#দর্পহরন
#পর্ব-৯
দীর্ঘ দিন পরে নিজের পিতৃভূমিতে ফিরে আপ্লূত হয় রণ। মাকে সাথে নিয়ে পিতার আদি নিবাসে আগমনটা বেশ জাঁকজমকপূর্ণই হলো। ভাবেনি এতো লোকের সমাগম হবে তার আসা উপলক্ষে। সাধারণ লোকের আকন্ঠ সমর্থন দেখে সে আর জলি দু’জনেই বিস্মিত। তাদের নতুন বাড়ির নামকরণ হয়েছে। ‘দর্পন’ নামের বাড়িটা সাধারণ জনগণ, মাঠপর্যায়ের কর্মীদের ভীড়ে সমাগম। আসলে নেত্রীর কড়া আদেশ, প্রার্থী যেই হোক তাকে দলের সবাই মিলে সাপোর্ট দিতে হবে। কোন ধরনের কোন্দল বরদাস্ত করা হবে না।
তারউপর রণ ফ্রেশ মুখ। তার বাবা এলাকার গন্যমান্য মানুষ ছিলেন। সমাজসেবক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুনাম ছিলো। মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানোর অভ্যাস ছিলো। তার ছেলে হিসেবে রণ এলাকার মানুষের অন্ধ সমর্থন পেয়ে গেছে। আর বাকী রইলো রাজনৈতিক পরিপক্বতা, সময়ের সাথে সাথে সেটাও অর্জন করে ফেলবে। এটা লোকের বিশ্বাস।
লোকজনের আন্তরিকতায় জলি সিক্ত। আজ মনেহচ্ছে, ভালো মানুষের মুল্যায়ন হয় না এ কথাটা ভুল। দেরিতে হলেও ভালো কাজ আর ভালো মানুষ দুটোরই মুল্যায়ন হয়। একসময় ছেলের রাজনীতিতে যোগদানে ভীষণ ভয় ছিলো জলির। আজ সব দেখে কেন যেন ভালো লাগে। তার ছেলে এতো এতো মানুষের ভালোবাসা পাবে সে তার ভাবনায় ছিলো না। ভীষণ ভালোলাগা নিয়ে জলি রণকে দেখে। ছেলে স্মিত মুখে সবার সাথে আলাপ করছে। দূর থেকে সে দৃশ্য দেখতে বড়ই ভালো লাগছে তার। গত কয়েকদিন ধরেই দূর থেকে লুকিয়ে দেখছে তবুও স্বাধ মিটছে না জলির। অবাক হয়ে ভাবছে, তার ছোট্ট ছেলেটা কবে এতো বড় হলো? এতো সেদিও বাবা বাবা করে কেঁদে জলির কোলে মুখ লুকাতো। সেই রণ আজ বাবার জায়গায়। জলি দেখে আর কাঁদে।
“মা, চলো আজ ঢাকায় ফিরবো।”
“এখানে তোর কাজ শেষ?”
জলি উৎকন্ঠিত হয়ে জানতে চায়। রণ মাকে দেখে হাসলো-“না মা, এখানে কাজ কেবল শুরু। আমার তো এখন এখানেই থাকতে হবে। কিন্তু তুমি এখানে এভাবে থাকলে হাসি খুশি তো পাগল হয়ে যাবে।”
জলি রাগ হলেন-“ওরা কেন পাগল হবে? ছোট আছে নাকি ওরা? ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে, নিজেদের দেখে রাখতে পারে।”
রণ হেসে দিলো-“আমি তো তাহলে বুড়ো হয়ে গেছি মা।”
জলি স্নেহার্দ হয়ে জবাব দিলো-“তোর কথা আলাদা। তুই তো এতোদিন দূরেই ছিলি। এখন চোখের আঁড়াল করতে মন চায় না। আমি তোর সাথে এখানেই থাকবো। উহু কোন কথাই শুনবো না।”
রণ মাকে জড়িয়ে ধরে-“আমার সাথে মিহির আছে, জাফর আছে। তাছাড়া হাসি খুশিকে দেখে রাখতে হয় মা। ওরা বড় হয়েও ছোটদের মতো আচরণ করে। তুমি ওদের সাথে থাকো মা।”
জলি মাথা নাড়ে-“তাহলে ওদেরকেও এখানে আনি।সবাই মিলে এখানেই থাকি। এতো বড় বাড়ি সমস্যা নেই তো কিছু।”
রণ আঁতকে উঠলো-“কখনোই না মা। আমি চাই না সবাই এখানে থাকি। অন্তত নির্বাচনের আগে তো নয়ই। আমি নতুন মানুষ মা। কে আমাকে বন্ধু ভাবছে কে শত্রু তা এখনো জানি না। তাই তোমাদের নিয়ে কোন রিস্ক নেব না আমি।”
“বেশ। তাহলে আর কোন কথা নেই। আমি তোর সাথেই থাকবো।”
রণ হতায় হয়ে মাথা নাড়ে-“আচ্ছা বেশ থেকো। আমাকে তাহলে দিন ঠিক করে নিতে হবে। চারদিন এখানে থাকবো তিনদিন ঢাকায় ফিরবো। ঠিক আছে?”
জলি জবাব দিলো না। গোছগাছে মন দিলো।
★★★
“তুহিন, একটা কাজ করতে পারবি?”
তুহিন বিস্মিত হয়ে ইব্রাহিম সালিমকে দেখলো। কতদিন পরে তুহিনকে ডাকছেন সালিম সাহেব। ছেলে সোহেলের চক্করে তুহিনকে ডাকতে ভুলে গেছিলেন ইব্রাহিম সালিম। আজ এতোদিন পরে তুহিনকে কাজের জন্য ডাকছে। আবেগপ্রবণ হয়ে গেলো তুহিন। দৃঢ় স্বরে বলে-“কি কাজ স্যার?”
“কি যেন নাম ছেলেটার? এই এলাকার প্রার্থী হইছে।”
“রণ?”
“হুমম। ওর হিস্ট্রি বের করে আমাকে জানা। ওই ছেলে হুট করে উড়ে এসে জুড়ে বসলো কেমনে? এতো শর্ট টাইমে আপা এর আগে কাউরে মনোনয়ন দেয় নাই। ওর কেসটা কি?”
তুহিন হাসলো। ও জানতো এই প্রশ্মটা আসবে তাই আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে ছিলো সে।
“স্যার, ওর হিস্ট্রি জানি আমি। হাসনাত হামিদের পোলা এই রণ। এতোদিন বিদেশ আছিলো। পড়ালেখার ধার ভালো। কি পুরস্কার পাইছে জানি। ছয়মাস মতো দেশে আইছে। এলাকার ছেলে, বাপের নামধাম ভালো, সবাই এখনো একনামে চিনে ওর বাপকে। এইজন্য আপা তারে মনোনয়ন দিছে। হয়তো ভাবছে নতুন মানুষ আপনিও নিজের মতো চালাইতে পারবেন।”
ইব্রাহিম সালিম বিস্ময়ের চুড়ান্ত হলেন-“কস কি? ওরা থাকে কই এখন?”
“ঢাকায় থাকে, শান্তিনগরে ওর নানার দেওয়া জমিতে বাড়ি করছে।”
“আচ্ছা, তাইতো বলি এলাকায় দেখি নাই কেন এতোদিন। হাসনাতের বাড়ি আছে না? ওইটায় কে থাকে?”
“ওই পুরান বাড়ি ভাইঙা দশতলা বিল্ডিং হইছে। তার তিনতলায় আইসা থাকবে রন। পার্টির কাজ করব এইখানে থাইকা।”
সালিম বিস্ময় নিয়ে তুহিনকে দেখলেন-“তুই এতো কিছু জানোস কেমনে? তুই কি জানতিস ওর ব্যাপারে?”
তুহিন মাথা নাড়ে-“জানতাম না। ওই এলাকায় সবচেয়ে সুন্দর বাড়িটা এখন হাসনাত হামিদের। ওই বাড়ি দেইখা একদিন খোঁজ নিছিলাম। পরে কালকে মনোনয়নের ঘোষণার পর আবার একটু খোঁজ নিলাম।”
সালিম সাহেব চিন্তিত হয়ে পান চাবালেন কিছুক্ষণ। তুহিন তাকিয়ে আছে তার দিকে। হয়তো কিছু শোনার প্রত্যাশায়। সালিম সাহেব আনমনা হয়ে বললেন-“আপাকে এতো কাঁচা কাজের মানুষ মনেহয় না। ওকে মনোনয়ন দেওয়ার পিছনে কারণ নিশ্চয়ই আছে। আচ্ছা, এক কাজ কর তুহিন।”
তুহিন উৎসুক হলো-“কি কাজ?”
“ওর উপর নজর রাখ। সারাদিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা। কোথায় যায় কি করে সব নজরে রাখ।”
তুহিন সন্দিহান গলায় জানতে চাইলো-“আপামনির ব্যাপারে কি আপনার সন্দেহ হয়?”
সালিম সাহেব সন্তুষ্ট চিত্তে তুহিনকে দেখলেন-“তোর মতো আর কেউ বোঝে না আমাকে। কিছু বলার আগেই বুইঝা যাস কি কইতে চাই।”
তুহিন হাসলো-“সত্যি বলতে আমি কালকে ওর পিছনে লোক লাগাইছি। দেখি সে কি কয়।”
সালিম সাহেব কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে দেখলেন সালিমকে-“এইজন্যই তোরে ভালা পাই তুহিন। তুই একদম আমার মনের মতো।”
তুহিন স্মিত হেসে চুপ করে গেলো। সালিম সাহেব আবারও শুয়ে গেলেন। গতদিন মিটিং শেষ হওয়ার আগেই ফিরতে হয়েছে তাকে। মিটিং এর মধ্যে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় আপা ডাক্তার ডেকে দেখান। ব্লাড প্রেশার বেড়ে বিচ্ছিরি অবস্থা। সাথে সাথে বাড়ি ফিরতে হয়েছে তাকে। কড়া সিডেটিভ দিয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হয়। দিনদুয়েক আধো ঘুম আধো জাগরনে কাটানোর পর আজ শরীর কিছুটা ভালো বোধ করার তুহিনকে নিজের কামড়ায় ডেকে নেয়।
রণ ছেলেটার সব শোনার পরও মনটা খচখচ করছে। ছেলেটা মিটিং এর মাঝে দুই একবার তাকিয়েছিল তার দিকে। সেই দৃষ্টিতে কি হেলা ছিল? কেন যেন রণ ছেলেটা মাথা থেকে যাচ্ছে না।
★★★
পুরো বাড়ির বাতি জ্বলে উঠতেই শুভ্রা চোখের উপর হাত দিলো।
“আরেহ, আপনি তো দেখি বেশ সাহসী মেয়ে। একদম ফিট আছেন।”
রণর গলা শুনেও শুভ্রা হাত সরায় না। রণ কয়েকটা প্যাকেট এনে টেবিলের উপর রাখলো। শুভ্রা ক্লান্ত গলায় বললো-“এখানে এসেছি কতদিন হলো?”
দু’সপ্তাহ হয়নি এখনো।”
“আর কতদিন থাকতে হবে?”
“এখনো বলতে পারছি না।”
শুভ্রা ধীরে ধীরে হাত সরায়। আলোতে চোখ মেলতে কষ্ট হচ্ছে তার। ক্ষীন কন্ঠস্বরে জানতে চাইলো-“আমাকে কি জীবিত মায়ের কাছে যেতে দেবেন নাকি মে/রে ফেলবেন?”
রণ মৃদু হাসি মুখে নিয়ে তাকিয়ে আছে। শুভ্রার মুখের বিস্বাদ তাকে স্পর্শ করলোনা। সে উৎফুল্ল কন্ঠে বললো-“আরেহ, কি বলছেন এসব? আমাকে বুঝি আপনার খু/নি মনেহচ্ছে? আমার কাজ হয়ে যাওয়ার পর আমি নিজে আপনাকে মুক্তি দেব। একদম ভাববেন না।”
শুভ্রা রণর দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে থেকে বললো-“একজন মেয়েকে একদম অন্ধকারে আঁটকে রেখে আপনি কি প্রমান করতে চাইছেন আমি জানি না। তবে যা করছেন খুব খারাপ করছেন।”
রণ ভাবলেশহীন তাকিয়ে থেকে উচ্চস্বরে হেঁসে দিলো। শুভ্রার চেহারায় বিরক্তি। নিস্তব্ধ ফ্লাটে রণর হাসি বড্ড কানে লাগে বলে সে কানে হাত দিলো-“প্লিজ আস্তে হাসুন কানে লাগছে।”
রণ হাসি বন্ধ করে-“আমেরিকার কি করতেন আপনি? পড়ালেখার সময় বাদে? জব করতেন কোন? টাকা তো আপনার বাবা পাঠাতো। কাজেই জব করতেন না। কি করতেন তবে? পাবে যেয়ে নতুন বয়ফ্রেন্ড বানানো, নাচানাচি, ঢলাঢলি। খুব জম্পেশ লাইফ কাটিয়েছেন তাই না?”
শুভ্রা কড়া গলায় জবাব দিলো-“দ্যাটস নান অফ ইয়োর বিজনেস। আপনার কোন ক্ষতি তো করিনি। আপনি কেন আমাকে নিয়ে এতো বদার হচ্ছেন?”
“আমি আপনাকে নিয়ে মোটেও বদার না। প্লিজ নিজেকে এতো ইমপর্টেন্ট ভাববেন না।”
“তাহলে কি অন্য কারো রোশ আমার উপর ঝাড়ছেন?”
রণ এবার বিরক্ত-“আজ এতো ওলটপালট বকছেন কেন? তিনদিন অন্ধকারে থেকে পাগল হয়ে গেলেন নাকি?”
শুভ্রা ভাঙবে তবু মচকাবে না-“পাগল হইনি তা বলবো না। আমি আসলে আর পারছি না। কোন দোষে দোষী হয়ে এই সাজা পাচ্ছি সেটাতো বলবেন?”
রণ শুভ্রাকে দেখলো খানিকক্ষণ। মেয়েটার চোখের নিচে কালি পড়েছে। মুখটা শুকনো হয়ে আছে। চুলে চিরুনি পড়েনি ক’দিন বোঝাই যাচ্ছে। মুখটা ফ্যাকাসে লাগছে দেখতে। প্রচন্ড ভয় পেয়েছে বোঝা যাচ্ছে। মুহুর্তের জন্য মনটা নরম হলো রণর। তারপরেই আবার ওর বাবার কথা মনে হয়ে কঠোর হলো।
“খাবার এনেছি আপনার জন্য। দ্বিতীয় চ্যালেন্জ পাস করেছেন সেই উপলক্ষে। আপনার পছন্দের খাবার।”
শুভ্রা খাবারের প্যাকেট খুলেও দেখলো না। রণর দিকে তাকিয়ে বললো-“তাহলে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিন। আমাকে কেন তুলে এনেছেন?”
“কারনটা আগেও বলেছি এখন আবার বলছি। বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আপনাকে অপহরণ করেছি। উদ্দেশ্য সফল হলে আপনাকে ফিরিয়ে দেব।”
“উদ্দেশ্যটা কি সেটাই জানতে চাইছি।”
রণ আবার পুরনো রুপে ফিরে এলো-“জানানোর হলে আগেই জানাতাম। শুধু শুধু এনার্জি ক্ষয় করবেন না। যতটা প্রয়োজন ততটা জানুন। আপনার জন্য সেটাই মঙ্গল হবে। আসছি আজ।”
শুভ্রা এবার আঁতকে উঠলো-“প্লিজ যাবেন না। গত তিনদিন হলো ঘুমাই না। গোসল হয় না। আপনি কিছুক্ষণ থাকুন প্লিজ। গোসল সেড়ে ঘন্টাখানিক ঘুমিয়ে নেই। তখন না আপনি চলে যাবেন।”
রণ কেন যেন শুভ্রার নিরীহ আবদার ফেলতে পারে না। মাথা ঝাঁকিয়ে বললো-“আচ্ছা, আমি বসছি কিছুক্ষণ।”
শুভ্রা ধীর পায়ে উঠে গেল। রণ একপলক দেখে সোফার গা এলিয়ে দিলো। আজ রাতে মিটিং আছে ওর নির্বাচনী প্রচারনা টিমের সাথে। কিছু বর্ষীয়ান নেতা উপস্থিত থাকবে সেখানে। কাল আবার ফিরতে হবে নির্বাচনী এলাকায়। নানা ভাবনা ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত রণ ঘুমিয়ে পড়লো।
খট করে আওয়াজ হতেই রণ চমকে উঠে বসলো। বুঝতে চাইলো কোথায় আছে সে। বোঝার সাথে সাথে দৌড়ে রুমে গেল। যা ভেবেছিল তাই। রুমে শুভ্রা নেই। পাশের রুমে ঢু মেরে দেখেই বাইরের দিকে ছুটলো। বাসার চাবিটা শার্টের বুকপকেটে ছিল। সেটা জায়গায় নেই। রান্না ঘরের দরজার দিকে ছুটলো রণ। দরজাটা হাঁট করে খোলা। রণর বুক ধক করে উঠলো। মেয়েটা পালিয়ে গেল শেষ পর্যন্ত? কি হবে এখন? কেন সে ঘুমিয়ে গেল? তার বোঝা উচিত ছিল ওর বাবা কে?
চলবে—
©Farhana_Yesmin