দ্বিতীয়_সূচনা পর্ব_৩৪

0
1634

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৩৪
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

কয়েক সেকেন্ডের আদুরে আক্রমণের পর যখন দু’জন একটু দূরে সরে গেল তখনও অয়নন্দিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ফারহানের দিকে। এই মুহুর্তটার জন্য অয়নন্দিতা প্রস্তুত ছিল না। ভালোবাসাময় স্পর্শ সব নারী-ই চায় তবে এইরূপ কিছু আশা করা যায় না। অয়নন্দিতা মনে মনে এমন কিছু চাইলেও ঘটনাটা যে এইভাবে ঘটবে এটা সে ভাবতেও পারেনি। ফারহানও অয়নন্দিতার দিকে তাকিয়ে আছে। অয়নন্দিতার ডান হাতে এখনও সিগারেট জ্বলছে। ফারহান ধীর ভঙ্গিতে অয়নন্দিতার হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে নেয়।
অয়নন্দিতা প্রশ্ন করে,
‘এটা কী হলো?’
‘কী হলো?’
‘এই যে এখন যা ঘটে গেল।’
‘ঘটার ছিল বলেই ঘটে গেল।’
‘তাই বলে এভাবে?’
‘বার বার বলেছিলাম, সিগারেটটা দিয়ে দাও, দিয়ে দাও। তুমি দিয়েছিলে? উল্টো বললে, তুমি নাকি সিগারেট টানবে। এমনভাবে বললে যেন মনে হচ্ছে, সিগারেট একটা চকলেট। খেতে ভীষণ মজা। তুমি সেই মজার খাবার মিস করতে চাও না। শোন, সিগারেট নিয়ে ছেলেখেলা করতে নেই। সিগারেট একবার যাকে ধরে তাকে নিঃশেষ করে তবে ছাড়ে।’
‘আপনি নিঃশেষ হয়েছেন?’
‘বোঝাতে পারব না তোমায় কতটা ক্রাইসিসের মধ্যে আমি থেকেছি। তুমি জানো না, কত রাত আমি নির্ঘুম কাটিয়েছি৷ আমার সেই নির্ঘুম রাতগুলোর সঙ্গী তোমার মতো কোনো সুন্দরী রমনী হয়নি। আমার সেই নির্ঘুম রাতের সঙ্গী হয়েছে এই সিগারেট। আমার শত যন্ত্রণার ভাগ তোমার মতো কোনো রূপবতী মেয়ে নেয়নি। নিয়েছে এই সিগারেট। আমার জীবনে এই সিগারেটের ভূমিকা অনেক। বুঝলে?’
অয়নন্দিতা এতক্ষণ মন দিয়ে ফারহানের কথাগুলো শুনেছে। অয়নন্দিতা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, ল্যাম্পপোস্টের আলোতে ফারহানের চোখ চিকচিক করছে। জমাট বাঁধা পানিটুকুন ফারহানের শত কষ্টের প্রমাণ।
অয়নন্দিতা অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করে,
‘আপনার চোখে পানি কেন?’
অয়নন্দিতার প্রশ্ন শুনে ফারহানের খেয়াল হয় কথাগুলো বলতে গিয়ে তার চোখে পানি এসে জমাট বেঁধেছে। ফারহান ঘাড়টা উঁচু করে চোখের পানি উধাও করার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অয়নন্দিতা বুঝতে পেরে বলে ওঠে,
‘চোখের পানি ওইভাবে উধাও করা যায় না। চোখের পলক ফেলে পানি বের করে দিতে হয়।’
‘নাহ। পুরুষ মানুষ চোখের পানি ফেলে না।’
‘আপনি কখনও ফেলেননি?’
বোকার মতো বলে তো দিয়েছে যে, পুরুষ মানুষ চোখের পানি ফেলে না। অথচ একটা সময় সে নিজেই ঘরের দরজা আটকে প্রচুর চোখের পানি ফেলেছে। কিন্তু অয়নন্দিতার প্রশ্নের উত্তর নেই বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। এই প্রশ্নের যে কোনো উত্তর নেই তা অয়নন্দিতা জানে। জানে বলেই দ্বিতীয় বার আর প্রশ্ন করেনি।
অয়নন্দিতার মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছা করে ফারহানের অতীত কী ছিল। কিন্তু অয়নন্দিতা সাহস পায় না। কেউ একজন যদি তার অতীত সম্পর্কে বলতে না চ্য তাহলে তাকে জোর করা যায় না। অয়নন্দিতা ফারহানকে জোর করতে চায় না। কিন্তু আজ ফারহানকে এইভাবে দেখে অয়নন্দিতার জানতে ইচ্ছে করছে।
ফারহান৷ হাতের সিগারেটটা শেষ করে অয়নন্দিতার হাতটা ধরে বলে,
‘ঘুমাবে না? চলো, অনেক রাত হলো।’
‘আপনার সিগারেট টানা শেষ হয়েছে?’
অয়নন্দিতার কথা শুনে ফারহান হেসে দেয়।
‘হ্যাঁ, শেষ। চলো।‘
অয়নন্দিতাও ফারহানের হাতটা শক্ত করে ধরে বলে,
‘চলুন।’

পাশাপাশি দু’জন মুখোমুখি হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। ফারহানের একটা হাত অয়নন্দিতার চুল এবং মুখশ্রীকে স্পর্শ করছে। ফারহানের ছোঁয়ায় অয়নন্দিতা নিরাপদ অনুভব করে। জরুরী নয় যে, সব ছোঁয়া নোংরা হবে। আবার এটাও জরুরী নয় যে, সব ছোঁয়া নিরাপদের হবে। কিন্তু এই ছোঁয়া নিরাপদের, এই ছোঁয়া শান্তির।
অয়নন্দিতা হালকা হেসে ফারহানকে বলে,
‘সকালে অফিসে যাবেন তো। ঘুমিয়ে পড়ুন।’
‘সকালে অফিসে যাব না। আগে তোমায় নিয়ে বাসায় যাব। তোমার রেখে ফ্রেশ হয়ে এরপর অফিস যাব।’
‘আপনি আমায় নিয়ে যাবেন?’
‘হ্যাঁ। কেন, যাবে না আমার সঙ্গে?’
ফারহানের কথাটা অয়নন্দিতার কানে অসহায়ত্বের মতো শোনাল। অয়নন্দিতা এক সেকেন্ড সময় না নিয়েই বলে দিল যে সে ফারহানের সঙ্গেই যাবে।
মিনিট পাঁচেক পর ফারহান একটা আবদার জুড়ে দেয় অয়নন্দিতার কাছে।
‘অয়নন্দিতা, শুনছো?’
ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে অয়নন্দিতা ফারহানের দিকে তাকায়।
‘শুনছি। বলুন।’
‘আমার বুকে মাথা রাখবে?’
এমন আশ্চর্যজনক আবদার শুনে এত রাতে অয়নন্দিতা সত্যিই অবাক হয়। সে এর আগেও অনেক রাত ফারহানের সঙ্গে একই বিছানায় কাটিয়েছে। ফারহান কখনও এইভাবে তাকে বলেনি। অয়নন্দিতার নির্বাক চাহনি দেখে ফারহান বলে,
‘অবাক হবার তেমন কিছুই হয়নি। আমি শুধু পরখ করতে চাই।‘
‘কী পরখ করতে চাচ্ছেন?’
‘তোমার মাথা এই বুক স্পর্শ করলে কেমন অনুভূতি হবে। এটাই পরখ করব।’
‘অনুভব মাপতে চাইছেন?’
‘হয়তো তাই-ই।’
‘একটা প্রশ্ন করি?’
‘করো।’
‘রাগ করা যাবে না কিন্তু।’
‘করব না।’
‘অতীতে যিনি ছিলেন সে বুকে মাথা রাখার পর কেমন অনুভূতি হয়েছিল?’
ফারহান অয়নন্দিতার দিকে তাকিয়ে আছে। অদ্ভুত প্রশ্ন করেছে অয়নন্দিতা। হয়তো জানার কৌতূহল অনেক বেশি তার। নয়তো দেখতে চাইছে কার প্রতি কেমন অনুভূতি। ফারহান বেশি কিছু না বলে অয়নন্দিতাকে ইশারা করে। ইশারায় সম্মতি জানিয়ে অয়নন্দিতা ফারহানের বুকের এক পাশে তার মাথা রাখে। অয়নন্দিতার চুলের ঘ্রাণ তখন পুরোপুরি ভাবে ফারহানকে কাবু করে ফেলেছে। এক হাত দিয়ে অয়নন্দিতার এক বাহু জড়িয়ে রাখে ফারহান।
অয়নন্দিতা ভাবছে সম্পর্কটা আরেকটু এগোলে ভালো হতো। মানুষটা খারাপ না। এমন একজন মানুষ কী করে এতটা কষ্ট পায়? মানুষটার অসম্ভব এক ক্ষমতা আছে। তার ভালোবাসার ক্ষমতা এতটাই বেশি যে, অন্য কেউ খুব সহজেই তার প্রেমে পড়তে বাধ্য হবে।
বুকের যে পাশটায় অয়নন্দিতা মাথা রেখেছে সেই পাশটা কিছু সময় পর স্যাতস্যাতে হয়ে যায়। ফারহান বুঝতে পেরে অয়নন্দিতা মাথায় হাত রেখে বলে,
‘তুমি কাঁদছ কেন? কেঁদো না। আমার দুঃখে খুব কম মানুষ কেঁদেছে। আমি কখনও কাউকে আমার কষ্ট দেখাইনি সেইভাবে। শতভাগের মধ্যে মাত্র বিশ ভাগ দেখাতেই তোমার এই অবস্থা। একেবারে কেঁদে অস্থির। বাকি আশি ভাগ দেখালে তো তোমায় বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। এইভাবে কখনও কাঁদবে না। জানি না কতটা সত্যি হবে, তবুও বলি তোমায়, হয়তো জীবনে কোনো না কোনো সময় একটা খারাপ সময় তোমার পার করতে হবে। ভেঙে পড়বে না। ভেঙে পড়লেই তুমি দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাবে। শক্ত থাকবে সব সময়। দেখবে একটা সময় পর সমস্ত কষ্ট চেপে রাখার অসাধারণ ক্ষমতাটা তুমি জব্দ করতে পেরেছ।’
ফারহানের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকা অয়নন্দিতা কখন যে ঘুমিয়ে গেছে সেটা আর ফারহান উপলব্ধি করতে পারেনি। সাড়াশব্দ না পেয়ে যখন অয়নন্দিতার দিকে তাকায় তখন দেখতে পায় অয়নন্দিতা ঘুমিয়ে আছে তার বুকে। ঘুমন্ত অয়নন্দিতার মুখখানা একটা নিষ্পাপ বাচ্চার মতো লাগছে ফারহানের কাছে। ফারহান একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে অয়নন্দিতার দিকে। এইভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ফারহানও ঘুমিয়ে পড়ে তার খবর ছিল না।
বাইরে তখন নিস্তব্ধতা। আকাশে অর্ধচাঁদ সেই সাথে কিছু তারা। হালকা হিম বাতাসও বইছে। ঘরের ভেতর এক জোড়া দম্পতি পরম নিশ্চিন্তে একজন অন্যজনকে আঁকড়ে ধরে ঘুমাচ্ছে।
ভালোবাসতে এর থেকে বেশি কিছু আর কী লাগে?

চলবে………………………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here