#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_১৯
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)
চারপাশে সবুজে ঘেরা। পুরো রাঙামাটি শহরটা যেন সবুজের রাজত্ব। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি দেখছে অয়নন্দিতা। মুক্ত বাতাস শরীর যখন স্পর্শ করে তখন উত্তেজিত মনটা শান্ত হতে কয়েক সেকেন্ড নেয় মাত্র। খোলা আকাশের দিকে তাকালে অজস্র চিন্তায় ঘেরা মস্তিষ্কটাও অবসরে যায়। এই সময়টায় একা থাকতে ইচ্ছে তো করছে না অয়নন্দিতার। কিন্তু তাকে থাকতে হচ্ছে। কারণ সে এখানে হানিমুন কিংবা ঘুরার উদ্দেশ্যে আসেনি। এসেছে বরের সঙ্গে। আর বর এসেছে কাজের সূত্রে।
ফোনের শব্দটা কানে যেতেই রুমে প্রবেশ করে অয়নন্দিতা। ফারহান ফোন করেছে। রিসিভ করে হ্যালো বলার পর ফারহান প্রশ্ন করে,
‘বাইরে বের হওনি তো?’
অয়নন্দিতা না চাইতেও মুচকি হাসে। যদিও তার এই হাসি ফারহানের দৃষ্টি থেকে বহু দূরে। অয়নন্দিতা ফোন কানে নিয়েই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। বেতের সিঙ্গেল সোফায় বসতে বসতে জবাব দেয়,
‘নাহ। বের হইনি।’
‘গুড। ভেরি গুড।’
‘বাইরে বের হয়েছি কি না এইটা জানার জন্য আমায় ফোন করেছেন?’
‘নাহ। তেমনটা নয়।’
‘আমার তো তেমনটাই মনে হচ্ছে।’
অয়নন্দিতার কন্ঠে কাঠিন্য ভাব। ফারহান ভাবছে, সে কি ফোন করে ভুল করেছে? নাকি অয়নন্দিতার কোনো কারণে মুড অফ। ফারহান কিছু বলার মতো কথা খুঁজে পায়নি। তাই, এসে কথা বলব বলে ফোন রেখে দেয়। অয়নন্দিতাও উচ্চবাচ্য করেনি। ফোনটা পাশে রেখে দূরে অবস্থিত পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে কিছু খোঁজ করার বাহানা করছে।
ঘড়িতে যখন রাত দেড়টা। ফারহান তখন রুমে আসে। সারাদিনের সমস্ত কাজ শেষ করে রুমে ফিরতে যে তার এত দেরি হতে পারে এটা তার কল্পনাতেই ছিল না। পুরো রুম অন্ধকার। ছোটো বাতিটা নীল রঙা আলো ছড়াচ্ছে। সেই আলোতেই ফারহান অয়নন্দিতাকে দেখতে পায়। অয়নন্দিতা ঘুমোচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে গভীর ঘুমের অতলে ঢুবে আছে সে।
রিসিপশন থেকে জানতে পেরেছে অয়নন্দিতা রাতের খাবার খায়নি। সন্ধ্যায় নাস্তা বলতে এক মগ কোল্ড কফি। এর বেশি আর কিছুই না। অয়নন্দিতা কাজটা না করলেও পারত। এভাবে না খেয়ে ঘুমোনো উচিত হয়নি তার। ফারহান নিজের প্রতিও বিরক্ত। আরও আগে আসা উচিত ছিল তার। এখানে এভাবে একটা রুমে একটা মেয়ে কতক্ষণ একা একা থাকবে? তার জীবনে ভুলের শেষ নেই। এই ভুল-ই তার জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছে। এখন যদিও বা কিছুটা ঠিক হতে নিচ্ছে কিন্তু তার ভুল আবারও হচ্ছে।
বেঘোরে ঘুমোনো অয়নন্দিতার চাহনি দেখতে ব্যস্ত ফারহান। সেও আর কিছু খায়নি। ফ্রেশ হয়ে পাশের খালি জায়গায় শুয়ে পড়ে। ভাবছে, অয়নন্দিতা ভুল করেনি তো তাকে বিয়ে করে। কিংবা সে ভুল করেনি তো নিজের সঙ্গে আবারও নতুন করে কাউকে জড়িয়ে। বাবা-মায়ের কথায় অয়নন্দিতাকে কি কেবল সঙ্গ দেবার জন্যই নিজের জীবনে নিয়ে এসেছিল? মনের মধ্যে কতশত প্রশ্নের ছুটোছুটি। কিন্তু স্থির হয়ে উত্তর খুঁজে বের করার সেই সময় এবং ইচ্ছা কোনোটাই নেই তার।
‘এইযে শুনছেন, হ্যালো। এইযে অয়নন্দিতা। শুনছেন?’
কারো ডাকে অয়নন্দিতা দাঁড়িয়ে যায়। থেমে গিয়ে পেছনে তাকায় সে। ইয়াসমিন নামের সেই নারীটা দাঁড়িয়ে আছে তার বিপরীতমুখী হয়ে। ভ্রু জোড়া হালকা উঁচু করে অয়নন্দিতা পা বাড়ায় ইয়াসমিনের দিকে। মেয়েটাকে আজ বেশ সুন্দর লাগছে। নেভী ব্লু রঙের একটা শাড়ি পরেছে।
দু’জন দু’জনার কাছাকাছি এসে কুশল বিনিময় করে। অয়নন্দিতা আজ বেশ সতর্কতা অবলম্বন করবে। ওইদিনের মতো আজ আর কোথাও যাবে না সে। ইয়াসমিনের সঙ্গে তো ভুলেও যাবে না।
ইয়াসমিন অয়নন্দিতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
‘কেমন আছেন অয়নন্দিতা?’
‘এইতো ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’
‘আমিও বেশ ভালো। কোথায় যাচ্ছেন?’
‘কোথাও না। এখানেই আছি।’
‘বর কোথায়?’
‘ব্যস্ত আছেন।’
‘রিসিপশনে শুনলাম আপনার বর নাকি আপনাকে খুঁজে না পেয়ে রাঙামাটির পুলিশ ফোর্স নামিয়ে ফেলেছিল।’
অয়নন্দিতা হালকা হেসে জবাব দেয়,
‘অনেকটা ওইরকমই।’
‘আমি থাকলে বলতাম। আমার জন্যই এত কিছু হয়ে গেল কয়েকঘন্টায়।’
‘ফোনটা নিয়ে গেলে এত ঝামেলা হতো না। আমি তো এখানে নতুন। সে ভেবেছিল যদি হারিয়ে যাই।’
‘এত ভালোবাসা!’
আবারও মুচকি হাসে অয়নন্দিতা। উত্তর দেয়,
‘হ্যাঁ। অনেক ভালোবাসা। যেই ভালোবাসার গভীরতা এতই বেশি যার তল পরিমাপ করার ক্ষমতা নেই।’
‘বাহ! আমার কর্তাও আমায় ভীষণ ভালোবাসে। চোখে হারায় আমায় সে। দুই বছরের সংসারে কখনও বুঝতেই দেয়নি যে আমাদের বিয়ের দুটো বছর পার হয়ে গেছে। আমার জন্য প্রতিটা দিনই সে স্পেশাল করে রেখেছে।’
‘আপনাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে।’
‘তাই বুঝি?’
‘হ্যাঁ। নেভী ব্লু রঙের শাড়িতে অপূর্ব লাগছে।’
‘আপনাকেও ভীষণ ভীষণ ভীষণ সুন্দর লাগছে অয়নন্দিতা। হলুদ রঙের শাড়িতে আপনাকেও হলুদ ফুলের মতো লাগছে। বর দেখলে পাগল হয়ে যাবে।’
‘হয়তো।’
‘চলুন না ওপাশটায় যাই। কর্তা আজ মিটিংয়ে ব্যস্ত। বিকেলে ফিরবে।’
যত যাই হোক অয়নন্দিতা আজ কোথাও যাবে না।
‘নাহ গো। কোথাও যাব না। এখানেই একটু হাঁটাহাঁটি করি।’
‘কর্তার ভয়ে যাবেন না?’
‘ভয় না। শ্রদ্ধা বলতে পারেন। সেই সাথে ভালোবাসাও।’
ইয়াসমিনের এক জোড়া চোখ যেন অয়নন্দিতার চাহনির মাঝে কিছু একটা খুঁজছে। কিন্তু ব্যর্থ হতে হচ্ছে তাকে। খুঁজতে থাকা সেই কিছুটা খুঁজে পাওয়া ভীষণ কঠিন।
রিসোর্ট থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান করছে ফারহান। পাশে বসে আছে অয়নন্দিতাও। বিকেলের শেষ সময়ে সমস্ত কাজে ইতি টেনে রিসোর্টে ফিরে আসতে সক্ষম হয় ফারহান। এসে অয়নন্দিতাকে নিয়ে বের হয়ে পড়ে। ফারহানের মনে হয়েছে এখন অন্তত কিছুটা সময় তাদের একত্রে অতিবাহিত করা উচিত। জীবনের খারাপ স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে থাকলে কোনো লাভ নেই। এতে কেবলই লসের পাল্লা ভারী হবে। অয়নন্দিতারও একটা জীবন আছে। মেয়েটা নিঃশব্দে সবটা মেনে নিয়েছে বলে তাকে সারাজীবন মানিয়ে নেওয়ার মতো জীবন উপহার দেওয়া ঠিক হবে না। সবকিছুই উপলব্ধি করতে হয়েছে ফারহানকে।
তাদের দু’জনের মাঝে নীরবতা এসে বাসা বেঁধেছে। এই মুহুর্তের পরিবেশটা নীরবতায় ছেয়ে আছে। নীরবতায় ছেয়ে থাকা পরিবেশটা যেন গুমোট হয়ে আছে। ফারহানের মস্তিষ্কে ঘুরঘুর করছে কিছু শব্দ। শব্দগুলো বলতে পারলে সে ভেতরগত ভাবে শান্তি পেলেও পেতে পারে। পাশ ফিরে যখন অয়নন্দিতার দিকে তাকায় অয়নন্দিতা তখন চুপচাপ অন্ধকার দেখছে।
মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাওয়া শব্দগুলো বের হয় ফারহানের কণ্ঠনালী দিয়ে।
‘চুপচাপ থাকার ব্রত করবে আজ?’
খানিকটা অবাক হয়ে তাকায় অয়নন্দিতা ফারহানের চোখের দিকে। সে তো বরাবরই চুপচাপ থাকে। কে জানে ফারহানের কেন মনে হয়েছে যে, স্পেশালভাবে আজই সে চুপচাপ আছে।
‘ব্রত করার মতো তেমন কিছু ঘটেনি।’
‘তবে নীরব কেন?’
‘আঁধার দেখছি।’
‘তুমি কি কোনো বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে রেগে আছো?’
‘নাহ। একদমই না।’
‘আচ্ছা।’
খানিকক্ষণের নীরবতা শেষে ফারহান একটা ছোটো নিঃশ্বাস গোপনে বাতাসে মিলিয়ে দেয়। প্রশ্ন করে,
‘কখনও ভালোবেসেছ কাউকে?’
অয়নন্দিতা অবাক হয়নি। স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই জবাব দেয়,
‘তেমন করে ভালোবাসার সুযোগ হয়নি।’
‘সুযোগ হলে বাসতে?’
‘চেষ্টা করতাম। তবে খাটি ভালোবাসা খুঁজতাম। অপাত্রে ভালোবাসা দান করব কেন?’
‘অপাত্রে ভালোবাসা দান করা সত্যিই বোকামি। আমার মতো বোকারাই কেবল এই বোকামি করে।’
অয়নন্দিতা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ফারহানের দিকে। ফারহানের নজর তখন দূরের পাহাড়ের শীর্ষ চূড়ায়।
‘আমার ভালোবাসা দান না করে আমি বোধ হয় ভালোই করেছি। আমার সকল ভালোবাসার অধিকার কেবলমাত্র একজনের জন্যে। আর সে আমার পাশেই বসে আছে।’
চমকিত নজরে ফারহান তাকায় অয়নন্দিতার মুখপানে। অয়নন্দিতা হাসিমুখে বলতে শুরু করে,
‘চলার পথে কাটা থাকবে। অনেক সময় পায়েও বিঁধবে। ব্যথাও লাগবে, রক্তও ঝরবে। তবুও এগিয়ে যেতে হবে। সত্যিকারের ভালোবাসা ধরা পড়বেই। একদিন আগে হোক আর একদিন পরে হোক। আপনার ভালোবাসা থেকে খানিকটা ভালোবাসা আমার পেছনে ইনভেস্ট করতে পারেন। লাভ না হলেও লস হবে না আশা করি।’
চলবে………………………….