রাত তিনটার সময় তিতলি আমার ঘুম ভাঙিয়ে বললো,ফুপি আমার বাবা মামণির ছবি নিয়ে কাঁদছে।আমি তিতলিকে জড়িয়ে ধরলাম।তিতলির বয়স মাত্র তিন।ভাইয়া আর ভাবীর একমাত্র সন্তান সে।বিয়ের পরপরই ভাবী সন্তানসম্ভবা হয়।সবাই অনেক খুশি হলেও ভাবী আমাকে আড়ালে ডেকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে,আমি এখনই বাচ্চা নিতে চাই না।সবটাই তোমার ভাইয়ার জোড়াজুড়িতে হয়েছে। তোমার ভাই একটা অমানুষ।তোমার ভাই খালি আমাকে সন্দেহ করে।মনে করে আমি অন্য পুরুষের সঙ্গে পালিয়ে যাবো।ছিঃ কেমন নোংরা মানসিকতার মানুষের সাথে বাস করছি।
ভাবী খুব কান্নাকাটি করছিলো সেদিন।আমি তখন মাত্র নাইনে পড়ি।কি বলা উচিৎ এমন পরিস্থিতিতে আমি জানতাম না।তাই চুপই ছিলাম। চার বছর পর আজও আমি চুপ করেই আছি।তিতলি আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।ওকে কি বলবো আমি?
ভাবী বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে আজ তিন দিন হলো।যাওয়ার সময় একটা চিঠি রেখে গেছে।চিঠির সারমর্ম এই, তিনি ভাইয়ার মতো ছোটলোক মানুষের সাথে সংসার করে হাঁপিয়ে উঠেছেন। তার পক্ষে আর সম্ভব না। তবুও ভাইয়া তাকে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে এখানে-সেখানে।থানা-পুলিশের উপর নাকি তার বিশ্বাস নেই।মাকে চিঠিটা দেখিয়েছি।মা দাঁতে দাঁত চেপে অশ্লীল কিছু গালি দিয়েছেন ভাবীকে।আসলে ভাবী কার সাথে পালিয়ে গেছে আমি জানি। ফারহান ভাইয়ের সাথে। ফারহান ভাই হলো আমার ভাইয়ার বন্ধু। সবচেয়ে ভালো বন্ধু। তিনি প্রায় প্রতিদিনই আমাদের বাড়ি আসতেন। ভাইয়ার সাথে গল্প করতেন,দাবা খেলতেন। কিন্তু,এই তিনদিন ধরে তিনি আসছে না এই বাড়িতে, তার ফোনও বন্ধ। শুধু এইটুকুতে কাউকে সন্দেহ করা বোকামি। কিন্তু, আমি একদিন ভাবীকে আর ফারহান ভাইকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে ফেলেছিলাম। সেদিন আব্বু-আম্মু সহ সবাই খালামনির বাসায় ছিল। পরিক্ষা থাকার কারণে আমি যেতে পারিনি আর ভাবী আমার সঙ্গে ছিলো। যাইহোক,এই ঘটনা ভাইয়াকে বলায় ভাইয়া বিশ্বাস করে নি।আমাকে উল্টা বকাবকি করেছে কেন এতো বড় মিথ্যা বলেছি তাই। এখনো ভাইয়া বিশ্বাস করছে না যে ভাবী ফারহান ভাইয়ার সাথে পালিয়ে গেছে।
আমি তিতলিকে ডাকলাম। বললাম, তুমি এতো রাতে একা একা বাবার রুমে কেনো গিয়েছো যদি তোমাকে ভূত এসে খেয়ে ফেলতো।
তিতলির তার ছোট্ট হাত দুটো দিয়ে চোখ মুছলো।বললো,যুথি ফুপি আমার বাবার জন্য অনেক মায়া লাগছে।আমি আর বাবা মিলে ঠিক করেছিলাম মায়ের জন্মদিনে কি কি সারপ্রাইজ দিবো। কিন্তু,মামণি কোথায় গেলো?
আমি বললাম, তোমার মা-ও তোমাদের জন্য সারপ্রাইজ আনতে গেছে। এখন ঘুমিয়ে পরো।
তিতলি এরপরেও খানিকক্ষণ কাঁদলো।কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পরলো। কিন্তু, আমার চোখে ঘুম আসলো না আর।ভোরের আলো ফুটলো ধীরে ধীরে।আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। বারান্দায় এসে দেখি ভাইয়া বারান্দায় বসে সিগারেট খাচ্ছে। ভাইয়ার সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস টা কি আবার ফিরে এলো?মা এসে দাঁড়ালো আমার পাশে। ভাইয়া কে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বললো,ঐ জানোয়ারের বাচ্চা তুই আবার সিগারেট খাওয়া ধরছিস?সাথে গাঞ্জা-মদও ধর। বেহাইয়া ছোটলোক কোনখানের বউয়ের জন্য কান্দে।তোর বউ তো আছিলো আস্তা বেশ্যা।ঐ বেশ্যার জন্য আরেক ফোঁটা চোখের পানি ফেললে তোরে আমি খুন করমু।মা চেঁচাতে চেঁচাতে চলে গেলেন। এখন তিনি রুমে গিয়ে কাঁদবেন আমি জানি।
মায়ের এতোগুলো কথা ভাইয়ার কান পর্যন্ত পৌঁছেছে বলে মনে হলো না। হঠাৎ, ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললো,যা তো যুথী আমার জন্য এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আয়।আমি গোসলখানায় ঢুকলাম।
আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। এরপর চা বানাতে গেলাম।
চা খেতে খেতে ভাইয়া বললো,বুঝলি যুথি ফারহান ফোন করেছিল।বললো,মালিহা তার সাথেই আছে এবং ভালো আছে।আমি যেন আর খোঁজাখুঁজি না করি।ডিভোর্স লেটার সময় মতো পৌঁছে যাবে।
আমিও ভেবে দেখলাম মালিহা যেহেতু ভালো আছে তাহলে আমার ঝামেলা করে লাভ কি?তাকে আর তিতলিকে ভালো রাখার চেষ্টা ই সবসময় করেছি।
কথাগুলো বলেই ভাইয়া ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো যেন খুব হাসির কথা বলেছে সে।
হাসি থামিয়ে বললো,আজকে তিতলির জন্য অনেক বড় সারপ্রাইজ গিফট আনবো বলিস ওকে।
আমি বললাম,ভাইয়া তুমি কোথায় যাবে?
ভাইয়া চোখ বড়বড় করে বললো,ওমা অফিস যেতে হবে না? এমনিতেই তিন দিন কামাই হয়ে গেছে। আচ্ছা, তোর কিছু লাগবে?
আমি নাবোধক উত্তর দিয়ে চলে এলাম।
মাকে সব বললাম।মা রেগে গেলেন খুব। বললেন,তোর শফিক মামারে কল দিতেছি এখুনি।ঐ কালসাপের বাচ্চারে জেলের ভাত ঠিকই খাওয়ামু।বলমু,পালায় যাওয়ার সময় দশ ভরী স্বর্ণ আর ৩ লাখ টাকা সঙ্গে নিয়ে গেছে চুরি করে।
শফিক মামা অনেক বড় পুলিশ অফিসার।
মা তাকে ফোন করতে যাচ্ছিলেন এমন সময় ভাইয়া আমাদের রুমে আসলো।বললো,মা তুমি কাউকে ফোন করবে না।কোনো পুলিশ কেইস হবে না।আমি ওকে মাফ করে দিলাম।
মা ভাইয়ার দিকে রাগী চোখে তাকালেন।”তোর নাম বাদশা রাখছিলাম কিন্তু তুইতো আসলে একটা নেড়ীকুত্তা।বউ লাত্থি মেরে গেছেগা এখনো বউয়ের পক্ষ ছাড়ছ না।”
বাদশাহ ভাইয়া মুচকি হেসে বললো,আমি সৃষ্টিকর্তার বিচার দেখতে চাই মা।এতো যত্ন, ভালোবাসার দেয়ার পরও যে ঠকাতে পারে সৃষ্টিকর্তা তাকে কি শাস্তি দেন আমি দেখতে চাই।
আমার ভাইয়া এমনি।তার জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতিও যে করবে তার প্রতিও সম্ভবত ভাইয়া কোনো প্রতিশোধ নিবে না।সব স্রষ্টার উপর চাপিয়ে দিবে।বলবে,স্রষ্টাই বিচার করবে।
আমরা তিন ভাইবোন।প্রথমে ভাইয়া তারপর ঝিনুক আপু আর তারপর আমি। ঝিনুক আপুও অনেক অদ্ভুত ধরনের।এইযে বাড়িতে এতো বড় ঘটনা ঘটলো তাতে তার কোনো হেলদোল নেই।দিব্যি খাচ্ছে-দাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে।যেন বাড়ির বউ পালিয়ে যাওয়াটা একটা স্বাভাবিক বিষয়।
কথায় কথায় আমি ঝিনুক আপুকে বললাম,ভাইয়া আজকে তিতলির জন্য সারপ্রাইজ গিফট আনবে।
অমনি ঝিনুক আপু লাফিয়ে উঠলো।বললো,চল তাহলে আজকে মজার কিছু রান্না করি।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।এই পরিস্থিতিতে? ঝিনুক আপু বললো,কেন কি সমস্যা?
এরপর সত্যি সত্যিই আপু আমাকে নিয়ে বাসার সবার পছন্দের খাবার রান্না করলো। বাবার প্রিয় সরষে ইলিশ,মায়ের জন্য গরুর মাংস ভূনা। বাদশাহ ভাইয়ার জন্য ছাদ থেকে কবুতর ধরা হলো।সেই কবুতর ঝিনুক আপু-ই জবাই করলো;রান্না করলো।তিতলির জন্য বানানো হলো আইসক্রিম আর পুডিং।সব মিলিয়ে হুলস্থুল ব্যাপার।
মা প্রথমে খুব গালিগালাজ করলেন। বিলাপ করে বললেন,ছেলে একটা বউ পাগল আর মেয়ে একটা আরেক ছাগল।কখন কি করতে হয় বোঝেনা। আল্লাহ আমি কই যাই?
তবে কিছু ক্ষন পর মা নিজেও এসে আমাদের সাথে হাত লাগালেন। রান্নাবান্না শেষ হওয়ার পর শুরু হলো ঘর সাজানো।তিতলির জন্মদিনের জন্য কিনা সব বেলুন, রঙিন কাগজের ফুল এইসব দিয়ে ঘর সাজানো হলো। এরপর,আপু নিজেও শাড়ি পরে সাজলেন।তিতলিকে সাজালেন,আমাকেও জোর করে সাজতে বাধ্য করলেন।হুট করেই ঘরের পরিবেশ বদলে গেলো।তিতলি বেলুন ফুটানোর জন্য বায়না করতে লাগলো।ঝিনুক আপু গম্ভীর হয়ে বললো, এইগুলো বেলুন না এগুলো হলো ভূতের পেট। এইগুলো ফুটালে ভূতেরা তোকে মেরে ফেলবে।তিতলি খিলখিল করে হেসে ওঠে।বাবাও এসে যোগ দেয় ওদের সাথে। শুধু মা মুখ কালো করে তাকিয়ে থাকে। এককথায়,পুরো বাড়ি জুড়ে উৎসবের আমেজ দেখা গেলো।
সন্ধ্যা বেলায় ভাইয়া বড় বড় দুইটা টেডিবিয়ার আর একটা সুন্দর সাদা জামা নিয়ে ফিরলো। ঝিনুক আপু মুখ গম্ভীর করে বললো,এই তিতলি এটা কিন্তু পরীর মেয়ের জামা।তোর বাবা চুরি করে নিয়ে এসেছে।
তিতলি আবার হাসতে লাগলো।এই ছোট্ট বয়সেই সে ভূত-পরীর গল্প যে বানানো তা বুঝতে শিখে গেছে।
আচ্ছা, ভাবীর কি এই নিষ্পাপ শিশুর মিষ্টি হাসি মাখা মুখটা মনে পরবে না?
ফারহান ভাইয়ার সাথে কি সে সত্যিই সুখে ঘর করতে পারবে?
এমন সময় আমাদের নিচতলার ভাড়াটিয়া ইশু ভাবী এলেন আমাদের বাসায়।ইশু ভাবী হলেন এই বাড়ির সাংবাদিক।সবার খবর তার কাছে থাকে,কার ছেলে ফেইল করলো,কার মেয়ে প্রেম করে,কার বাড়িতে ঝগড়া হয়েছে সব। তিনি এসে যখন দেখলেন,ঘরময় আনন্দের ছড়াছড়ি তার চোখ ছানা বড়া হয়ে গেলো।বললো,একি যুথি এতো হাসাহাসি করছো কেন তোমরা সবাই?
আমি কিছু বলার আগেই মা জবাব দিলেন, বললেন,এক চরিত্রহীন আপদ বিদায় হইছে সেজন্য কি আমরা সারাক্ষণ কাঁদবো?
ইশু ভাবী থতমত খেয়ে গেলেন। বললেন,না আন্টি কি যে বলেন। আপনাদের দেখে আমার অনেক খুশি লাগছে।বাদশাহ ভাইয়ের উচিৎ বিয়ে করে ফেলা।
মা বললেন,তা তো করবেই। আমার ছেলে কি দেবদাস হয়ে থাকবে না কি?ওর চেয়ে হাজার গুণ সুন্দর মেয়ে আমি বাদশার বউ করে আনবো।
ইশু ভাবী বললেন,আন্টি আমার কাছে পাত্রীর অভাব নেই। আমার দুঃসম্পর্কের বোন তিশি।অসম্ভব সুন্দর। এক্কেবারে পরী।আপনি ছবি দেখবেন?
মা হ্যাঁ না কিছুই বললো না।ইশু ভাবী ফোন থেকে ছবি বের করে দেখালেন।
ছবি দেখে মায়ের মন গললো মনে হয়।মা বললো,মেয়ে সুন্দর হলে তো হবে না।বাপ-মা কি করে?
ইশু ভাবী বললেন,আন্টি মেয়েরা হলো জমিদার বংশ বুঝলেন।আদি পুরুষ জমিদার ছিলো। কিন্তু, এখন টাকা পয়সা বিশেষ নাই,তবে খুব সৎ লোক উনারা ।
মা জানতে চাইল, মেয়ের বয়স কত?
ইশু ভাবী বললেন,১৬ তে পরলো এবার।
আমরা সবাই চমকে উঠলাম,কিহ?এটা তো বাচ্চা মেয়ে।ছবিতে শাড়ি পরেছে বলে বড় লাগছে।
ইশু ভাবী বললো, ছোট ই ভালো।যেমনে বলবা তেমনে চলবে।ঠিক না আন্টি? আপনি বললে ওকে আমার বাসায় আনি।আপনি সামনাসামনি দেখেন। এরপর দরকার পরলে ওদের বাড়ি যাবেন।
মা ঝিম মেরে রইলো। ঝিনুক আপু বললো, আপনি যান তো ভাবী।এই দুধের বাচ্চার জন্য প্রস্তাব আপনি কোন আক্কেলে দেন? আমার ভাইয়ের বয়স ৩২। বুঝলেন?ঐ মেয়ের ডাবল। আমাদের যুথিও ঐ মেয়ের চেয়ে তিন বছরের বড়। আপনার বিবেক দেখে আমি হতবাক।
মা ঝিনুক আপুকে থামিয়ে বললো,ঐ মেয়েটাকে এনো তোমার বাসায় আমি দেখতে চাই।
আমি আর ঝিনুক আপু দুইজনই মায়ের কথা শুনে থ হয়ে গেলাম।
#ধূসর_অনুভূতি
পর্ব:-০১
লেখক: শাপলা