#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_২৮
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)
ফরমাল পরে ফারহান রেডি হয়ে গেছে। অয়নন্দিতা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ফারহানকে দেখছে। আয়নায় অয়নন্দিতার রিফ্লেকশন দেখতে পাচ্ছে ফারহান। আয়নার সামনে নিজেকে তৈরি করছে আর আড়চোখে অয়নন্দিতাকে দেখছে।
গত পাঁচদিনের জ্বরে অয়নন্দিতার চোখ মুখ একেবারেই ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। চোখের নিচের দিকটায় হালকা কালি পড়েছে। ঠোঁট জোড়াও শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। চুলগুলোরও এই কয়েকদিন একেবারেই বাজে অবস্থা ছিল। যদিও গতকালকে সাজি আর রওশন বেগম মিলে তার মাথা ধুয়ে দিয়েছে। বেঁধেও দিয়েছে।
অয়নন্দিতার অসুস্থতা ফারহানকে বেশ চিন্তিত করে তুলেছিল। ছেড়ে ছেড়ে জ্বর আসা ভালো না। বার বার ডক্টরের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছে ফারহান। যখন যেই মেডিসিন সাজেস্ট করেছে সেটাই আনিয়েছে নয়তো নিজে গিয়ে এনেছে। রাত ভর অয়নন্দিতার মাথার পাশে বসে জাগিয়েছে। আপনজন হারানোর যন্ত্রণা ফারহান বোঝে। তাই ভয় হয় তার অয়নন্দিতাকে নিয়ে। যদিও অয়নন্দিতার সঙ্গে তার সম্পর্কটা আসলে কতটুকু গভীর সেটা নিয়ে সে এখনও দ্বিধা দ্বন্দ্বে আছে।
ফারহান সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে পেছন ফিরে অয়নন্দিতার দিকে তাকায়। ফারহান তাকালে অয়নন্দিতাও হালকা হাসি দিয়ে হাতের ইশারায় বোঝায় ফারহানকে বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে। ফারহানও অয়নন্দিতার ইশারায় এক গাল হেসে সামনে এগিয়ে আসে। পাশের খালি জায়গাটায় বসে পড়ে।
‘শরীর কেমন লাগছে এখন?’
‘ভালো।’
‘গলাটা এখনও ঠিক হচ্ছে না দেখছি।’
‘মনে হয় আর ঠিক হবে না।’
‘হা হা। ধুর বোকা। কেন ঠিক হবে না। আরও খাও আইসক্রিম।’
‘দুইটা খেয়েছিলাম। বুঝব কী করে যে আইসক্রিম খেলে আমায় এইভাবে জ্বরে ভুগতে হবে।’
‘যতদিন বাঁচবে ততদিন ভুলেও আর আইসক্রিমের কথা মুখেও আনবে না।’
এমন কড়া আদেশ! অয়নন্দিতা কিঞ্চিৎ রেগে বলে,
‘এটা কেমন কথা! জ্বর হয়েছে বলে আমি আইসক্রিম খাব না আর। তাও আবার সারাজীবনের জন্য।’
‘চেহারার কী করেছ দেখেছ তুমি? এত সুন্দর চোখ জোড়ার নিচে কালি পড়ে গেছে। এই যে এত সুন্দর আর্ট করা ঠোঁট তোমার। দেখেছ কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। সেদিকে খেয়াল আছে তোমার?’
অয়নন্দিতা অবাক নয়নে ফারহানের দিকে তাকিয়ে আছে। পলক যেন পড়ছেই না তার চোখে। এই প্রথম ফারহান তার সৌন্দর্যের বর্ণনা দিল।
কিছুক্ষণ পর ফারহানও নড়েচড়ে বসে। সে কী সব বলল এতক্ষণ। অজান্তেই অয়নন্দিতার সৌন্দর্যের বর্ণনা করে দিল।
ফারহানের কাছ থেকে পজেটিভ ভাইব পাচ্ছে অয়নন্দিতা। তার মানে ফারহানও কি পজেটিভ হচ্ছে এই সম্পর্কটায়।
ফারহান কোনো রকমে কথা কাটিয়ে উঠে যায় বিছানা থেকে। আসছি বলে সোজা ঘর থেকে বের হয়ে যায়। অয়নন্দিতা তখন বিছানায় বসে মুচকি হেসে ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার স্বপ্ন কি তবে সত্যি হতে চলেছে? ফারহান কি তবে তাকে ভালোবাসতে শুরু করে দিয়েছে?
অফিসে কাজের চাপ অনেক। রমজান শেখ সব দিক গুছিয়ে উঠতে পারছেন না। ফারহানকেও দেখতে হচ্ছে সব দিক। কাজে মন বসে গেলে কোনদিক দিয়ে যে সময় চলে যায় তার আর হিসেব থাকে না।
ল্যাপটপে হাত রেখেই ঘড়িতে নজর দেয় ফারহান। বিকেল সাড়ে চারটা বেজে গেছে। সে এখন পর্যন্ত লাঞ্চ করেনি। অয়নন্দিতা খেয়েছে কি না কে জানে। ফারহান চট করেই ফোনটা হাতে নেয় আর ফোন করে অয়নন্দিতাকে।
বার কয়েক বাজতেই অয়নন্দিতা ফোন রিসিভ করে।
‘হ্যালো।’
‘কী করছ?’
‘শুয়ে ছিলাম।’
‘দুপুরে খেয়েছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘মেডিসিন নিয়েছ?’
‘হ্যাঁ। আপনি খেয়েছেন?’
সে যে এখনও লাঞ্চ করেনি এটা অয়নন্দিতাকে বলা যাবে না। বললেই বিপদ৷ তাই অকপটে মিথ্যা বলে দেয়,
‘হ্যাঁ।’
‘কখন ফিরবেন?’
‘দেখি কখন ফেরা যায়।’
‘আমি বসে থাকতে থাকতে বোর হয়ে গেছি।’
‘কেন বসে থাকছ কেন? সাজি কোথায়, মা কোথায়?’
‘সাজি বাসায় নেই। মা বের হয়েছে। ফারাশ ভাইয়াও নেই।’
‘তুমি বাসায় একা?’
‘আপাতত একা। নিচে তো বুয়া আছে।’
‘মহা মুশকিল।’
‘আমিও বের হবো।’
‘কোথায় যাবে?’
‘রিক্সায় ঘুরব।’
‘আবার!’
‘হ্যাঁ। মন চাইছে।’
‘সুস্থ হও আগে। এরপর ঘুরতে নিয়ে যাব।’
‘আমি তো সুস্থ-ই আছি।’
‘রেস্ট নাও। রাখছি এখন।’
ফারহান ফোন রেখে দেয়৷ অয়নন্দিতার মনটাও খারাপ হয়ে যায়। আজ কতদিন সে ঘরে বন্দী হয়ে রয়েছে। এখন শরীর মোটামুটি সুস্থ। বাড়ির বাইরে পা রাখলে বেশ ভালো হতো। বিছানা থেকে নামে অয়নন্দিতা। বারান্দায় গিয়ে বসে। শান্ত আকাশটার দিকে মুখ তুলে তাকায়। মাঝে মাঝে দুই একটা পাখি উড়ে যাচ্ছে। নীড়ে ফেরার সময় হয়েছে তাদের। তাই এদিক-সেদিক ছোটাছুটিতে ব্যস্ত তারা।
নিজেকে ভীষণ একা মনে হচ্ছে তার। এই সময় মামীর সঙ্গে থাকলে ভালো হতো। মামী নিশ্চয়ই তাকে একা রেখে কোথাও বের হতো না। শাশুড়িকেও দোষ দেওয়া যাচ্ছে না। তিনি কাজেই বের হয়েছেন। নয়তো এই কয়েকটা দিন তিনি যথেষ্ট করেছেন তার জন্য। সাজি পড়াশোনার জন্যই বের হয়েছে। ফারাশকে তো আর বলা যায় না পাশে বক্সে গল্প করো।
সবাই সবার মতো ব্যস্ত এ বাড়িতে৷ শুধু তারই ব্যস্ততা নেই। আজ মা বাবাকে মনে পড়ছে অয়নন্দিতার। বাবা থাকলে হয়তো বাবার সঙ্গে বসে গল্প করত। মা থাকলে হয়তো চুলে হাত বুলিয়ে দিত। কতদিন হলো মায়ের হাতের স্পর্শ পায় না অয়নন্দিতা। চোখে পানি এলেও নিজেকে দমিয়ে রাখে সে। এখন আর কাঁদে না তেমন। শুধু দোয়া করে তারা যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক।
হঠাৎ গাড়ির শব্দ কানে যায় অয়নন্দিতার। ইজি চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে নিচে তাকায় সে। গেইট দিয়ে গাড়ি ঢুকেছে। হয়তো শাশুড়ি মা এসেছেন। একটা ছোটো নিঃশ্বাস গোপন করে অয়নন্দিতা। তার মন হয়তো এই সময় অন্য কাউকে আশা করেছিল। সব সময় সব আশা পূরণ হয় না। এটা অয়নন্দিতার জানা আছে।
চেয়ার থেকে উঠে ঘরে ঢুকতেই ভূত দেখার মতো চমকে যায় সে। তার সামনে ফারহান দাঁড়িয়ে আছে। এই সময় ফারহান কখনও বাড়ি আসে না। অয়নন্দিতা যে মনে মনে ফারহানকেই আশা করেছিল আর ফারহানও যে এইভাবে তার সামনে প্রকট হয়ে যাবে এটা তার ভাবনায় একেবারেই ছিল না। অয়নন্দিতা বেশ অবাক হয় ফারহানকে দেখে। প্রশ্ন করে,
‘আপনি! এই সময়ে?’
‘আশা করোনি বোধ হয়?’
অয়নন্দিতা সত্যিটাই বলে,
‘চেয়েছিলাম যাতে আপনি আসেন। কিন্তু ভাবিনি যে আসবেন।’
‘তোমার চাওয়া-পাওয়াগুলো আমার সামনে একবার প্রকাশ করতে পারো তো।’
‘সব চাওয়া-পাওয়া কি আর প্রকাশ করা যায়?’
‘যায় কি না জানি না। তবে করে দেখতে হয়।’
‘হঠাৎ বাড়ি এলেন যে?’
‘তৈরি হয়ে নাও। বের হবো আমরা।’
‘কোথায় যাব?’
‘রিক্সায় ঘুরতে যাবে না?’
অয়নন্দিতা যেন এক মুহুর্তেই আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেছে। মনে মনে চাওয়া জিনিসটা যখন বাস্তবে রুপ নেয় তখন এর থেকে ভালো কিছু হয়তো আর হয় না। অয়নন্দিতা এক গাল হেসে মুগ্ধ নয়নে ফারহানের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের ইশারায় ধন্যবাদ জানায়৷ আর ফারহান, সেও অয়নন্দিতার মুগ্ধ ইশারায় একদৃষ্টে চেয়ে আছে।
চলবে………………………….