দূর_হতে_আমি_তারে_সাধিব #পর্ব_১৪ শেষ #অনন্যা_অসমি

0
970

#দূর_হতে_আমি_তারে_সাধিব
#পর্ব_১৪ শেষ
#অনন্যা_অসমি

সময় নদীর স্রোতের মতো বয়ে গিয়েছে। সময়ের সাথে তোহা এবং সাফাইতের বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ইতি ঘটেছে। আজ তাদের বিদায় অনুষ্ঠান। তারা দু’জন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে ভেবেছিল শেষ দিনটা তারা অনেক আনন্দে কাটাবে যেন তা সারাজীবন সুন্দর স্মৃতি হয়ে থাকে। কিন্তু সব চিন্তা ধারণাই যে বাস্তবে রুপ নেই না। তারা ভেবেছিল অনেক আনন্দ উল্লাস করে শেষ দিনটা উপভোগ করবে কিন্তু সেই আনন্দ তোহা কিংবা সাফাইত কারোরই ভেতর থেকে আসছেনা। সেইদিনের পর আগের সেই হাসিখুশি থাকা সাফাইত একদম নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে। পূর্বে যাকে পরীক্ষার আগে ছাড়া ক্লাস কিংবা বইয়ের কাছে দেখা যেতো না সেইদিনের পর থেকে সে সারাদিন বইয়ে মুখ গুঁজে থাকে। তার এই পরিবর্তনের কারণে তোহার মনেও তার প্রভাব পড়েছে। দু’জনের বন্ধুত্ব থাকলেও না চাইতেও কোথাও একটা অদৃশ্য ভাসা ভাসা দেয়াল তৈরি হয়েছে তাদের মাঝে। আগের তুলনায় অনেকাংশে কম কথাবার্তা হয়। সংক্ষেপে কথাবার্তা শেষ করলেই যেন তারা বাঁচে।

অনুষ্ঠানের মাঝে তোহা সাহস জুগিয়ে মিনমিন করে সাফাইতকে বলল,

” একবার ইশরাকে ফোন দিবি? হয়তো এতোদিনে সব ভুলে গিয়েছে। একটু কথা বলে দেখ, সে মেনে নেবে।”

কথার মাঝেই সাফাইত শান্তভাবে তার দিকে তাকালেও তার চোখে রাগের আভাস স্পষ্ট বুঝতে পারল তোহা। পরবর্তীতে কিছু বলার সাহস হলো না তার।
.
.

দেখতে দেখতে আরো একটি বছর পার হয়ে গেল।

দরজার সামনে অনেকগুলো জুতো দেখে কপাল কুচকে এলো ইশরার। নিজের জুতো জোড়া জায়গা মতো রেখে কৌতূহলী নয়নে ভেতরে প্রবেশ করল সে।

বসার ঘরে পরিচিত দু’জনের পাশে বর্তমানে বিতৃষ্ণার তালিকায় থাকা মানুষটিকে দেখে ইশরা কিছুটা অবাক এবং বিরক্ত হলো।

ইশরাকে দেখে তার দিকে হাসিমুখে তাকাল তোহা। তবে ইশরা কোনরূপ বিপরীত প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে রান্নাঘরে নিজের মায়ের কাছে চলে গেল।

” মা ওনারা এখানে কেন এসেছেন?”

ইশরার মা সাফাইতের কথা জানলেও তাদের সম্পর্কের এই উত্থানপতন, বিচ্ছেদ এসবের কিছু সম্পর্কেই তিনি অবগত নন বলেই হাসিমুখে বললেন,

” আরে ওনারা তোর জন্য সম্বন্ধ নিয়ে এসেছেন। যা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। তুই আমাদের আগে বলবি না। তাহলে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতাম।”

অবাকের চেয়েও বেশি বিরক্ত এবং রাগ হলো ইশরার। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

” এসেছে ভালো মন্দ কিছু পরিবেশন করে ওনাদের প্রস্থান করতে বলো। ওনারা যেই আশায় এসেছেন সেটা হবে না।”

” কিসব বলছিস তুই?”

” আমি এই প্রস্তাবে রাজি নয়৷ সাফাইত নামে কোন পুরুষের স্থান এখন আমার জীবনে নেই। তুমিই ওনাদের বিদেয় করবে৷ আমাকে যদি কিছু বলতে হয় কাউকে কথা শোনাতে ছাড়ব না।”

পরবর্তীতে মায়ের কোনরূপ কথা না শুনে ইশরা নিজের ঘরে চলে এলো৷ তাকে বেরিয়ে যেতে দেখে তোহার বুঝতে বাকি নেই ইশরা তাদের আগমনে মোটেও খুশি হয়নি। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তোহা।

রাগে কষ্টে চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ইশরা। এতোদিন পর পুনরায় এই মানুষগুলোর সম্মুখীন হয়ে তার ভেতরে অস্থিরতা বেড়ে গিয়েছে। মানসপটে পুরোনো স্মৃতি আবারো জীবিত হয়ে উঠছে।

ঠকঠক শব্দে ধ্যান ভাঙল ইশরার। ভাবল হয়তো তার মা এসেছে। দরজা খুলতে খুলতে রাগী কন্ঠে বলল,

” মা তোমাকে না বলেছি আমাকে ডাকবে না। আমি…..” মাঝেই চুপ হয়ে গেল সে। দরজার ওপারে তোহাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমথমে ভাব ছেঁয়ে গেল তার মুখশ্রীতে।

” ভেতরে আসতে দেবে না?” হাসিমুখে বলল সে। ইশরারও ভদ্রতা বজায় রাখার জন্য সরে ভেতরে আসার জায়গা করে দিল। তোহা ভিতরে ঢুকে পুরো ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে নিল৷

” বেশ গোছানো তোমার ঘরটা।”

ইশরা তার কথায় মনোযোগ না দিয়ে গমগম কন্ঠে প্রশ্ন করল, ” এখানে কেন এসেছ? কি চাই এতোদিন পর?”

” বসতে পারি?”

তার এধরণের ভাবলেশহীন কথা বিরক্ত হলো ইশরা। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। একটা চেয়ার টেনে বসে তোহা ধীরেসুস্থে বলল,

” আন্টি থেকে তো শুনেছ কেন আমরা এখানে এসেছি।”

” হুম শুনেছি আর নিজের উওরও বলে এসেছি। এখন তোমাকে আবারো বলছি দয়া করে এখান থেকে চলে যাও। সাফাইতের সাথে আমি কোনরূপ সম্পর্ক রাখতে চাইছিনা৷ দু’বছর পর আবারো অভিনয় করতে এসেছ কেন? ভালো ভালোই তো সরে গিয়েছিলাম তোমাদের দু’জনের মাঝখান থেকে। নিজেকে নিয়ে বেশ ভালোই ছিলাম, তাহলে কেন পুনরায় আবারো আমাকে পীড়া দিতে এলে? আঙ্কেল আন্টিকে আমি কোনরূপ অসম্মান করতে চাইছিনা। তাই তোমার কাছে অনুরোধ করছি ওনাদের নিয়ে চলে যাও।”

” কেন তুমি সাফাইতের থেকে দূরে সরে এলে? আমার কারণেই তো?”

চুপ হয়ে গেল ইশরা। তার এই বিষয়ে কথা বলতেও বিতৃষ্ণা লাগছে।

” কি হলো বলো?”

” হ্যাঁ। শুনতে খারাপ লাগলেও তোমার কারণেই আমাদের মাঝে এই অনাকাঙ্ক্ষিত দূরত্ব৷ এতোগুলা দিন, এতোগুলা মাস আমরা দূরে থেকেছি শুধুমাত্র তোমার কারণে।”

” কেন? আমাদের বন্ধুত্বটা কি তোমার পছন্দ নয়?”

” তোমাদের বন্ধুত্ব নিয়ে আমার কোন সমস্যা কোনকালেই ছিল না৷ কিন্তু তোমাদের এই বাড়াবাড়ি আমি আর নিতে পারছিলাম না।”

” সাফাইত তো বলেছেই সে আমাকে বন্ধু ছাড়া অন্য কোন দৃষ্টিতে দেখে না৷ তাও কেন এই সম্পর্কের ইতি টানলে?”

” সত্যিই দেখে না? এই দু’বছরে কি তার মধ্যে এমন কোন কিছুর আভাসই তুমি পাওনি?”

” না।” সোজাসাপ্টা জবাব দিল তোহা৷ পরবর্তীতে আরো বলল, ” সাফাইত খুবই পবিত্র মনের একজন মানুষ। সে প্রত্যেকটা সম্পর্ককে সম্মান করে এবং তা নিয়ে খুবই সিরিয়াস৷ শুনতে ভালো না লাগলেও তোমার আগে তার জীবনে আমার আগমন হয়েছে। তাই সে আমাকে নিয়ে বেশি ভাবতো, এখনো ভাবে। তবে তা শুধু একজন ভালো বন্ধু হিসেবে। যা একজন প্রকৃত বন্ধুর বৈশিষ্ট্য। এইযে এতো উত্থানপতন, সম্পর্কের বিচ্ছেদ এতে সে আগের থেকে চুপচাপ হয়ে গিয়েছে, আগের সেই মুক্ত পাখির মতো উড়া স্বভাবটা সে খাঁচার মধ্যে বন্ধ করে রাখলেও আমাদের বন্ধুত্ব আজো অটুট। একজন বন্ধু হিসেবে সে আজো আমার পাশে আছে৷”

ইশরা কিছুসময় চুপ থেকে বলল,

” সাফাইত নাহয় তোমাকে বন্ধুর নজরে দেখে কিন্তু তুমি? তুমিও কি শুধু তাকে বন্ধুই ভাবো? নিজের বুকে হাত রেখে বলতে পারবে?”

থমকে গেল তোহা। মূহুর্তেই কোনরূপ উওর সে দিতে পারল না৷ জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মুখে হাসি রেখে বলল, ” সে আমার ভালো বন্ধু, বিপদের সঙ্গী, হাসি-কান্নার ভাগীদার এবং আমার গোপন কথার ভান্ডার।”

তোহা খানিকটা এগিয়ে এসে ইশরার কাঁধে হাত রেখে বলল, ” সাফাইতকে কি তুমি সত্যিই আর ভালোবাসো না ইশরা। সে ফিরে আসতে চাইলেও কি তাকে ফিরিয়ে দেবে?”

ইশরা উওর দিতে না পেরে চোখ দিক ওদিক ঘুরাতে লাগল। তোহা তাকে ঘুরিয়ে আয়নার দিকে ফিরিয়ে বলল, ” তোমার চোখের ভাব’ই বলে দিচ্ছে তুমি আজো সাফাইতকে আগের মতো ভালোবাসো। ইশরা ভালোবাসায় ঝগড়া, মনোমালিন্য, খুনসুটি থাকে। এসব ছাড়া ভালোবাসা ফিকে। কিন্তু ভালোবাসায় ইগো থাকতে নেই। ইগো থাকলে সেই সম্পর্ক কখনোই সুখকর হয় না।”

বিছানায় রাখা ব্যাগটা ইশরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে বলল, ” সাফাইত তোমার ছিল, তোমারই থাকবে। আমি কখনোই তোমাদের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তির ভূমিকা পালন করব না বরং একজন বন্ধু এবং শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে তোমাদের পাশে থাকব।”

ইশরা ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল তার এখন কি করা উচিত।

” আসতে পারি?”

এতোগুলা দিন পর আবারো সেই চিরচেনা কন্ঠ শুনে বুক হু হু করে উঠল ইশরার। কম্পনরত কন্ঠে ছোট করে বলল,

” আসুন।”

সম্মতি পেয়ে ভেতরে এলো সাফাইত। দরজাটা হালকা ভিড়িয়ে দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। দু’জনের মাঝে অস্বস্তি৷ ইশরা ভাবতে লাগল একসময় পাশের মানুষটা তার কতটা আপন ছিল, তার সাথে কথা বলার জন্য মন উতলা হয়ে থাকত। অথচ আজ সেই মানুষটার উপস্থিতই তাকে অস্বস্তিতে ফেলছে। নীরবতার অবসান ঘটিয়ে সাফাইত প্রথমে বলল,

” কেমন আছেন?”

” ভালো।”

” আপনাকে ভালো লাগছে দেখতে।”

” আপনার বন্ধু সাজিয়ে বলে?” কোথাও একটা সূক্ষ্ম আক্রোশ থেকে নিজের অজান্তে বলে বসল ইশরা। সাফাইত খানিকটা বিরক্ত হলেও তা প্রকাশ করল না। এবার ইশরা ভালো করে তার দিকে তাকাল৷ পরখ করে বুঝতে পারল আগের মানুষটার সাথে এই মানুষটার পোশাক, আচরণ কোনটাই মিল নেই৷ সেই সময় সাফাইত একদম ক্যাজুয়াল থাকতে পছন্দ করত। অথচ এখন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাফাইত একদম ফর্মাল পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে।

” হঠাৎ এতো পরিবর্তন?”

সাফাইত তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

” সময়ের সাথে সবই পরিবর্তন হয়ে যায়, হতে বাধ্য হয়।”

” ঠিক বলেছেন। আমাদের সম্পর্ক থেকে ভালো উদাহারণ আর কি হতে পারে।” আকাশের পানে তাকিয়ে উদাস কন্ঠে বলল ইশরা৷ চোখ ঘুরিয়ে আবারো তার দিকে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করল,

” এতোগুলা দিন কেন খোঁজ নিলেন না? ভালোবাসা কমে গিয়েছিল বুঝি? নাকি ইগো হার্ট হয়েছিল?”

” আপনার প্রতি আমার ভালো একবিন্দুও কমেনি বরং তা এক সমুদ্র পরিমাণ বেড়েছে৷ কিন্তু সেই ভালোবাসার স্রোতে ভাসিয়ে নেওয়ার মানুষটা হারিয়ে গিয়েছিল বলে স্রোতের তীব্রতা সম্পর্কে সে অবগত নয়। ভালোবাসায় বিশ্বাস থাকতে হয়, না হলে সম্পর্কটা আজীবন নড়বড়ে থেকে যায়। কারো আমার প্রতি এতো নড়বড়ে বিশ্বাস দেখে মনঃক্ষুণ্ন হয়েছিল, ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। এখন যদি কেউ সেটাকে ইগো হিসেবে বিবেচনা করে তাহলে এটা তার ব্যর্থতা।”

” এতোগুলা দিন পর কি মনে করে আবারো ফিরে এলেন? তোহা বলেছে বলে?”

সাফাইত ঘুরে দাঁড়াল। ইশরার চোখে চোখ রেখে জানতে চাইল , “কোনটা শুনতে চান? সত্যিটা নাকি মিথ্যা, যা আপনার মনকে সন্তুষ্ট করবে?”

” সত্যিটা।”

” হ্যাঁ তোহার প্রচেষ্টার কারণেই আজ আমরা আবার মুখোমুখি হয়েছি। আপনি আমাকে কষ্টের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেলেও সে ছেড়ে যায়নি। বরং মাঝির ভূমিকা পালন করে আমাকে সেই সমুদ্র থেকে তুলে এনেছে। মেয়েটা আজো প্রতিনিয়ত নিজেকে দোষী ভেবে গুমড়ে মরছে। এই সম্পর্কে টানাপোড়নের কারণ নিজেকে মনে করছে৷ সে আমাদের এক করার জন্য বদ্ধ পরিপক্ক ছিল, তাই তো আমাদের এক করার জন্য কোন পথই সে বাদ রাখেনি।”

” এখন যদি সে বলে আমাকে ছেড়ে দিতে তাহলে কি ছেড়ে দেবেন? কিংবা যদি বলে সে আপনাকে বন্ধুর থেকেও বেশি কিছু মনে করে তখন?”

” তোহা কখনোই এরকম করবে না৷ এটা আমার বিশ্বাস৷ সে জানে আমি একজনকে কতটা ভালোবাসি৷ প্রয়োজনে নিজেকে কষ্ট দেবে তাও জেনে বুঝে কারো ক্ষতি সে কখনোই করবে না।”

” এখন যদি আমি বলি এরপরেও আমি আপনার সাথে সম্পর্ক গড়তে চাই না৷ তখন?”

সাফাইত হতাশা ভরা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,

” যদি এই সিদ্ধান্তই হয় তবে ভবিষ্যতে জীবনের জন্য শুভাকামনা। সবসময় ভালো থাকবেন।”

নিজের সিদ্ধান্ত জানানোর আগে তোহার দিকে তাকাল ইশরা। তোহা কি বুঝল সে জানেনা তবে সে মুচকি হেসে তাকে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করল। যা দেখে কোথাও যেন ইশরার একটা শান্তি অনুভব করল, মনে হলো কোন বোঝা কমে গিয়েছে।

” আমি রাজি এই বিয়েতে।” হাসিমুখে জানল সে৷ তার উওরে পুরো ঘরে খুশির জোয়ার বয়ে গেল। সাফাইতের মা সাথে নিয়ে আসা আংটিটা ইশরার হাতে পড়িয়ে দিয়ে বিয়ের কথা পাকা করল।

সাফাইত এবং ইশরা তার দিকে তাকালে তোহা হেসে ইশরায় তাদের একসাথে ভালো লাগছে বোঝাল। সাফাইত তাকে বিনা শব্দে ঠোঁট নাড়িয়ে ধন্যবাদ জানাল। হাসিমুখেই বাকি সময়টা কাটল তারা, তোহাও তাদের সাথে সম্পূর্ণ সময়টা হাসি মজাতে কাটল। তবে বাইরে হাসিখুশি থাকলেও অন্তরে তার কি চলছে তা শুধু একমাত্র সে এবং তার সৃষ্টিকর্তায় জানে।
.
.

চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে সাফাইত এবং ইশরার বিয়ের দিন ধার্য করা হয়েছে। বর্তমানে দু’ই পরিবারই বিয়ের আয়োজন এবং কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত। আয়োজনে তোহা থেকেও যেন নেই। সাফাইত এবং তার মা তোহাকে একবার বলেছিল যেন কেনাকাটা করতে সেও তাদের সাথে যায় তবে তোহা গেল না, বাহানা দিয়ে সুকৌশলে কাটিয়ে গেল৷ কারণ সে জানে তার যাওয়াটা ইশরা খুব একটা পছন্দ করবে না। আর সে জেনে বুঝে কারো সুখীর দিনে তার মনে কষ্ট দিতে চাইনা। সাফাইত বুঝল তোহার এড়িয়ে যাওয়াটা তবে এবার সেও বেশি জোর করল না৷ কিন্তু তোহার জন্য পছন্দ করে পোশাক কিনতে ভুলল না এবং তার ইশরার পছন্দসই কিনেছে।

অনেক জল্পনা কল্পনা শেষে, বহুপ্রতিক্ষার পর সেই দিনের আগমন অবশেষে ঘটল। বিয়ের পুরো সময়টা তোহা সেখানেই উপস্থিত ছিল। কারণ সে চাইনা শেষ সময়ে এসে অদ্ভুত ব্যবহার করতে যা সবার নজরে খুবই সহজে পড়ে যাবে এবং তাতে ঝামেলা বাড়বে বয় কমবে না।

বিয়ে শেষ হওয়ার কিছুসময় পর তোহা দু’জনের কাছে এলো।

” নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা রইল। আমার এই বন্ধুটার খেয়াল রেখো ইশরা৷ সাহেব এখন গম্ভীর গম্ভীর ভাব দেখালেও ভেতরে কিন্তু সেই আগের মতোন’ই আছে৷”

একটা রেপিং পেপারে মোড়ানো বক্স এগিয়ে দিল ইশরার দিকে৷ ইশরা তা নিতেই সে দু’টো ব্যাসলেটের মতো জিনিস সামনে এগিয়ে বলল,

” ওকে এটা পড়িয়ে দিতে পারবো কি? নাকি তোমার বর হয়ে গিয়েছে বলে এখন তাকে আর ছোঁয়া যাবে না?” হেসে বলল সে। ইশরা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উওর দিল। তোহা মুখে হাসি বজায় রেখে একটা সাফাইতকে এবং অপরটা ইশরাকে পড়িয়ে দিল এবং নিজের বামটা সামনে এগিয়ে আনল।

” এটি আমি নিজের হাতে ভালোবেসে বানিয়েছি, আমাদের বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে। যাতে আমি না থাকলেও আমাকে একজন বন্ধু হিসেবে সবসময় মনে রাখো।”

সাফাইত হেসে বলল, ” কেন? শশুড়বাড়ি যাওয়ার জন্য প্ল্যান করছিস নাকি?”

তোহা ঢোক গিলে বলল, ” হ্যাঁরে৷ তবে শশুড়বাড়ি নয় দূর সম্পর্কে শশুড়বাড়ি যাওয়ার। আমার ওপ্পারা যে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

এবার সাফাইত সিরিয়াস হলো৷ বুঝল তোহা মজা করছে দেখালেও সে মজা করার মুডে নেই।

” এই কি হয়েছে তোর? কিসব বলছিস এগুলো?”

” হ্যাঁ সাফু তুই যা বুঝেছিস তাই। কয়েকঘন্টা পরেই আমার ফ্লাইট৷ আমি আজকেই কোরিয়া চলে যাচ্ছি।”

” মানে! এই তুই এসব কি বলছিস? কখন করেছিস এগুলো? তোর আজ ফ্লাইট, তুই কি আমাকে এখন বলছিস! এটা তোর ধরণের মজা তোহা?” শেষে রাগী কন্ঠ বলল সে৷

” প্রস্তুতি তো অনেক আগে থেকেই নিচ্ছিলাম কিন্তু হুট করেই ভিসা হয়ে গেলো। মাঝে তুই এতো ব্যস্ত ছিলিস তোকে জানিয়ে বিরক্ত করতে চাইনি।”

” বিরক্ত! আমার তো এখন রাগ হচ্ছে। তুই এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নিলি আর আমাকে একটাবারো জানালি না। এই আমি তোর বেস্টফ্রেন্ড?”

” আরে বাবা সরি। বললাম তো হুট করেই ভিসা হয়ে গেল৷”

” ভিসা নাহয় হলো কিন্তু প্রসেসিং? প্রিপারেশন? তার বেলায়? তোর থেকে একটা আমি আশা করিনি। তুই আমার সাথে একদম কথা বলবি না।” সাফাইত রাগ করে চেয়ারে বসে পড়ল। তোহা জানত সাফাইত ভীষণ রাগ করবে, কষ্ট পাবে।

” কিছুসময় পর তো চলেই যাবো৷ শেষ সময়ে কি একটু কথা বলবি না?” বেশ ইমোশনাল হয়ে বলল তোহা। এবার নিজের কঠোরতা আর বজায় রাখতে পারল না সাফাইত। হাজার হোক এতোবছরের বন্ধুত্ব।

ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলল,

” তুই এটা ঠিক করছিসনি তোহারাণী। এভাবে ছেড়ে চলে যেতে পারছিস তুই।”

” আরে বাবা আমি তো কয়েকবছর পর চলেই আসব। এরকম করলে কিন্তু আমার যেতে খারাপ লাগবে। তুই কি সেটাই চাইছিস?”

” না। চল তোকে আজ কবজি ডুবিয়ে খাওয়াবো৷ শেষ বারের মতো দেশের খাবার তৃপ্তি করে খেয়ে নে। ওখানে গিয়ে এসব সুস্বাদু খাবার জীবনেও পাবিনা৷ তখন আমি তোকে ফোন দিয়ে এসব খাবার দেখাবো। তুই শুধু দেখবি আর মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়বে।”

” ছিঃ, চুপ কর শয়তান। আমাকে খাবারের লোভ দেখাতে আসবিনা।”

তোহার বেশ যত্ন আঁত্তি করল সবাই, এমনকি ইশরাও। বিদায় বেলায় সবাই তোহার সাথে টুকটাক কথা বলল, কেউই প্রস্তুত ছিল না তোহার এই অনাকাঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্তে। তোহা ইশরাকে জড়িয়ে ধরল।

” ভালো থেকো তোমরা।”

” তুমি আমার কথায় কষ্ট পেয়ে দেশ ছাড়ছ৷ তাই না আপু?”

কেঁপে উঠল তোহা। নড়বড়ে কন্ঠে বলল, ” না, একদমই না। তোমার কথায় আমি একটুও কষ্ট পাইনি। আমার আগে থেকেই ইচ্ছে ছিল বাইরে যাওয়ার৷ তাই তো আগে থেকেই সবকিছুর প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিলাম।” ইশরাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল তোহা৷ তার কাঁধে হাত রেখে আবারো বলল, ” এসব কথা এখন মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও। নতুন একটা জীবন শুরু করছ, এতে অতীতের স্মৃতি নিয়ে প্রবেশ করো না। নতুন করে সব সাজাও, নিজের মনের মতো করে। ভালো থেকো সবসময়।”

সাফাইতের বাহুতে হাত রেখে তোহা টলমলে চোখে বলল, ” ভালো থাকিস সাফু। তোকে অনেক মিস করব। আমার জায়গাটা কাউকে দিসনা।”

” তোর জায়গা সবসময় তোরই থাকবে। সেটা আর কেউই পূরণ করতে পারবে না। সাবধানে যাস, পৌঁছে জানাতে ভুলবিনা।” মাথায় হাত বুলিয়ে বলল সে।

বিদায় পর্ব শেষে গাড়ির কাছে এসে দাঁড়াল তোহা। শেষ বারের মতোন পেছন ফিরে হাত নাড়িয়ে সবাইকে বিদায় জানাল।

গাড়ি চলছে শুরু করেছে। সাইড মিররে নবদম্পতির হাসি মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে তোহা নিজের মনে বলল,

” আমি চাইলেই পারতাম তোদের দূরত্বের সুযোগটা নিতে। চাইলেই পারতাম তোকে নিজের করে নিতে। কিন্তু আমি এতোটাও নিষ্ঠুর হতে পারিনি। পারিনি নিজের স্বার্থের জন্য দু’জন ভালোবাসার মানুষকে আলাদা করতে। হয়তো দেখা যেতো মনের কথা জানালে হীতে বিপরীত হতো। আমাদের বন্ধুত্বই হয়তো ভেঙে যেতো। আমার প্রতি তোর বিশ্বাস ভেঙে যেতো, তোর নিজের কাছে নিজেকে ছোট মনে হতো। আমার থেকে দূরে চলে যেতি তুই। কিন্তু আমি তো তা চাইনা সাফাইত। তুই আমার ভালোবাসার মানুষ হিসেবে, জীবনসঙ্গী হিসেবে আমার জীবনে না থাক। কিন্তু বন্ধু হিসেবে সারাজীবন আমার পাশে থাক এটাই আমার চাওয়া। তোকে একেবারে হারিয়ে ফেললে যে আমি ধুঁকে ধুঁকে মরবো। আমার একপাক্ষিক ভালোবাসা আমার হৃদয়েই থাক। আমার অনুভূতি একমাত্র আমার। কাছ থেকে তোকে না পাই দূর থেকে না হয় তোকে সারাজীবন ভালোবেসে যাবো। তাও তুই ভালো থাক।”

অশ্রভেজা নয়নে চাঁদবিহীন অন্ধকার আকাশের পানে চেয়ে রইল তোহা৷ গাড়িতে থাকা রেডিও থেকে ভেসে এলো,

” দূর হতে আমি তারে সাধিব
গোপনে বিরহডোরে বাঁধিব।”

_________________ সমাপ্ত ___________________

সমাপ্তি নিয়ে অনেকেই সন্তুষ্ট হতে পারেন আবার অনেকেই মন খারাপ করবেন৷ আপনাদের কিছু প্রশ্নের উওর,

১) মূল চরিত্র কে?
উ: এই গল্পে মূল চরিত্র শুধু এবং শুধু তোহা। গল্পটা সম্পূর্ণ তোহার দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয়েছে। তোহার স্থান থেকে সে মূল চরিত্র হলেও যদি সাফাইত এবং ইশরার গল্পটা দেখা হয় তাহলে কিন্তু সে সম্পূর্ণ রুপে একজন সেকেন্ড লিড৷

২) সাফাইত এবং ইশরা যদি জুটি হয় তবে তাদের ঘটনার বর্ণনা তেমন নেয় কেন?
উ: যেহেতু এটা তোহার গল্প অর্থাৎ একজন সেকেন্ড লিডের একপাক্ষিক ভালোবাসার গল্প তাই এখানে জুটির ভালোবাসা থেকে তার কষ্টটাই বেশি দেখানো হয়েছে।

গল্পের মূলভাব:

আমাদের গল্পে আমরা মূল চরিত্র হলেও কারো না কারো গল্পে আমরা পার্শ্ব চরিত্রের ভূমিকা পালন করে থাকি। যদি ইশরা এবং সাফাইতের দিক থেকে গল্পটা দেখা হয় তবে তোহার চরিত্রটাও কিন্তু সেরকম।

উক্ত গল্পটা মূল একজন সেকেন্ড লিডের দিক বিবেচনা করে লেখা হয়েছে। আমরা সবসময় নায়ক-নায়িকাদের দুষ্ট-মিষ্টি ভালোবাসা দেখি, সমাপ্তিতে প্রায় তাদের সুখকর মিলন হয়। কিন্তু প্রতিটা গল্প কিংবা জীবনে একজন থাকে যে শেষ পর্যন্ত একা থাকে, ভালোবাসার মানুষকে পাইনা। যাকে আমরা সেই গল্পের সেকেন্ড লিড বলে আখ্যায়িত করে থাকি। আমি সেই সেকেন্ড লিডের দিকটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। সেই সাথে একপাক্ষিক ভালোবাসার অনুভূতি। তোহার মতো আমাদের মাঝে অনেকেই সম্পর্ক নষ্টের ভয়ে কিংবা অন্যের ভালো বিবেচনা করে, পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে নিজের ভালোবাসা, অনুভূতি লুকিয়ে রাখি। সেটাই “তোহা” চরিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি৷ আশা করছি এবার গল্পের মূলভাবটা আপনারা অনুভব করতে পেরেছেন। গল্পের শুরু থেকেই নানা রুপ মিশ্র মন্তব্য পেয়েছি। জানিনা কতটুকু স্বার্থক হতে পেরেছি। যারা পড়েছেন আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। আশা করবো গঠনমূলক মন্তব্য করবেন এবং নিজের মতামত জানাবেন। নতুন বছরের জন্য অগ্রীম শুভেচ্ছা রইল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here