দর্পহরন #পর্ব-৬৯

0
305

#দর্পহরন
#পর্ব-৬৯

তাহের আর মোর্শেদ মিলে তন্ময়কে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করলেও সফল হতে পারলোনা। দিলশাদ বলেই দিলো-“নির্বাচনের পরে আসেন। এইমুহূর্তে কোনভাবেই সম্ভব না। তাছাড়া আপনার ছেলে যে অপরাধ করেছে তার জামিন পাওয়া বা জেল থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব না আসলে। নির্বাচন হয়ে যাক, তখন মন্ত্রী স্যারের সাথে পারসোনালি কথা বলে মিটমাটের চেষ্টা করেন। অন্যথায় আপনার ছেলের জীবন শেষ।”
মোর্শেদ পড়লো বিপদে। মিনু তো খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তার এক কথা ছেলে না বাড়ি ফিরলে খাবে না। দুই মেয়ের পরে এই এক ছেলে তার। বেশ আদরে মানুষ হয়েছে বলা যায়। সেই ছেলে কি করে থানায় নোংরা পরিবেশে থাকবে? ভেবে মাথা নষ্ট হওয়ার জোগার মোর্শেদের। কিন্তু নিরুপায় হয়ে মেনে নিয়ে যতটুকু সম্ভব টাকা দিয়ে সুব্যবস্থা দেওয়ার চেষ্টা করলো। আপাতত এর বেশি কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। মোর্শেদ ঠিক করলো নির্বাচন হওয়ার পরই রণর কাছে যাবে। দরকার হলে রণর পায়ে পড়বে ছেলের জন্য।

এদিকে নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে দুটো জিনিস ভাইরাল হয়ে গেলো। একটা রাতের আঁধারে দিলশাদকে মারার ভিডিও আরেকটা ফোন রেকর্ড যেখানে সরকারি দলের খুব উচ্চ পদস্থ একজনের সাথে সালিম সাহেবের কথোপকথন। নির্বাচনি এলাকা তো বটেই সরকারি দলের মধ্যেও শোরগোল পড়ে গেলো। সালিম সাহেবের জন্য এটা বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা বটে। এমনিতেই বাড়িতে তন্ময়কে নিয়ে বেশ চাপে আছেন তারউপর নির্বাচনের মাঠে এরকম কোনঠাসা অবস্থা। এই অবস্থায় সালিম সাহেব একেবারেই চুপচাপ হয়ে গেলেন। বাড়ির ভেতর বাহির কোন দিক থেকেই কারো সাহায্য পাচ্ছেন না। তিনি বুঝতে পারছেন নির্বাচনে তার হার আসন্ন। মনে মনে ভীষণ মুড়ষে পড়লেও বাইরে শক্ত ভাব ধরে রেখেছেন। আগের রাতে নিজের কাছের
ছেলেপেলেদের বলে ভোটকেন্দ্র দখলের কথা বলে রাখলো।

মেয়র নির্বাচন মোটেও শান্তিপূর্ন হলো না। সালিম সাহেব সর্ব্বোচ্চ চেষ্টা করলেন। তবে সফল হলেন না। কয়েকটা ভোটকেন্দ্রের ভোট গ্রহন বাতিল হলেও পুলিশী তৎপরতায় ভোটগ্রহন শেষ হলো। বিকেলের দিকে ফলাফল আসতে শুরু করলো। শুরুর দিকে বেশ অনেকগুলো কেন্দ্রে সালিম সাহেব এগিয়ে থাকলেও শেষ মেষ দেখা গেলো সুমনা জিতে গেছে। রাত গভীর হতে হতে প্রায় বেশিরভাগ কেন্দ্রের ফলাফল চলে এলো। দেখা গেলো সুমনা বিপুল ব্যবধানে সালিম সাহেবকে হারাতে চলেছে। প্রথমে দীর্ঘদিনের পারিবারিক আসন সংসদ নির্বাচনে হারানো তারপর মেয়র নির্বাচনে ভরাডুবি, পারিবারিক ভাবে হেও হওয়া সবমিলিয়ে সালিম সাহেবের জন্য বিরাট একটা ধাক্কা। ফলাফল ঘোষণার পর সালিম সাহেব মুষড়ে পড়লো। সারাক্ষণ বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকা বা শুয়ে থাকা। দিন দুয়েক পরে ভোরের দিকে সালিম সাহেব ঘুমের মাঝে হার্ট অ্যাটাক করলেন।

*****

নির্বাচনের পরের দিনই মোর্শেদ ছুটে এসেছে রণর কাছে৷ রাজিব যখন বললো মোর্শেদ দেখা করতে চায় তখনই রণর চেহারা গম্ভীর হলো। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে তাদের ভেতরে আসতে বললো। মোর্শেদ আর মিনু দু’জনই এসেছে একসাথে। ওরা বসার ঘরে বসে ছিলো। কিছুক্ষণ পর রণ এলো। মোর্শেদ অসহায় চাহুনি দিয়ে আর্জি জানায়-“বাবা, তন্ময়ের হয়ে মাফ চাই। আমার ছেলেটা ভুল করে ফেলছে। তাকে এবারের মতো মাফ করে দাও। কথা দিচ্ছি আর এমন কিছু হবে না।”
মিনু মোর্শেদের সাথে তাল দিলো-“হ্যা বাবা, এইবারের মতো তন্ময়কে মাফ করে দাও। আমি মা হয়ে অনুরোধ করছি বাবা।”
রণ মাথা নাড়ে-“এটা তো ভুল না। তন্ময় অপরাধ করেছে। আপনারা একবার ভাবেন আমার বোনটাকে সময় মতো উদ্ধার না করলে কি হতো? ওর এই অতিরিক্ত সাহস দেখানো মোটেও ঠিক হয়নি। এই অপরাধের কোন ক্ষমা নেই, হবে না।”
মোর্শেদ হাঁটু গেড়ে বসে যায়-“বাবা, আমার একটামাত্র ছেলে। আবেগের বশে একটা কাজ করে ফেলেছে তার জন্য ওর ভবিষ্যত নষ্ট করে দিয় না বাবা। মানলাম ও খারাপ কাজ করেছে। তোমার বোনকে কিডন্যাপ করেছে কিন্তু যেভাবেই হোক তোমার বোনের কোন ক্ষতি হয়নি। বাবা, এবারের মতো একটা সুযোগ দাও। আমরা ওর বাবা মা, আমাদের জন্য হলেও না দাও।”
“সুযোগ দিলে ভবিষ্যতে আবার এমন কিছু করবেনা এর কি কোন গ্যারান্টি আছে? আপনি জোর দিয়ে বলতে পারবেন যে ও আবার এমন কিছু করবেনা? বলতে পারলে ওকে ছেড়ে দেব।”
মোর্শেদের চেহারা গম্ভীর হলো-“করবে না বাবা। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি।”
রণ মাথা নাড়ে, হেসে বললো-“একটা ব্যাপার জানেন, কথা দেওয়া জিনিসটা খুব খারাপ। কথা দেওয়া হয় কথা না রাখর জন্য। তাই আপনাদের কথা দেওয়ার ব্যাপারটা মানতে পারছি না। একটা কাজ করতে পারেন।”
এতক্ষণে আশার আলো দেখলো মোর্শেদ। সে ব্যস্ত হয়ে জানতে চাইলো-“বাবা, কি করার কথা বলবে? তুমি যা বলবে তাই করবো তবুও আমার ছেলেটাকে জেল থেকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করো।”
“তন্ময়কে চিরদিনের মতো দেশ ছাড়তে হবে। ও আর কোনদিন এদেশে আসতে পারবে না। এবং সেটা হবে এই তিনদিনের মধ্যে। একটা বন্ড লিখে এই শর্তে সাইন করবেন আপনারা সবাই। তাতে যদি রাজি থাকেন তাহলে ভেবে দেখতে পারি।”
মোর্শেদ আর মিনু দু’জনই একে অপরকে দেখলো বোকার মতো। রণ কথা কর্নকুহরে ঢুকাতে কিছুটা বেগ পেতে হলো। কথা মগজে গেথে যাওয়ার পরই দু’জনই হাউমাউ করে উঠলো। মিনু বললো-“ছেলেকে না দেখে কি করে থাকবো বাবা। তাছাড়া আমাদের পরে আমাদের সম্পদের উত্তরাধিকার তো তন্ময়ই। এ কেমন শর্ত বাবা?”
“বোকার মতো কথা বলছেন আন্টি। ক’দিন আগেই তিনমাস মেয়ের কাছে থেকো এসেছেন। এভাবেই ছেলেকে যখন দেখতে মন চাইবে তখন যেয়ে দেখে আসবেন। এ আর এমন কি কঠিন ব্যাপার?”
“তবুও বাবা, এমন কঠিন শর্ত দিয় না বাবা মাকে। সন্তানের জন্য বুক হাহাকার করে বাবা।”
রণ উঠে দাঁড়ায়-“আমার কথা আমি বলে দিলাম আন্টি। আপনাদের কিংবা তন্ময় কাউকেই আর বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার বোনের সিকিউরিটির জন্য এতটুকু আমাকে করতেই হবে। আপনারা যদি আমার শর্ত রাজি থাকেন তাহলে তন্ময়ের কাগজপত্র, টিকেট, বন্ডের সাক্ষর সব কাজ শেষ করে নিয়ে আসবেন। আমি সব দেখে তন্ময়কে জেল থেকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করবো।”
বলেই রণ ঘড়ি দেখলো-“সরি আপনাদের আর সময় দিতে পারছি না। জরুরি মিটিং আছে আমার। কি করতে চান আমাকে জানাবেন। আসছি।”

*****

সেদিন ইব্রাহিম নিবাসের সকালটা হলো ভীষণ রকম ভয়ংকর। এমনিতেই গত কয়েক রাত ধরে সবাই দেরিতে ঘুমাতে যায়। সকালে রিমার আর্তচিৎকার সবার আগে শুনতে পেলো শুভ্রাই। ছুটেও এলো সবার আগে। বাবাকে দেখেই ঘটনা আঁচ করতে সময় লাগলো না তার। সে চিৎকার করে শরীফ আর তাহেরকে ডাকলো। তুহিনকে গাড়ি বের করতে বলে হাসপাতালে ফোন করে দিলো। একঘন্টার মধ্যে সালিম সাহেব হাসপাতালের আইসিইউতে। আইসিইউতে একের পর এক টেস্টের পর জানা গেলো হার্ট অ্যাটাকের খবর। শুভ্রা মাথায় হাত দিয়ে বসে যায়। কেন জানে না বাবার এই অবস্থায় জন্য বারবার নিজেকে দায়ী মনেহচ্ছে। নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। কেন এমন হলো? সে তো বেশি কিছু চায়নি্ কেবল চেয়েছে বাবার দ্বারা যেন আর কোন খারাপ কাজ না হয়, আর কারো ক্ষতি না হয়। এই চাওয়া কি অন্যায়? শুভ্রা ভীষন মুষড়ে পড়লো। শরীফ তাকে সান্তনা দিলো-“অযথাই নিজেকে দোষ দিস না শুভ্রা। তুই একদম ঠিক আছিস। এমনটা হওয়ারই ছিলো। বাবাকে আর কোনোভাবে থামানো যেত না শুভ্রা।”
“কিন্তু বাবার এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী ভাইয়া।”
শুভ্রা কেঁদে দেয়। শরীফ ওর মাথায় হাত রাখে-“বাবা নিজে দায়ী শুভ্রা। সোহেল মারা যাওয়ার পর বাবার নিজেকে শুধরে নেওয়া উচিত ছিলো কিন্তু বাবা তা করেনি। এসব তো হতই আগে অথবা পরে। তুই শুধু শুধু নিজেকে দোষ দিস না।”
শরীফের সান্ত্বনায় সাময়িক সস্তি মিললেও মনটা ছোট হয়ে রইলো শুভ্রার। বারবার আল্লাহকে ডাকে শুভ্রা। এবারের মতো বাবাকে যেন জীবিত ফিরে পায় না হলে মায়ের চোখে সারাজীবনের মতো অপরাধী হয়ে থাকতে হবে। শুভ্রার দোয়া শুনেই বুঝি আল্লাহ সালিম সাহেবের জান বকসে দিলেন। টানা তিনদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে সালিম সাহেব জীবন ফেরত পেলেন। আরও দু’দিন পরে জানা গেলো সালিম সাহেবের ডান পাশ সম্পূর্ণ প্যারালাইজ।

★প্রিয় পাঠক, বইমেলা শেষ। তবুও বই সংগ্রহ চলবে। আমার নতুন বইসহ তিনটে বই ঘরে বসে অর্ডার করতে পারবেন রকমারিসহ আপনার পছন্দের বুকশপে। আমার লেখা ছয়টি ই-বুক পড়তে পারবেন বইটই থেকে। বই পড়ুন বইয়ের কথা ছড়িয়ে দিন।★

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here