দ্বিতীয়_সূচনা পর্ব-১২

0
1874

#দ্বিতীয় সূচনা
#পর্ব_১২
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

‘কী যে সুন্দর লাগছে তোমায় অয়নি। মাশা-আল্লাহ।’
মিলির প্রশংসা শুনে নিজেকে আয়নায় দেখছে অয়নন্দিতা। হলুদে সাধারণত প্রায় সব কনেরাই হলুদ শাড়ি পড়ে। কিন্তু সে ব্যতিক্রম। তার শাড়িটা একেবারেই আনকমন। সাজির কাছ থেকে শুনেছে, ফারহান অলয়েজ ইউনিক ভাবে। তার সব কিছুই ইউনিক। শুনেছে, বন্দনাকেও নাকি সে সব সময় আনকমন রাখতে চাইত। বন্দনা তার জীবনে আসা থেকে শুরু করে সব কিছুই ছিল আনকমন। একটু বেশিই ভালোবেসেছিল সে বন্দনাকে। অয়নন্দিতা এখনও জানে না যে, তার ভাগের ভালোবাসাটুকুন সে পাবে কি না। মিলি আবারও বলে,
‘ফারহান সাহেবের পছন্দ আছে। বেছে-বেছে একেবারে বেস্ট শাড়িটাই চুজ করেছে তোমার জন্য।’
মিলির কথা শুনে মলিন হাসি দেয় অয়নন্দিতা। মিলি আরও বলে যে,
‘তোমার ইন্সট্রাকশন শুনতে-শুনতে পার্লারের মেয়েগুলোও বিরক্ত হয়ে গেছে। এমন করলে কেন?’
‘তুমি তো জানো ভাবী, আমার এইসব পার্লার টার্লার পছন্দ না। পার্লারে আমি যাই নিজস্ব কিছু প্রয়োজনে। এরপর বাকি সব আমি নিজেই করি। তাদের না বললে তারা আমায় একটা মেকাপের ডিব্বা বানিয়ে দিত।’
‘এখনও কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে তোমায়। মাশা-আল্লাহ। ফারহান সাহেব দেখা মাত্রই হা হয়ে থাকবে।’
অয়নন্দিতার মুখে আবারও মলিন হাসি। মিলি বুঝতে পারছে যে, অয়নন্দিতা কিছু একটা ভাবছে।
‘অয়নি, তুমি কি কিছু ভাবছ?’
‘ভাবছি সংসারটা করতে পারব তো?’
‘এইসব কী ধরনের কথা বলতেছ?’
‘আমার তো আবার কপাল ভালো না। এই যে দেখ, আব্বু-আম্মুর কি এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার কথা ছিল? চলে তো গেল আমায় ছেড়ে। আমার কপালে তো আবার সুখ সয় না।’
‘হায়াতের উপর কি কারো হাত থাকে বলো? ওইটার সঙ্গে এইটা কেন মেলাও। বাদ দাও না বোকা। আর সংসার করতে পারবে না মানে কী? দেখবে তুমি রাজরানী হয়ে থাকবে। তারা নাকি ভীষণ ভালো মানুষ। দেখবে তুমি ভীষণ সুখী হবে।’
মিলির কথার পরিপ্রেক্ষিতে মুচকি হাসে অয়নন্দিতা। তাকে এখন নিয়ে যাওয়া হবে শহরের আভিজাত্যপূর্ণ একটা সেন্টারে। সেখানকার আয়োজনে তার মামা আর ভাইয়ের যে বেশ ভালো টাকা খরচ হয়েছে এট বুঝতে পারছে সে। এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করছে নিজের ভেতরে। এখন মনে হচ্ছে, এত বড়ো পরিবারে সম্বন্ধ না করলেই পারত। অন্তত তাদের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে এত টাকা খরচ হতো না তাদের। হাসান গাড়ি পাঠিয়েছে তাদের জন্য। এই গাড়িতে করেই সেন্টারে যাবে তারা। গাড়িটা দেখে একটু অবাকই হয় অয়নন্দিতা। প্রশ্ন করে,
‘ভাবী, ভাইয়া হঠাৎ গাড়ি পাঠাল?’
‘আমরা যাব। তাই পাঠিয়েছে।’
‘কিন্তু গাড়িটা পেল কোথায়?’
‘টাকা থাকলে সব কিছুই পাওয়া যায় অয়নি। সব কিছুই পাওয়া।’
‘আমরা রিক্সা কিংবা সি এন জি করেও তো যেতে পারতাম।’
‘হয়তো পারতাম। কিন্তু ওইখণে তোমার শ্বশুরবাড়ির সবাই উপস্থিত। বউ সি এন জি কিংবা রিক্সা থেকে নামবে এটা তাদের কাছে ভালো লাগবে না। তাই তোমার ভাই উবার ভাড়া করেছে।’
‘বাড়তি কাজে টাকা কেন নষ্ট করছে তারা। তুমি কিছু বলোনি।’
‘ভালোই তো করেছে। বরং এর মতো ভালো কিছু আর হয় না।’
‘নাহ ভাবী। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিলে অনেক সমস্যা পড়তে হবে। ভবিষ্যতের কথাও ভাবা উচিত।’
‘ভবিষ্যৎ ভাবার জন্য আমরা আছি। তুমি নতুন জীবন নিয়ে ভাবো আপাতত।’
স্পষ্টই বোঝা গেল মিলি এই ব্যাপারে আর কথা বলতে ইচ্ছুক না। তাদের সবার চিন্তা অয়নন্দিতার নতুন জীবন নিয়ে৷ আর অয়নন্দিতার চিন্তা তার মামার পরিবার নিয়ে।

বিরাট আয়োজন। অনেকেই উপস্থিত হয়েছে। ফারহানের বন্ধুরা সবাই এক এক করে উপস্থিত হয়েছে। শরীফও এসেছে তার বউকে সাথে নিয়ে। অয়নন্দিতার পরিবারের সবাই এবং কিছু বান্ধবীরাও এসেছে। খাইরুল সাহেব কয়েকজনের সঙ্গে ফারহান অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে একটা মুখের। কখন আসবে সে, কখন আসবে? এই প্রশ্নটা তার মাথায় গিজগিজ করছে। এরই মাঝে তাকে অবাক করে সেখানে পা রাখল অয়নন্দিতা।
ফারহান খেয়াল করল, অয়নন্দিতাকে তার দেওয়া শাড়িটা পরে অপূর্ব লাগছে। এক কথা ভীষণ সুন্দর লাগছে তাকে। চারপাশ থেকে হইচই পড়ে গেছে বউ এসেছে বলে। ফারহান তাকিয়ে আছে অয়নন্দিতার কাছে। অয়নন্দিতাকে ফারহানের পাশে বসানো হয়েছে। কিছুক্ষণ পর অনুষ্ঠান শুরু হবে। শরীফ তাকিয়ে আছে দু’জনের দিকে। এখানে উপস্থিত সবার থেকে সে-ই বেশি খুশি। এতদিনে তার বন্ধুর একটা গতি হলো। একটা দুর্ঘটনায় একজন মানুষের সারাজীবন নষ্ট হতে পারে না। ফারহানের জন্য ভালো কিছুই অপেক্ষা করছিল। আজ সেই ভালো কিছুই তার একেবারে কাছে এসে পৌঁছেছে। শরীফ ভীষণ খুশি।
অয়নন্দিতার কানের কাছে এসে ফিসফিস শব্দে ফারহান কথা বলে।
‘সুন্দর লাগছে আপনাকে।’
ফারহানের মুখ থেকে নিজের সম্পর্কে প্রশংসা শুনে হালকা হাসে অয়নন্দিতা। প্রতিউত্তরে সেও বলে,
‘হোয়াইট পাঞ্জাবিতে আপনাকেও বেশ লাগছে।’
‘ধন্যবাদ।’
হালকা কথোপকথনের শেষে ফারহান ভাবছে অন্যকিছু। আজকের এই দিনটা সে আশা করেনি। একেবারেই আশা করেনি। এই দিনটা তার জীবনে না আসলেই পারত। তার মনে হচ্ছিল এই মুহুর্তে জীবন তাকে বলছে, দিনটি তোর জন্য অভিশাপ। পরক্ষণেই ভাবে, বন্দনার চলে যাওয়াটাই হয়তো এই দিনটির জন্য দায়ী। না সে তাকে ফেলে এইভাবে বহুদূরে চলে যেত না-ই এই দিনটি তার জীবনে আসত। এতকিছুর পরেও বন্দনার কথা, বন্দনার চলাফেরা, বন্দনার হাসি সে ভুলতে পারছে না। এইসব কিছুই তাকে চারপাশ থেকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। ভাবছে যদি অয়নন্দিতাকে এই মুহুর্তে জানানো হয় যে তার বর তারই সাথে বসে হলুদের অনুষ্ঠানে আগের বউকে কল্পনা করছে তখন কি অয়নন্দিতার অভিমান হবে নাকি সে কষ্ট পাবে? যত যা-ই হোক না কেন এইসব শুনে নিশ্চয়ই কোনো মেয়ে আনন্দিত হবে না।

অনুষ্ঠান শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় দুটো। সবাই এক গাড়িতে এলেও ফারহান অয়নন্দিতাকে নিজের গাড়িতে করে নিয়ে আসে। ফারহানের উদ্দেশ্য ছিল কিছুটা সময় সে অয়নন্দিতার সঙ্গে কাটাবে। এবং সেটাই হলো।
ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চলছে আপন গতিতে। দু’জনেই চুপচাপ। অয়নন্দিতার গালে হাতে হলদেটে ভাব রয়ে গেছে। টিস্যু দিয়ে মোছার পর ফারহানের হাতেও হলদেটে ভাব রয়েছে। ফারহান অয়নন্দিতার দিকে আড়চোখে তাকায়। অয়নন্দিতাকে দেখে মনে হচ্ছে সে সহজেই কিছু বলবে না। এদিকে রাস্তাও ফুরিয়ে যাচ্ছে। ফারহান নিজ থেকেই প্রশ্ন করে,
‘অয়নন্দিতা নামটার আগে কী বসানো যায় বলুন তো?’
ফারহানের প্রশ্ন শুনে অয়নন্দিতা একটু হকচকিয়ে ওঠে।
‘জি?’
‘অয়নন্দিতা নামের মানুষটার নামের আগে কী বসানো যায়, মিস নাকি মিসেস?’
এবার অয়নন্দিতা একটু হাসে। ফারহান বেশ মজার ছলে কথা বলতে পারে।
‘যেটা বলে আপনি খুশি হোন।’
‘অয়নন্দিতা, আমার সঙ্গে সারাটা জীবন কাটাতে হবে আপনাকে যদি আমি বেঁচে থাকি তো। পারবেন তো সব সামলে নিতে?’
ফারহানের কথাটায় কীসের ইঙ্গিত ছিল সে বুঝতে পারছে না অয়নন্দিতা। কিন্তু যদি বেঁচে থাকি তো এই লাইনটা বুকে গিয়ে লেগেছে তার। বাবা-মায়ের পর আরও একজন প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয় তাকে ঘিরে ধরেছে। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে আল্লাহর কাছে একটাই প্রার্থনা করে সে, এই মানুষটার যেন কিছু না হয়। কখনও যেন কিছু না হয়।

চলবে……………………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here