দর্পহরন #পর্ব-৬৭

0
279

#দর্পহরন
#পর্ব-৬৭

মন খারাপ করে জানালার কাছে বসে ছিলো শুভ্রা। তখনই তন্ময়ের গাড়ি ঢুকতে দেখলো। কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে ছিলো শুভ্রা। গাড়িটা না থেমে ভেতর বাড়ির দিকে চলে গেলো। শুভ্রার হুট করে কি মনে হলো সে উঠে দাঁড়ায়। দ্রুত পায়ে ছাদে উঠে এলো। গাড়িটা রঙমহলের সামনে থেমেছে। ভেতরের ওই বাড়িটায় কখনো যাওয়া হয় নি শুভ্রার। ওটা বাবার চ্যালাদের আস্তানা বলে ওখানে বাড়ির মেয়েদের যাওয়া নিষেধ ছিল। তন্ময়ের ওখানে কি কাজ? শুভ্রা সরু চোখে তাকিয়ে থেকে দেখলো তন্ময় নেমে এসে পছনের দরজা খুললো। একটা মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে ভেতরের দিকে গেলো। দূরত্ব বলে মেয়েটার চেহারা পরিস্কার দেখতে না পেলেও শুভ্রার মনটা কেঁপে উঠলো অজানা আশঙ্কায়। তন্ময় কাকে তুলে এনেছে? খুশিকে নয়তো? না তা কি করে হয়? রণ নিশ্চয়ই খুশিদের সিকিউরিটিতে কোন ছাড় দেয়নি? খুশি না হলে কে? মনের মধ্যে আশা প্রশ্নগুলো শুভ্রাকে চঞ্চল করে তুললো। শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের একটা স্রোত নেমে যাচ্ছে। এরইমধ্যে তন্ময়কে বেড়িয়ে আসতে দেখলো। তন্ময় আশেপাশে তাকালো চোরা চোখে। শুভ্রা লুকিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর উঁকি দিয়ে তন্ময়কে দেখতে পেলো না কোথাও।

দ্রুত ছাঁদ থেকে নেমে এলো শুভ্রা। নিজের কামরায় বসে ছটফট করছে কি করবে। কোন মেয়েকে তুলে এনেছে সেটা দেখতে হবে তাকে। কিন্তু কার সাহায্য নেবে? হাসপাতাল থেকে ছুটি হয়নি তুলতুলের তাই বাড়ির সকলে তুলতুল আর বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত। কাকে বলবে কাকে বলবে না বুঝতে পারছে না শুভ্রা। আবার চুপচাপ বসেও থাকতে পারছে না। মনটা অশান্ত হয়ে আছে। শরীফ থাকলে তাকে বলা যেত কিন্তু সে তুলতুলকে নিয়ে ব্যাস্ত। শুভ্রা ছটফট করতে করতে বসার ঘরে এলো। একবার বাইরে উঁকি দিলো। আজ বাড়ি একটু বেশি নিরব। কাজের লোকগুলো কাজ করছে নিঃশব্দে। বাবা চাচা মিলে কোথাও প্রচারনায় গেছে। চাচী আর মা হয়তো হাসপাতালে। ছোট চাচা ঢাকায়। বাড়ীটাকে আজ মৃত্যু পুরী লাগছে। শুভ্রা কি একবার দেখে আসবে? তন্ময় কোথাও আছে এখন? মেয়েটার সাথে কিছু করছে নাতো? ভয়ে শিউরে উঠলো শুভ্রা। সে তন্ময়ের খোঁজে বেরুল।

*****

ইউনিভার্সিটি থেকে গায়েব হয়েছে খুশি। এই খবর পেতে পেতে বেলা গড়িয়ে গেছে রণর। ততক্ষণে সিকিউরিটির লোকজন পুরো ইউনিভার্সিটিতে খুশিকে খুঁজেছে। চব্বিশ ঘণ্টার আগে নিখোঁজ এর মামলা করা যায় না। রণ এতো কিছুর ধার দিয়ে গেলো না। সে সরাসরি অপহরণের মামলা করলো। প্রধান আসামি করা হলো তন্ময়কে। তাৎক্ষণিকভাবে ইব্রাহিম নিবাসে অপারেশন চালানোর অর্ডার দিলো। অপারেশন এর দায়িত্ব দিলশাদের উপর।

এরপরের ঘটনা অতিদ্রুত ঘটলো। দিলশাদ ফোর্স নিয়ে ইব্রাহিম নিবাসে এলো। কিন্তু প্রবেশ করতে পারলোনা কিছুতেই। গেট খোলা হচ্ছে না। কারণ এ বাড়িতে পুলিশ ঢোকার অনুমতি নেই। হাজারো বাকবিতন্ডার পরর দরজা খুলে দিতে রাজি না হওয়ায় গেটম্যানের হাতে গুলি ছুড়লো দিলশাদ। বলে দিলো সরকারি কাজে বাঁধা দিলে জানে মেরে ফেলবে। ভয়ে বাকীরা গেট থেকে সরে গেলো। একে একে সবাই ইব্রাহিম নিবাসে প্রবেশ করে। পুলিশ ইব্রাহিম নিবাসের প্রধান ভবন তল্লাশি শুরু করে। তন্নতন্ন করে প্রতিটা কামড়া চেক করছে। শুভ্রা বেরিয়ে এসেছে। ও পুলিশ দেখে অবাক হলো। দিলশাদ শুভ্রাকে দেখে সালাম ঠুকলো। শুভ্রা পুলিশী তল্লাশীর কারন জানতে চাইলো। এরইমধ্যে খবর পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন সালিম আর মোর্শেদ। দিলশাদকে দেখেই তেড়ে মারতে এলেন সালিম সাহেব-“কোন সাহসে আমার বাড়িতে ঢুকছোস তুই?”
দিলশাদ হাসলো-“সাহস তো এই পোশাকের। তাছাড়া আদালত থেকে অনুমতি নিয়েই ঢুকছি। দেখি কি কি খাজানা লুকায় রাখছেন বাড়িতে যে এতো লুকোচুরি।”
দিলশাদের উত্তরে সালিমের প্রচন্ত হুঙ্কার শোনা গেলো-“তোরে ওইদিন ছাইড়া দিয়া ভুল করছি। তয় আইজকা ছাড়ুম না। এক্ষন বাইর হ বাড়ি থিকা নাইলে খারাপ হইবো।”
“বের তো হবোই তবে কাজ শেষ হোক আগে। এখন বলুন আপনাদের সুযোগ্য পুত্র তন্ময় কোথায়? কোথায় রেখেছে মন্ত্রী স্যারের বোনকে। যত তাড়াতাড়ি বলবেন তত তাড়াতাড়ি বাঁচবেন। যদি স্যারের বোনের কিছু হয় তাহলে আজ এই ইব্রাহিম নিবাস ধ্বংসস্তুপে পরিনত হবে।”
দিলশাদের ঠান্ডা স্বরে বলা কথাগুলো শুনে মোর্শেদ চমকে উঠলো-“অফিসার আমার ছেলে তো বাসাতেই আছে। তোমার হয়তো বুঝতে ভুল হইছে। তার দ্বারা এমন কিছু করা সম্ভব না।”
দিলশাদ হাসলো-“ডাকেন আপনের ছেলেকে।”
সালিম গজগজ করলো-“তন্ময় বাসায় থাকলে তোর খবর আছে আইজ।”
মোর্শেদ তুহিনকে ইশারায় তন্ময়কে ডেকে আনতে বলে। কিছুক্ষণ পরেই তন্ময় এলো হেলতে দুলতে। পুলিশ দেখে মনে মনে ভরকে গেলেও মুখটা স্বাভাবিক রাখলো। হাই তুলে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো-“আব্বা ডাকছিলেন আমাকে?”
“হহহ। তুই আছিলি কই? পুলিশ আইছে টের পাস নাই?”
“ঘুমায় আছিলাম আব্বা কেমনে টের পাবো?”
তন্ময় আবারও হাই তুললো। সালিম দিলশাদের দিকে তাকিয়ে বললো-“দেখছোস। ওয় বাসাতেই আছিল। কি করবি এখন?”
দিলশাদের অবিচল থেকে বললো-“পুরো বাড়ি তল্লাশি করবো। এই তোমরা যা করছিলে করো। আর খুঁজে দেখো স্যারের বোন আছে কিনা। কোন ঘর যেন বাদ না পড়ে।”
“এই কেউ ঘরে যাবি না কইলাম।”
সালিম সাহেব আঙুল তুলে শাসালেন। তন্ময় অবাক হওয়ার ভান করে বললো-“কাকে খুঁজতেছেন আপনারা? কি হইছে?”
দিলশাদ জবাব দিলো-“কি হইছে একটু পরেই টের পাবা।”
তন্ময় নরম কন্ঠে বললো-“অফিসার, কি বলছেন বুঝতে পারছি না। আমাদের মতো গন্যমান্য মানুষের মান সন্মান নিয়ে এরকম তামাশা করা কি উচিত হচ্ছে?”
দিলশাদ মোলায়েম হাসি ফেরত দিলো-“তামাশা করা কাকে বলে তা আপনার কাছ থেকে শিখতে হবে না স্যার। একটু পরেই টের পাবেন কে তামাশা করছে।”
তন্ময় রেগে গেলো-“আপনি কিন্তু অপমান করছেন আমাদের।”
“ডাকাতদের আবার মান আছে?”
তন্ময় কিছু বলতে যাচ্ছিল তখন দুইজন হাবিলদার আর সাব ইন্সপেক্টর ফিরে এলো-“পেলাম না স্যার। কোনদিকেই খোঁজ পেলাম না।”
দিলশাদের কপালে ভাঁজ পড়লো। যতটুকু শুনেছে তন্ময় আজ একা আসেনি এ বাড়িতে। তাহলে গেলো কোথায় মেয়েটা? অন্য কোথাও রেখেছে?
দিলশাদের ভাবনার মাঝের সালিম তেড়ে এলো-“তোর মন্ত্রী বাপরে যাইয়া ক তার বোন এইখানে নাই। আমাগো রুচি এতো খারাপ হয় নাই যে তার বোনের লাইগা পাগল হইবো আমাগো পোলা। কার না কার লগে ভাইগা গেছে এখন আমাগো নাম দিতেছে। যা ভাগ এখন। তোর এই কাজের সাজা তো তোকে দিবই। নির্বাচনটা পাড় হইতে দে তারপর তোরে দেখতেছি।”
দিলশাদ দাঁতে দাঁত চাপে। বাইরে বেরুতে যাবে তখন হুট করে পেছন থেকে শুভ্রা ডাকলো-“ওসি সাহেব, দাঁড়ান।”
ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা সকলেই বিস্মিত। সালিম সাহেব অবাক হয়ে মেয়েকে দেখলো-“আম্মাজান, কি হইছে?”
শুভ্রা বাবার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এগিয়ে এলো দিলশাদের দিকে-“ওপাশে আমাদের আরেকটা বিল্ডিং আছে। প্লিজ ওদিকটায় একটু দেখুন। আপনারা যার খোঁজ করছেন তার খোঁজ পেয়ে যাবেন হয়তো।”
দিলশাদের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। সে সাব ইন্সপেক্টর আর হাবিলদারদের ইশারায় সেদিকে যেতে বললো। মোর্শেদ বিস্ময় নিয়ে তন্ময়কে দেখলো। তন্ময় মাথা নামিয়ে নিল। সালিম সাহেব এগিয়ে এসে মেয়ের গালে চড় কষালেন-“আম্মাজান, আপনারে কে কথা কইতে কইছে? জানেন না এই বাড়ির মাইয়ারা বাইরের কোন ব্যাপারে কথা কয় না?”
শুভ্রা অবাক হলো না। সে কেবল গালে হাত দিয়ে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। দিলশাদ এগিয়ে এলো-“বিবাহিত মেয়ের গায়ে হাত তোলা গর্হীত অপরাধ।”
সালিম ঝট করে দিলশাদের গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছিল। দিলশাদ হাত ধরে ফেলে ঝাটকা দিলো-“নেভার ডেয়ার সামথিং লাইক দ্যাট। একবার ভুল হয়েছে বলে বারবার মাফ পাবেন না।”
“স্যার, তাড়াতাড়ি আসেন।”
দিলশাদ দৌড়ে গেলো। তন্ময় কটমট করে তাকিয়ে আছে শুভ্রার দিকে-“কাজটা ভালো করলি না শুভ্রা।”
শুভ্রা অসহায় চোখে হাসলো-“তোমাকে বাঁচিয়ে দিলাম।
“পূন্য করছোস। পূন্যের পুরস্কার পাবি।”

“এবার কি বলবেন আপনি মিস্টার সালিম ইব্রাহিম?”
জ্ঞানহীন খুশিকে দেখে মনচোখ কুঁচকে গেলো সালিমের। শুভ্রার বুকের রক্ত ছলকে উঠলো। সে ছুটে গিয়ে খুশিকে ধরলো। আহা! তার মন তবে তাকে ঠিকই বলেছিল? কেন যেন বুকের উপর থেকে একটা পাথর সরে গেলো। সে তাহলে বাঁচাতে পারলো খুশিকে? রণকে দেওয়া কথা রাখতে পারলো, এই আনন্দে লাফ দিতে মন চাইলো।
“মিস্টার তন্ময়, ইউ আর আন্ডার এরেস্ট। চলুন থানায় যাওয়া যাক। আপনার আসল শশুর বাড়িতে।”
হ্যান্ডকাফ নিয়ে এগিয়ে যেতেই মোর্শেদ মাঝে টপকে পড়লো-“খবরদার ওসি, আমার পোলাকে কিছু করবা না। কোথাও যাইবো না আমার পোলা।”
“আমাদের কাজ করতে দিন না হলে খারাপ হবে।”
“দিমু না। কি করবি? এই তুহিন যা তো জিনিস নিয়ায়।”
সালিমের কথা শুনে দিলশাদ বললো-“আমাদের পথ থেকে সরে দাঁড়ান। অনেক ঝামেলা হয়েছে আর করবেন না।”
“সরুম না। যা করার কর দেখি কি করতে পারোস।”
সালিম আর মোর্শেদ অনড় হয়ে তন্ময়ের সামনে দাঁড়ায়। তুহিন কিছুক্ষণ পরই ফিরলো পিস্তল নিয়ে। দিলশাদ তা দেখে শেষ বারের মতো বললো-“সরে যান সালিম সাহেব না হলে গুলি ছুড়তে বাঁধ্য হবো।”
“আমরা বইসা তোমারে চুমা দিমু।”
বলা মাত্রই দিলশাদ সেকেন্ডের গতিতে পিস্তাল বের করে সালিম সাহেবের হাত লক্ষ করে গুলি ছুড়লেন। গুলিটা ডান হাত এফোর ওফোড় করে বেরিয়ে গেলো। সালিম সাহেব ব্যাথায় ককিয়ে উঠলে। দিলশাদ অপেক্ষা না করে পিস্তলের বাট দিয়ে তন্ময়ের মাথায় মারলেন। শেষ পর্যন্ত মোর্শেদের দিকে বন্দুক ধরতেই মোর্শেদ দুইহাত উপরে তুলে সারেন্ডার করলেন। দিলশাদ কেবল তন্ময়কে তুলে নিয়ে চলে গেলো। যাওয়ার আগে শুভ্রাকে কেবল বিদায় জ্বানালো। ফিসফিস করে শুভ্রাকে বললো-“আপনি যোগ্য ভাবির মতো কাজ করলেন। স্যার শুনলে খুব খুশি হবে। স্যারকে বাঁচিয়ে দিলেন ভাবি।”

★প্রিয় পাঠক, বইমেলা শেষ। তবুও বই সংগ্রহ চলবে। আমার নতুন বইসহ তিনটে বই ঘরে বসে অর্ডার করতে পারবেন রকমারিসহ আপনার পছন্দের বুকশপে। আমার লেখা ছয়টি ই-বুক পড়তে পারবেন বইটই থেকে। বই পড়ুন বইয়ের কথা ছড়িয়ে দিন।★

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here