- #দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_১১
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)মামার চেঁচামেচি শুনে পাশের ঘর থেকে বের হয়ে আসে অয়নন্দিতা। সাথে হাসানও আছে। সেই সাথে আছে যে প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল সেই লোক। তাদের কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে ফারহান যে বিবাহিত এটা তারা আগে জানত না। হাসানও বেশ ক্ষেপে গেছে। সে লোকটাকে বলছে,
‘আপনি আমার বাবার বয়সী বলে কিছু বললাম না। আপনি আমাদের আগে কেন জানান নাই যে, ছেলে বিবাহিত। আগে বিয়ে করেছে একটা। আপনার কী মনে হয় আমরা টাকার খাইস্টা? যে টাকা দেখে বোনকে ঠেলে দিয়ে দিব।’
খাইরুল সাহেব বললেন,
‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করছিলাম ভাই। এটা কী করলেন? বিয়ের আর কয়েকদিন বাকি আর এখন আমার ছেলে জানতে পারে যে, ছেলের আগেও একটা বিয়ে হয়েছে। এটা কোনো কথা?’
লোকটা মাথা নিচু করে বসে আছে। আয়শা বেগমও সামান্য উত্তেজিত। এতক্ষণে তিনিও মুখ খুললেন,
‘ভাই, আপনি অয়নিকে দেখেছেন? আমার ভাগনি লাখে একটা। কোনোদিনও ওর নামে কিছু শুনছেন? ননদের মেয়ে বলে আমি ওরে এতটুকুও অবহেলা করিনি। এইযে আমরা ওর বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলাম, মেয়ে আমার উচ্চবাচ্য করে নাই। চুপচাপ মেনে নিয়েছে। এখন যদি শুনে ছেলে বিবাহিত, তাহলে ভাববে মামা-মামী হয়তো ইচ্ছা করেই ওকে এমন জায়গায় দিয়েছে। এটা কী করলেন ভাই? টাকা দিয়ে কী হয় ভাই?’
লোকটা কাচুমাচু স্বরে বলতে শুরু করলেন,
‘ভাবী, তারা মানুষ ভীষণ ভালো। আর আমিও জানি অয়নি মা কতটা ভালো মেয়ে। তাই তো,,,।’
হাসান চট করেই জবাব দেয়,
‘তাই আপনি ভেবেছেন বিয়াত্তা ছেলের সঙ্গে ওরে জুড়ে দেওয়া যায়। তাই না চাচা?’
‘বাবা, ভুল বুঝতেছ। আমিও চাই অয়নি মা ভালো থাকুক।’
‘এখন যদি বোন শোনে, তাহলে ওরে কীভাবে বোঝাব। এদিকে বিয়েটা ক্যান্সেল করাও কি পসিবল?’
খাইরুল সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
‘ভাই, আপনি তাদের বারণ করে দেন। বিয়ে হবে না। আমরা রাজি না। আর তাছাড়া তারাও মিথ্যুক। তারাও আমাদের কাছ থেকে লুকিয়েছে।’
‘নাহ ভাই। তাদের মিথ্যুক বলবেন না। তারা জানত যে আপনারা সব কিছুই জানেন। তারা আগেই আমাকে বলেছিল আমি যেন আপনাদের সব বলি। দোষটা আমারই। আমিই বলি নাই।’
‘যাই হোক। বিয়ে হবে না। তাদের না করে দেন।’
অয়নন্দিতা সব কিছুই বুঝতে পারে৷ একটা লোক বিবাহিত বলে যে সে অবিবাহিত মেয়ে বিয়ে করতে পারবে না এমন কোনো রীতি কোথাও নেই। আবার একজন বিবাহিত মেয়ের যে অবিবাহিত ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে না সেই রীতিও কোথাও নেই। তবে ভেদাভেদ কেন হবে। এটা অন্যায়। আবার খাইরুল সাহেব সহ বাকিদের রাগ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। তাদের জানানো হয়নি। তারা আগে থেকে জানলে হয়তো তখনই না করে দিত। অয়নন্দিতা বুঝতে পারছে যে এই বিয়ে উপলক্ষে তার মামার বেশ টাকা খরচ হবে যদিও তার বাবা-মা তার জন্য কিছু রেখে গেছেন। পাড়ায় মোটামুটি সবাই জানে যে, দশ তারিখ বিয়ে। কিন্তু এখন যদি শোনে যে, বিয়ে হবে না। বিয়ে ভেঙে গেছে। তাহলে, অনেকেই বাড়ি বয়ে এসে কথা শোনাবে। এসব ঝামেলা পোহাতে হবে আয়শা বেগম, খাইরুল সাহেব এবং হাসানকে। অয়নন্দিতা চায় না এরা কেউ মানুষের কটু কথা শুনুক। তাছাড়া ফারহানকে তার ভালো লেগেছে। আর ফারহান যে বিবাহিত এটা সে আগেই তাকে জানিয়ে দিয়েছে। বিয়েতে আর কোনো আপত্তি নেই। অয়নন্দিতা খাইরুল সাহেব সহ সবার সামনে এসে দাঁড়ায়। তাকে দেখে হাসান বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তারা বুঝেছে যে, অয়নন্দিতা সব শুনেছে। হাসান হালকা হেসে বলে,
‘এর থেকেও ভালো প্রস্তাব আসবে অয়নি। তুই চিন্তা করিস না। মন খারাপ করিস না।’
লোকটা বিদায় নিতে চাইলে অয়নন্দিতা তাকে বসতে বলে। এরপর ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়ায়। মামা-মামীর মুখের দিকে তাকায় অয়নন্দিতা। খাইরুল সাহেবের মুখে অসহায়ত্বের ছাপ। অয়নন্দিতা তার মামাকে বলল,
‘মামা, এই বিয়েতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আপনারা বিয়ের আয়োজন করেন। উনি বিবাহিত নাকি অবিবাহিত এইসব নিয়ে আর কথা না হোক।’
খাইরুল সাহেব, আয়শা বেগম, হাসান এরা তিনজনই অবাক। তারা যেই কারণে বিয়েতে না করে দিল। সেই কারণ নিয়ে অয়নন্দিতার আপত্তিই নেই। আয়শা বেগম বললেন,
‘অয়নি, মা তুই চিন্তা করিস না। আমরা এগুচ্ছি না আর।’
‘নাহ মামী। বিয়ের অর্ধেক আয়োজন শেষ। ওখানেও হয়তো আয়োজন চলছে। এখন যদি না করে দেওয়া হয় ব্যাপারটা বাজে দেখায়। আর তাছাড়া এই এলাকার মানুষও ভাববে আমার দোষ আছে। তাই বিয়ে ভেঙে গেছে। আমি নিশ্চয়ই চাইব না আমার জন্য আমার মামা-মামী, ভাই কথা শুনুক। আমার আপত্তি নেই।’
খাইরুল সাহেব অস্পষ্ট স্বরে বললেন,
‘অয়নি, মা রে।’
অয়নন্দিতা মামার সামনে এসে দাঁড়ায়। হাটু গেড়ে বসে।
‘মামা, ওনাদেরও তো দোষ নেই। হয়তো তারা জেনেছিল যে, আমাদের জানানো হয়েছে। এখন, ব্যাপারটা চাচা না জানালে তো তাদের দোষ না এটা। এ নিয়ে আর কথা না বাড়ানোই ভালো। আপনারা বিয়ের আয়োজন করুন।’
আয়শা বেগম বললেন,
‘কিন্তু মানুষ যখন শুনবে তখন তো উল্টো কথা বলবে।’
‘কী বলবে মামী? বলবে যে, মেয়ের বাপ-মা নাই দেখে মামা-মামী এমন জায়গায় বিয়ে দিয়েছে। এইটুকুই তো বলবে, তাই না? আমায় উষ্কাবে। দেখি না, কত উষ্কাতে পারে। এইসব নিয়ে ভেব না। বাদ দাও। বিয়ের বাকি আয়োজন করো।’
হাসান কিছু বলতে যাবে তখনই অয়নন্দিতা ভাইয়ের হাতটা ধরে।
‘আই এম ফাইন ভাইয়া। ট্রাস্ট মি। আই এম ফাইন। প্লিজ, বিয়েটা ভেঙে দিও না। আমি রাজি এই বিয়েতে। ব্যবস্থা করো। আর তোমার বউটাকে নিয়ে এসো। আর তো মাত্র এক সপ্তাহ। সে এসে আমার সঙ্গে শেষবারের মতো ঝগড়া করে নিক।’আত্মীয়স্বজন তেমন নেই। অয়নন্দিতার দুই খালা আর অন্য দুই মামা আর তাদের পরিবার এসেছেন। অয়নন্দিতার চাচা এবং ফুপুদের বলা হয়েছে। তারা বলেছেন, তারা আসলে বিয়ের অনুষ্ঠানে আসবেন। এর বেশি তেমন কথা বলেননি। অয়নন্দিতাও চায় না তারা আসুক। তাদের সঙ্গে হিসাবটা সে পরে বুঝে নিবে।
এখন টুকটাক ঘরের সব কাজই করে মিলি। হাসান একটু অবাক মিলির আচরণে। বাপের বাড়িতে কয়েকদিন থেকে এখানে আসার পর অনেকটাই বদলে গেছে সে। আগে যেখানে ভাতের প্লেটটাও সরিয়ে রাখত না এখন সব কাজ একা হাতে করে। আত্মীয়স্বজনদের খেয়াল রাখা থেকে শুরু করে রান্নাবান্নাতেও তার হাত পাকা। আরও অবাক করা কান্ড হচ্ছে সে এখন হাসানের সঙ্গেও উচ্চস্বরে কথা বলে না। জি, হ্যাঁ, ওহ, আচ্ছা এইসবের মাঝেই উত্তর দিয়ে দেয়।
আয়শা বেগম, খাইরুল সাহেব দু’জনেই বেশ অবাক মিলির আচরণে। মিলি আগে অয়নন্দিতাকেও দেখতে পারত না। সেই মিলি এখন অয়নন্দিতার খাবারটা পর্যন্ত তার ঘরে দিয়ে আসে। অয়নন্দিতাও বেশ অবাক। সে ভেবেছিল বিয়ের কথা শুনে সর্বপ্রথম খোঁচাটা তাকে মিলিই মারবে। হয়তো বলবে, বাহ বাহ, বড়োলোক জামাই পাইছ অবশেষে। কিন্তু নাহ, মিলি এইসব কিছুই বলেনি।
সব কাজ শেষ করে গোসল করে আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে চুল শুকাচ্ছে মিলি। হঠাৎ হাসানের ফোন বেজে ওঠে। দুইবার রিং হওয়ার পর মিলি ফোনের দিকে তাকায়। হাসান তখন বাথরুমে। আগে হাসানের ফোন বিনা কারণেই ঘাটত মিলি। এখন হাসানের ফোনে বিনা কারণে হাত পর্যন্ত দেয় না। উল্টো হাসান মিলির ফোন ঘাটলেও মিলি কিছুই বলে না। হাসান ভাবে এটা তার বউ না। অন্য কেউ মিলি সেজে এই বাড়িতে এসেছে৷
ফোন হাতে নিয়ে দেখে একটা নাম্বার। বাথরুমের সামনে গিয়ে দরজা নক করে মিলি।
‘হাসান, এই হাসান।’
‘হ্যাঁ বলো।’
‘ফোন আসছে দুইটা।’
‘কে ফোন করেছে?’
‘চিনি না। একটা নাম্বার। সেভ করা নাই তো।’
‘রিসিভ করে কথা বলো।’
‘তুমিই বলো।’
‘তুমি রিসিভ করো মিলি।’
‘এখনও কী শাওয়ার নিতেছ তুমি? এতক্ষণ লাগে?’
‘বাই দ্যা ওয়ে মিলি, একটা কথা বলি?’
‘বলো।’
হাসান টাওয়াল প্যাচিয়ে বাথরুমের দরজা খুলে দাঁড়ায়। মিলির হাত ধরে ঘুরিয়ে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নেয়। মিলির চুলগুলো সরিয়ে বলে,
‘চলো একসঙ্গে শাওয়ার নেই।’
‘মাথা নষ্ট হয়ে গেছে নাকি। ছাড়ো আমায়। আমার শাড়িটা ভিজে যাচ্ছে। আর দেখ কে ফোন করেছে?’
এরই মধ্যে আবারও ফোন আসে। হাসান ইশারায় মিলিকে বোঝায় যেন মিলি ফোনটা রিসিভ করে। সে এখন ব্যস্ত। সে তার বউকে আদর করবে। মিলি চোখ তাড়া মুখ তাড়া দিয়েও লাভ হয়নি। ততক্ষণে হাসান তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে। মিলি ফোন রিসিভ করে।
‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?’
ফোনের অপরপাশ থেকে জবাব আসে,
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। এটা হাসান সাহেবের নাম্বার না?’
‘জি। এটা হাসান সাহেবের নাম্বার। আমি ওনার ওয়াইফ বলছিলাম।’
‘ওহ আচ্ছা। হাসান সাহেব কি আশেপাশে আছেন?’
‘নাহ। ও তো শাওয়ার নিচ্ছে। আপনার পরিচয়টা জানতে পারি। তাহলে আমি হাসানকে বলব।’
‘আমাকে আপনিও চেনেন। চেনেন বলতে নাম শুনেছেন।’
‘জি, মানে!’
‘আমার নাম ফারহান।’
‘ফারহান,,,!’
মিলির মুখে নামটা শুনে হাসান মিলিকে ছেড়ে দেয়। একটু ইতস্তত হয়ে মিলির কান থেকে ফোন সরিয়ে নাম্বার চেক করে। নিজের উপর এখন বিরক্ত হয় হাসান। ফারহান তাকে গতকালকেও ফোন করেছিল কিন্তু সে মনের ভুলে নাম্বারটা সেভ করেনি। আর কিছুক্ষণ আগে সে মিলিতে ডুবে থাকায় নাম্বার দেখেনি।
হাসান মিলিকে কথা বলার জন্য ইশারা করে। মিলিও ইশারা বোঝে।
‘জি ফারহান ভাই। বলেন। এখন চিনতে পেরেছি। ভালো আছেন আপনি?’
‘জি আমি ভালো। আপনারা ভালো আছেন?’
‘জি আমরাও ভালো। আচ্ছা, আই এম এক্সট্রিমলি সরি। আমি চিনতে পারিনি তখন।’
‘ইটস ওকে। আচ্ছা, হাসান সাহেবের কতক্ষণ লাগতে পারে?’
‘একটু সময় লাগবে। কোনো প্রয়োজন। আমায় বলতে পারেন।’
‘একচুয়ালি আমার একজনের নাম্বার লাগত।’
‘জি কার নাম্বার বলেন। বাবার মাকি মায়ের?’
‘নাহ নাহ। আংকেলের নাম্বার আছে আমার কাছে। অয়নন্দিতার নাম্বারাটা লাগত একটু।’
মিলি হালকা হেসে বলে,
‘ওহ আচ্ছা। ঠিকাছে। আমি আপনার নাম্বারে টেক্সট করে দিচ্ছি। একটু অপেক্ষা করুন।’
‘অয়নন্দিতা কি বাসায় আছেন?’
‘জি জি। ও বাসাতেই। ঘুমোচ্ছে। সমস্যা নেই। আমি নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি।’
‘ধন্যবাদ।’
মিলি হেসে বিদায় নেয়। আর রাগান্বিত চোখে হাসানের দিকে তাকায়।
‘বোকা নাকি তুমি? নাম্বার সেভ করোনি কেন?’
‘একদম ভুলে গিয়েছিলাম। সব দোষ তোমার?’
‘আমি কী দোষ করলাম?’
‘এমন ভেজা চুলে সামনে এসে দাঁড়াও কেন? জানো না আমার কেমন কেমন লাগে।’
‘হাসান, তুমিও না।’
হাসান ঠোঁট বাঁকিয়ে মুচকি হেসে মিলিকে জড়িয়ে ধরে বাথরুমের দরজা আটকে দেয়।তিন থেকে চারবার ফোন বাজার পর ঘুম ভাঙে অয়নন্দিতার। রাতের বেলা এত সুন্দর ঘুম হবার পরেও দিনের বেলায় এত ঘুম কীভাবে যে আসে, আল্লাহ পাক জানেন। অপরিচিত নাম্বার বলে আমলে নেয়নি অয়নন্দিতা। চোখ বুজতেই আবার ফোন বেজে ওঠে। এবার সত্যিই বিরক্ত অয়নন্দিতা। ফোন রিসিভ করে সে।
‘হ্যালো, কে বলছেন?’
গলা খাকাড়ি দেয় ফারহান। বলে,
‘এই পড়ন্ত বিকেলে ঘুমোচ্ছেন কী করে?’
‘কে আপনি?’
‘ফারহান বলছি।’
ফারহান নামটা শুনেই অয়নন্দিতার ঘুম দৌড়ে পালিয়ে যায়। শোয়া থেকে উঠে বসে সে। অয়নন্দিতা ভাবছে, তার নাম্বার কোথায় পেয়েছে কোথায়? তাই সরাসরি প্রশ্ন করে,
‘আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?’
‘কেমন আছি জিজ্ঞেস না করে নাম্বার কোথায় পেয়েছি প্রশ্ন করছেন। অদ্ভুত।’
‘সরি। কেমন আছেন?’
‘ভালো। আপনি?’
‘ভালো আছি।’
‘শুনলাম দু’হাত ভর্তি মেহেদী দিয়েছেন। মেহেদীতে রঙ এসেছে?’
অয়নন্দিতা এবার নড়েচড়ে বসে। গতকাল তার মেহেদী অনুষ্ঠান হয়েছিল। দুই হাতে মেহেদী পরেছে সে। সেই মেহেদীতে আজ গাঢ় রঙ এসেছে। কিন্তু এতকিছু ফারহান অবধি কে পৌঁছেছে। ভাবতে শুরু করে সে। তার ভাবনার শেষ হয় গতকাল রাতে গিয়ে। হ্যাঁ, গতকাল অনুষ্ঠানে সাজি এসেছিল। ফারহানের ছোটো বোন। সাজিকে নিয়ে যেতে ফারাশ এসেছিল। ফারাশ ফারহানের ছোটো ভাই। যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে সাজি আর ফারাশ তার সঙ্গে আড্ডা দিয়েছে। তার মানে সাজি গিয়েই তার ভাইকে বলেছে। অয়নন্দিতা হালকা হাসে।
‘রঙ হয়েছে কি না নিজে এসে দেখে গেলেই তো পারতেন।’
‘আপনি কি চান আমি আসি?’
‘আমি চাইলেই বা কি? আমার সেই চাওয়াকে কয়জন পাত্তা দেয় বলেন। আমার নিজের বাবা-মা-ই তো আমার চাওয়াকে পাত্তা না দিয়ে চলে গেল। তাই এখন আর নিজস্ব কোনো চাওয়া পাওয়া নেই।’
‘ফোন হাতে নিয়ে বসার ঘরে যান।’
‘এখন?’
‘হ্যাঁ। এখন।’
বসার ঘরে অনেকেই বসে আছে। অয়নন্দিতা ঘুম চোখে ফোন কানে বসার ঘরে যায়। চুল গুলো ছাড়া। হলুদ রঙের থ্রিপিস পরা অয়নন্দিতার রুপ যেন চুঁইয়ে পড়ছে। দু’হাত লাল রঙা মেহেদীতে রঙিন হয়ে আছে। সবাই তখন চা খাচ্ছে। বসার ঘরে পা রাখতেই অয়নন্দিতার দিকে সবার চোখ পড়ে। অয়নন্দিতা বোকার মতো সবার দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই অয়নন্দিতার রুপের প্রশংসা করতে ব্যস্ত। কয়েকজন আবার মাশা-আল্লাহও বলে ফেলেছে৷ এদিকে আয়শা বেগম অয়নন্দিতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন,
‘কী ব্যাপার। আম্মাজানের ঘুম ভেঙেছে। আগামীকাল হলুদ। প্রিপারেশন নিতে হবে না?’
ফারহান ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে হাসছে। অয়নন্দিতা সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ফারহানের হাশির শব্দ কানে লাগতেই তার বুকটা ধক করে ওঠে।
‘আপনি হাসছেন যে?’
‘আগামীকাল হলুদ সন্ধ্যা। আপনি কি জানেন, আগামীকাল আমরা দু’জন একত্রিত হবো?’
‘জানি। বলা হয়েছে আমায়।’
‘দ্যাটস গুড।’
‘আমায় বসার ঘরে আসতে বলার কারণ কি?’
‘এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত গুনবেন। জোরে-জোরে গুনবেন যেন আমি শুনতে পাই।’
‘মানে কী?’
‘স্টার্ট করেন।’
অয়নন্দিতাও সবার সামনে এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত গুনতে শুরু করে। মিলি পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে। মিলির পাশে দাঁড়িয়ে আছে রত্না। চাপা হেসে মিলিকে জড়িয়ে রেখেছে সেও। এদিকে সবাই অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে অয়নন্দিতার দিকে। অন্যদিকে হাসান প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাসানও হাসছে।
অয়নন্দিতা পাঁচ বলার সঙ্গে-সঙ্গে ডোরবেল বেজে ওঠে। ডোরবেলের শব্দে অয়নন্দিতা ভড়কে যায়। ফোন কানে নিয়েই সে প্রশ্ন করে,
‘কেউ হয়তো এসেছে।’
ফারহান বলে,
‘খুলে দেবেন না? দেখেন কে এসেছে?’
হাসানও পাশ থেকে বলে ওঠে, অয়নি দরজাটা খুলে দেখ তো কে এসেছে। আয়শা বেগম অয়নন্দিতাকে খুলতে না দিয়ে নিজে খুলতে গেলে মিলি তাকে চেপে ধরে।
‘আপনি কেন যাচ্ছেন মা। অয়নি তো দাঁড়িয়েই আছে সে-ই খুলে দিক। অয়নি খুলে দাও দরজাটা।’
অয়নন্দিতা ফোন হাতে নিয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলে অয়নন্দিতা এতটাই চমকে যায় যে, তার মুখ থেকে কথা পর্যন্ত বের হয়নি। ফারহান, স্ব-শরীরে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ফারহানকে এখানে এভাবে কেউ আশা করেনি। আর অয়নন্দিতা, সে তো ভুলেও আশা করেনি। অন্যরা সবাই যখন জামাই দেখতে ব্যস্ত অয়নন্দিতা তখন ভাবনার ঘোরের মধ্যে আছে। অন্যান্য সবাই বলাবলি করছিল, জামাই দেখি বিয়ের আগেই হাজির। মাশা-আল্লাহ জামাই তো না যেন রাজপুত্র। কেউ কেউ বলছিল, বয়স তো বোঝাই যায় না। কে বলছে বয়স বেশি।
ফারহান তার চোখ থেকে ব্ল্যাক সানগ্লাসটা খুলে অয়নন্দিতার দিকে তাকায়। অয়নন্দিতার চোখ জোড়া তখন মুগ্ধ হয়ে ফারহানকেই দেখছে। ফারহান তখন একবার সবার দিকে তাকিয়ে বাসায় প্রবেশ করে। আয়শা বেগম ভীষণ খুশি। তিনি খাইরুল সাহেবকে ফোন করে বাসায় আসতে বলেন। ফারহানের পেছনে সাজিও আছে। সাজির হাতে একটা বক্স। ফারহান অয়নন্দিতার সামনা-সামনি দাঁড়ায়। অয়নন্দিতা তখনও ঘোরের মধ্যেই আছে। ফারহান ঠোঁট নেড়ে হেসে বলে,
‘মেহেদীতে তো ভালো রঙ এসেছে। তাহলে আমার এখানে আসাটা সার্থক হয়েছে। কী বলেন?’
অয়নন্দিতার চোখের পলক পড়ে।
‘আপনি এখানে!’
‘আপনি চাইলেন। আপনার চাওয়াকে পূর্ণ করে দিলাম।’
না চাইতেও অয়নন্দিতার চোখে পানি। অয়নন্দিতার চোখে পানি দেখে ফারহান খানিকটা বিচলিত। সে ভাবছে, সে কি কোনো ভুল করেছে নাকি যার কারণে মেয়েটার চোখে পানি জমেছে। সাজি পেছন থেকে তার ভাইকে বলছে,
‘ভাইয়া, এটা কি হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে থাকব? ভাবীকে দেবে না?’
সাজির কথায় সবাই আরও চমকে যায়। আয়শা বেগমও অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। মিলি চা নাস্তার ব্যবস্থা করছে। ফারহান সাজির হাতে থাকা বক্সটা খুলে। অত্যন্ত সুন্দর একটা শাড়ি বের করে অয়নন্দিতার শরীরে জড়িয়ে দেয় তাও আবার সবার সামনে। ফারহানের এমন আচরণ দেখে সবার চোখ কপালে। সবার চোখ কপালে হলেও হাসানের চোখ ফোনে। সে এই সুন্দর মুহুর্তটা তার ফোনে বন্দী করে রেখেছে। রত্না পাশ থেকে ছবি তুলছে। অয়নন্দিতার নজর তখন নিচে মেঝের দিকে। শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে গেছে। ফারহানের চোখের দিকে তাকানোর মতো সাহস আর এই মুহুর্তে হচ্ছে না তার। ফারহানের নজর তখন শুধুই অয়নন্দিতাকে দেখছে।
‘আপনার সঙ্গে দেখাটা আমার একদম ভিন্ন হলেও আমাদের জীবন যে একই সুতোয় গাঁথা হবে তা বুঝতে পারিনি। শাড়িটা আমার নিজের পছন্দের। এটা পরেই কালকের অনুষ্ঠানে আমার পাশে আপনাকে দেখতে চাই।’সবার কথার মান রাখতেই ফারহান আর সাজি বসার ঘরে বসে। ফারহানের লাইফস্টাইল অনুযায়ী এখানকার বসারঘর বেশ ছোটো। সোফাটাও তার চোখে একদমই সামান্য। কিন্তু মানুষগুলোর মন অনেক নিষ্পাপ। ফারহান যেখানে-সেখানে বসার মানুষ না। যা তা খায়ও না সে তবুও আজ সে সবার সঙ্গে বসে নরমাল একটা কাপে চা খাচ্ছে। এর একটাই কারণ, এই মানুষগুলোকে ফারহানের মনে ধরেছে।
অতীতের খাতায় যারা ছিল তাদেরও তো এমন করেই ভালোবেসেছিল ফারহান। বিশেষ করে বন্দনা। আজ আর বন্দনা নেই। যদি বন্দনা থেকে যেত তবে হয়তো এদের সঙ্গে আর কোনোদিনও দেখা হতো না। এই কারণে বন্দনাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত কি না ভেবে পাচ্ছে না ফারহান।
পর্দার আড়ালে থেকে অয়নন্দিতা ফারহানকে দেখছে। চুপচাপ বসে চা খাচ্ছে আর সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছে। এই লোকটাকে মনে ধরেছে। ভাবছে, হুট করেই লোকটার জীবনে তার অনুপ্রবেশ ঘটতে চলেছে। অনধিকার চর্চা করতে করতে একদিন অধিকার চর্চাও হয়ে যাবে। সেদিন আর বেশি দূরে নয়।
ফারহান সবার সঙ্গে কথা বলার মাঝখানেই কী মনে করে যেন সামনের দিকে নজর দেয়। আর তখনই অয়নন্দিতা পর্দার আড়াল থেকে সরে যায়। ফারহান বুঝতে পেরে মুচকি হেসে চায়ের কাপে চুমুক দেয়।চলবে……………………….