দ্বিতীয়_সূচনা পর্ব-১০

0
1842

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_১০
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

মুখোমুখি বসে আছে ফারহান এবং অয়নন্দিতা। বেশ অস্বস্তি হচ্ছে অয়নন্দিতার। এভাবে কোনো পুরুষ মানুষের সঙ্গে এর আগে কখনও রেস্টুরেন্টে বসেনি সে। মূলত এটাই অস্বস্তির কারণ। ফারহান ম্যানুকার্ড দেখছে আর অয়নন্দিতা আড়চোখে ফারহানকে দেখছে। ভাবছে, এই লোকটার মতলব কী হতে পারে? এই লোক কেন তাকে এখানে নিয়ে এলো? লোকটাকে একটু সন্দেহও হয় তার।
ফারহান ম্যানুকার্ড দেখে কনফিউজড। ঘড়িতে একবার নজর দিলেন প্রায় দুটো বাজতে চলল। বলা যায় এখন লাঞ্চ আওয়ার। লাঞ্চ আওয়ারে কফি খেলে ব্যাপারটা জমবে না। লাঞ্চ করাই অতি উত্তম। কিন্তু কী খাবে, কী অর্ডার করবে সেটা নিয়েই কনফিউজড সে। নিজের জন্য হলে সে চাইনিজ অর্ডার করে দিত কিন্তু সাথে আছে আরেকজন। একে তো অপরিচিত, যদিও পরিচিত কিছুটা। তার উপর সোনায় সোহাগা হবু বউ। তিনি কী খাবেন কে জানে।
ম্যানুকার্ড অয়নন্দিতার দিকে এগিয়ে দিতে-দিতে বলল, ‘এইযে মিস অয়নন্দিতা, কী খাবেন দেখুন। দেখে অর্ডার করুন।’
‘আমি বাসায় গিয়ে খাব। আপনি আপনার মতো অর্ডার করুন।’
এই মুহুর্তে অয়নন্দিতাকে গবেট মনে হচ্ছে। যদিও কাউকে মুখের উপরে গবেট বলা সাজে না তাই চুপ হয়ে যায় ফারহান। নিজেকে যথেষ্ট সংযত রেখে বলল,
‘এখন তো আর সকাল নেই। এখন লাঞ্চ আওয়ার। রেস্টুরেন্টে বসেছি। লাঞ্চ না করে কফি খেলে লোকজন বলবে আমি গরীব। মেয়ে পটানোর জন্য রেস্টুরেন্টে ঢুকিয়েছি।’
‘কোন লোকজন বলবে এইসব ফালতু কথা।’
‘বলবে বলবে। কত লোকজন আছে বলার। এদের খালি চোখে দেখা যায় না। অণুবীক্ষণযন্ত্র লাগে এদের দেখতে।’
‘এইসব কী বলেন আপনি?’
‘চাইনিজ খান আপনি?’
‘জি।’
‘ওকে। তাহলে নো কথাবার্তা। চাইনিজ অর্ডার করে দেই।’
ফারহান খাবার অর্ডার দিয়ে অয়নন্দিতার দিকে তাকায়। মেয়েটা ভীষণ অস্বস্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। নাকের নিচের দিকটা ঘেমে গেছে। অয়নন্দিতার ভয় দেখে ফারহানের বেশ ভালোই লাগছে। গলায় সামান্য খাকাড়ি দিয়ে ফারহান বলে ওঠে,
‘আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি ভয় পাচ্ছেন।’
‘নাহ তো। ভয় কেন পাব?’
‘মনে হচ্ছে।’
ফারহানের এমন প্যাচানো কথা অয়নন্দিতার বুঝে আসছে না। সে বুঝতেও চায় না। বার কয়েক ঢোক গিলে ফারহানের দিকে তাকায় অয়নন্দিতা। ফারহান তখন জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। অয়নন্দিতা ভাবছে তাকে বলতে হবে। বলতে হবে যে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। হুট করেই সব ঠিক হয়েছে। ফারহান পানি খেতে-খেতে অয়নন্দিতাকে প্রশ্ন করে,
‘কিছু নিয়ে ভাবছেন নাকি?’
অয়নন্দিতা মুখ তুলে তাকায় ফারহানের দিকে।
‘নাহ তেমন কিছুই ভাবছি না।’
‘মনে হচ্ছে ভাবছেন।’
‘আপনার কি সবই মনে হয়?’
‘সব মনে হয় না। কিছুটা মনে হয়।’
‘আপনাকে একটা কথা বলা হয়নি।’
‘বলে ফেলুন।’
‘আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।’
‘তাই নাকি! এত দ্রুত?’
‘জি। ট্যুর থেকে যেদিন এলাম। তার পরদিনই মেহমান এসেছিলেন। এরপর কথা বলে ডেট ফিক্সড হলো।’
‘দাওয়াত দেওয়ার ভয়ে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। আপনি তো দেখছি বেশ কিপটা।’
‘জি না। সেইসব কিছুই না।’
‘আপনার বর কী করেন?’
‘শুনেছি ব্যবসা করেন। পারিবারিক ব্যবসা।’
‘নাম কী। ছবি আছে?’
এটাই তো মুশকিল। অয়নন্দিতা তো নাম জিজ্ঞেস করেনি। আর ছবিও তো নেই। এমনিতে মামার কাছ থেকে শুনেছে ছেলে নাকি বেশ স্মার্ট। তবে বয়স একটু বেশি। এই মুহুর্তে মাথায় যেটা এসেছে সেটাই বলে দেয় অয়নন্দিতা।
‘ছবি তো নেই। নামও জানি না। তবে মামা দেখেছেন। মামা বলেছেন, যাকে দেখেছে তিনি স্মার্ট আছেন। তবে বয়স একটু বেশি। অনেকটা আপনার মতো।’
অয়নন্দিতার কথা শুনে ফারহানের কাশি উঠে যায়। অয়নন্দিতা এটা কী বলল? বয়স বেশি! একটু বেশি! তাও তার মতো! তার মানে কি, তার বয়স বেশি!
‘এক্সকিউজ মি, আমাকে দেখলে বোঝা যায় যে আমার বয়স বেশি।’
‘একটু বেশি বলেছি।’
‘ওই একটুই কি বেশি নাকি?’
‘ভুলেও বরের সামনে বলতে যাবেন না যে তার বয়স বেশি। নয়তো কানের নিচ বরাবর মারবে।’
‘গায়ে হাত তুলবে?’
‘তুলতে কতক্ষণ।’

খাবার খেয়ে অয়নন্দিতাকে নিয়ে বের হয় ফারহান। পরবর্তী প্ল্যানিং অয়নন্দিতাকে নিয়ে শপিংয়ে যাবে। পছন্দ মতো কিছু কিনে দেবে। কিন্তু তা আর হলো না। অয়নন্দিতা এত জেদ ধরেছে। সে বাসায় যাবে। যাবে মানে যাবেই যাবে। অয়নন্দিতার জেদের কাছে হার মানতে হয় ফারহানকে।
গাড়ি অয়নন্দিতার বাসার সামনে এসে দাঁড়াতেই ফারহান অয়নন্দিতাকে বলতে শুরু করে,
‘অয়নন্দিতা, আপনাকে একটা কথা বলতে চাই আমি?’
‘জি বলেন।’
‘আমি বিবাহিত। সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন না বন্দনা কে? বন্দনা আমার স্ত্রী। যদিও সে,,,
হঠাৎই ফোন আসে ফারহানের। ফোন রিসিভ করেই কথা বলে সে। মিনিট দুয়েক পর ফোন রেখে অয়নন্দিতার দিকে তাকায় সে।
‘আজ আর পুরোটা বলতে পারলাম না। যদি কখনও সময় হয় বলব। সবটা বলব৷ তখন বলবেন না যেন, যে আমি কথা লুকিয়েছি। আজ আসি।’
অয়নন্দিতা একটু চিন্তিত। চিন্তিত একটা কথা ভেবে। ফারহান বিবাহিত এটা তাকে জানানোর কী আছে৷ আর এখানে বলাবলির কী আছে। অয়নন্দিতা গাড়ি থেকে নামতেই ফারহান আরও একবার ডাক দেয় অয়নন্দিতা বলে। অয়নন্দিতা পেছনে তাকায়।
‘জি বলেন।’
‘বাসায় গিয়ে মামাকে জিজ্ঞেস করবেন আপনার বরের নাম কী? এরপর আমায় জানাবেন।’
অয়নন্দিতার কথার অপেক্ষা না করেই ফারহান তার গাড়ি স্টার্ট দেয়।
এদিকে অয়নন্দিতা কনফিউজড। ভাবছে, এই লোকের কি মাথায় সমস্যা আছে নাকি। সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অয়নন্দিতা। আজ মা-বাবাকে ভীষণ মনে পড়ছে তার। আজ হয়তো বাবা-মা বেঁচে থাকলে মামা-মামীকে তার বিয়ে নিয়ে ভাবতে হতো না। মনটা ভালো নেই, তারউপর আরও অবাক হয়েছে এটা শুনে যে, তার বরের নাম ফারহান। ফারহান শেখ৷ অয়নন্দিতা বুঝে সবটা গেছে। সেদিন ফারহানের বলা প্রতিটা কথার অর্থ এখন বুঝতে পারছে অয়নন্দিতা। তার মনে হচ্ছে, ফারহান হয়তো জেনে বুঝেই সবটা বলে গেছে তাকে। তার জন্যই বলেছে বরের নাম জিজ্ঞেস করতে।
‘লোকটা কত সাসপেন্স রেখে চলাফেরা করে।’
বলেই নিজের অজান্তে হেসে ওঠে অয়নন্দিতা। কিন্তু সে যে বিবাহিত এটা কি তার মামা আর ভাই জানে? জেনে শুনেই কি তবে একজন বিবাহিত লোকের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করে দিল? এতিম বলেই কি এই ভেদাভেদটা করে দিল?
পরমুহূর্তেই তার ভাবনায় আসে,
‘নাহ। মামা-মামী কখনও তো ভেদাভেদ করেনি। হয়তো ভেবেছে আমি এখানেই ভালো থাকব। হোক না বিবাহিত। ক্ষতি কি?
মনে পড়ে বন্দনার কথা। আচ্ছা বন্দনা কোথায়? সে কি মারা গেছে?
ফারহানকে এতটাও খারাপ লাগেনি অয়নন্দিতার। জীবনসঙ্গী হিসেবে সে সব দিক থেকেই পারফেক্ট। তার কথা বলার ভঙ্গীমা ভালো লাগে। সব দিক থেকে ভালো মনের মানুষ বলেই মনে হয়। ভাবছে, আল্লাহ পাক কী খেলাটাই না খেলেন৷ যেই মানুষটার সাথে প্রথম পরিচয় ব্যথার মাধ্যমে। কিছুদিন পর সেই মানুষটাই সারাজীবনের দায়িত্ব নিতে চলেছে। অবাক লাগে আল্লাহ পাকের লীলাখেলা দেখলে। বিয়েতে না করার মতো কোনো কারণ নেই অয়নন্দিতার। কোনো পিছুটানও নেই। যেখানে পিছুটান নাই সেখানে চলতেও বাধা নেই।
ফারহানের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করতেছে অয়নন্দিতার। কিন্তু ফোন নাম্বার নেই। মামা কিংবা হাসানের কাছে চাইলেই নাম্বার পাওয়া যায় কিন্তু সে চাইবে না। চট করেই মাথায় বুদ্ধি আসে, ফেসবুক। আইডি তো অবশ্যই আছে। একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে।
অয়নন্দিতার বেশি কষ্ট করতে হয়নি। শরীফের আইডিতে গিয়েই ফারহানের আইডি খুঁজে পেয়ে যায়। প্রোফাইল পিকচারে থাকা ছবিটা মাশা-আল্লাহ। ফারহানকে কালোতে বেশ মানায়। টাইমলাইন পাবলিক করা। টাইমলাইন ঘুরে রীতিমতো অবাক হয় অয়নন্দিতা। সোস্যাল সাইটে ফারহানের বেশ ভালো পরিচিতি আছে। ফারহান আর্টিকেল লেখে কয়েকদিন পর পর। সেই আর্টিকেলে বেশ ভালো রেসপন্স। টাইমলাইন স্ক্রল করতে গিয়ে একটা আর্টিকেলে চোখ আটকে যায় অয়নন্দিতার।
“স্বার্থপরতা,
ছেলেটা মেয়েটাকে নিখাদ ভালোবেসেছিল। তার ভালোবাসাকে পরিমাপ করার মতো কোনো যন্ত্র হয়তো এই দুনিয়ায় নেই। নিজের সব কিছু উজাড় করে দিয়ে তার ভালোবাসার জানান দিয়েছিল। কিন্তু একদিন সব বন্ধন ছিন্ন করে মেয়েটা উড়াল দিল। এতটাই দূরে চলে গেল যে ছেলেটা মেয়েটাকে আর খুঁজে পেল না। তারপর থেকেই ছেলেটা সৃষ্টিকর্তার কাছে মুক্তি চাইত। মুক্তির নেশায় পাগলাটে ছেলেটা নিজেকে শেষ করার সম্পূর্ণ ব্যবস্থাও করে ফেলে। কিন্তু মুক্তি নেওয়া আর হয়নি। অবশেষে সৃষ্টিকর্তা নিজেই তাকে মুক্তি দিয়ে দিলেন। ছেলেটা আজও তার সেই নিখাদ ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে আছে। মিথ্যা আশায় বুক বেধেছে।”

পড়ে কখন যে চোখ জোড়া বেয়ে খানিকটা পানি পড়ে যায় তা অয়নন্দিতা নিজেও জানে না। মনের অজান্তেই আর্টিকেলে একটা রিয়্যাক্ট দেয়। তার ঠিক পাঁচ মিনিট পরেই অয়নন্দিতার মেসেজ রিকুয়েষ্ট থেকে নোটিফিকেশন আসে।
অয়নন্দিতা এবার আর অবাক হয়নি। মেসেজ রিকুয়েষ্ট চেক করে দেখে ফারহানের আইডি থেকে মেসেজ এসেছে।
‘অনলাইনে আমায় খুঁজে পেতে এতটা সময় লেগে গেল? তবে আমি শিওর ছিলাম, আমায় খুঁজে নেবেন আপনি। মিলেও গেল।’
মেসেজটা দেখে অয়নন্দিতা মুচকি হেসে দেয়।

চলবে……………………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here