবেন বইটই থেকে। বই পড়ুন বইয়ের কথা ছড়িয়ে দিন।★
চলবে—
©Farhana_Yesmin