দ্যা_গিফ্ট। [০১] মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

দ্যা_গিফ্ট। [০১]
মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

গুরুগম্ভীর মন নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ভূমি। তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারো চিন্তা। কিছুক্ষণ আগে আলমারি গুছাতে গিয়েছিলো সে।অনেকদিন হলো আলমারিতে হাত লাগায় না । সমস্ত জামাকাপড় এলোমেলো হয়ে পরে আছে। আরাব বড্ড অগোছালো ছেলে। সে কিছুতেই নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে পারে না। পুরো রুম জুরেই তার জিনিসপাতি বিচরণ করে। আলমারি সমস্ত জামাকাপড় বের সেটা আবার সেখানেই গুছিয়ে রাখছে ভূমি। তখন তার চোখ আটকে যায় একটা গিফ্ট বক্সের দিকে। যেটা গত এক বছর আগে কোন এক অঞ্জাত ব্যক্তি পাঠিয়েছিল তার নামে। এটা নতুন কিছু নয়। গত পাঁচবছর যাবৎ ভূমির জন্মদিনের দিন এই অঞ্জাত ব্যক্তি ভূমিকে গিফ্ট পাঠিয়ে যাচ্ছে। গিফ্টগুলো খুব ইউনিক। প্রথমবার পাঠিয়েছিল একটা নীল শাড়ি আর শেষের কবিতা বই। দ্বিতীয়বার পাঠিয়েছিল, মেকআপ এর সরঞ্জাম। তারপরের বার কয়েটা নেইল পালিশ,গিফ্টগুলো দেখে খুবই আশ্চর্য হয় ভূমি। কারন অঞ্জাত ব্যক্তি ভূমির পছন্দের জিনিসগুলোই তাকে পাঠিয়েছে। কিন্ত কে পাঠায়?? কোন বারই প্রেরকের নাম দেওয়া থাকে না। প্রথম দুই বছর ঢাকা থেকে আসলেও পরের তিনবছর যাবৎ মৌলভীবাজারের পোষ্ট অফিস থেকে পাঠানো হয় গিফ্টটা। কিন্ত সেখানে ভূমির বাপ দাদার কোন আত্নীয় থাকে বলে তো মনে হয় না ভূমির। তাহলে প্রেরক কে?? তাছাড়া ভূমির বর্তমান ঠিকানাই বা সে জানে কি করে। পঞ্চমবার যখন গিফ্ট আসে তখন সেটা না দেখেই আলমারিতে তুলে রাখে ভূমি। আজ যখন আলমারি টা গুছাতে যায় তখন তার চোখ আটকিয়ে যায় এই গিফ্ট বক্সের উপর। এক বছর আগের গিফ্ট এখনো সেটা খুলে দেখেনি ভূমি। ভেবেই আশ্চর্য হয় সে। গিফ্ট বক্স বিছানার উপর নিয়ে সেটা খুলতে থাকে। বক্স খুলার পর সেদিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ভূমি। কারন গিফ্টবক্সে ছিলো জুতা। এগারো নাম্বারের জুতা। যেটা ভূমির পায়ের মাপের জুতা। এই গিফ্টটা বেশ ভাবাচ্ছে তাকে। কে পাঠাচ্ছে এই গিফ্ট। আরাভ ছাড়া তার ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ শুধু একজনই জানতো। দিগন্ত। কিন্তু সে তো তাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে। সে তো গিফ্ট পাঠাচ্ছে না।

দিগন্তের কথা কখনো বলা হয়নি আরাবকে। অনেকবার বলতে চেয়েছিল কিন্তু বলা হয়ে উঠে নি। কলেজে থাকা কালিন সময়ে দিগন্তের সাথে পরিচয় হয় ভূমির। তারপর ভালোলাগা, ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা। কলেজের মাঠে ক্যান্টিনে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে তাদের।কত মধুময় ছিলো সেই দিনগুলো। কিন্তু কলেজের গণ্ডি পার হতেই দিগন্তের হাতে একটা ম্যালিগন্যান্ট টিউমার দেখা যায়। যেটা সময়ের সাথে সাথে ক্যান্সারের রুপ নেয়। কেমোথেরাপি, রেডিও থেরাপি সবই প্রয়োগ করাহয় ক্যান্সার কোষের উপর কিন্ত দিগন্তকে বাঁচানো যায় নি। এইভাবে দিগন্তের চলে যাওয়াটা ঠিক মেনে নিতে পারে নি ভূমি।

ওই ঘটনার বেশ অবসাদে ভুগতে থাকে ভূমি। কাউন্সেলিংয়ে যেতে হয় তাকে। বাড়িতে বাবা মায়ের থেকে বেশ সাপোর্ট পায় সে। তারপর আস্তে আস্তে ভুলতে থাকে দিগন্তকে। কিন্তু তারপর থেকে আর কোন ছেলেকে নিয়ে কোন আগ্রহ দেখায় নি ভূমি। লেখাপড়া নিয়েই সময় পাড় করতো সে। তারপর হঠাৎ করে আরাবের সাথে আলাপ হয় ভূমি। ওদের প্রথম আলাপ ছিলো হসপিটালের বাইরে একটা ফার্মেসীতে।

ফ্ল্যাশব্যাক,,

ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরার সময় রাস্তার পাশে অনেক লোকজন দেখে রিক্সা থামাতে বলে ভূমি।রিক্সাওয়ালা রিক্সা থামিয়ে দেয়। ভূমি তার হাতের ইশারায় রাস্তার পাশে থাকা লোকগুলোকে দেখিয়ে বলে,

-ওইখানে এতো ভীড় কিসের।

-এক্সিডেন্ট হইছে ওইখানে। তাই হগ্গলে মিল্যা তারে দেখছে।আবার কেও কেও মোবাইল নিয়্যা আইস্যা ফটো তুলছে। ফটো।

-আপনি রিক্সাটা ওইখানে নিয়ে যাবেন প্লিজ। অনুরোধের সুরে বলল ভূমি।

রিক্সাওয়ালা তার রিক্সাটা নিয়ে সেই এক্সিডেন্ট হওয়া লোকটা কাছে যায়। ভূমি রিক্সা থেকে নেমে সবাইকে ঠেলে লোকটার কাছে যায়। লোকটাকে দেখে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে সে। এক্সিডেন্ট হওয়া লোকটার মাথা ফেটে সেখান থেকে রক্ত পরছে অনেক। বাম হাতে কিছুটা কেটে গেছে সেখান থেকেও রক্ত পরছে।ডান হাতে ছিঁলে গেছে। জিন্সপ্যান আর সু-জুতা পরে থাকার কারনে পায়ে কোন রকমের ক্ষতি হয়নি।

এখানে উপস্থিত সকলের দিকে তাকিয়ে তাছিল্যের হাসি দিলো ভূমি।হায়রে আজব মানুষ, এখানে একজন রক্তাক্ত অবস্থায় পরে আছে আর তারা সকলে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। ভূমি রিক্সাওয়ালার সাহায্য নিয়ে লোকটাকে নিয়ে হসপিটালে যায়। হসপিটালে পৌঁছাইতে নার্স এসে লোকটাকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যায়। ভূমি আর রিক্সাওয়ালা বাহিরে অপেক্ষা করতে থাকে। যদিও এখান থেকে তাদের চলে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু লোকটার ঞ্জান না ফেরা পর্যন্ত রিক্সাওয়ালা যেতে নারাজ। তাই ভূমিকেও এখানেই থাকতে হয় তার সাথে।

কিছুক্ষণ পর ডক্টর আসলে ভূমি আর রিক্সাওয়ালা তার কাছে এগিয়ে যায়। আর লোকটার সম্পর্কে জানতে চায়। ডক্টর বিষন্ন মন নিয়ে বলে,

– মাথা থেকে প্রচুর পরিমানে রক্ত বের হয়েছে। আমাদের এখুনি ও পজেটিভ রক্ত লাগবে। ফাস্ট।

ডক্টরের কথা শুনে রিক্সাওয়ালা আর ভূমি একে অপরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়।কারন তাদের করো ব্লাডগ্রুপ ও পজেটিভ নয়। ভূমি রিক্সাওয়ালা কে বলে,

-আপনি এখানে বসুন। আমি দেখছি রক্তের ব্যবস্থা করতে পারি কি না। তারপর ভূমি সেখান থেকে বেড়িয়ে আসে। আর সামনে যাকে পায় তাকেই জিগ্যেস করে, আপনার ব্লাডগ্রুপ কি ও পজেটিভ। দু-একজন ও পজেটিভ ব্লাডগ্রুপের মানুষ মিললেও তাদের আবার নানান সমস্যা। কারো রক্তে ভাইরাস আবারও কেও ড্রাগ এডিকশন। বর্তমানে যুবসমাজের এই এক সমস্যা।

দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ। এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক, অর্থাৎ ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৫ হাজার ৩০০। আর ৭ বছরের বেশি কিন্তু ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোর ও তরুণদের মধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৫৬ হাজারের কিছু বেশি। মোটকথা বর্তমান তরুন সমাজে বড্ড টেনশন। সেই টেনশন কমানোর জন্যে নাকি তাদের মাদক দ্রব্য সেবন করতে হয়।

হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে ফার্মেসির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে ভূমি। তখন সামনেই একটা লোককে দেখে তার গা গুলিয়ে আসে। কি বিশ্রী দেখতে, হলুদ দাঁত বের করে মোবাইলে কারো সাথে কথা বলছে আর সিগারেটের ধোয়া উড়াচ্ছে। ভূমি হাত দিয়ে তার নাক মুখ চেপে ধরে উল্টোদিকে হাটা শুরু করলো। ফার্মেসির কাছে আসতেই দেখতে পায় একটা যুবক উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে কয়েকটা প্রেসকিপশন নিয়ে ফার্মেসির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভূমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

-আপনি কি সিগারেট খান??

হঠাৎ আগন্তুক এই রমনীর কথা শুনে যুবকটা বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলে অস্ফুটভাবে বলে,

-মানে,,,,,

-আমি তো খাঁটি বাংলাতে বললাম। না বুঝার কি আছে। ওকে ফাইন, আপনি কি কোন মাদক দ্রব্য সেবন করেন।

-সরি। আই ডোন্ট ইউস, আমি কোন মাদক সেবন করি না।

-আপনার ব্লাড গ্রুপ জানতে পারি!!!

-ও পজেটিভ।

-আচ্ছা চলুন আমার সাথে। একজনকে রক্তদিতে হবে। বলেই সামনের দিকে কয়েক পা এগিয়ে যায় ভূমি। যুবকটা এখনো সেই আগের জায়গাতেই থাকে। আসলে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। তাছাড়া এই মেয়েটাই বা কে??সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে ভাবছে। ভূমি পিছনের দিকে যখন দেখতে পায় যুবকটি তার আগেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে তখন ভূমি আবারও বলে উঠে,

-দাঁড়িয়ে আছেন কেন??আসুন আমার সাথে। যুবকটি মাথা নাড়ায় আর ফার্মেসির লোকটার হাতে প্রেসকিপশন দিয়ে ভূমির পিছন পিছন যায়।

ডক্টর যুবকটির ব্লাডের কয়েকটা টেষ্ট করালেন তারপর তার শরীর থেকে রক্ত নিয়ে এক্সিডেন্ট হওয়া লোকটার শরীরে দিলেন।

হসপিটালে সবাই ভূনির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সেদিকে খেয়াল নেই ভূমির। সে শুধু একটা কথাই ভাবছে লোকটার ঞ্জান কখন ফিরবে। ওয়েটিংরুমে বসে লোকটার কথা ভাবছিলো ভূমি এমন সময় যেই যুবকটি আসে ওয়েটিংরুমে। যুবকটাকে দেখে ভূমি দাঁড়িয়ে যায় আর ইনোসেন্ট মুখ করে বলে,

-আপানাকে কি বলে ধন্যবাদ দিবো বুঝতে পারছি। আজ যদি আপনি না থাকতেন তাহলে হয়তো,,,, । আচ্ছা আপনার কোন অসুবিধা হয়নি তো।

ভূমির এমন অপরাধী সুরে কথা বলা দেখে যুবকটি স্মিত হাসে। অতঃপর বলে,

– আই এম ফাইন। ডোন্ট ওরি। এভাবে বলছেন কেন? আপনি যা করছেন একদম ঠিক করছেন। বাই দ্যা ওয়ে,
আপনার নামটা জানতে পারি??

-আমাইরা ইত্তেহাদ ভূমি। অধরোষ্ঠ প্রসারিত করে বলল ভূমি। ভূমির হাসি দেখে যুবকটার অধরেও হাসি ফুটে উঠলো। তারপর সে হ্যান্ডসেক করার জন্যে তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

-আমি জুহায়িন আরাব।

জুহায়িন আরাব নামটা শুনে ভূমির চোখ বড় বড় রসগোল্লার মতো হয়ে গেলো। এই নামটা সে আগেও অনেকবার শুনেছে। হ্যাঁ এটাতো তাদের এক প্রফেসরের ছেলের নাম। যে কিছুদিন আগেও ক্যাম্পাসে একটা ছেলেকে মেরেছিলো। আবার পরে সেই তাকে হসপিটালে নিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছিল। কলেজে সকলের মুখে এমনটাই শুনেছে সে। ভূমি জড়ানো গলায় বলল,

-খ-খন্দকার জু-জুহায়িন আরাব।

আরাব নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকিয়ে হাসলো। তারপর বলল, আগে থেকেন চিনেন দেখছি। যুবকটি তার হাত নামিয়ে নিলো। ভূমি তার সাথে হ্যান্ডসেক করে নি।

-নাম শুনেছি শুধু। আচ্ছা আপনার দেরী হয়ে যাচ্ছে না।

আরাব বুঝতে পারছে তাকে এখন থেকে তাড়ানোর জন্যে বলছে এসব। তাই সে বলল, চলেই তো যাচ্ছি। তারপর সে রিক্সাওয়ালার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা যাবেন না। চলুন আমি আপনাদের পৌঁছে দিই। রিক্সাওয়ালা কিছু বলবে তার আগেই ভূমি বলে উঠলো,

-তার কোন প্রয়োজন নেই। আমরা যেতে পারবো। ভূমির এই কথাতেও মৃদু হাসলো আরাব। তারপর সে ভূমির মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ভালো থাকবেন। এক মুহূর্তও অপেক্ষা করে না আরাব, চলে যায় সে।

লোকটার ঞ্জান ফেরার পর ভূমি আর রিক্সাওয়ালা দুজনেই হসপিটাল থেকে চলে যায়।

পরের দিন ইউনির্ভাসিটিতে থেকে ফেরার পথে নিতুকে নিয়ে আবারও হসপিটালে যায় ভূমি। লোকটাকে দেখার জন্যে। সেখানে গিয়ে জানতে পারে রাতে লোকটার পরিবারে লোকজন এসে তাকে নিয়ে চলে গেছে। ভূমি স্বস্তির শ্বাস ফেলে। তারপর সে সোজা বাসায় চলে আসে

বিকালবেলায় ছাদে বসে গল্পের বই পড়ছে ভূমি।অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভায় নীল আকাশে সাদা মেঘ আর ধরনীর বুকে প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য। প্রকৃতি প্রেমিদের কাছে এমন দৃশ্যবলি খুব প্রিয়। আর এমন একটা পরিবেশে বই পড়ার অনুভূতি আলাদা। বেশ মনোযোগ দিয়েই বই পড়ছে ভূমি। এমন সময় তার মোবাইলে একটা এসএমএস আসে । খানিকক্ষণ পর ভূমি মোবাইল হাতে নিয়ে এসএমএস টা ভিউ করে নেয়। এসএমএস টা দেখেই কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকে সে। এরকম মেসেজ তার ফোনে আগেও আসছে। তখন তো দিগন্ত ছিলো সেই দিতো। এখন তো সে নেই তাহলে মেসেজটা কে পাঠালো। মেসেজটা ছিলো এরকম,

-আমার আকাশে চাঁদ দেখার আমন্ত্রন রইলো।

চলবে,,,,,,,

দ্যা_গিফ্ট। [০১]
মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here