#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_১০
লিখা: Sidratul Muntaz
রুমে নীলচে আলো। বারান্দার স্লাইডিং দরজাটা খোলা।কিন্তু পর্দা লাগানো। তাই বাতাস আসলেও পরিষ্কার আলো আসছে না। নীল পর্দা ভেদ করে নীল আলো আসছে। মাথার উপর শুধু ফ্যানের শনশন শব্দটাই শোনা যাচ্ছে। এছাড়া সবকিছু নিস্তব্ধ। মনে হচ্ছে যেন পুরো পৃথিবী ঘুমিয়ে আছে। আর তোহা একলাই জেগে আছে। তোহার কান্না আসে। মা-বাবার ঝাঝালো শব্দের কঠিন কথাগুলো মনে পড়তেই চিল্লিয়ে কেঁদে বুক ভাসাতে ইচ্ছে করে। বাবার জন্য মায়া লাগছে, মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে। নিজের প্রতি রাগ লাগছে। সব মিলিয়ে বিষাক্ত একটা যন্ত্রণা তোহার মনে কাটার মতো ফুটে আছে। সেই যন্ত্রণায় ঘুম আসছে না। তোহার পাশে প্রায় এক হাত দূরত্ব বজায় রেখে আমীর শুয়ে আছে। তোহার মেনে নিতে কষ্ট হয়, সে একটা অচেনা মানুষের ঘরে, অচেনা বিছানায়, অচেনা কারো স্ত্রী হয়ে শুয়ে আছে। অস্বস্তিতে দম আটকে আসে৷ যদিও আমীর সবসময় তোহার থেকে প্রয়োজনীয় দূরত্ব মানিয়ে চলে৷ ঘুমের ঘোরে ভুল করেও কখনো আমীর তোহার সংস্পর্শে আসেনি।কখনো একজনের হাতের সাথে আরেকজনের হাত ঘেষে না। পিঠের সাথে পিঠ লাগে না৷ ভুলবশতও না। কখনো তোহার গায়ে হাত তুলে দেয়নি আমীর৷ শুধু হাত কেন? আমীরের তপ্ত নিঃশ্বাসের স্পর্শও কখনো তোহা অনুভব করেনি। স্বামী-স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে কেন এই দূরত্ব তোহা জানেনা। অথচ আমীর সবসময় বলে, সে তোহাকে ভালোবাসে। তাদের বিয়ের বয়স তিনমাস। এই তিনমাসের মধ্যে আবার বড় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল। তখন তোহা স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে। টানা তিনদিন ওর কোনো হুশ ছিলনা। এরপর যখন জ্ঞান ফেরে, সে আমীরকে স্বামী হিসেবে অস্বীকার করে। কারণ তোহার ব্রেইন থেকে গত এক বছরের সব স্মৃতি মুছে গেছিল। আমীর বলেছে, তাদের প্রেমের সম্পর্ক সাতমাসের। আর বিবাহিত জীবন তিনমাসের। সব মিলিয়ে এক বছর। তোহার বুঝে আসে না, আমীর যে কয়টা দিন ওর জীবনে ছিল ঠিক সে কয়টা দিনের স্মৃতিই কেন তোহা ভুলে গেল? একটাবারের জন্যও কিছু মনে করতে পারছে না। আমীরকে মনে করতে পারছে না। তোহা যখন এসব নিয়ে বিব্রত হয়ে যায়, চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পাগলের মতো আচরণ করে, তখনি আমীর তোহার সামনে পুরনো স্মৃতি মেলে ধরে। তাদের ভালোবাসার রঙিন, স্বপ্নময় দিনগুলো দেখে তোহা আর কোনোকিছু অস্বীকার করতে পারেনা। তখন আমীরকেই সবচেয়ে আপন ভাবতে ইচ্ছে করে। তোহা ঘাড় ঘুরিয়ে আমীরের দিকে ফিরল। আমীর একহাতে মাথা রেখে অন্যহাতে চশমা মুঠোয় নিয়ে ঘুমাচ্ছে। এই ছেলে সবসময় এভাবে ঘুমায়। চশমাটা এমনভাবে ধরে রাখে, যেন ছাড়লেই হারিয়ে যাবে৷ কি আছে এই চশমায়? আমীরের কপালে ছড়ানো কালো চুলগুলো বাতাসে এলোমেলো ভাবে উড়ছে। মুক্ত অণুর মতো ছোটাছুটি করছে। তোহার ইচ্ছে করে হাত দিয়ে আমীরের কপাল ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু সেটা করতে গেলে আমীরের ঘুম ভেঙে যাবে।
তোহা প্রথম থেকেই খেয়াল করে আসছে। আমীর ঘুমানোর সময় একটুও নড়ে না। একফোঁটাও না। প্রথমে যেভাবে শোয় ঠিক সেভাবেই সারারাত শুয়ে থাকে।আর একটু শব্দ হলেই উঠে যায়। সেই শব্দ যদি ছোট পিন মেঝেতে হালকা ঘষা লাগার মতো সুক্ষ্ম শব্দ হয় কিংবা একফোঁটা পানি টুপ করে পড়ার শব্দ হয় তাও আমীর উঠে যায়। চোখ দুটো এমনভাবে খোলে, যেন সে জাগ্রতই ছিল। এতো সচল মানুষ কিভাবে হয়? এইযে তোহা এখন আমীরের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে, আমীর সেটাও টের পেয়ে গেছে। হঠাৎ চোখ খুলে তাকায়। তোহা ঘাবড়ে যায়। অবাক হয়ে বলল,
” কি হয়েছে?”
আমীর চশমা চোখে লাগিয়ে বালিশ থেকে মাথা উঠিয়ে বলল,
” তুমি ঘুমাওনি কেন এখনো? ”
” আমার ঘুম আসছে না। কিন্তু আপনি উঠে গেলেন কেন?”
আমীর ছোট্ট করে হাই তুলে বলল,” ঘুম ভেঙে গেছে।”
” কিভাবে ভাঙল?”
” তুমি এক মিনিট ধরে আমার দিকে তাকিয়ে আছো। এমন করলে ঘুমাই কিভাবে?”
তোহা চোখ বড় করে আরও বিস্মিত গলায় বলল,” মানে আপনি এতোক্ষণ জেগেছিলেন?”
” না। কিন্তু ঘুমের মধ্যে যদি কেউ একধ্যানে তাকিয়ে থাকে তাহলে আমার ঘুম ভেঙে যায়।”
” অদ্ভুত তো!”
” অদ্ভুত না, ঠিকই আছে। বরং তুমি অদ্ভুত। না ঘুমিয়ে বড় বড় চোখ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছো কেন? কি দেখছো?”
” আপনাকে।”
তোহা মুখ ফসকে কথাটা বলে জিভ কাটল। আমীর মুচকি হেসে বলল,” আমার মুখে কি এমন আছে যে না ঘুমিয়ে আমাকে দেখতে হবে?”
তোহা ভ্রু কুচকালো। মানুষটা আবেগ,ইমোশনও বুঝে না? মুখ চিমসে তোহা উচ্চারণ করল,
” সরি, আর দেখবো না।”
আমীর ফোনের লাইট জ্বালিয়ে ঘড়ি দেখে নিল। এরপর বলল,
” সাড়ে বারোটা বাজে। দশমিনিটে ঘুমাও তো তোহা।”
” দশমিনিটে একটা মানুষ কিভাবে ঘুমায়? আমি কি কম্পিউটার যে দশমিনিটে অফ হয়ে যাবো?”
” মানুষ কম্পিউটারের চেয়েও সক্ষম। তুমি শুধু চোখ বন্ধ করে মনে করো তোমাকে দশমিনিটেই ঘুমাতে হবে৷ দেখবে অটোমেটিক ঘুম চলে আসবে। নাও এখন শুরু করো।”
” আপনি আমাকে ঘুম পাড়াতে চাইছেন কেন? এখন চাইলেও আমার ঘুম আসবে না। মাথাব্যথা করছে।”
” আর তুমি না ঘুমালে সেই টেনশনে আমারও ঘুম আসবে না৷ তাই তোমাকে ঘুমাতে হবে। ঘুমাও, আমি মাথা টিপে দেই।”
” থাক দরকার নেই। ঘুমাচ্ছি।”
” দরকার না লাগলেও মাথা টিপে দেই।”
আমীর সত্যি সত্যি তোহার মাথা টিপে দিচ্ছে৷ তোহা চোখ বন্ধ করে রইল। এই মানুষটা তার খুব যত্ন নেয়। কিন্তু শুধু শারীরিক যত্ন। তোহার শরীর খারাপ করলে কিংবা আঙুলে যদি সূচের মতো কিছু ফোটে তাহলেও পাগল হয়ে যায়। কিন্তু মনের খবর একদমই রাখে না। এইযে এখন তোহার মনখারাপ। কই আমীর তো বুঝতে পারল না৷ মাথাব্যথার কারণটাও জিজ্ঞেস করল না। কিন্তু কষ্ট করে মাথাটা ঠিকই টিপে দিচ্ছে। এ ধরণের যত্নকে তোহা কি বলবে? ভালোবাসা? নাকি অন্যকিছু!
(আমারও মাথাব্যথা। আজ দীর্ঘ একবছর পর কলেজ গিয়েছিলাম একটা কাজে। কাঠফাটা রোদে ঘুরতে ঘুরতে প্রচন্ড টায়ার্ড। এখন আমার দরকার ঘুম.. শুধু ঘুম।😴 তো আজ আমি ঘুমাই৷ গল্প আবার কাল দিবো।😘)