#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_১৪
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)
গতকালকের রাতটা বেশ সুন্দর ছিল। বিশেষ করে অয়নন্দিতার কাছে অন্যরকম লেগেছে। রাতের প্রায় অর্ধেকটা সময় সে আর ফারহান গল্প করেছে। ফারহান তার নিজের কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছে সেই সাথে নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগার কথা জানিয়েছে অয়নন্দিতাকে। অয়নন্দিতাও নিজের বাবা-মায়ের গল্প করেছে। খানিকটা সময় ধরে কেঁদেছেও।
অয়নন্দিতার আরও ভালো লেগেছে যে, ফারহান তাকে সব থেকে জরুরী কথাটা খুব অনায়াসে বলে দিয়েছে। অয়নন্দিতাও তার মতো করেই সবটা বুঝে নিয়েছে। ভবিষ্যতে আর কোনো ঝামেলা হবে না এইসব বিষয় নিয়ে।
সকাল সকাল সাজি এসে বকবক শুরু করে দিয়েছে। অয়নন্দিতা গোলাপি রঙের একটা জামদানী পরেছে। চুলগুলো ভারী হওয়ায় খোঁপাটা বেশ বড়ো হয় তার। অয়নন্দিতার খোঁপা দেখে সাজি বলে ওঠে,
‘খোঁপাটা বড্ড খালি খালি লাগছে। ফুল নিয়ে আসি?’
অয়নন্দিতাও হালকা হেসে জবাব দেয়,
‘কোথা থেকে আনবে আর কী ফুল আনবে?’
‘বাগান থেকে। বাগানে গোলাপ ফুল ফুটেছে।’
‘নাহ থাক। এমনিতেই ভালো লাগছে। গোলাপ ফুল দিলে কেমন পিকুলিয়ার পিকুলিয়ার লাগবে।’
‘অবশ্য তোমায় এমনিতেও সুন্দর লাগে।’
‘তোমাকে আমার থেকেও বেশি সুন্দর লাগে।’
তাদের দু’জনের কথার মাঝেই ফারহানের প্রবেশ ঘটে। ঘরে ঢুকেই ফারহান অবাক চোখে তাকায় অয়নন্দিতার দিকে। এই শাড়িতে ভীষণ সুন্দর লাগছে অয়নন্দিতাকে।অয়নন্দিতার নজরও ফারহানের দিকে। কালো শার্টে ফারহানকে দারুণ মানিয়েছে।
ভাইকে ঘরে ঢুকতে দেখে সাজি বের হয়ে যায়। সআজি বের হলে ফারহান ধীর গতিতে ড্রেসিং টেবিল অবধি আসে। চোখ রাখে অয়নন্দিতার চোখের দিকে। অয়নন্দিতা তখন হালকা হেসে বলে,
‘কোথায় চলে গিয়েছিলেন?’
‘যাইনি কোথাও। নিচেই ছিলাম।’
‘ওহ।’
‘সাজি একটু বেশি কথা বলে। যদিও ও খুব ফ্রী মাইন্ডের একজন মানুষ। সবার সঙ্গে খুব সহজেই মিশে যায়।’
‘আমারও ভীষণ ভালো লেগেছে সাজিকে। লক্ষ্মী আর মিষ্টি একটা মেয়ে।’
‘তুমি রেডি হয়ে গেছ।’
‘হ্যাঁ। আমি রেডি। একবার অবশ্য নিচে গিয়েছিলাম। মা বলল আমি যেন গোসল করে রেডি হয়ে যাই।’
‘মা! কোন মা?’
‘কোন মা মানে? আপনার মা। আমাকেও মা ডাকতে বলা হয়েছে। তাই আমিও ডাকলাম মা।’
‘কেউ না বলে দিলে ডাকতে না বুঝি?’
‘অবশ্যই ডাকতাম। আমার মা নেই। এখন থেকে উনিই আমার মা।’
ফারহানের হঠাৎই কিছু কথা মনে পড়ে যায়।
‘তুমি আমার মাকে আন্টি কেন ডাকো?’
‘আন্টি কি খারাপ নাকি বলো, আন্টি ডাকলে সমস্যা কোথায়?’
‘আমার মা তো তোমার শাশুড়ি। তাই না? শাশুড়িকে মা ডাকতে হয়৷’
‘আমার নিজের মা তো আছে। নিজের মা থাকতে আবার অন্য একজনকে কেন মা ডাকতে যাব?’
‘অন্য একজন মানে? কে অন্য একজন?’
‘তোমার মা তো আমার আপন কেউ নন। তিনি তো অন্য একজনই। তাই না?’
ফারহান আচমকাই তার চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলে। এদিক থেকে তাদের দু’জনের মাঝে খানিক গড়মিল আছে। দু’জনের চিন্তায় গড়মিল।
দুই দিন পর।
সবাই মিলে নাস্তার টেবিলে বসেছে। অয়নন্দিতাও এই দুই দিনে নিজেকে সবার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেনা করছে। ধরেই সবার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া যায় না। একটু সময় লাগে। সেই অনুযায়ী অয়নন্দিতা অনেকটাই পেরেছে নিজেক সবার মতো করে মানিয়ে নিতে।
রমজান শেখ ব্রেডে বাটার লাগাতে লাগাতে ছেলের দিকে তাকান। এরপর বলেন,
‘এই শুক্রবার তোমার রাঙামাটি যাওয়ার কথা। মনে আছে তো ফারহান?’
বাবার কথা শুনে মুখ উপরে তুলে তাকায় ফারহান। গত চার/পাঁচ দিনের ব্যস্ততায় মাথা থেকে একেবারেই বের হয়ে গিয়েছিল যে তাকে একটা মিটিংয়ের জন্য এই শুক্রবার রাঙামাটি যেতে হবে। ভাগ্যিস বাবা মনে করিয়ে দিয়েছে। ফারহান মাথা নেড়ে সায় দেয়। রমজান শেখ ছেলের ইশারা পেয়ে বলে,
‘অয়নন্দিতাকেও সাথে নিয়ে যেও। মিটিং শেষ করে অয়নন্দিতাকে নিয়ে চারপাশের জায়গাগুলো ঘুরে এসো।’
ফারহান এতটাও আশা করেনি যা তার বাবা বলেছে।
‘কিন্তু বাবা, আমি সেখানে ব্যস্ত থাকব। ওকে কীভাবে সময় দেব?’
‘আমরা বিজনেসম্যানরা কতটুকুই বা সময় পাই ফারহান। এর মাঝেই নিজের প্রিয়জনকে সময় দিতে হয়েছে। কিংবা এখনও দিতে হয়। তোমার মায়ের সঙ্গেও আমি এভাবেই সময় কাটিয়েছি। ভবিষ্যতে ফারাশকেও এই পথেই চলতে হবে। মিটিং শেষে কয়েকদিন সেখানে বেড়াবে তোমরা। এখানকার আমি ফারাশকে বুঝিয়ে দেব।’
‘ফারাশ কাজ বুঝে নেবে?’
‘অফ কোর্স বুঝে নেবে। কম বড়ো তো হয়নি। একদিন দেখবে হুট করেই এসে বলবে বাবা আমি বিয়ে করব। তা বিয়ে যে করবে বেকার ছেলের কাছে মেয়ে দিবে কে?’
ফারাশ খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে বাবা আর ভাইয়ের দিকে। অন্য একটা কারণে ফারাশের মুখে চিন্তার ভাব পড়ে। কপাল কুঁচকে যায় তার। যা স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ে অয়নন্দিতার চোখে। রমজান শেখ ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি মেখে ছোটো ছেলের দিলে তাকান। এরপর খেতে খেতে বলেন,
‘ফারহান, একটা নিউজ কানে এসেছে তো।’
‘হোয়াট?’
‘তোমার ভাই নাকি মেয়ে নিয়ে ঘুরে।’
‘কীহ?’
‘জি, তোমার ভাই। ফারাশ শেখ। মেয়ে নিয়ে ঘোরাঘুরি করে।’
ফারাশ এতক্ষণ যেই ভয় পেয়েছিল সেটাই হয়েছে। তার মানে নায়া’র খবর তার বাবার কানে পৌঁছে গেছে। ফারহান একবার তার বাবার দিকে তাকায় আবার তার ভাইয়ের দিকে তাকায়। আবার চোখ চলে যায় তার মায়ের দিকে। রওশন বেগমও চোখের ইশারায় জানান দেয় ঘটনা সত্য। এবার ফারহান বলা শুরু করে,
‘ঘটনা সত্যি নাকি ফারাশ?’
না জানার ভঙ্গি নিয়ে ফারাশ জবাব দেয়,
‘কীসের ঘটনা ভাইয়া?’
‘এই যে মেয়ে ঘটিত ঘটনা।’
‘এইসব ভুয়া কথা। বানোয়াট। এমন কিছুই না।’
এমন সময় রমজান শেখ রওশন বেগমকে বলেন,
‘হ্যাঁ গো, আমাদের কি জমজ ছেলে ছিল নাকি?’
‘আগে জানতাম ছিল না। এখন তো মনে হচ্ছে ছিল।’
ফারহান না হাসলেও অয়নন্দিতার বেশ হাসি পাচ্ছে। এদের সবার মধ্যে সবার বন্ডিংটা অয়নন্দিতার বেশি ভালো লাগছে।
এরই মাঝে রমজান শেখ বললেন,
‘সবই যদি বানোয়াট হবে তাহলে আমি আর তোমার মা বোধ হয় বসুন্ধরায় ফুড কোর্টে অন্য আরেকজনকে দেখেছিলাম যে অনেকটাই তোমার মতো। অনেকটা বলতে কি, পুরোটাই তোমার মতো। বলতে গেলে লুক আ লাইক।’
ফারাশ বুঝে গেছে আর লুকিয়েও কোনো লাভ নেই। তাকে স্বয়ং তার পিতা এবং মাতা দু’জনেই দেখে ফেলেছে। ফারাশ ভাবছে এখান থেকে কেটে পড়া যায় কীভাবে।
মরার ওপর খাড়ার ঘা বলে একটা কথা আছে। এখানেও সেটা প্রযোজ্য হয়ে গেছে। নায়া ফোন করেছে। ফারাশ এক্সিউজ মি বলে উঠেই দ্রুত গতিতে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। রমজান শেখ এবং রওশন বেগম দু’জনেই হাসছেন। ভাবছেন কিছুদিন পর নতুন সদস্য আরেকজন আসতে চলেছে তাদের সংসারে।
রাত প্রায় বারোটা। ফারহান অয়নন্দিতার পাশেই শুয়ে আছে। অয়নন্দিতা না বলছে কথা না নড়ছে। একদম চুপচাপ পড়ে আছে ওপাশে মুখ করে। ঘুমিয়ে আছে কি না তাও বোঝা যাচ্ছে না। ফারহান ভাবছে, অয়নন্দিতাকে নিয়ে কি তার রাঙামাটি যাওয়া উচিত হবে? আবার ভাবছে, না নিয়ে গিয়েও উপায় নেই। যেখানে বাবা বলে দিয়েছে। কিন্তু অয়নন্দিতা কী চায়? সে কি যেতে চাইবে ফারহানের সঙ্গে?
অয়নন্দিতাকে ডাকবে কি ডাকবে না, জিজ্ঞেস করবে কি করবে না ভাবছে ফারহান। মনে মনে বলছে, মেয়েটা এত ঘুম পাগল কেন? মনে হচ্ছে ঘুম ছাড়া দুনিয়ায় আর কিছুই নেই।
চলবে………………..