দ্বিতীয়_সূচনা পর্ব-১৩

0
1870

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_১৩
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

আলহামদুলিল্লাহ কবুল শব্দটা ভীষণ সহজ কিন্তু এর অর্থ বেশ শক্ত। আলহামদুলিল্লাহ কবুল শুধু একটা শব্দ না। সারাজীবনের দায়িত্ব। এমন এক দায়িত্ব যা সারাজীবন পালন করতে হয় উভয়কেই।
অয়নন্দিতা বসে আছে। ফারহান বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে৷ অয়নন্দিতা বিয়ে নিয়ে কখনও তেমন কিছু ভাবেনি। ভাবেনি তার জীবনে এমন একজন আসবে। দুই একজন বান্ধবীর কাছ থেকে বিয়ে, সংসার, স্বামী, দায়িত্ব এইসব সম্পর্কে শুনেছে। আগে বাবা-মায়ের সংসারে খুনসুটি দেখেছে। এরপর মামা-মামীর সংসার। ভাইয়া-ভাবীর টক ঝাল মিষ্টি সম্পর্কের সাক্ষী সে। কিন্তু কখনও ভাবেনি নিজেরও সংসার করতে হবে। নিজেরও স্বামী হবে। ঘর হবে। আজ তার সবই হয়েছে। আনন্দের চাইতে ভয়টাই বেশি। নিজেকে প্রস্তুত হতে হবে সব কিছুর জন্য। সংসার করতে হবে বুঝে-শুনে। স্বামীর সব কিছুতে নজর রাখতে হবে।
বিছানায় বসে বসে এসবই ভাবছিল অয়নন্দিতা। ঘরটা বেশ সুন্দর। দেখে বোঝা যাচ্ছে তার স্বামী রুচিসম্মত আসবাবপত্রে অভ্যস্ত। অয়নন্দিতা কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারে সে এসি’র নিচে বসে আছে। তার মানে তার ঘরে এসিও আছে। সে বার বার তাকাচ্ছে বারান্দার দরজার দিকে। ফারহান তখনও বারান্দায়। এদিকে শাড়ি পরে তার যেন দম আসে আর যায় অবস্থা। এসব পরে থাকার তো মানেই হয় না। লাগেজ খুলে পুরো লাগেজে চোখ বুলায় অয়নন্দিতা। একটা নরম সুতি শাড়ি পরলে ভালো হয়। আসার সময় মামী বার বার বলে দিয়েছে দুই তিন দিন এই বাড়িতে শাড়ি পরতে। পরে থ্রিপিস পরা যাবে। মামীর কথা অনুযায়ী অয়নন্দিতা একটা সুতি শাড়ি বের করে। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। এক এক করে গহনাগুলো খুলে ফেলে নিঃশব্দে। একটা গোসল দিলে অনেক ভালো হবে। এটা অবশ্য অয়নন্দিতার ভাবনা। দোপাট্টা খুলে বিছানায় রেখে টাওয়াল নিয়ে ওয়াসরুমে যায় অয়নন্দিতার। ওয়াসরুমটা বেশ বড়ো আর ভীষণ সুন্দর। অয়নন্দিতা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পুরো ওয়াসরুমের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ফারহান অলরেডি ছয়টা সিগারেট টেনেছে। রাতটা সুন্দর হলেও তার অসহ্য লাগছে। আজকে জোছনা কিন্তু জোছনাটাকেও বিরক্ত লাগছে তার কাছে। বন্দনার কথা বার বার মনে পড়ছে। বিয়ে পড়ানোর সময়ও বন্দনাকে ভীষণ মিস করেছে সে। একই রকম একটা দিন, একই রকম একটা রাত। জোছনাটাও অদ্ভুতভাবে মিলে গেছে। সেও একই আছে। শুধু নারী চরিত্রটা বদলে গেছে। আজ কেন যেন মন থেকে সরাতে পারছে না বন্দনাকে। মাঝে মাঝে নিজের ওপর সে ভীষণ বিরক্ত হয়। এই মন নামক অদৃশ্য অনুভূতিটাকে যদি খুন করা যেত তাহলে ফারহান সবার আগে এই মনটাকেই খুন করে ফেলত। মেরে ফেলত সমস্ত অনুভূতিকে। বন্দনা তাকে ছেড়ে কেন চলে গেল এই প্রশ্নটা আজও ঘুরপাক খায়। কিন্তু উত্তর পাওয়ার উপায় নেই।
এমন সময় ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। ফারহান দেখতে পায় ফোনের স্ক্রিনে শরীফের নাম্বার ভাসছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোনটা রিসিভ করে ফারহান। বলে,
‘হ্যালো।’
‘হ্যাঁ। কী অবস্থা বন্ধু। মধুরাত কেমন কাটছে।’
শরীফের কথায় হালকা মলিন হাসে ফারহান। বলে,
‘মধুরাতে কর্মরত থাকলে কি আর তোর ফোন রিসিভ করি আমি?’
ফারহানের কথায় ফাইযলামি থাকলেও শরীফ বুঝতে পেরেছে ফারহান এখনও অয়নন্দিতার সাথে কথা বলেনি।
নিজেই প্রশ্ন করে,
‘অয়নন্দিতার সাথে কথা বলিসনি এখনও?’
‘নাহ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি।’
‘সিগারেট টানছিস নিশ্চয়ই।’
‘হ্যাঁ ছয়টা শেষ করলাম।’
‘তোর মাথা ঠিকাছে?’
‘ভালো লাগে না রে। বিশ্বাস কর, এই বিয়েটা করেছি একমাত্র মা-বাবার জন্য। অয়নন্দিতা মেয়েটা ভালো। ভীষণ শান্ত আর চুপচাপ। তাই ভাবলাম ওকে বিয়ে করলে এটলিস্ট রোজ রোজ বিয়ের প্যারা থেকে বেঁচে যাব।’
‘পাগল নাকি তুই ফারহান। যা কথা বল ওর সাথে। আই থিংক তোর ভালো লাগবে। আমার ছাত্রী বলে বলছি না। মেয়েটার দিকে দু’দন্ড তাকা। দেখবি তোর অস্থির মন শান্ত হয়ে যাবে।’
‘কিছুতেই তাকে মন থেকে সরাতে পারছি না। কিছুতেই না। আজকে আরও বেশি করে মনে পড়ছে আমার। আমিই কি একমাত্র প্রেমিক পুরুষ যে কি না এমন পাগলের মতো ভালোবেসেছিলাম তাকে। চলে গেল আমায় ফেলে রেখে। আর এত দূরেই গেল যে ফিরে এলো না।’
সামনে থাকলে ফারহানকে দুইটা চড় বসাতো শরীফ। আফসোস সামনে নেই। নিজেকে যতটা সম্ভব সংযত রেখে ফারহানকে কিছু কথা বলে ফোন রাখে সে।

ফারহান ঘরে এসে অন্যকিছু আবিষ্কার করে। সে যেমনটা ভেবেছিল, এখনও হয়তো বারান্দা থেকে এসে দেখবে অয়নন্দিতা পূর্বের মতো বসে থাকবে। কিন্তু নাহ, ফারহান ঘরে ঢুকেই চমকে গেছে। ততক্ষণে অয়নন্দিতা অনেকগুলো কাজ শেষ করেছে। গোসল করেছে, গহনাগুলো গুছিয়ে এক পাশে রেখেছে। লেহেঙ্গাটা অন্যপাশে রেখেছে। বিছানার ওপর থেকে ফুলগুলো সরিয়ে ফেলেছে। একদম টিপটপ হয়ে গেছে। ফারহানের মুখ থেকে আচমকাই বের হয়ে যায়,
‘কী করছেন আপনি?’
অয়নন্দিতা পেছনের দিকে তাকায়। ফারহান অয়নন্দিতার দিকে তাকিয়ে আছে। অয়নন্দিতাকে আরও সুন্দর লাগছে। বিনা মেকআপে মেয়েটাকে ভীষণ সুন্দর লাগে এর প্রমাণ অবশ্য সে আরও আগেই পেয়েছিল। তবে আজ আরও সুন্দর লাগছে। দু’হাতে লাল রঙা মেহেদী যেন হাতের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। হালকা মিন্ট কালারের শাড়িটায় অপূর্ব লাগছিল অয়নন্দিতাকে। ফারহান এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে শরীফ তাকে ভুল কিছু বলেনি। মেয়েটার মধ্যে আসলেই তেমন কোনো ব্যাপার আছে। অয়নন্দিতা হালকা হেসে বলে,
‘আপনি তো বারান্দায় ছিলেন। আমারও গা গোলাচ্ছিল। তাই শাওয়ার নিয়ে নিলাম। সব গুছিয়ে রাখলাম। ভাবলাম আপনি ঘুমাবেন অথচ বিছানায় ফুলের ছড়াছড়ি। তাই সেইগুলোও সরিয়ে দিলাম। এখন ঘুমোতে আর অসুবিধা হবে না৷’
অয়নন্দিতার কোনো কথাতেই তার ইন্টারেস্ট নেই। সে আপাতত অয়নন্দিতার প্রশংসা করছে,
‘শাড়িটায় আপনাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে।’
অয়নন্দিতাও হাসিমাখা মুখে ধন্যবাদ জানায় ফারহানকে।
‘আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। আপনি ঘুমাবেন না কিন্তু।’
মাথা দোলায় অয়নন্দিতা। হ্যাঁ সূচক ইশারা পেয়ে ফারহান টাওয়াল নিয়ে ওয়াসররুমে চলে যায়।

ঠিক একই জায়গায় দাঁড়ায় অয়নন্দিতা। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে। বারান্দাটা দক্ষিণ দিকে অবস্থিত বলে এখানে খুব সহজেই বাতাস আসে। বারান্দায় দাঁড়ালে প্রাকৃতিক বাতাসে মন ভরে যায়। এই বাতাস যেন এসি’র বাতাসকেও হার মানায়।
ফারহান চুপিসারে অয়নন্দিতার পাশে এসেই দাঁড়ায়। ফারহানের উপস্থিত নিজের পাশে টের পেয়ে অয়নন্দিতাও পাশ ফিরে তাকায়।
‘আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না।’
অবাক নয়নে তাকায় অয়নন্দিতা।
‘কোন প্রশ্ন?’
‘ওই যে পরশু জিজ্ঞেস করলাম, আপনাকে কী বলে ডাকব?’
ফারহানের কথায় মুচকি হাসে অয়নন্দিতা।
‘আমি কিন্তু উত্তরটা সেদিনই দিয়েছিলাম।’
‘কখন, কোথায়?’
‘ওই যে, যে নামে ডেকে আপনার মন ভরবে।’
‘একেক সময় একেক নামে ডকব। কখনও অয়নন্দিতা, কখনও অয়নি, কখনও বা মিসেস শেখ। চলবে?’
এবার একটু শব্দ করেই হাসে অয়নন্দিতা
‘আচ্ছা। চলবে।’
‘আচ্ছা আমি কি তুমিতে যেতে পারি নাকি আপনিতেই থাকব।’
‘মানে?’
‘মানে, এইযে আমরা একে অপরকে আপনি আজ্ঞে করছি। এটা কি তুমিতে বদলানো যায়?’
‘আপনি তুমি বলতে পারেন। সমস্যা নেই।’
ফারহান অনুমতি পায়। কিন্তু অয়নন্দিতা, সে কি তুমি ডাকবে তাকে? প্রশ্নটা খচ খচ করছে মনে।
‘তুমি ডাকবে না?’
‘অভ্যেস নেই তো। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। আই মিন আমি চেষ্টা করব।’
ফারহানের মনে হচ্ছে অয়নন্দিতা খুব ম্যাচিওর। তার কথাবার্তার ভাব ভঙ্গি অন্যরকম। অয়নন্দিতাকে বুঝিয়ে বললে সে বুঝবে। আর ফারহান এই সুযোগটাই কাজে লাগাবে।

কিছুক্ষণের বিরতির পর ফারহান অয়নন্দিতার হাত ধরে। এতে অয়নন্দিতা চমকে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়েছে বেশ। ফারহান অয়নন্দিতার চোখের দিকে চেয়ে বলল,
‘ঘরে চলো। কিছু কথা বলব তোমায়।’
ফারহানের আমন্ত্রণে ঘরে যায় অয়নন্দিতা। বিছানায় বসতেই ফারহান তার পাশে এসে বসে। বুকটা ধক করে ওঠে অয়নন্দিতার। এত দ্রুতই ফারহান তার এত কাছে চলে আসবে সে ভাবেনি। তবে ভেবে আর কাজ কী। ফারহান তার স্বামী। আর সে ফারহানের স্ত্রী। স্বামীর সব চাহিদা মেটানো একজন স্ত্রীর কর্তব্য। গতকাল রাতে মামী আর খালা মিলে সব বুঝিয়ে দিয়েছে তাকে। তারা এটাও বলেছে যদি, তার নিজের ভালো লাগে বা সম্মতি থাকে তাহলে ফারহান তাকে স্পর্শ করলেও সে যাতে সাড়া দেয়। অয়নন্দিতাও সেই পরামর্শ অনুযায়ী চলবে বলে ঠিক করে।
ফারহান দ্বিতীয়বারের মতো অয়নন্দিতার হাত ধরে। অয়নন্দিতা এবার আর চমকায়নি। এবার সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। সে আজ এই মধুরাতে তার বরকে সঙ্গ দেবে। মন উজাড় করে, নিজেকে উজাড় করে সঙ্গ দেবে।

চলবে……………………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here