দাম্পত্য সুখ পর্ব-১৪ শেষ

0
1651

###দাম্পত্য সুখ (১৪ ও শেষতম পর্ব)
###লাকি রশীদ

আপা ১ মাসের জন্য বাবার বাসায় এসে খবর পাঠিয়েছে, আমি যেন গিয়ে দেখা করি ওর সাথে।সবাই জানে শাশুড়ির দুষ্টু বুদ্ধির জন্য, আমার কোথাও যাওয়া হয় না। এবার রাফি বলছে,”এই
কয়দিন আমি বন্যাকে স্কুল থেকে আনবো মা। তুমি নানার বাসায় কিছুদিন না হয় থেকে আসো”।
রাতে শাহীন কে বলতেই বলল,”যাও, ছেলে তখন
পথ বাতলে দিয়েছে, তখন আমাকে জিজ্ঞেস করো কেন”? আমি বলি,”শুধু শুধু অপবাদ দিওনা
শাহীন। আজ পর্যন্ত যেখানেই, যেভাবে ই যাই,
তোমার অনুমতি ছাড়া কখনো গিয়েছি। ঝগড়া করে হোক আর অভিযোগ করেই হোক, তুমি না বললে আমি কোথাও যাই”? এবার কি ভেবে এক
দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,”আজ আমি বারণ করলে কি তুমি যাবে না”? আমি বলি,
“না যাবো না। আমি জানি তোমার মতো স্বার্থপর লোকের সাথে এসব নীতি দেখিয়ে লাভ নেই, কিন্তু
তারপরও মনটা খচখচ করে”। এখন একদম নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছে। আমিও আর কিছু বলি না। ৪৩ বছরে ছুঁই ছুঁই নদীর এখন আর মানসিক টানাপোড়েন সহ্য হয় না। মনে হয় ক্লান্তিতে সারা টা তনু,মন ছেয়ে আছে যেন।

এক সপ্তাহের জন্য বাবার বাসায় যাবার অনুমতি মিলল। আমার শাশুড়ি এটা শুনে, রাতে শাহীন কে ডেকে নিয়ে বললেন,”এসব কি শুরু করলি?
বৌ এর পা এতো লম্বা করছিস,পরে তোর কথা শুনবে তো বাপ? যা ইচ্ছে তাই করছে, ছেলে মেয়ে গুলো কে পাখি পড়া পড়াচ্ছে যে, বাবা ও
দাদু খারাপ, মাকে আলুর দম বানিয়ে ফেলবে।
কি হলো, চুপ করে আছিস কেন”? শাহীন মিনমিন করে কি বলছে, কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না।

বাবার ওখানে গিয়ে সবকিছু ভুলে গেলাম। আমি যাবার আগে, বাবার কঠিন নিষেধ থাকে, কেউ যেন শশুরবাড়ী নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস না করে।তাই, অনেক ভালো কাটলো পূরোটা সপ্তাহ। আপা জানালো সবাই মিলে কক্সবাজার যাবার প্রোগ্ৰাম
হয়েছে, আমি যেতে পারবো কি না? বললাম,”যা পেয়েছি,তা ই আলহামদুলিল্লাহ, বেশি লোভ করে কি হবে”?

বাসায় এসে মনটা খুব ফুরফুরে মেজাজে আছে।
বাচ্চারা বলছে,”তুমি এতো দিন আরামে থেকে এসেছো মা, আজকের দিন টাও তোমার আরামে
কাটুক। আমরা দুই ভাই পরোটা ও গ্ৰীল চিকেন এনেছি আর বন্যা চা বানিয়ে খাওয়াবে। আমার শাশুড়ি ই শুধু কঠিন মুখ বানিয়ে বসে আছেন। রেণু আপা বললেন,”আজকে ঘরটা ভরা ভরা লাগছে। ঘরের বৌয়ের অভাব কেউ মেটাতে পারে না বোন”। আমি হাসিমুখে বলি,”এ কয়দিন আপনার কোনো কষ্ট হয়নি তো”? বন্যা হেসে বলে,
“সবচেয়ে কষ্ট তো ফুপুর ই হয়েছে মা। কি একটা বিস্কিটের মতো একদিন বানিয়ে দিয়েছিলেন, এত
মজা পেয়েছি আমরা,প্রত্যেকদিন বানিয়ে দিতে বলি আর ফুপু কষ্ট করে বানিয়ে দেন”।

আমাকে দেখে খুব খুশি হয়েছে আরেক জন….সে
আমার বুয়া। মুখ ভর্তি পান নিয়ে, হাসিমুখে হাত টা জড়িয়ে ধরে রেখেছে। সংসারে চলার পথে এসব ছোট ছোট মমতা অনেক কাজে আসে। মনে হয়, এদের জন্য বাঁচতেও সুখ। রাতে শাহীন
এলো, হেসে বলল,”কি ব্যাপার? কেমন ইনজয় করলে”? আমি বলি,”অনেক। তার জন্য তোমার
ধন্যবাদ প্রাপ্য”। মোজা খুলছে আর বলছে,”আমি হলাম চশমখোর টাইপ মানুষ। আমাকে আবার কি ধন্যবাদ দিবে বলো”? এ কথা দিয়ে খোঁচা মেরে কথা বলল কারণ জোহা একবার রেগে ওকে তা ই বলেছিল।

রাফি কে সিলেটে দিয়ে আসার জন্য, শাহীন সাথে গেল। আমার মনে হচ্ছে, বুকের একটা পাশ যেন খালি হয়ে গেছে। আমার চিরদিনের শক্তপোক্ত ডাকাবুকো ছেলে, আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলছে,”মা আমি সবসময় তোমার একদম কাছে
আছি মনে রেখো। শুধু একটা কলের অপেক্ষা,
আমি বাতাসের মতো তোমার পাশে চলে আসব। আমাকে কোনো লেখাপড়া ই আটকাতে পারবে না”। আমার তো চিরকালের কষ্ট ই হলো, চোখে পানি নেই। বুকটা ধুমড়ে মুচড়ে একাকার, কিন্তু চোখ দুটো পদ্মার চরের মতো খটখটে। কিছু না বলতে পেরে, ছেলের টি শার্টের পিছনটা খামচে ধরে ভাবছি, ছেলেমেয়েদের সাথে বিচ্ছিন্ন থাকা হয়তো বা মাত্র শুরু হলো নদী। বাকিটা ভবিষ্যত ই বলে দিবে তোমাকে।

শাহীন বলছিল,” ষ্টেশনে আর গিয়ে কি করবে, নদী? বাদ দাও”। আমি বলেছি,”আমি যেতে চাই
শাহীন। এটুকু সময় তো আমি ছেলেকে কাছে পাবো”। বললো,”ঠিক আছে,চলো তাহলে”। সে সামনে বসে, ছেলেদের নিয়ে আমাকে পিছনে বসার সুযোগ করে দিল। সারাটা পথ মধ্যেখানে বসে, দুই ছেলেকে দুই পাশে নিয়ে এলাম। রাফি আমার মতো ই,কান্না কি বলতে পারে না। কিন্তু,
ইতিমধ্যে কাঁদতে কাঁদতে রাহির চোখ টকটকে লাল হয়ে গেছে।

রাফি ওর দিকে ভালোমতো না তাকিয়ে বললো,
” তোর কিন্তূ ডিউটি বাড়লো রাহি, এখন মা কে আমার ভাগের খেয়াল টাও তোকেই করতে হবে”। রাহি বাইরের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে তো কাঁদছেই।
এবার রাফির ওর দিকে চোখ পড়তেই রাগ উঠে গেছে,”কি হলো, কেন এই ফ্যাচর ফ্যাচর কান্না লাগিয়ে রেখেছিস বলতো? দয়া করে চুপ করবি”? এতোক্ষণ ধরে নিশ্চুপ হয়ে থাকা শাহীন এবার হেসে বললো,”সবাই তো তোর মতো শক্ত নয় রাফি। সে তার দুঃখ, কান্না দিয়ে যদি কমাতে পারে তবে তোর সমস্যা কি”? শাহীন কখনো রাহির ব্যাপারে কিছু বলে না। অজ্ঞাত কারণে অদ্ভুত একটা নিষ্ক্রিয় ভাব নিয়ে থাকে।আজ এসব বলাতে আমরা তিনজন ই অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই।

ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে, নিয়ে যাচ্ছে আমার প্রিয়জন
কে। আরেক প্রিয়জন তার শক্ত হাতের মুঠিতে আমার হাত ধরে আছে। বিশাল সাম্রাজ্যধিপতি,
দুই জাহানের মালিক, আসমান জমিনের সৃষ্টি কর্তা আল্লাহ তাআলা কে মুখ উঁচু করে মনে মনে
বলছি,”আমার কি কোনো ক্ষমতা আছে, এদের কে পাবার। আমার মতো কতো নারী সারা জীবন কান্না করেও একটা বাচ্চা পাচ্ছে না। অপরিসীম
মমতা বুকে নিয়ে, রাতদিন মনোকষ্টে ভুগছে। সেই
জায়গায় তুমি আমাকে, এদেরকে কোলে দিয়ে
পরিপূর্ণ করেছো। এখন এদের দেখার মালিকও
তুমি। আমার বাচ্চাদের সব ধরনের শারীরিক ও
মানসিক কষ্ট থেকে তুমি দূরে রাখো”। স্বচ্ছ, সুন্দর নিলাকাশ আমার আকুতি টাকে যেন মুক্ত দৃষ্টিতে
দেখে শুষে নিচ্ছে।

বাসায় এসে দেখি আমার শাশুড়ি রেণু আপাকে আচ্ছা মতো ঝাড়ছেন। চেঁচিয়ে চূড়ান্ত করছেন,
“আগে ছিলে অভাবী, থাকার জায়গা নাই। এখন কয়দিন যেতেই মাথায় বসে গেছ। না করছি আমি
যে, আমার তরকারি যেন এতো পাতলা না হয়।
আমার বৌয়ের মতো, তোমারও কি আমাকে এখন চোখে লাগে না? আমাকে তো তুমি চেনো
নাই,আনতে যেমন পারি তোমাকে,ঠিক তেমনি জুতা দিয়ে পিটিয়ে বেরও করে দিতে পারি, সেটা
ভালো মতো মনে রেখো”। আগে হলে আমি অস্থির হয়ে যেতাম, এখন শান্তস্বরে বলি,”কি হল
মা? তরকারি পাতলা হলে, আবার মসলা বাগাড়
দিয়ে,ঘন করা যাবে। উনাকে এতো বকাঝকা করছেন কেন”? দ্বিগুণ শক্তিতে পরিণত হয়ে, আমাকে বললেন,”আমার তরকারি ঘন করার তোমার আর সময় কোথায় বৌমা? তুমি তোমার তালেই আছো”। আমি বলি,”হ্যা, আমার তাল,লয়
সব ই বেঠিক, একমাত্র আপনি ই ঠিক। হলো তো”?

কাপড় পাল্টে এসে দেখি রেণূ আপা ভাত, তরকারি সবকিছু বেড়ে দিয়ে বলছেন,”খাও নদী।
শান্তি মতো খেয়ে উঠো”। আমি বলি,”আপনার
প্লেট কই, আসুন সবাই এক সাথে খাই”। বন্যা ও তার দাদি খেয়ে নিয়েছেন, আমি,রাহি ও রেণু আপা খেতে বসলাম। রেণু আপা বললেন,”খালার
রাগ উঠেছে কেন বুঝতে পারলাম না। তরকারি কি তুমি দেখেছ”? আমি হেসে বলি,”আমি সেটা এসেই দেখেছি। তরকারি পাতলা হয়নি,আসল কথা আমার উপর রাগ করে এসব কথা বলেছেন
আপনি কিছু মনে করবেন না প্লিজ”।

উনি কষ্টের হাসি দিয়ে বলেন,”এরচেয়েও অনেক কষ্ট পেয়ে পেয়ে, এগুলো কে এখন মোটেই কষ্টকর মনে হয় না বোন। তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে। অনেক সম্মান আমাকে দিয়েছে তুমি,এর কোটি গুণ যেন তুমি ফেরত পাও, বাচ্চা
রা পায়”। এসময় আমার শাশুড়ি তার তীক্ষ্ম কন্ঠে উনাকে ডাকা শুরু করেছেন। উনার খাওয়া
শেষ হয়ে গেছে,হাত ধুয়ে তাড়াতাড়ি করে যান।
এবার রাহি মুখ খুললো,”নানু সবসময় কাউকে না কাউকে না বকলে মনে হয় শান্তি পান না। এতো বছর তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে, এখন ফুপুকে পেয়ে উনার লাভ হয়েছে”।

পরদিন রাত দশটায় শাহীন সিলেট থেকে ফিরেছে
এসে, খেয়ে, কিছুক্ষণ ওর মায়ের সাথে গল্প করে শুতে এসেছে। আমি কি যেন বলতে চেয়েছিলাম,
তার আগেই দেখি আমি বাহুবন্দী হয়ে গেছি। সে খুব ভারী গলায় বলল,”ছেলের সাথে যতো ঘন্টা
ছিলাম নদী,ওয়ান থার্ড সময় সে তোমার কথা ই
বলেছে, ইনফ্যাক্ট সে অনেক চিন্তিত তোমাকে নিয়ে। বাবা তার কাছে অলমোস্ট ভিলেন হয়ে গেছি। ঢাকায় ফেরত আসার পথে অনেক চিন্তা করেছি আমি। একটা মাত্র ছেলে আমার,সেই যদি
আমাকে দেখতে না পারে….. তাহলে কি করলাম জীবনে”? আমি নিশ্চুপ হয়ে বক্ষলগ্না হয়ে শুয়ে আছি। মাঝে মাঝে জীবনে এমন এমন সময় আসে……. তখন কি বলব, সেটাই আমার বুদ্ধিতে
কুলোয় না।

পরদিন আবার আরেক বিপদ উপস্থিত। বন্যা ওর বান্ধবী শম্পার বোনের বিয়েতে যাবে।তাই, শাহীন
অফিস থেকে এসে দিয়ে এসেছে। ঘন্টা দুয়েক পরে, আবার আনবে বলে ড্রাইভার কে বিদায় দেয়নি। এখন আনতে গিয়ে, দেখি ঘন্টা দুয়েক চলে গেছে ওরা আর আসে না। চিন্তায় আমি অস্থির, দুজনের কেউই ফোন ধরছে না। অবশেষে
এলো,যখন রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। “কি হয়েছে” জিজ্ঞেস করতেই শাহীন বলছে, আসার সময় ওর এক বান্ধবীর জুতার হিলের নিচে বন্যার
আঙ্গুল পড়ে, বড় নখ পুরোপুরি উল্টে গেছে। এই
জন্য পাশের হাসপাতালে নিয়ে,ব্যান্ডেজ করে নিয়ে এসেছে।

রাগে আমার তালু জ্বলছে,”আমি অনেক আগেই তোমাকে বলেছিলাম শাহীন, মেয়ের হাত পায়ের দিকে একটু তাকিও। আমি তো ওকে বলে বলে হয়রান। খেয়াল করলে দেখবে ঈগলের মতো হাত পায়ের নখ লম্বা করেছে। তুমি কানে ই নেওনি আমার কথা। এখন তো এসব হবে ই”। শাহীন ও তার মেয়ে চুপ করে বসে শুনছে, শুধু আমার শাশুড়ি বলে উঠলেন,” শুধু
বাপকে দোষ দিয়ে কি হবে বৌমা? মায়ের যদি সংসারে মন না থাকে, তবে বাচ্চাদের এরকম তো
হওয়া ই স্বাভাবিক”। আমি কিছু বলার আগেই অনেকক্ষণ থেকে ঘাড় গুঁজে কাঁদতে থাকা বন্যা ওর দাদির দিকে তাকিয়ে বললো,”তোমার একটা
বদভ্যাস হলো, সবকিছু তেই মাকে দোষী করার চেষ্টা করা। এখানে মা কি করলো”? সাথে সাথে ই
সমস্ত ঘরে নিঃশব্দতা ছেয়ে গেছে।

কাঁকন ফোন করেছে,”আমাদের রাজশাহীর সাহিত্য সম্মেলন তো আগামী সপ্তাহে। আমার প্লেনের টিকেট এর সাথে তোরটাও করিয়ে ফেলি। আমি বলি,”আমি তো শাহীন কে জিজ্ঞেস ই করিনি এখনো। কালকে জানাবো তোকে”। রাতে
শাহীন কে জিজ্ঞেস করতেই সোজাসুজি না করে
বললো,”না এখন তুমি রাজশাহী যেতে পারবে না
নদী। আগামী সপ্তাহ অফিসের কাজে আমার ভীষণ ব্যস্ত কাটবে। দুদিনের জন্য আমাকে চিটাগাং যাওয়া লাগতে পারে”। আমি বলি,
“শাহীন প্লিজ, যেদিন যাবো সেদিন ই প্রোগ্ৰাম।পর
দিন সকালের ফ্লাইটে আবার ফিরে আসব ইনশাল্লাহ”। ও তখনো বলছে,”না, আমি না করলাম তো। এবারের প্রোগ্ৰাম ক্যান্সেল করো”।
আমি তাকে মানানোর জন্য, প্রায় ঘন্টা খানেক
ধরে ঘ্যানঘ্যান করার পর, অবশেষে রাজি হলো।

কিন্তু,শর্ত দিল “পরের দিন না আসলে আমার অফিসে সমস্যা হয়ে যাবে নদী”। আমি আশ্বস্ত করি,”চিন্তা করো না। আমি সময় মতো চলে আসবো”। জীবনে কখনো কোনো দিন সাহিত্য সম্মেলনে যাইনি। আমি ভীষণ খুশি। ছোট একটি
ট্রলি ব্যাগ নিয়ে,যাবার দিন কাঁকনের গাড়িতে করে এয়ারপোর্টে গেলাম। আমার বাচ্চারা আমার খুশি দেখে খুব ই খুশি। রাফি আগের দিন ভিডিও কল দিয়ে বলেছে,”খুব ভালো হয়েছে মা, ঘুরে এসো”। বন্যা, রাহি, রেণু আপা সবাই আমার জন্য খুশি। শুধু আমার শাশুড়ি ই শাহীন কে বকছেন,
কেন ও যাবার জন্য মানা করলো না আমাকে।

রাজশাহী তে পৌঁছানোর পর দেখি, আয়োজক রা
গাড়ি নিয়ে আমাদের জন্য উপস্থিত। একজনের বাসায় নিয়ে গেলেন।বিশাল বড় বাড়িতে দুইরুমে
আমাদের থাকতে দিলেন। বিকেল থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত প্রোগ্ৰাম চলতে থাকে। খুব উপভোগ করি আমি। কতো সুন্দর সুন্দর কবিতা,একে একে কতো নবীন,প্রবীন কবিরা আবৃত্তি করতে থাকে। সময়টা ভীষণ ভালো কাটে আমার। এছাড়া, চার বন্ধু একসাথে অনেক বছর ধরে
এভাবে থাকিনি। সবাই খুব ইনজয় করি।

পরদিন সকালে ভীষণ ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে।এয়ারপোর্টে
এসে বসে আছি, খারাপ আবহাওয়ার কারণে ডিলে হচ্ছে ফ্লাইট। এদিকে শাহীন দুই বার ফোন
দিয়েছে। সন্ধ্যায় যখন কর্তৃপক্ষ ফ্লাইট ক্যান্সেল হবার ঘোষণা দিল, তখন ভয়ে ভয়ে শাহীন কে জানাই। রাগে ফেটে পড়েছে শাহীন, বারবার সে বলছে,”আমি আগেই বলেছিলাম যেও না এটাতে, আমার কথা শুনতে তোমার বয়ে গেছে।
বেশি উড়তে শিখে গেছো তুমি, এটাই হচ্ছে তো সমস্যা”। বলেই কটৃ করে ফোন রেখে দিয়েছে।

পরদিন সকালের ফ্লাইটে এসে, কাঁকন নামিয়ে দিয়ে গেছে। বুয়া দরজা খোলার পর ঢুকতেই দেখি, শাহীন,বন্যা ও আমার শাশুড়ি নাস্তা করছেন। শাহীন চা খাচ্ছিল। আমাকে দেখে ই বলল,”কি ব্যাপার? সাহিত্য সম্মেলনে থেকে ই যেতে। এতো কষ্ট করে আসার দরকার কি”? আমি বলি,”ফ্লাইট ক্যান্সেল না হলে তো, কালকে ই আসতাম”। সে এবার চেঁচিয়ে উঠলো,” আসার
ই দরকার নেই তো। তুমি তোমার সাহিত্য সাধনা নিয়ে থাকো”। এবার এগিয়ে এসে ট্রলিব্যাগ ২ হাত দূরে ছুড়ে দিয়ে বললো,”যেখানে খুশি তুমি সেখানে যাও। আমার বাসায় আর তোমার জায়গা হবে না। ফাজলামির আর জায়গা পাও না? চলে যাও তোমার যেখানে ইচ্ছে”।

আমি যেন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। চেয়ে দেখি আমার শাশুড়ির মুখে রাজ্য জয়ের হাসি। এটাই তো স্বাভাবিক, সারারাত ইচ্ছেমতো কানমন্ত্র দেয়া
টা সাফল্য লাভ করেছে। বন্যা চেয়ার থেকে উঠে এসে কাঁদছে,”বাবা তুমি এসব কি বলছো,বলো তো? মা কেন চলে যাবে”? গোয়ার শাহীনের তাতে
কোনো হিল্ দোল্ নেই। জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে,
আমি ব্যাগটা নিয়ে সিড়ির দিকে পা বাড়াই। বুয়া ও রেণু আপা দুজনেই মুখে আঁচল দিয়ে কাঁদছে। বুয়া দৌড়ে এসে ব্যাগ আমার কাছে থেকে কেড়ে নিয়েছে। আমাকে মোড়ে যেতে না দিয়ে,বাসার সামনে দাঁড় করিয়ে সিএনজি ফোরষ্ট্রোক নিয়ে এসেছে। সে তো কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। শুধু নদীর পোড়া চোখে ই পানি নেই।

বাবার বাসায় যখন আসি, তখন সকাল সাড়ে ১১
টা বাজে। মায়ের প্রশ্নের ভয়ে, আমি ঢুকেই বলি,
“আমি এখন আমার রুমে গিয়ে ঘুমাবো। ডাকবে না আমি না উঠা পর্যন্ত”। রুমে এসে পরনের শাড়ি
না পাল্টিয়েই শুয়ে পড়ি। অনেক কষ্ট পেয়েছি দাম্পত্য জীবনে। কিন্তু, আজকের কষ্টটা সবকিছু
ছাপিয়ে গেছে। ১৮ বছরের এই জার্নিতে শাহীন এতো খারাপ ব্যবহার কখনো করেনি। দাঁত মুখ খিচিয়ে যেভাবে কথা বলে, ঘরে যাবার পথ আগলে দাঁড়ালো,জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে থাকার জন্য
এই স্মৃতি ই যথেষ্ট।

৩ টার দিকে উঠে, অনেক পানি দিয়ে গোসল করলাম। মাথা টা যেন ছিঁড়ে পড়ে যাচ্ছে। নামাজ শেষ করে,ডাইনিং স্পেসে এসে দেখি, রাহি বসে আছে। বললাম,”তুই কখন এলি”? সে গলা জড়িয়ে ধরে বলছে,”তুমি আমাকে না ডেকে চলে এলে কেন মামস”? আমি বলি,”কিভাবে ডাকবো
তোকে? আমি যাতে ভেতরে যেতে না পারি, সেজন্য তোর মামা পথ আগলে দাঁড়িয়ে ছিল”।
জোহা পাশে বসেছিল,সে বললো,”এমনি এমনি কি আর আমি চশমখোর বলি”? এবার বাবা ও
মাকে সবকিছু খুলে বলি।

বাবা কিছু বলার আগেই,মা বকছে,”তা তোরই বা এটাতে না গেলে এমন কি দুনিয়া সুদ্ধু উল্টে যেতো”? অফিসের জরুরি কাজ ছিল, হয়তো সে
জন্য ও সমস্যায় পড়েছে,ওর রাগ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক”। আমি মৃদু হেসে বলি,”হ্যা মা শাহীনের সবকিছু ই তো স্বাভাবিক, অস্বাভাবিক শুধু আমার কর্মকাণ্ড ই”। রাহির বাবা অসুস্থ হয়ে এখন
বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। রাহি আজকে রাতে বাবার সাথে ই থাকবে। আমাকে জোর করে ধরে, পাশের মার্কেটে নিয়ে গিয়ে সুতির দুইটা ড্রেস কিনে দিয়েছে। বললাম,”টাকা
পেলি কোথায়”? হেসে বলল,”ইংলিশ মিডিয়াম এর যে ছাত্রটা কে পড়াই, গতকাল তারা বেতন
দিয়েছে”। এবার আমি বলি,”আমার একটা কথা রাখতে হবে বাবা। তুই বন্যাকে মানা করবি, রাফি কে যেন না বলে।আর তুইও বলবি না কথা দে”।

বন্যা প্রতিদিন ২/৩ বার ফোন দেয় আর কাঁদে।
রাফি ফোন দিলে, আমি খুব স্বাভাবিক ভাবে কথা
বলি। ও এখনো জানে না,তাই স্বস্তি অনুভব করি।
বাবা কে গতরাতে বলি,”এতো লোক বলেছে, আপনার আত্মসম্মান নেই। সংসার কে লাথি মেরে বের হয়ে আসেন না কেন”? আমি কখনো সংসার ছাড়ার কথা ভাবিনি বাবা। কিন্তু, শাহীন
কিভাবে, আমাকে ঘর ছাড়ার কথা বললো বাবা”?
বাবা বললো,”শোন মা যে কোনো ধৈয্যের ফল সব সময় ই মিষ্টি হয়। না হয় তুই হীরার টুকরো ২/৩
টা সুযোগ্য বাচ্চা পেতি”? আমি বলি,”হ্যা বাবা, আমি আর ঐ সংসারে যাবো না”। বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছে,”না যাবি, সমস্যা কি? তুই যা বলবি,তাই হবে”।

চতুর্থ দিন নাস্তার পর, বিছানায় বসে বসে আমার
গল্পের কমেন্ট পড়ছি। এই গত তিনদিন পড়ার ইচ্ছে ই হয়নি। হঠাৎ দেখি শাহীন দরজা খুলে, ভেতর থেকে লক্ করছে। ধড়ফড় করে উঠে বসে
বলি,”সব জায়গা কি তোমার বাসা নাকি? চুপচাপ
রুম থেকে এক্ষুনি বের হয়ে যাও। না হয় জোহা কে ডাক দিবো। ভালোমত বেইজ্জত হয়ে যাবে”।
শাহীন কোনো কথা না বলে ই, ফ্লোরে বসে আমার
পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলছে,” আমি সেদিন মানুষ ছিলাম না নদী,পশু হয়ে গিয়েছিলাম। প্রমোশন হাতছাড়া হয়ে যাবে ভেবে, পাগলের মতো আচরণ করেছি। কথা দিলাম,আর জীবনেও আমার কাছে
থেকে খারাপ ব্যবহার পাবে না। যদি আর একদিন
ও পাও, আমাকে ছেড়ে চলে আসবে। প্লিজ,মাফ করে দাও”।

আমি বলি,”তোমার কথার তো কোনো দাম নেই শাহীন। তোমার মা কিছু বললেই, আবার তুমি বদলে যাবে”। এবার সে বলছে,”আমার এই ৪ দিনে ভালো শিক্ষা হয়েছে নদী। তোমাকে ছাড়া আমার বাঁচা অসম্ভব। এই লাষ্টবার বিশ্বাস করে দেখো প্লিজ”। সংসার বুভুক্ষু নদী এবার তার হারিয়ে যাওয়া সংসার এর জন্য প্রচন্ড লালায়িত। মনে হচ্ছে,”দেখি না বিশ্বাস করে এবার কি হয়”!!!

এর ঠিক ৫ দিন পর, আমরা সিলেটের এক হোটেলের একরুমে বসে আছি। আমরা বলতে আমি, রাহি ও বন্যা। আমার শাশুড়ি আসতে
রাজি না হওয়ায়, শাহীন দীপার বাসায় উনাকে রেখে এসেছে, রেণু আপা সহ। ঔদিন আসার পর ই, রাতে শাহীন বাচ্চা দুটোকে নিয়ে এই প্রোগ্ৰাম বানায়। রাফি কে সারপ্রাইজ দেয়া হবে বলে, জানানো হয়নি। শাহীন বলেছে, অফিসের কাজে ও একা এসেছে। লাঞ্চ করবে ওকে নিয়ে এসে। দরজা খোলার আগেই আমরা ৩ জন ব্যালকনি
তে লুকিয়ে গেছি। রাফি ভেতরে ঢুকেই বলছে,
“বাবা কোথায় খাবে, রুমে না ডাইনিং হলে”? কিছু
জবাব পাওয়ার আগেই, আমি চোখ ধরি ওর।
সেকেন্ডের মধ্যেই আমার আত্মার টুকরো বলে,
“মায়ের গায়ের গন্ধ নাকে আসছে কেন? বাবা তুমি কি মা কে নিয়ে এসেছ”? চোখ খুলে দেখে ই
মা বলে জড়িয়ে ধরেছে। তিন ছেলে মেয়ে ও স্বামী
পরিবেষ্টিত হয়ে নদী আহমদ ভাবছে,”এতো খুঁজেছি এতো দিন দাম্পত্য সুখের সংজ্ঞা। এটাকেই না হয় বলি, আমার দাম্পত্য সুখ” !!!

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here