ধূসর অনুভূতি পর্ব-১৪

0
1837

#ধূসর_অনুভূতি
পর্ব:১৪
দেখতে দেখতে একমাস হয়ে গেলো। আমাদের বাসায় যে কি চলছে নিজেও বুঝতে পারছি না।কখনো কখনো মন চায় সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যাই।
বড়চাচা বাবার উপর ক্ষোভ থেকে বাড়ির অর্ধেক টা বিক্রি করে দিয়েছে এক অসৎ লোকের কাছে।যে প্রতিদিন মদ খেয়ে বাড়ি আসে। সারাক্ষন ই ছাদে বসে থাকে, আজেবাজে লোকের আড্ডা লেগেই থাকে। তার কারণে আমরা কেউই ছাদে উঠতে পারি না।তাকে কিছু বলাও যায়না কারণ সেও তো বাড়ির মালিক।এই লোকের আচরণে সবাই ত্যাক্ত-বিরক্ত;বড় চাচা ইচ্ছা করেই এমন একটা লোকের কাছে বাড়ি বিক্রি করেছে যেন আমাদের কষ্ট পেতে হয়।ইশিতা ভাবীরা বাসা ছেড়ে চলে গেছে।কারণ,এমন মাতাল যেই বাড়িতে থাকে সেখানে কি কোনো ভদ্রলোক থাকতে পারে?
বাবা তো এমনিতেও সংসারের কোনো বিষয়ে কথা বলেন না। আত্মভোলা মানুষ।ঠিক ভুল সব সিদ্ধান্ত মা-ই নিতো আগে। এখন তো সে-ও আমাদের উপর রাগ করে একদম চুপচাপ হয়ে গেছে।নিজে থেকে কিছু বলে না ,আমরা কিছু জিজ্ঞেস করলেও হ্যাঁ,না করে উত্তর দেয়।এই বাড়িতে বর্তমানে তিতলি ছাড়া কারো সাথেই মা কথা বলে না।
বাদশাহ ভাইয়া কিছু দিন ভালোই ছিল।জবের জন্য চেষ্টা করছিলো পাশাপাশি তার বন্ধুর দোকানে বসতো।
কিন্তু, সাতদিন ধরে বাদশাহ ভাইয়ার অবস্থা খুবই খারাপ।কাউকে চিনতে পারে না।ঘরের মধ্যে ভাঙচুর করে।তাই,তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।কলেজে পড়ার সময় মা আমাকে আর ঝিনুক আপু কে কিছু গয়না গড়িয়ে দিয়েছিল।নানিও কিছু দিয়েছিলেন। ঝিনুক আপু এখন সব বিক্রি করে দিয়েছে ভাইয়ার চিকিৎসার জন্য।
ঝিনুক আপু একদম অন্যরকম হয়ে গেছে। আগের মতো চঞ্চল, হাসিখুশি আর নেই। সারাক্ষন কপালে চিন্তার রেখা,সংসারের পুরো ভারটাই তার উপর। এখন আর ইউনিভার্সিটি তে ক্লাস করতে যায়ও না। সারাদিন বাইরে থাকে। বাসায় ফিরে রাত আটটায়।বাসা থেকে খানিকটা দূরে একটা কম্পিউটার টিচিং সেন্টারে ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কাজ করছে দুপুর পর্যন্ত। এরপর টানা ৫ টা টিউশনি করছে। বাসায় ফিরেও ফুরসৎ নেই। আমাদের পাশের বিল্ডিং এ একজন ড্রেস ডিজাইনার থাকে।তার থেকে বিভিন্ন ড্রেস এনে সেলাই করা,স্টোন বসানো এইসব কাজ করে রাত ১২টা পর্যন্ত কমপক্ষে। অনেক সময়সাপেক্ষ কঠিন কাজ কিন্তু পারিশ্রমিক খুবই কম।তবুও,এই কম টাকাই বা কে কাকে দেয়।আমিও আপুকে রাত্রে বেলা সাহায্য করি।দু-একটা ছাত্রও পড়াই দিনে। ঝিনুক আপু বলে, প্রতিদিন ইউনিভার্সিটি যাবি।ক্লাস কামাই দেওয়া চলবে না।
ঝিনুক আপু-ই এখন বাজার সদাই করছে। বাবার ওষুধ কিনছে। আমার পরিক্ষার ফি দিচ্ছে।তিতলির জন্য দিনশেষে খেলনা নিয়ে ফিরছে। ভাইয়ার চিকিৎসার টাকা দিচ্ছে।
আপুর অনেক কষ্ট হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু,আপু সব সহ্য করে নিচ্ছে।কারণ,আজ যদি তার শাহীন ভাইয়ার সাথে বিয়ে হতো তাহলে হয়তো বড়চাচা আমাদের উপর রাগ করে মুখ ফিরিয়ে নিতেন না।
কোথাও না কোথাও আপু সব কিছুর জন্য নিজেকেই দোষী মনে করে।যদিও তার আসলে দোষ নেই,সব দোষ আমাদের কপালের।
আগে কি সুন্দর ছিল সবকিছু। এখন সেসব শুধু ই স্বপ্ন।
একটা জিনিস বুঝতে পারলাম, মানুষ যখন সুখে শান্তিতে থাকে তখন তার সঙ্গী-সাথির অভাব হয় না। কিন্তু,দুঃখের সময়টুকু বড়ই একাকী পার করতে হয়।
জীবনের সমস্ত গ্লানি,কষ্ট-দুঃখ,যন্ত্রনা,ব্যর্থতা অর্থাৎ সবচেয়ে কঠিন মূহুর্তগুলো কাটাতে হয় একা একাই।কেউ সাহায্য করবে,পাশে এসে দাঁড়াবে এই চিন্তা করা বোকামি।কত আত্মীয় স্বজন কিন্তু কেউই বলছে না ওদের পাশে দাঁড়াই।সবারই নিজ নিজ সংসার আছে,সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত।
মেহেদী ভাইয়া আর ঝিনুক আপুর বিয়েটা হয়নি। পরিবারের সবাইকে এমন অনিশ্চয়তার সাগরে ফেলে নিজে বিয়ে নামক ভেলায় চড়ে তীরে চলে যাবে এমন কাজ আর যে-ই করতে পারুক ঝিনুক আপু তো পারবে না। মেহেদী ভাইয়ার সাথে আর কথাও হয়নি ঝিনুক আপুর…আমি বলেছি যোগাযোগ করো, তোমার যে বিয়ে হয়নি সেটা জানাও।
ঝিনুক আপু বলে,পারবো না রে।ওর যদি গরজ থাকে ও নিজেই খোঁজ নিবে। আমাদের বিয়ে হওয়ার কোনো দরকার নেই।বিয়ে করে আমি স্বার্থপরের মত স্বামী নিয়ে সুখে সংসার করতে পারবো না তোদের কষ্টে রেখে।আর, মেহেদীর বাবারও আমাকে পছন্দ না।উনি বলেছেন আমরা নাকি পাগলের বংশ। আমার ভাই পাগল,তাই আমিও পাগল হবো একদিন।এমন জায়গায় উনি ছেলেকে বিয়ে করাতে চানও না।
আমি অবাক হয়ে বললাম,আপু তোমাকে এইসব কে বলেছে?
ঝিনুক আপু বললো,শুনেছি একজনের কাছে।কি ব্যাপার মুখ গোমড়া করছিস কেন?তুই কি ফিউচারে তোর ছেলের বিয়ে কোনো মাথা খারাপ মেয়ের সাথে দিবি?দিবি না।সবাই নিজের টা ষোলো আনা বোঝে।তাই বলে,কেউ খারাপ না।
আমি বললাম, আপু তুমি মেহেদী ভাইয়ার সাথে একবার কথা বলো…
– কথা বলতে ইচ্ছা করে না।এই যে এতো সমস্যায় আছি এখন আর কাউকে বলতেও ইচ্ছা করে না। সেদিন এক ফ্রেন্ডকে বলছিলাম যে অনেক আর্থিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।ওমা.. আমার কথা শুনে দেখছি ওর চোখ মুখ কেমন হয়ে গেছে।হয়তো ভাবছে,আমি ওর থেকে ৫-৬ হাজার টাকা ধার চেয়ে বসবো।হাহা…
আমি বললাম, আপু মেহেদী ভাইয়া অন্যদের মতো না তুমি তো জানো।
– না রে বোন আমি এতো কিছু জানি না।ওর সাথে আমার তেমন কোনো সম্পর্কই ছিল না। শুধু একজনের আরেকজনকে ভালো লেগেছিল সেই কথা জানাতেও পারিনি মুখে।আমাকে ও এতো দিনে ভুলেও গেছে হয়তো… যাক ভুলে যাক…
ঝিনুক আপু দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
এইরকম রঙহীন-ধূসর জীবন কাটছিল আমাদের। ঝিনুক আপু প্রায় রাতেই কাঁদে ঘুমের মধ্যেও মেহেদী ভাইয়ার নাম নেয়। কিন্তু, সকাল হলে সব অন্যরকম। একজন কঠোর নারী আত্মপ্রকাশ করে সে।
একদিন ঝিনুক আপু হাসিমুখে এসে বললো,যুথি আমি একটা নতুন চাকরি পেয়েছি।
ঝিনুক আপুর নতুন চাকরি হলো একটা ছোট্ট বাচ্চা কে রাতের বেলায় রাখা। বাচ্চার মা ডাক্তার,সিঙ্গেল মাদার।সপ্তাহে তিনদিন নাইট ডিউটি করেন।ঐ তিনরাত বাচ্চাটাকে আপু রাখবে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।”আপু তুমি এখন আয়ার কাজ করবা?”
ঝিনুক আপু বললো,শোন কোন কাজ ছোট করবি না।এটা তো কোনো পাপ কাজ না।কত বড় বড় অফিসার রা যে ঘুষ খায়, অবৈধ টাকা কামাই করে তাদের দেখলে তো স্যার..স্যার করিস।আর,আমি সৎপথে একটা কাজ করবো সেটা তোর ছোট মনে হয়।ঐ লেডি ডাক্তার বাচ্চা কে আমার কাছে রেখে রাতভর কত রোগীর সেরে ওঠার ওসিলা হবে, এখানে আমারও কৃতিত্ব আছে পরোক্ষভাবে বুঝলি?
আমি আর কিছুই বললাম না।
অনেক দিন পর মা আমাদের ঘরে এলেন, আমাদের সাথে কথা বললেন।
বললেন, ঝিনুক যদি বিয়েটা করতো তাহলে আর দিন রাত এতো কষ্ট করতে হতো না।
ঝিনুক আপু বললো, বিয়ের পর আরো কষ্ট করতে হতো মা। তুমিই বা কেমনে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে টাকা পয়সা পাওয়ার স্বপ্ন দেখো।উল্টা জামাই যৌতুকের আশা করে বসে থাকতো।হাহা।ঐ দেশে ওরা আমাকে শত কষ্ট দিলেও আমি চুপ করে সহ্য করতাম।এখন তো সারাদিন পরিশ্রম, কষ্ট করে এসেও নিজের কাছের মানুষদের মুখ দেখি। মায়ের মুখ দেখি।ঐ যে একটা কবিতা আছে না,দেখিলে মায়ের মুখ, দূরে যায় সব দুখ।
মা আর কিছু বললেন না।চলে গেলেন রুম থেকে।
মায়ের চোখে পানি টলটল করছিলো আমি দেখেছি।
…….
…….
মালিহা আজ ভোররাতে খুব অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছে।তার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠেছে স্বপ্নটা দেখে। আচ্ছা, ভোরের স্বপ্ন কি সত্যি হয়? কোথায় জানি শুনেছিল।স্বপ্নে দেখলো কি সুন্দর একটা সবুজ মাঠ, চারপাশে মৃদু বাতাস বইছে,পাখিরা গান গাইছে।আর, সবুজ ঘাসের উপর তারা তিনজন হাঁটছে।তিতলি মাঝখানে আর তিতলির দুই হাত ধরে সে আর বাদশাহ হাঁটছে‌।তিতলি কি মিষ্টি করে হাসছে। হঠাৎ,সে তিতলির হাত ছেড়ে দৌড়ে কোথায় একটা চলে গেল।তিতলি এদিক ওদিক তাকিয়ে তাকে খুঁজতে লাগলো।মামণি…মামণি বলে ডাকতে লাগলো। কিন্তু, কোথাও আর মালিহার চিহ্নটুকুও নেই। বাদশাহ একাই তিতলির হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ, বাদশাহও তিতলির হাত ছেড়ে চলে গেলো …তিতলি দিগন্ত বিস্তৃত পুরো মাঠটায় একা দাঁড়িয়ে রইলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে বাবা-মা বলে খানিক ক্ষন ডাকলো। এরপর, ঘাসের উপর বসে কাঁদতে লাগলো।
এই পর্যায়ে এসে স্বপ্নটা ভেঙে গেলো।মালিহা শুনতে পেলো ফজরের আজান হচ্ছে।মালিহার বুক কাঁপতে লাগলো।এ কেমন অলক্ষুনে স্বপ্ন! সাধারণত মালিহা ফজরের নামাজ পড়ে না। কিন্তু,আজ খুব সময় নিয়ে নামাজ পড়লো। দীর্ঘ সময় মোনাজাতে কাঁদলো।
কিন্তু, কিছুতেই তার মনের অস্থিরতা কমছে না।
তিতলিকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে তার….
সকাল বেলা ফারহান কে নাস্তা দিয়ে মালিহা সাহস করে বললো,তিতলিকে কিছু দিন এখানে এনে রাখতে পারলে…..
ফারহান একরাশ বিরক্তি নিয়ে মালিহার দিকে তাকালো।
মালিহা সবটুকু কথা শেষ করতে পারলো না আর।
ফারহান অফিসে যাওয়ার পর সে ঘরে একা একা বসে কাঁদলো কিছুক্ষণ।
আচ্ছা, বাদশাহ কি আবার বিয়ে করেছে?১৬ বছরের মেয়েটার সাথে তো বিয়ে টা হয়নি। এখন কি অন্য কাউকে করেছে? বিয়ের পর কি তিতলিকে ভুলে গেছে?এটাই কি স্বপ্নের মানে?
মালিহা ডুকরে কেঁদে উঠলো।”তিতলি মা আমার আমি তোমাকে ফেলে এসে অনেক বড় অপরাধ করেছি। তুমি আমাকে কোনোদিনও ক্ষমা করো না, কোনোদিনও না।”
মালিহা সিদ্ধান্ত নিলো সে তিতলিকে দেখতে যাবে।
কিন্তু, ফারহানকে তো বলতে হবে অন্যকথা। দুইদিন পর মালিহা ফারহানকে বললো,আমি মায়ের কাছে গিয়ে কয়েক দিন থাকতে চাই।
ফারহান প্রথমে রাজি হলো না।
কিন্তু,মালিহা তাকে বুঝালো সন্তানসম্ভবা অবস্থায় প্রতিটা মেয়েরই নিজের মায়ের কাছে থাকতে মন চায়।
কয়েকটা দিনের-ই তো ব্যাপার।সে গেলে কি তার মা তাকে তাড়িয়ে দিতে পারবে?
ফারহানকে অনেক অনুরোধ করে রাজি করালো মালিহা। ফারহান কে রাজি করাতেই লেগে গেল সাতদিন। ফারহান কাঁটা কাঁটা ভাবে বলে দিয়েছে ভুলেও যেন বাদশাহর ধারেকাছে না যায়।তার বউ এখন মালিহা,এটা যেন মনে রাখে।
ফারহানের অফিস খোলা তাই ফারহান এখানেই থাকবে।মালিহা মনে মনে খুশি হলো।সেটাই ভালো।
একাই রওয়ানা হলো সে।যদিও একা না, তার মধ্যে এখন আরো একটি সত্ত্বাও বেড়ে উঠছে।
মালিহা সারা শরীরে কাঁপুনি অনুভব করতে লাগলো।
কতদিন হয়ে গেছে তিতলির গোলগাল মুখটা সে দেখে না। কতগুলো মাস পেরিয়ে গেছে তিতলিকে সে জড়িয়ে ধরতে পারে না।
বাবার সামনে গিয়ে সে কিভাবে দাঁড়াবে? তিতলি কি তাকে দেখে ছুটে চলে আসবে কোলে উঠতে,মনে হয়না আসবে।তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সাথেও কি দেখা হবে?না সে কিছুতেই পারবে না। ঝিনুক,যুথি ওরা তাকে দেখে কি বলবে?
আর, বাদশাহ??
বাদশার কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মালিহা।
তার চোখ বেয়ে পানি পড়ে।ইশ!এতো বড় ভুলটা না করলে কি হতো…..তার সংসারে যেতেই তার আজ এতো সংকীর্ণতায় ভুগতে হচ্ছে….
.
লেখক-শাপলা
চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here