#দর্পহরন
#পর্ব-৬৫
“আব্বা, বসেন আমার কাছে। কোথাও যাবেন না আপনি।”
শুভ্রার আবদারে সালিম সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন-“আপনে ইচ্ছা কইরা নাটক করছেন আম্মাজান?”
“হ্যা, কারণ আমি চাই না আপনে আর একটাও অন্যায় করেন।”
“কিসের অন্যায়ের কথা কইতেছেন আম্মাজান?”
“যে মেয়েটা ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপনার ছেলের সন্তান তার পেটে ধরছে আপনে তার ভাইকে মাইরা ফেলতে চান? কেন আব্বা? এতো নিষ্ঠুরতা কেমনে করতে পারেন?”
সালিম চমকে উঠলো-“এইগুলা কি কন আম্মাজান?”
শুভ্রা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাঙা গলায় বললো-“আপনের বিরুদ্ধে কত অভিযোগ শুনছি, পত্র পত্রিকায় কতো লেখা পড়ছি আব্বা তাও বিশ্বাস হয় নাই। গতকালই আপনারে আর তুহিন ভাইকে কথা কইতে শুইনা ফেলছিলাম। কথাগুলা বিশ্বাস করতে মনচায় না কিন্তু নিজের কানকে অবিশ্বাস করি কেমনে? আমার আব্বা এমন খারাপ মানুষ কেমনে বিশ্বাস করি আব্বা?”
“আম্মাজান, থামেন।”
“কেন থামবো আব্বা? ফাহিমকে কেন মারবেন? ও আপনার জন্য কাজ করে না তাই নাকি আপনার জামাই এর হয়ে কাজ করে তাই? নিজের স্বার্থের জন্য মেয়ের সুখের পথে কাটা হইতেও বাঁধবে না আব্বা?”
শুভ্রার কাটা কাটা কথায় সালিম সাহেবের মেজাজ চড়েছিল। সে হুঙ্কার দিলো-“না বাঁধে না। আপনে কইছিলেন প্রতিশোধ নিতে বিয়া করতেছেন। এখন জামাই জামাই কইরা মরতেছেন। এইদিকে বাপের ইজ্জত নিলামে উঠতেছে তার কোন পরোয়া নাই আপনের। এই আপনের বাপের প্রতি ভালোবাসা?”
শুভ্রা বিস্ময়ে মুক হয়ে গেলো। বাবার এমন রুপ আগে দেখেনি সে। সালিম সাহেবের মেজাজ চড়েছে। সেই চড়া মেজাজ নিয়ে সে বলে উঠলো-“আপনার কথা ভাইবা শত্রুর পোলার লগে আত্মীয়তা করতে রাজি হইছিলাম। আপনার কারণে আমার পোলা মরছে। আপনে আমাগো না জানায়ে দেশে না আসলে এই যে এতোকিছু হইছে এইসবের কিছুই হইতো না। আমি এতোদিনে মন্ত্রী থাকতাম। আপনে দায়ী সবকিছুর জন্য আপনে দায়ী। আপনার কারনে আমি আমার পোলা হারাইছি।”
সালিম সাহেব উঠে দাঁড়ান-“ওই ফকিরের বাচ্চাকে মারবো আমি। বহুত ভদ্রতা দেখাইছি আর না।”
শুভ্রা কিছু না ভেবে পথ রোধ করে দাঁড়ায়-“না আব্বা, এই পাপ আপনাকে করতে দেব না আমি। কোনমতেই না। আপনার পাপের কারনে আমি সাজা পাইছি আর কেউ এই সাজা না পাক আব্বা।”
“পথ ছাড়েন আম্মাজান। আমার কাজে বাঁধা দিয়েন না।”
সালিম সাহেবের হুঙ্কার শুনেও শুভ্রা অটল হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে-“কিছুতেই না আব্বা। আজকে যদি আপনে চলে যান তাহলে আপনার মেয়ের লাশের উপর দিয়ে যাইতে হবে।”
সালিম সাহেব থেমে যান। হেসে দিলেন শুভ্রার আচরণ দেখে-“আপনে চান আমি না যাই? ফাহিম বাঁইচা থাক?”
শুভ্রা মাথা দুলায়। সালিম সাহেব গম্ভীর হয়ে বললো-“তাইলে ডিভোর্স পেপারে সাইন কইরা দেন। বেশি কিছু চায় না আপনের আব্বা।”
“আব্বা!” শুভ্রা আর্তনাদ করে উঠলো।
“বলেন দিবেন কিনা? নাইলে আইজ অথবা কাইল ফাহিমকে মরতেই হইবো।”
শুভ্রা নিরব হয়ে গেলো। বুকের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে। তার বাবা এমন শর্ত আরোপ করতে পারে ভাবেনি কোনদিন। শুভ্রা কাতর গলায় বললো-“কেমন শর্ত দিতেছেন আব্বা? আপনার মেয়ের জীবনের খুশি কাইড়া নিতে চান? কেমন বাপ আপনে?”
“আমি কেমন বাপ তা আপনে জানেন আম্মা। এখন কথা বাড়ায়া লাভ নাই। আপনে যা কিছু করেন না কেন লাভ নাই। হয় ডিভোর্স পেপারে সাইন করেন নয়তো পথ ছাড়েন। আপনে মহান সাজতে চান তো সাজেন। কিন্তু মহান সাজা খুব কঠিন আম্মাজান। এর জন্য অনেক মুল্য চুকাইতে হয়।”
“আব্বা এমন কইরেন না। জেদ কইরা বিয়া করলেও মানুষট ভালো আব্বা। সে তার ভালোবাসা আর ভদ্র ব্যবহার দিয়ে আমাকে পাল্টায়া দিছে। এমন কইরেন না। আমাকে কষ্ট দিয়েন না।”
শুভ্রা কাতর গলায় আকুতি জানায়। ওর চোখ দিয়ে জল গড়াতে শুরু করেছে এরইমধ্যে। সালিম সাহেব জবাব না দিয়ে ডিভোর্স পেপার খুঁজে সামনে মেলে ধরেন-“সাইন করেন নয়তো পথ ছাড়েন। আমি খুব কঠিন মানুষ আম্মাজান। আমাকে এখনো আপনি চেনেন নাই পুরাপুরি।”
শুভ্রাকে হতবিহ্বল দেখায়। কতদিন ধরে এই কাগজটাকে এড়িয়ে যাচ্ছে সে। অথচ আজ আর এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তুলতুলের সেদিনের বলা কথাগুলো কানে বেজে উঠলো। এই মেয়েটাকে আরও একবার কষ্ট দেওয়ার চিন্তা করাও পাপ হবে। এই পাপ করা তার পক্ষে সম্ভব না।
তুলতুলের মুখটা ভেবে শুভ্রা কাগজ টেনে নিলো। শেষবারের মতো আশায় তাকালো বাবার দিকে-“ভুল করতেছেন আব্বা।”
“আমি ঠিক করতেছি না ভুল তা তাড়াতাড়ি জানবেন আম্মা। সাইন করেন।”
শুভ্রা অশ্রুসিক্ত নয়নে কলম ধরে। কাগজে কলম চেপে ধরতেই বুকটা হুহু করে উঠলো তার।
*****
তুলতুল ভয়ে কাঁপছিল থরথর করে। সোহেল মা*রা যাওয়ার পর ভয়ের জীবন থেকে খানিকটা মুক্তি পেয়েছিল সে। বাচ্চার উসিলায় খানিকটা ভালো জীবন পেয়েছে। আজ হুট করে সব মিছে মনেহচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে টের পাওয়া সত্যিটা তাকে ভীষণ অস্থিরতায় পোড়াচ্ছে। বারবার মা আর ভাইয়ের চেহারা ভাসছে চোখের সামনে। হুট করে তার অসুস্থ লাগতে লাগলো। সে বিছানায় শুয়ে হাসফাস করছে। মালা কয়েকবার করে জানতে চাইলো কিন্তু তুলতুল জবাব দিলো না। কিছুক্ষণ পরে উঠে বসে বমি করে ঘর ভাসিয়ে ফেললো তুলতুল। মালা আতঙ্কিত হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে শরীফকে ডাকতে গেলো-“ভাইজান, ভাবি জানি কেমন করে?”
শরীফ ছুটে এসে দেখে তুলতুলের এই অবস্থা। আতঙ্কিত হয়ে সে তুলতুলকে ধরে-“কি হয়েছে তুলতুল? খারাপ লাগছে?”
তুলতুল বিরবির করলো-“আমার ভাইটাকে ডাকেন তাড়াতাড়ি। ওর কিছু হইলে মা বাঁচবে না। আপনি আমার ভাইটাকে বাঁচান। আপনার পায়ে পড়ি। কথা দিতেছি বাচ্চাটা হইলেই আমি আপনাকে বিয়ে করলো, বাচ্চাটাকেও ভালো বাসবো। সত্যি বলতেছি। আমি শুধু আমার ভাইটাকে বাঁচান।”
শরীফ হতভম্ব হয়ে গেলো-“কি বলো এইসব আবোলতাবোল। হইছেটা কি? শরীর বেশি খারাপ লাগে? দাঁড়াও ডাক্তার ডাকতেছি।”
তুলতুল শরীফের হাত আঁকড়ে ধরলো-“আমার ভাইটাকে ডাকেন। ওকে দেখতে চাই আমি। প্লিজ।”
শরীফ মালাকে বললো-“মাকে ডাক। আর ফাহিম আছে কিনা দেখ। তুহিন ভাইকে এম্বুলেন্স ডাকতে বল।”
মালা ছুটে বেড়িয়ে এলো। মুহূর্তেই সালিম নিবাসে হুড়োহুড়ি পড়ে গেলো। তুলতুল জ্ঞান হারিয়ে ফেললো তখনই। এম্বুলেন্সে যেতে যেতে তুলতুল আঁধবোজা চোখে দেখলো ফাহিম ওর হাত জড়িয়ে ধরে আছে। তুলতুল চোখ দুটো মেলতেই ফাহিম হাউমাউ করলো-“তুলতুল, বোন আমার। আমি এই যে এখানে। তোর কাছে বসে আছি। কিছু ভাবিস না তুই। তুই সুস্থ হয়ে যাবি।”
তুলতুল শুনলো আবারও চোখ বুঁজলো। বিরবির করে কিছু বললো। ফাহিম কান লাগিয়ে কথা শুনতে চাইলো। তুলতুলে বারবার একই কথা বিরবির করছে-“আমার মা বাঁচবে না। মাকে বাঁচাও।”
*****
সালিম সাহেব বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছেন। নিজের অফিস ঘরে বসে আছেন তিনি। সামনে শুভ্রার সাইন করা কাগজ। পা দোলাতে দোলাতে মোবাইল হাতে নিয়ে হাসলো। একটু বুদ্ধি করে না চললে মুসকিল আসলে। এই যে যখন মনেহচ্ছিল তার নির্বাচনে জেতার সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে তখনই আচমকা এই পথটা সামনে এলো। এখন নিজের কাজে নিজেরই ভীষণ গর্ব অনুভব হচ্ছে। সালিম সাহেব পা দোলাতে দোলাতে ফোন করলেন। কয়েকবার রিং হতেই ওপাশের মানুষটার কথা শোনা গেলো-“কাজ হয়ে গেছে?”
সালিম হাসলো-“আপনি যা চাইছেন করলাম। এইবার আপনের কথা রাখার পালা। আমার পদ পাক্কা তো?”
“অবশ্যই। কথার নড়চড় হবে না সালিম। তবে তোমাকেও কথা দিতে হবে, রণর পিছু লাগা বন্ধ করবে তুমি। ঠিক আছে?”
“লাগবো না।”
“আর নির্বাচনে উল্টো পাল্টা কিছু করো না।”
“করবো না।”
“তাহলে আর কি। এখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও। বাকীসব কাজ হয়ে যাবে। আর হ্যা, কাল মনে করে কাগজটা পাঠিয়ে দিয় বাকী কাজ শেষ করার জন্য।”
ওপাশের জন ফোন নামিয়ে রেখেছে। সালিম সাহেব তৃপ্তির হাসি হাসেন। অবশেষে নির্বাচনটা তার হতে যাচ্ছে। নির্বাচনে জিতে প্রথম কাজ হবে ওই দিলশাদকে শেষ করা। শত্রুকে বাঁচিয়ে রাখতে নেই। নয়তো সুযোগ মতে ফনা তুলে ফেলে৷ সালিম সাহেব খ্যাকখ্যাক করে হাসেন। অবশেষে জীবনটা আগের মতো হতে যাচ্ছে দেখে মনটা তুষ্ট। রণ, সুমনা, নেত্র্রীসহ এক ঢিলে কতগুলো পাখিকে শায়েস্তা করা যাবে তা ভেবেই মনটা বাকবাকম করতে চাইছে তার।
★প্রিয় পাঠক, বইমেলা শেষ। তবুও বই সংগ্রহ চলবে। আমার নতুন বইসহ তিনটে বই ঘরে বসে অর্ডার করতে পারবেন রকমারিসহ আপনার পছন্দের বুকশপে। আমার লেখা ছয়টি ই-বুক পড়তে পারবেন বইটই থেকে। বই পড়ুন বইয়ের কথা ছড়িয়ে দিন।★
চলবে—
©Farhana_Yesmin