#ধূসর_অনুভূতি
পর্ব:১২
চারদিন হাসপাতালে থাকার পর বাদশাহ ভাইয়া বাসায় এসেছে। তার মধ্যে,আর কোনো পাগলামির চিহ্ন দেখা যায় নি।যদিও ডাক্তার-রা ছাড়তে চায়নি। কিন্তু, বাদশাহ ভাইয়া এক প্রকার জোর করেই চলে এসেছে।
তবে, বাসায় আসার পর থেকে তেমন কারো সাথে কথা বলছে না।একা একা রুমে বসে থাকছে সারাক্ষন। মেহেদী ভাইয়া এসেছে আমাদের বাসায় বাদশাহ ভাইয়ার খোঁজ নিতে।আসলে সে ঝিনুক আপুকে দেখতেই এসেছে আমি বুঝতে পারছি।খালি এদিক ওদিক তাকিয়ে ঝিনুক আপুকে খুঁজছে।
একপর্যায়ে আমাকে জিজ্ঞেস ই করে ফেললো, ঝিনুক কই?
আমি কিছু বলার আগেই ঝিনুক আপু গোসলখানার দরজা খুলে মাথা বের করে বললো,বলে দে ঝিনুক সাগরে।
বলেই হাসলো। মেহেদী ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো, তোমার মুখে কি হলুদ বাটা দিছো?
ঝিনুক আপু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। মেহেদী ভাইয়া বললো, কেন?
ঝিনুক আপু বললো, কেন আবার মা বললেন রূপ চর্চা করতে।
~তোমার না জ্বর , এখন এই সবের কি দরকার…
ঝিনুক আপু বললো,জ্বর বলে কি বিয়ের কনে-কে অসুন্দর লাগলে চলবে?
মেহেদী ভাইয়া কিছু বললো না।সম্ভবত সে ভেবেছে আপু তার স্বভাব মতো উল্টা পাল্টা কথা বলছে।
বিকালে আমি আর ঝিনুক আপু ছাদে গেলাম।
মেহেদী ভাইয়া আমাদের দেখেই এগিয়ে এলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,যুথি তোমার আপুর সাথে আমার একটু কথা আছে।
আমি লজ্জা পেয়ে খানিকটা দূরে সরে এলাম।
মেহেদী ভাইয়া বললো, ঝিনুক তুমি আর আমার রুমে আসো না কেন?আমি তো চাবি রেখেই যাই।
ঝিনুক আপু বললো, আপনার ঘরে আমি ঢুকবো কিসের জন্য?
মেহেদী ভাইয়া বললো,প্লিজ মজা করো না তো। তুমি আমার সাথে দেখা করছো না,ম্যাসেজ দিলে রিপ্লাই দিচ্ছো না।এমন করছো কেন?
ঝিনুক আপু বললো,আজব তো আপনার সাথে আমার এতো কথা বলতে হবে কেন?
মেহেদী ভাইয়া ঝিনুক আপুর হাত ধরে ফেলল। বললো, তুমি এমন করে কি মজা পাও?একটু সিরিয়াস হও দয়া করে।
ঝিনুক আপু ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো, আপনার তো সাহস কম না, আমার হাত ধরছেন কোন সাহসে? অসভ্য।
ঝিনুক আপু দ্রুত পায়ে হেঁটে ছাদ থেকে নেমে গেলো। মেহেদী ভাইয়া উদ্ভ্রান্তের মতো আমার দিকে তাকালো,বললো, তোমার আপু সারাক্ষন আমার সাথে মজা করে…
আমি বললাম, ভাইয়া আপুর কিন্তু সত্যিই বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
মেহেদী ভাইয়া মনে হয় বুঝলো না আমার কথা।হেসে বললো, তোমার বোনের এসব ফাজলামির সাথে তুমিও যুক্ত আছো দেখছি।
আমি আর কিছু বললাম না।নেমে চলে এলাম।
ঘরে ঢুকে দেখি আপু একটা বই মুখের সামনে ধরে কাঁদছে।আমার এতো মায়া লাগলো।
আপু আমার দিকে তাকিয়ে বললো,স্যাড একটা উপন্যাস পড়ছি।প্রথম পেইজ পড়েই চোখে পানি চলে আসলো বুঝলি…
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।আপু বইটা উল্টা ধরে আছে।
এমন সময় মা প্রবেশ করলেন রুমে। আপুকে কাঁদতে দেখে বললেন,তোর চোখে পানি কেন?
ঝিনুক আপু বললো,তোমাকে বলে কোনো উপকার হবে না তাই বলতে চাইনা মা।
মা রাগী চোখে তাকালেন,কি উপকার চাস তুই শুনি? মেহেদীর সাথে বিয়ে দিতাম তোকে?বল না বল। জবাব দিচ্ছিস না কেন?
ঝিনুক আপু মাথা নিচু করে বললো,হ্যাঁ আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।
মা অদ্ভুত ভাবে হাসলো, বিয়ের দরকার কি তোর? বিয়ের পরের কাজ তো আগেই সাইরা ফেলছিস ঐ ছোকড়ার সাথে।মনে করিস আমি কোনো খবর রাখি না? সারাদিন তুই যে ওর ঘরে থাকিস আমি কি জানি না মনে করছিস?
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম,ছিঃ মা তুমি এসব কি বলছো?
মা আমার দিকে তাকালেন,তোর সাথে কথা বলছি আমি?তুই বের হ এখান থেকে….
ঝিনুক আপুর চোখে পানি টলমল করছে।
-কিরে জানোয়ার তোর চোখে পানি আসে কেন এত?
তোর সাত কপালের ভাগ্য তুই শাহীন কে বিয়ে করে উন্নত একটা দেশে থাকবি বুঝছিস? দুই দিনের পরিচয়ের ছেলের জন্য কান্দিস? মায়ের থেকেও বেশি হয়ে গেলো এই ছেলে?
ঝিনুক আপু বললো, তোমার আচরণ দেখে তো মাঝে মাঝে ভুলেই যাই তুমি আমার মা।
মা হঠাৎই খুব হিংস্র হয়ে উঠলো।
কিছু বুঝে উঠার আগেই আপুর চুল ধরে এলোপাথাড়ি কয়েকটা চড়-থাপ্পড় মারলো।
বাদশাহ ভাইয়া পাশের ঘর থেকে ছুটে এসে ঝিনুক আপুকে জড়িয়ে ধরলো।
নাহয় আজকে আপুর খবরই ছিলো।মা আপুর দিকে তাকিয়ে বললো, সুন্দর ভাবে সেজে গুজে হাসিমুখে থাকবি।কালকে তোর চাচারা আসবেন,কোনো ধরনের বেফাঁস কথা যদি তোর মুখ দিয়া বেরোয় আমি যে তোরে কি করবো ঝিনুক…
মা বের হয়ে গেলেন ঘর থেকে।
বাদশাহ ভাইয়া বললো,কি করছিস তুই?মা কেন তোকে মারলো?
ঝিনুক আপু বললো, কেন ভাইয়া?মা কিছু করতে পারে না? তোমার কেন মনে হয় আমিই কিছু করছি…আগেও তুমি সবসময় এমনই করতা।মালিহা ভাবী কিছু বললেই…….
আমি আপুকে চুপ করিয়ে দিলাম।
বাদশাহ ভাইয়া আর কিছুই বললো না। নিজের ঘরে চলে গেল।
.
পরদিন বাসায় তোড়জোড় চলতে লাগল।মা রান্না বান্না করছে।আমিও মাকে সাহায্য করছি।
বড় চাচা,চাচি আর শাহীন ভাইয়া এলেন সন্ধ্যায়।
ঝিনুক আপুকে পরী আপু এসে সাজিয়ে দিলো।
বাবা মন খারাপ করে বসে রইলো বারান্দায়।আমি আর মা বাবাকে ডাকতে গেলাম।দেখি বাবার চোখে পানি।বাবা বললো, শেষমেশ এ ছিলো আমার ঝিনুকের কপালে।একটা আস্ত লম্পট ও….
মা চেঁচিয়ে উঠলেন, তোমার মেয়ে কি ধোয়া তুলসী পাতা?কত বড়লোক ওরা তোমার ধারনা আছে? তোমার মতো তো ফকির না। ঝিনুকের ভাগ্য যে শাহীন ওকে পছন্দ করে।
বাবা মিনমিন করে বললো, আমার মেয়েটাকে বিদেশে নিয়ে মেরে ফেললেও তো আমি জানবো না।
হঠাৎ,শাহীন ভাইয়া বারান্দায় আসলো।
হাসি মুখে বললো,কি চাচা,এখন থেকেই কান্না শুরু করে দিয়েছেন…এখনো তো বিয়েই হয় নি।
আমি অবাক হলাম খুব…এতো বছর পরে কথা বলছে,না সালাম না কোনো কুশল বিনিময়।
শাহীন ভাইয়া তাকালো আমার দিকে।যেন বিষধর সাপের চাহনি।
হুট করে একটা ভয়াবহ স্মৃতি মনে পরলো আমার।তখন আমি অনেক ছোট। বাসার সবাই অর্থাৎ আমাদের আর শাহীন ভাইয়াদের পরিবার ফুপুর বাড়িতে গেছে। ফুপুর বাড়ি বেশি দূরে না। আমার বোরিং লাগছিল দেখে আমি চাবি নিয়ে বাসায় চলে আসি। হঠাৎ দেখি বড় চাচাদের ফ্ল্যাটে তালা নেই,ভিতর থেকে লক। উনাদের ফ্ল্যাট নিচ তলায় ছিলো।তাই, কৌতুহল বশত জানালার একটা ছোট ছিদ্র দিয়ে উঁকি দিই।দেখি শাহীন ভাই আর একটা মেয়ে ঘরের মধ্যে।বুঝাই যাচ্ছে মেয়েটাকে উনি জোর করে ধরে নিয়ে এসেছে।মেয়েটার মুখ বাঁধা ছিল।আর, শাহীন ভাইয়াকে দেখাচ্ছিলো একটা পশুর মতো।
সেই দৃশ্য আমার ছোট মনে কত প্রভাব ফেলেছিল আমি বলে বুঝাতে পারবো না। শাহীন ভাইয়ার কুকীর্তির অনেকখানি ই তার বাবা মা জানতো কিন্তু, কিছুই বলতো না। আবার,বললেও শাহীন ভাই পাত্তা দিতো না।কয়েক বার পুলিশের হাতেও পরতে হয়েছিল তাকে। ছাদের ঘরে প্রায়ই বন্ধু বান্ধব এনে মদ্যপানের প্রতিযোগিতা চলতো।এইসবই তো মা দেখেছেন। সবাই দেখেছে।তবুও, এখন নাকি বিদেশে গিয়ে শাহীন ভাই পুরো বদলে গেছেন। একদম খাঁটি মানুষ হয়ে গেছেন।আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কুকুরের লেজ কি সোজা হয় কখনো?
বড় চাচা,চাচি বসার ঘরে বাবা মায়ের সাথে কথা বলছেন। তাদের কি কি স্বয়-সম্পত্তি হয়েছে সেইসব শুনাচ্ছেন আরকি।
হঠাৎ দেখি শাহীন ভাইয়া আমাদের রুমে প্রবেশ করলো। আমার আর আপুর দু’জনের ই কলিজা কেঁপে উঠলো।
শাহীন ভাইয়া হাসলো।কি কুৎসিত সেই হাসি।
বললো,কি ব্যাপার তোরা দুই বোন আমাকে দেখে এমন চুপসে গেলি কেনো?
আমরা কিছুই বললাম না। শাহীন ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললো,যা তো আমার আর ঝিনুকের জন্য দুইকাপ কফি বানিয়ে আন…নাকি তোদের বাসায় কফি নাই?হাহাহ…
আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না উনি আমাকে এই ঘর থেকে সরাতে চাইছে। ঝিনুক আপুরও বুঝতে বাকি রইলো না।আপু আমার দিকে অসহায় ভাবে তাকালো।তার দৃষ্টি বলে দিচ্ছে আমাকে এঘর থেকে না যেতে।
শাহীন ভাইয়া অগ্নিগরম চোখে আমার দিকে তাকালো। কিন্তু,মুখে ঠিকই হাসি আছে।”কিরে যুথি কফি অনতে বললাম না।যা…”
আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেরিয়ে যেতে লাগলাম।
শাহীন ভাইয়া আমাকে পিছু ডেকে হেসে বললো,কফি নিয়ে আবার দুই মিনিটের মধ্যেই চলে আসিস না বোকার মতো কেমন?
আমি কিছু না বলে বেরিয়ে এলাম। দাঁড়িয়ে রইলাম দরজার কাছেই। কিচেন এ গেলাম না আপু কে ফেলে।
শাহীন ভাইয়া ঝিনুক আপুকে বললো,তো ঝিনুক তোকে তো আবার তুমি বলতে করে বলতে হবে রাইট?
আচ্ছা,ঠিকাছে বলো জান তোমার তেজ কি এখনো আছে?নাকি এখন নিস্তেজ হয়ে গেছো?অবশ্য মেয়ে মানুষের তেজ দেখতে আমার ভালোই লাগে।
ঝিনুক আপু বললো,মানে বুঝতে পারছি না।
– মানে না বুঝার তো কিছু নেই। আমার নামে পুলিশের কাছে সাক্ষী দিয়েছিলা আমি মেয়ে আনছি বাসায় ভুলে গেছো? আবার আমাকে বলছিলা আমি কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্ট মনে নাই? এখন তো সেই কুকুরের বউ হবা তুমি… তোমার জন্য মায়াই লাগছে ঝিনুক। হাহা।
ঝিনুক আপু চুপ করে বসে রইলো। কোনো প্রতিউত্তর করলো না।
শাহীন ভাইয়া-ই আবার বলে উঠলো, এই গরমের মধ্যে ওড়না পেঁচিয়ে আছো কিসের জন্য?ওড়না সরিয়ে বসো আমার সামনে লজ্জা করে লাভ কি….
এরপর এমন একটা কুৎসিত কথা বললো যেটা আমার কানে আসার পর আমি আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। আমার সারা শরীর কেঁপে উঠলো।
আমি ছুটে বসার ঘরে চলে এলাম।
মা কে ডেকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললাম,মা শাহীন ভাইয়া আপুর রুমে বসে আছে কেন? বের হতে বলো।
মা নিস্পৃহ ভাব নিয়ে বলে উঠল, বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়ে গেছে।এখন বসে থাকুক নাহয় শুয়ে থাকুক তুই দেখতে যাস কিসের জন্য?
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।”মা তুমি যে এমন আমি কল্পনাই করতে পারিনি।”
– কেমন আমি? খারাপ? তোর বোন ভালো? মেহেদীর সাথে রুমের মধ্যে ঢলাঢলি করছিল আর তুই বাইরে দাঁড়িয়ে পাহাড়া দিচ্ছিলি কই তখন তো এসে বলিস নি আমাকে….
আমি বললাম, চুপ করো মা। তোমার কন্ঠ শুনতেও আমার মন চাচ্ছে না।
– শোন যুথি। বিয়ের পর সুখে থাকতে হলে একটা জিনিস ই লাগে সেটা হলো টাকা।যেটা বিয়ের আগে তোদের বয়সী ছেলে মেয়েরা বোঝে না…
-প্লিজ তুমি যাও।
মা চলে গেলেন। হঠাৎ দেখি শাহীন ভাইয়া দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
আমি অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকলাম।
বসার ঘরে সবাই কথা বলছিল ,সেখানে গিয়ে আমি দাঁড়ালাম। হঠাৎ করেই,দরজায় কে যেন পাগলের মতো বেল বাজাতে লাগলো।
মা গিয়ে দরজা খুললো। মেহেদী ভাইয়া হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো।মা বিরক্ত হয়ে বলল,এখন যাও তুমি মেহেদী।পরে এসো…
আমি ই মেহেদী ভাইয়া কে ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলাম।
মেহেদী ভাইয়া চেঁচিয়ে উঠলো,”ঝিনুক কই?কই আমার ঝিনুক?”
.
চলবে,,
.
লেখক: শাপলা