#দূর_হতে_আমি_তারে_সাধিব
#পর্ব_১২
#অনন্যা_অসমি
” আমি আর তোমার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাইনা সাফাইত। তোমার ভাষার ইট’স ওভার, ব্রেকাপ।”
বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো সাফাইত। নিজের কানে বিশ্বাস করতে পারছে না ইশরা কখনো এধরণের কথা বলবে। মনে হলো সে দিবাস্বপ্ন দেখছে।
কয়েক কদম এগিয়ে এলো সে। বিস্ময়মিশ্রিত কন্ঠে বলল, ” তুমি আমাকে ভয় দেখানোর জন্য মজা করছো তাই না ইশরা? তুমি জানো আমি এই কথা শুনে অস্থির হয়ে যাবো। তাই না, বল?”
এবার ইশরা একটু উঁচু স্বরেই বলল,
” বাংলা কথা বোঝো না তুমি? বললাম না একবার আমি তোমার সাথে আর কোন সম্পর্ক রাখতে চাইনা। এই সম্পর্ক আমার কাছে এখন বিষাক্ত মধুর মতো লাগছে। সেটা দেখতে তো মিষ্টি কিন্তু গলাধঃকরণ করলে নিশ্চিত মৃ’ত্যু৷ কিন্তু আমি বাঁচতে চাই সাফাইত।”
সাফাইতের মনে এবার ভয় গ্রাস করল। সে ইশরার হাত ধরে মিনতি করে বলল, ” এরকম কেন করছো ইশুপাখি? তুমি জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি সত্যিই একা হয়ে যাবো, পাগল হয়ে যাবো আমি। কেন তুমি এরকম কথা বলছ? আমি কি কোন ভূল করেছি, করলে বলো আমি তা ঠিক করে দেবো।”
” সত্যিই ঠিক করতে পারবে তো সাফাইত?” বিদ্রুপ করে বলল সে।
সাফাইত অস্থির কন্ঠে বলল, ” হ্যাঁ পারব পারব, তুমি শুধু বলো আমার ভূলটা কোথায়?”
” সত্যিই তুমি পারবে আমার মনের ক্ষতটা সারিয়ে তুলতে? পারবে আমার জন্মদিনের সময়টা ফিরিয়ে আনতে? পারবে কি যে লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে আমি পড়েছিলাম সেই সময়টা পরিবর্তন করতে? বলো পারবে?”
সাফাইত এখনো পর্যন্ত তার কথার কোন অর্থ বুঝতে পারলো না৷
” ইশরা তুমি এসব কি বলছ? সেদিন কি হয়েছিল? আমি পরবর্তীতে আবারো রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম কিন্তু গিয়ে কাউকে পাইনি৷ তোমার সাথে যোগাযোগ করার কত চেষ্টা করেছি কিন্তু তুমি কোন উওর দাওনি।”
” কেন ফিরে গিয়েছিলে? আমাকে লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে দেখে মজা নিতে?”
” এসব তুমি কি বলছ ইশরা! আমি কেন তোমাকে…. ”
” সেদিন তুমি আমাকে একবার বলে যেতে পারতে। আমাকে খুঁজে বলে যেতে পারতে তুমি কোথায় যাচ্ছো৷ কি হতো সর্বোচ্চ একটা মিনিট অতিবাহিত হতো। কিন্তু না তোমার কি আর সেই সময় আছে নাকি? আমি কে? তোমার জীবনে তো আমার কোন মূল্যই নেই এখন৷ সেদিন যখন সবাই তোমার খোঁজ করছিল, জানতে চাইছিল তোমার ব্যপারে আমি কিছু বলতে পারি। সবাই কানাঘুষা করছিল, বলছিল আমি কতটা উদাসিনী যে নিজের প্রেমিক কোথায় তা জানিনা। তখন একজন বলল তোমাকে নাকি তোহা ফোন করেছিল৷ তোমার জীবনে সে গুরুত্বপূর্ণ একজন তা আমি জানি, আমি আজ পর্যন্ত তোমাদের নিয়ে কোন চিন্তা মাথায় আনিনি৷ সবসময় ভালোদৃষ্টিতে তোমাদের দেখেছি। তার গুরুত্ব তোমার কাছে অনেক মানলাম কিন্তু আমি? আমি কি এতোটাই ফেলনা?”
” ইশরা আমার কথাটা তো শোন আগে। তারপর সিদ্ধান্ত নিও।”
” কি শুনব আমি? কি শোনার বাকি রেখেছ আর?”
ইশরা চলে যেতে চাইলে সাফাইত তাকে জোড় করে ধরে রাখল৷
” সেদিন আন্টি অনেক বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তোহা বাড়িতে একা ছিল, ছোট তমালকে নিয়ে সে কি করবে বুঝতে না পেরে আমাকে ফোন দিয়েছিল। আন্টি একদিন হসপিটালে ছিল। আমি ছাড়া তোহা কাউকে ভরসা করতে পারে না বলেই সে আমাকে ফোন করেছিল। আমিও টেনশনে তোমাকে জানিয়ে বের হওয়ার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। সরি বলছি তো আর কখনো হবে না।”
” সাফাইত আমিও একটা মানুষ, আমারো কিছু নিজস্ব ইচ্ছে, শখ আছে৷ আমারো ইচ্ছে হয় নিজের প্রেমিকপুরুষের সাথে একান্তে সময় কাটাতে, বসে দু’টো নিজের কথা বলতে। কিন্তু তুমি, তুমি প্রায় সময় তোহা আপু নিজে থেকে আমাদের মাঝে নিয়ে আসো৷ আমি কখনোই তা নিয়ে কিছু বলিনি, না ওভার রিয়েক্ট করেছি৷ আমরা একা থাকলেও তুমি আমাদের কথার মাঝেও তোহা আপুর কথায় নিয়ে আসতে। তখনও আমি কিছু বলতাম না, নীরবে তোমার কথা শুনে যেতাম। কিন্তু সেদিন আমার জন্মদিনের নাম করে আমাকে সবার সামনে যেরকম লজ্জায় ফেললে আমি সত্যিই কখনো এটা আশা করিনি।”
” ইশরা আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি তোহা আমাদের সাথে থাকলে তোমার সমস্যা হয়। আমরা সেই স্কুল লাইফ থেকে বন্ধু, সে আমি ছাড়া বাকিদের সাথে তেমন করে মিশে না। এখন সম্পর্কে জড়িয়ে যদি আমি তাকে একেবারেই ভুলে যায় তাহলে সে কষ্ট পাবে।”
ইশরা আহত কন্ঠে বলল, ” তুমি শুধু ওর কষ্টটাই বুঝলে আমারটা বুঝতে পারলে না তুমি।”
” সরি ইশরা৷ আচ্ছা এবার থেকে আমি আমাদের মাঝে তোহাকে আনব না। সত্যি বলছি, তাও তুমি যেও না।”
” সত্যি পারবে তো?”
” হ্যাঁ, আমি ওকে বলে দেবো ওইসময় যেন আমার সাথে যোগাযোগ না করে।”
” আর আমি যদি বলি শুধু কয়েকঘন্টা নয় একেবারে সারাজীবনের জন্য যোগাযোগ বন্ধ করে দাও, পারবে সাফাইত?”
” এসব তুমি কি বলছ ইশরা! এটা কখনোই সম্ভব নয়।”
” কেন সম্ভব নয় সাফাইত?”
” আমি আগেও বলেছি তোহা আমার বেস্টফ্রেন্ড। এভাবে কোন কারণ ছাড়া আমি ওর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারি না?”
” কেন পারো না সাফাইত? তোমরা কি আসলেই বন্ধু? নাকি আশেপাশের স্টুডেন্টরা যা বলে তাই সত্যি? তোমরা দু’জন বন্ধুর থেকেও বেশি কি?”
” ইশরা।” হুংকার দিয়ে উঠল সাফাইত৷ লোকসমাগম থেকে একটু দূরে থাকায় তেমন কেউ তাদের খেয়াল করল না৷ ইশরা মনে মনে ভীষণ কষ্ট পেলো৷ চোখে জল জমতে চাইলেও সে আটকে রাখল। বিদ্রুপ করে হেসে বলল,
” গায়ে লেগেছে না খুব? খুব বড় সত্যি বলে ফেলেছি কি আমি? তারমানে লোকে যা বলতো তাই সত্যি৷ তোমরা আসলেই ফ্রেন্ড’স উইথ বেনিফিট। তাই জন্যই কি সে ফোন দিলেই তুমি সব কাজ ফেলে ছুটে যাও তার কাছে?”
” চুপ একদম চুপ৷ তোমাকে ভালোবাসি বলে এতোসময় সহ্য করেছি কিন্তু আর নয়। তোমার ওই নোংরা মুখ বন্ধ করো। ছিঃ এরকম একটা নিচু মনমানসিকতার মেয়েকে আমি সবটুকু দিয়ে ভালোবেসেছি ভাবতেই লজ্জা লাগছে।”
সাফাইতের কথায় বেশ আহত হলো ইশরা৷
” ও… এখন আমি নোংরা হয়ে গেলাম। কেন বলতো? সত্যিটা বলেছি তাই?”
” চুপ করো ইশরা। তুমি এতোটা নিচু মনের হবে আমি ভাবতেও পারিনি৷ ভেবেছিলাম বাকিরা যাই বলুক অন্তত তোমার চিন্তাধারা ভিন্ন হবে, পবিত্র হবে। কেন? দু’জন ছেলে কিংবা দু’জন মেয়ে যদি বন্ধু হতে পারে তবে একজন ছেলে এবং একজন মেয়েকে কেন হতে পারে না? বন্ধুত্ব কি লিঙ্গ দিয়ে হয়? বন্ধুত্ব একটা মধুর সম্পর্ক, যাদের রক্তের মিল না থাকলেও মনের মিল থাকে৷ তোহা আর আমার বন্ধুত্বটাও ঠিক সেইরকম। আমি কখনই তোহাকে সেই নজরে দেখিনি। ওকে সবসময় বন্ধুর নজরে দেখিছি, একজন বোনের নজরে দেখেছি। তাই তো সবসময় চেষ্টা করি ওকে ভালো রাখার, সুরক্ষিত রাখার। আর তুমি কিনা! ছিঃ। ইশরা আর যাইহোক তোমার মুখ থেকে এই কথা শোনার পর আমি তোমার সাথে আর থাকতে পারব না। তোমাকে দেখলেই আমার এখন গা ঘিন ঘিন করছে। আজকের পর থেকে তুমি কি আমিই তোমার সাথে আর সম্পর্ক রাখব না। যার এখনই মনমানসিকতা এরকম তাকে নিজের অর্ধাঙ্গিনি হিসেবে আমি অন্তত মেনে নিতে পারব না৷ ভালো থেকো।”
সাফাইত দ্রুত স্থান ত্যাগ করল, একবারো পেছনে ফিরে তাকালো না। ইশরা সেখানে থাকা বেঞ্চে বসে নীরবে এতো সময় আটকে রাখা চোখের জল বির্সজন দিতে লাগল৷ তখন কষ্ট এবং রাগের মাথায় কথাগুলো বললেও এখন তার কষ্ট হচ্ছে, প্রিয় মানুষ হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট। আর যাইহোক তার ভালবাসা একদম পবিত্র ছিল, সে মন থেকেই সাফাইতকে ভালোবেসেছিল৷ ইশরা নিজেও কখনোই চিন্তা করেনি এরকম একটা পরিস্থিতি কখনো তৈরি হতে পারে।
চলবে….