দূর_হতে_আমি_তারে_সাধিব #পর্ব_০৪ #অনন্যা_অসমি

0
499

#দূর_হতে_আমি_তারে_সাধিব
#পর্ব_০৪
#অনন্যা_অসমি

কড়া রোদে সবার জান যায় যায় অবস্থা। রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছে তোহা এবং সাফাইত। এদিক-সেদিক তাকাতে তোহার নজর পড়ল রাস্তায়৷ কিছু একটা দেখে তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। খানিকটা পিছিয়ে গেল সে। ঘাড়টা সামান্য বাঁকা করল যেন সাফাইতের ছায়ার কাঁধে কাছে তার মাথাটা যায়। আস্তে করে ফোনটা বের করল এবং এই মূহুর্তেটা ক্যামেরা বন্দি করে রাখল।
বিরবির করে বলল, ” এইভাবে যদি ভালোবাসা মানুষ হিসেবে তোর কাঁধে মাথা রাখতে পারতাম সাফু। কি হতো যদি ইশরা তোর জীবনে না আসত? কি হতো যদি আমি তোকে নিজের মনের কথা বলে দিতাম? তুই আমার না হয় সাফু কিন্তু এই ছোটছোট মূহুর্তগুলো আমি যত্ন করে স্মৃতিতে সাজিয়ে রাখব।”

” কিরে তোহা এই দামড়ি বয়সেও ছায়ার সাথে কথা বলছিস।”

নিজের অনুভূতি সূক্ষ্মভাবে গোপন করে সে মিথ্যা ভাব দেখিয়ে বলল, ” করছি তোর সমস্যা? আমার ছায়া, আমার যা ইচ্ছে করব।”

” তাহলে তুই এই রোদে দাঁড়িয়ে ছায়ার সাথে গল্প কর, আমি গেলাম।”

সাফাইত রিকশায় চড়ে বসেই তোহাও তাড়াহুড়ো করে উঠে বসল।

” বেয়া’দব আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিস কেন?”

” তোরই তো ছায়ার সাথে আড্ডা দেওয়ার শখ হয়েছে, তো তুই থাক না৷ চলে যাচ্ছিস কেন?”

” চুপ কর শয়’তান। আর বাজে কথা বললে রিকশা থেকে ফেলে দেব।”

রিকশা তার আপনগতিতে চললে, সাথে পুরো রাস্তাজুড়ে চললো দু’জনের দুষ্টমিষ্টি ঝগড়াও।
.
.

সাফাইতে ফোন পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে নিচে নেমে এলো ইশরা। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল,

” কি হয়েছে? হঠাৎ এতো জরুরি তলব কেন?”

” এভাবে ছুটে এসেছ কেন? হোঁচট খেলে কি করতে?”

” তুমি যেভাবে বলেছ তাড়াতাড়ি নিচে নামতে চিন্তায় আমি আপনাআপনি ছুটে চলে এসেছি। এবার তাড়াতাড়ি বলো কেন ডেকেছ? পড়াপ্রতিবেশী কেউ দেখে ফেললে রক্ষে নেই।”

সাফাইতে একটা ব্যাগ ইশরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ইশারায় তা নিতে বলল। ইশরা ব্যাগটা নিয়ে ভেতরে দেখলে কয়েকটা খাবারের প্যাকেট, যা থেকে সুন্দর একটা গন্ধ নাকে এসে পৌঁছাচ্ছে।

” এগুলো কি?”

” কাল না বলেছিলে তোমার কাচ্চি খেতে মন চাইছে। কাল তো পারিনি তাই আজ নিয়ে এলাম।”

ইশরা মনে মনে ভীষণ খুশি হলো৷ তবে তা প্রকাশ না করে বলল,

” কেন শুধু শুধু টাকা খরচ করতে গেলে? ওটা তো আমি এমনিতে বলেছিলাম। আমি টিউশনির টাকা পেলে ঘরেই বানিয়ে নিতাম।”

” তোমার ইচ্ছে হয়েছে তা কি আমি পূরণ না করে থাকতে পারি?” এগিয়ে এলো সাফাইত৷ ইশরার হাতজোড়া আঁকড়ে ধরে তার চোখে তাকিয়ে বলল, ” টাকা কোন ব্যপার না ইশরা। টাকা আসবে, যাবে কিন্তু এই সামান্যতে তোমার যে খুশি তার কাছে টাকা কিছুই না। তোমার খুশির জন্য আমি সবকিছু করতে রাজি। ভালোবাসার কাছে এসব কিছুই না।”

” হয়েছে আমার প্রেমিক পুরুষ৷ এবার আমি যাই, মা খোঁজ করবে আমার।”

” সাবধানে যেও আর আন্টিকে বলো আমার তরফ থেকে এগুলো ট্রিট।”

ইশরা গেট পার হয়ে চলে গেল কিন্তু সাফাইত এখনই গেল না। কিছুসময় পর ইশরা বারান্দা এসে বিদায় জানালো৷ সাফাইত ইশরায় ভালোবাসি বলে বাইকে চড়ে নিজের গন্তব্যে পাড়ি দিল।
.
.

” কিরে তোহারাণী এভাবে মুখ ফুলিয়ে বসে আছিস কেন?” ঘাসের উপর বসে বলল সাফাইত। কিন্তু তোহার কোন ভাবান্তর সে দেখল না। পুনরায় একই প্রশ্ন করেও যখন কোন উওর পেলো না তখন সাথে বসে থাকা ইলাকে প্রশ্ন করল,

” কি হয়েছে ইলা? তোহা এরকম মূর্তির মতো বোবা হয়ে বসে আছে কেন?”

ইলা তোহার দিকে তাকাল, সে ইশারায় না বলল যা সাফাইতের চোখ এড়িয়ে গেল না। সে অস্থির হয়ে গেল।

” ইলা কিছু লুকাবিনা, বল কি হয়েছে? কোন সমস্যা হয়েছে কি? বল ইলা।” শেষে ধমক দিয়ে জানতে চাইল সাফাইত। ধমক খেয়ে ইলা গড়গড়িয়ে বলতে লাগল,

” সিয়াম বেশ কয়েকদিন ধরে তোহাকে বিরক্ত করছিল। আজতো সীমা পার করে ফেলেছে।”

” কী করেছে?” গম্ভীর কন্ঠে বলল সে।

” আমরা দু’জন করিডোর দিয়ে আসছিলাম তখন সে কোথা থেকে এসে তোহার হাত ধরে বাজে বাজে কথা বলতে শুরু করেছে। অনেক টানাহেঁচড়া করে তোহা নিজের হাত ছাড়িয়েছে।”

সাফাইত তোহার দিকে তাকাল। সে মনমরা হয়ে ঘাস নাড়াচাড়া করছে৷ একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সাফাইত উঠে দাঁড়াল৷ তাকে চলে যেতে দেখে তোহা ধীর কন্ঠে জানতে চাইল, ” কোথায় যাচ্ছিস? ইশরার কাছে?”

সাফাইত গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,

” কাজ আছে৷ তুই ইশার সাথে ক্লাসে চলে যা।”

তোহা আর কিছু বলল না। আপাতত তার কিছু বলতে ইচ্ছে করছেনা। অপরিচিত একটা ছেলে এভাবে সবার সামনে হাত ধরে টানাহেঁচড়া করেছে, ধাক্কাটা সে এখনো সামলিয়ে উঠতে পারছেনা।

ইশরা ক্লাসে বসে গল্প করছিল। সেসময় একটা মেয়ে দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে তাকে জানাল,

” ইশরা তাড়াতাড়ি চল। সাফাইত ভাই অনেক বড় ঝামেলায় জড়িয়ে গিয়েছে।”

” কি হয়েছে সাফাইতের?”

” কয়েকটা ছেলের সাথে গেটের কাছে মারামারি করছে সাফাইত ভাই। আমি ওদিক আসার সময় দেখলাম।”

মেয়েটার কথা শুনে ইশরা একমুহূর্তও দেরি করল না। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দৌড় লাগাল গেটের কাছে।

সিয়াম নামক ছেলেটির গালে পুনরায় সজোড়ে থা’প্পড় মারল সাফাইত। রাগে গজগজ করতে করতে বলল, ” শা’লা তোর সাহস তো কম না তুই তোহার সাথে অসভ্যতামী করেছিস। আজ তো একেবারে সীমা পার করে ফেলেছিস। ইচ্ছে করছে তোকে জ্যান্ত মাটিতে পুঁ’তে দি। কু** বা** শরীরে অনেক জ্বালা না তোর। তোর জ্বালা আমি আজকে যদি না মিটিয়েছি না।”

মার খেয়েও সিয়ামের মধ্যে কোনরূপ অনুশোচনা কিংবা ভয়ের রেশ দেখা গেল না। বরং সে কুৎসিতভাবে হেসে বলল, ” আমার শরীরে না হয় জ্বালা ধরেছে তাই ওই মেয়ের হাত ধরেছি ফিল নেওয়ার জন্য। কিন্তু তোর এতো জ্বলছে কেন? এতো রাগ করছিস কেন? শুনেছি ওই মেয়ে তোর বন্ধু, তা শুধুই কি বন্ধু নাকি ফ্রেন্ড’স উইথ বেনিফিট? আরে বলতে পারিস কোন সমস্যা নেই। ফাঁকা জায়গা লাগলে আমাকে বলতে পারিস।”

সিয়ামের কুৎসিত কথা শুনে সাফাইতের মাথায় আগুণ ধরে গেল। রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে সিয়ামকে আঘাত করতে লাগল সে। সাফাইতের এধরণের ক্ষিপ্ত রুপ দেখে ঘাবড়ে গেল ইশরা। প্রথমে এগিয়ে আসার সাহস না পেলেও সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে এলো তাকে আটকানোর জন্য৷

” সাফাইত ছেড়ে দাও ওকে৷ ওর রক্তক্ষরণ হচ্ছে আরো মারলে বড় কিছু হয়ে যাবে। ছাড়ো সাফাইত।”

তাকে টানাটানি করতে লাগল ইশরা কিন্তু সাফাইতকে একচুলও সরাতে পারল না সে। একসময় সাফাইত খেয়াল না রেখে ইশরাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিল। যার ফলে সে ছিটকে খানিকটা দূরে সরে গেল। ইশরা এগিয়ে এলোনা, অবাক নয়নে সাফাইতের দিকে তাকিয়ে রইল।

এরইমাঝে কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো তোহা। সে ভার্সিটি পেরিয়ে অর্ধেক রাস্তা চলে গিয়েছিল, ইলার ফোন পেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে পুনরায় ফিরে এসেছে।

” সাফু ছাড় ওকে, মরে যাবে ও। সাফু ছেড়ে দে।”

বেশ কয়েকবার চেষ্টার পরেও যখন তোহা ব্যর্থ হলো তখন উপায় না পেয়ে চড় মেরে বসল সাফাইতের গালে। থমকে গেল সবাই। কিছু মূহুর্ত আগেও জায়গাটা কোলাহলপূর্ণ ছিল মূহুর্তেই তা নীরবতায় ছেঁয়ে গেল৷ তার আচমকিক কাজে সবার সাথে ইশরাও অবাক হলো, সঙ্গে তার খানিকটা রাগও হলো। তবে সাফাইতের মুখভাব পরিবর্তন হলোনা। সে এখনো হিংস্র বাঘের মতো সিয়ামের দিকে তাকিয়ে আছে। তোহা হুংকার দিয়ে বলল,

” এটা ভার্সিটি সাফাইত, তুই এখানের পড়াশোনা করতে এসেছিস গুন্ডামি করতে নয়৷ কে বলেছে তোকে এসব করতে? আমি বলেছিলাম আমার হয়ে লড়তে আয়? বলেছিলাম বল? ওর উল্টাপাল্টা কিছু হলে তোর ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে এটা বুঝতে পারছিস না?”

সাফাইত দাঁতে দাঁত চেপে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। রক্তমাখা থু মাটিতে ফেলে কুৎসিত নজরে তোহার দিকে তাকিয়ে সিয়াম বলল,

” এতোগুলা মানুষ আটকানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। যেই না তোহা এলো ওমনি সরে গেলি। কি ব্যপার গুরু? আমি যা বলেছি তাই না? কি তোহা বন্ধুত্বের নামে ভালোই চললে না? আমিও তো তোমার বন্ধুই হতে এসেছিলাম বিনিময়ে তুমি যদি….” সিয়ামের কুৎসিত চাহনি এবং কথাবার্তায় গা গুলিয়ে এলো তোহার। সে সহ্য করতে না পেরে সজোড়ে চড় মেরে বসল সিয়ামের গালে। মাটিতে একদলা থুতু ফেলে ঘৃণা ভারা কন্ঠে বলল,

” এই থুতু তোর মুখে মারতে পারলে শান্তি পেতাম। তুই নোংরা বলে অন্যজনও নোংরা হবে এই ভাবনা ছেড়ে দে। তোর চরিত্র খারাপ বলে অন্যরাও যে সে পথে হাঁটছে এই ভূল ধারণা থেকে বেরিয়ে আয়। তোদের মতো কুকুরদের সাথে কথা বলতেও আমার রুচিতে বাঁধে।”

সিয়াম থেকে চোখ সরিয়ে সাফাইতের দিকে তাকাল তোহা। দেখল সে হাত মুষ্টি করে দাঁড়িয়ে আছে।

” কুকুর যদি তোকে কামড় দেয় তুইও কি তাকে কামড় দিবি? কেন শুধু শুধু পচা নর্দমা হাত দিতে যাস বলতো? নর্দমা যতই পরিষ্কার করা হোক না কেনো তা থেকে পচা গন্ধ আসবেই। কেন নর্দমায় গিয়ে নিজেকে দূষিত করছিস? চল এখান থেকে।”

সাফাইতে টেনে নিয়ে গেল তোহা। সিয়ামকে কয়েকটা ছেলে মিলে ব্যান্ডেজ করাতে নিয়ে গেল। আস্তে আস্তে জায়গাটাও ফাঁকা হতে লাগল। তবে ইশরা এখনো সেই জায়গায় মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাবতেও পারছেনা সাফাইত তাকে খেয়ালই করেনি৷ সাফাইতের এই হিংস্র রুপ, এধরণের ব্যবহার দেখে সে একপ্রকার ঘোরে চলে গিয়েছে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here