#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_২০
লিখা: Sidratul Muntaz
পূরবী মুনকে ধরে জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে মুন? ভয় পাচ্ছো? এটা তো একটা ভাইয়া। এইযে তোমার ডল আপু আছে না? এই ডল আপুর হাসব্যান্ড হয় উনি।”
তোহা মিষ্টি করে হাসলো। আমীর শান্ত দৃষ্টিতে মুনের দিকে তাকিয়ে আছে। পূরবী বলল,
” ভাইয়া, এটা রিম্মির ছোটবোন। মুন।”
আমীর একটু হেসে বলল,
” হাই।”
আমীরের কথা শুনে মুন আরও দ্বিগুন ভয়ে অদ্ভুত শব্দ বের করল মুখ দিয়ে। কোনো কথা বলতে পারল না। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে এতোক্ষণ তারা যে রুমে ছিল সেই রুমে এক দৌড়ে ঢুকে গেল। পূরবী আর তোহা অবাক হয়ে চোখাচোখি করল। তারপর ওরাও মুনের পেছন পেছন গেল। গেল না শুধু আমীর। তোহা আর পূরবী গিয়ে দেখল মুন বিছানায় উঠে কাঁথার নিচে নাক-মুখ ঢেকে শুয়ে আছে। ওর ছোট্ট শরীরটা তখনো কাঁপছে। ওর মুখ দিয়ে হু হু টাইপ শব্দও বের হচ্ছে। তোহা আর পূরবী দুজনেই ভয় পেয়ে যায়। পূরবী মুনের মাথায় হাত রেখে প্রশ্ন করল,
” বাবু তোমার কি হয়েছে?”
মুনের কোনো সাড়া নেই। পূরবী তোহার দিকে তাকিয়ে ‘চ’ টাইপ শব্দ করে বলল,” বুঝলাম না তো কিছু।”
” আমিও বুঝলাম না।”
তোহা মুনের গা থেকে কাঁথা টেনে উঠানোর চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ জোরাজুরির পর কাঁথা সরতেই দেখল মুন চোখ-মুখ উল্টে অজ্ঞান হয়ে গেছে। ওর মুখ দিয়ে ফেনার মতো কিছু একটা বের হচ্ছে। তোহা ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল। পূরবী অস্থির গলায় বলল,
” মাকে ডাক, রিম্মিকে ডাক, নীলাভ্র ভাইকে ডাক, সবাইকে ডাক।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই সারাঘরে মানুষ জড়ো হয়। মুনের চোখেমুখে পানির ঝাপটা দেওয়া হলো। ওর জ্ঞানও ফিরে আসলো একটু পর। নীলাভ্র মুনকে কোলে নিতে নিতে বলল,
” আমীরকে দেখে অজ্ঞান হবে কেন? অদ্ভুত ব্যাপার! এটা নিশ্চয়ই অতিরিক্ত গরমে ডান্স প্র্যাকটিসের জন্য হয়েছে। মেয়েটাকে নিয়ে যে কি করেছিস তোরা আল্লাহই জানে।”
পূরবী বলল,” বাঃ রে! এখন সব দোষ আমাদের হয়ে গেল?”
রিম্মি ইশারায় তখন থেকে কি যেন বলছে। লতিফা জিজ্ঞেস করলেন,” তুমি কি কইতাসো মা?”
নীলাভ্র রিম্মির দিকে তাকালো। রিম্মি কথাটা নীলাভ্রকে বুঝিয়ে দিল। এবার নীলাভ্র সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” বুঝেছি৷ রিম্মি বলতে চাইছে ওরা আগে যে জায়গায় থাকতো সেখানে আমীরের মতো দেখতে চশমা পড়া একটা ছেলে ছিল। ওই ছেলেটা অনেক মেজাজী ছিল। তাই মুনকে প্রায়ই ধমক দিতো। সেই থেকে চশমা পড়া ছেলে দেখলে মুন ভয় পায়।”
পূরবী বলল,” তাহলে তো হলোই। শুধু শুধু আমাদের দোষ দিচ্ছিলে।”
” তোদেরও দোষ আছে। কি দরকার এতো গরমে নাচানাচি করার?”
” এসি চলছিল। গরম কই? মুন গরমে ঘামেনি। ভয়েই ঘেমেছে।”
একটু পর সবাই জায়গা ত্যাগ করল। নীলাভ্র আর রিম্মি মুনকে নিয়ে চলে গেল। বসে রইল শুধু তোহা আর পূরবী। তোহা মাথায় হাত রেখে বলল,
” মুনের অবস্থা দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না কারণটা এতো সামান্য।”
পূরবী বলল,” একজেক্টলি। আমিও এটাই বলতে চাচ্ছিলাম। এখানে বড় কোনো ঘাপলা আছে। তুই ভাবতে পারছিস মেয়েটার একদম খিঁচুনি উঠে গিয়েছিল। মানে কি মারাত্মক ভয়টাই না সে পেয়েছে!”
তোহা ভাবতে ভাবতে বলল,” হুম।”
” আচ্ছা, দুলাভাই কোথায় রে? উনাকে তো দেখলাম না। চলে গেল নাকি?”
” বাদ দে ওর কথা। বিরক্তিকর একটা। ”
” মাত্র তিনমাসেই বিরক্তিকর হয়ে গেল? কাহিনি কি বলতো? ঝগড়া-টগড়া করেছিস নাকি?”
তোহা অসহায়চোখে তাকিয়ে বলল,” পূরু, তোকে একটা কথা বলবো। কিন্তু তুই প্রমিস কর লতিফা আন্টি অথবা আম্মুকে কিছু বলবি না। শুধু তোর আর আমার মধ্যে থাকবে ব্যাপারটা।”
” আচ্ছা বল। কি এমন কথা?”
পূরবী একটা বালিশ কোলে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে বসে। তোহা গতরাতের ঘটনাগুলো সব বলে। আমীর আর রিম্মির জবানবন্দীর পার্থক্যও বলে। পূরবী বলল,
” আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম ওই রিম্মির মধ্যে ঘাপলা আছে। কিন্তু এতোটা ঘাপলা থাকবে সেটা ভাবতে পারিনি। আচ্ছা মেয়েটা কি জাদু-টাদু জানে?”
” উফফ রিম্মির কথা বাদ দে। ওকে আমার সহ্য হয়না। তুই শুধু বল আমি এখন কি করবো? আমীরকে বিশ্বাস করবো?”
” তুই ভাইয়াকে সন্দেহ কেন করছিস? ভাইয়া তো বলেছেই ওদের মধ্যে ইন্টারনাল কোনো সম্পর্ক নেই। যেখানে নীল ভাই পর্যন্ত রিম্মির কথা বিশ্বাস করেছে সেখানে তুই কেন ভাইয়াকে বিশ্বাস করতে পারছিস না?আচ্ছা তোদের সম্পর্ক স্বাভাবিক তো? আমার কাছে কিছু লুকাস না তোহা। বল প্লিজ।”
তোহা মাথা নিচু করে রইল। কিভাবে বলবে? অস্বস্তি লাগছে। পূরবী বলল,
” ভাইয়া কি তোকে পাত্তা দেয়না?”
তোহা কিছুটা কেঁপে উঠল এই প্রশ্নে। পূরবী সন্দিহান চোখে তাকালো। এক আঙুল তাক করে বলল,
” সত্যি করে বলবি কিন্তু।”
তোহা ইতস্তত হয়ে বলল,” আসলে, তুই ঠিকই বলেছিস। আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক না।”
” কিরকম?”
তোহা ওদের সম্পর্কের সমীকরণ পূরবীকে বুঝিয়ে বলল। পূরবী এক চুটকিতে বলল,
” তাহলে তুই নিশ্চিত থাক, রিম্মির সাথে কিছু একটা আছেই। হান্ড্রেড পারসেন্ট।”
তোহার ভেতরটা অদ্ভুত যন্ত্রণায় জ্বলে উঠল। কান্না পেয়ে গেল। মাথা নিচু করে চোখের জল আটকানোর চেষ্টা করতে লাগল। পূরবী বলল,
” কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক পুরুষের পক্ষে কখনো এটা সম্ভব না যে স্ত্রীর সাথে এক বিছানায় থেকেও কখনো স্ত্রীকে একটু স্পর্শও করবে না। উহুম, আমি মানিনা। এর দুইটা কারণ থাকতে পারে। হয় সে কোনো পুরুষই না আর নাহলে অন্যকোনো মেয়েতে আসক্ত।”
তোহা চোখ খিঁচড়ে বন্ধ করে নিল। শেষ কথাটা সহ্য করতে পারল না। চোখ দিয়ে গড়গড় করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। পূরবী তোহার কাধে হাত রেখে বলল,
” কাঁদিস না প্লিজ। তোদের দেখে তো ভেবেছিলাম খুব সুখে আছিস৷ অথচ ভেতরে ভেতরে এসব চলছে? তোহা শোন, একটা কথা বলি। তুই ডিভোর্স নিয়ে চলে আয়। এসব মানুষ কখনো শুধরায় না।”
তোহা ছ্যাত করে উঠল,” না। আমি ওকে কখনো ছাড়তে পারবো না। এটা অসম্ভব। ”
” কেন?”
” ভালোবাসি।”
” উনি তোকে ভালোবাসে?”
” জানিনা।”
পূরবী বলল,” না জানার কিছু নেই। আমি বলছি তোকে এক বিন্দুও ভালোবাসে না উনি।”
” কিন্তু উনি আমার খুব খেয়াল রাখে। আমার গায়ে ফুলের টোকা লাগলেও পাগলের মতো হয়ে যায়। কখনো আমার উপর মেজাজ দেখায় না। আমি যখন যেটা খেতে চাই সেটাই এনে দেয়। না চাইলেও এনে দেয়। সবসময় চেষ্টা করে আমি যেন খুশি থাকি। দ্যাখ কত রিস্ক থাকা সত্ত্বেও আমাকে মা-বাবার কাছে নিয়ে এসেছে। শুধু আমি চেয়েছিলাম বলে।”
” তোর মাথা আমার মুন্ডু। উনি এখানে তোর জন্য আসেনি। রিম্মির জন্য এসেছে। এখনো এটা বুঝতে পারলি না?”
তোহা মনে মনে চিন্তা করল, পূরবীকে তো সে সবকিছু বলেনি। তোহা যে এক বছরের স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছে এসব তো পূরবী জানেও না। আমীর যে তোহার সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় আছে এটাও পূরবীকে বলা হয়নি। তাই হয়তো পূরবী আমীরকে ভুল বুঝছে। যদি সত্যিটা জানতো তাহলে এভাবে ভুল বুঝতো না। কিন্তু তোহা এই মুহুর্তে পূরবীকে কিছু বলতেও পারছে না। আমীর নিষেধ করেছে স্মৃতি হারানোর ঘটনা কাউকে জানাতে৷ পূরবী এখনি ডিভোর্সের কথা বলছে। আর এসব জানলে তো… না না কিছুই বলা যাবে না ওকে। তোহা চুপ করে রইল। পূরবী বলল,
” দ্যাখ তোহা, তোর ভালোর জন্যই বলছি। আমি বড়বোন হিসেবে তো তোর খারাপ চাইবো না তাইনা?”
” ডিভোর্স ছাড়া অন্যকোনো উপায় থাকলে বল।”
” আরেকটা উপায় আছে। কিন্তু সেটা কতটুকু কার্যকর হবে জানিনা। আর তুই কি পারবি?”
তোহা করুণ কণ্ঠে বলল,” উনার জন্য আমি সব করতে পারবো। তুই শুধু বল।”
পূরবী তোহাকে অনেককিছু বুঝিয়ে বলল। তোহা চুপচাপ শুধু শুনে গেল। তার খুব লজ্জা লাগছিল শুনতে।
অনেকক্ষণ ধরেই শাওয়ারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আমীর কোনো কাজেই কনসেন্ট্রেট করতে পারছে না। বিষয়টা খুবই বিরক্তিকর। সহ্য করা কঠিন। অবশেষে থাকতে না পেরে আমীর রুম থেকে বের হলো। তোহার রুমে ঢুকে দেখল বাথরুমের দরজাটা একটু ফাঁক করে তোহা শাওয়ার ছেড়ে বসে আছে। ঝর্ণার পানিগুলো দরজা টপকে বাহিরে আসছে। ভেসে যাচ্ছে সাদা ফ্লোর। আমীর বিরক্তি আর রাগ দমন করে বলল,
” কি সমস্যা তোহা? সারাঘর ভাসিয়ে ফেলবে নাকি? দরজা বন্ধ করো!”
তোহা জবাব দিল না৷ আমীর ভ্রু কুচকে অধৈর্য্য গলায় বলল,
” কি বললাম শুনতে পাওনি? দরজা বন্ধ করো।”
এবারও কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। আমীর দরজার সামনে গিয়ে দাড়াল। দরজাটা হালকা ফাঁক করে দেখল তোহা এক ধ্যানে দুই হাতে হাটু জড়িয়ে বসে আছে। গায়ের ম্যারুন কালার শাড়িটা ভিজে জপজপ করছে। আমীর ধমক দিল,
” তোহা! ছেলেমানুষীর একটা লিমিট থাকে। কি শুরু করলে তুমি? দেখছো না সারাঘর ভিজে যাচ্ছে?”
তোহা নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর এক-পা দু’পা করে এগিয়ে এলো। আমীর কিছুটা পিছিয়ে গেল। তোহার বিশ্বাস নেই। যদি পানি ছিটিয়ে ওকেও ভিজিয়ে দেয়? তোহা দরজার বাহিরে এসে দাড়ালো। আয়নাতে তাকিয়ে একবার নিজের অবয়বটা দেখল। ম্যারুন কালার শাড়িতে, ভেজা শরীরে তাকে কত অপূর্ব লাগছে! আমীরের কি চোখে পড়ে না এসব? নাকি রিম্মি ওর চোখ অন্ধ করে দিয়েছে? তোহা ঠান্ডা গলায় বলল,
” দেখুন, আমি কত সুন্দর একটা মেয়ে। আপনার কি ইচ্ছা করেনা আমাকে একটু আদর করতে?”
আমীর ভ্রু কুচকে চেয়ে রইল। যেন তোহা খুব আজব কথা বলেছে। হঠাৎ আমীর বলল,
” এভাবে দাড়িয়ে থাকলে তোমার ঠান্ডা লাগবে তোহা। অন্তত মাথাটা মোছা উচিৎ। ”
আমীর বারান্দায় চলে গেল৷ তোহা হা করে তাকিয়ে দেখল। বারান্দা থেকে তোয়ালে এনে তোহার মাথা মুছে দিতে দিতে আমীর বলল,
” ভেজা শাড়িটা দ্রুত চেঞ্জ করে নাও।”
তোহা বোকার মতো দাড়িয়ে থাকে। এতো আশ্চর্য মানুষও হয়? আমীর কি সত্যিই মানুষ? নাকি অনুভূতিহীন কোনো যন্ত্র?
নীলাভ্র হাতের চিঠিটা প্রায় পাঁচবার পড়েছে। কিন্তু তার মাথায় এখনো কিছু ঢুকছে না। রিম্মি এমন অদ্ভুত শর্ত কেন দিল? তার শর্ত হচ্ছে, ওদের বিয়ের পর কখনো ওদের জীবনে কোনো সন্তান আসতে পারবে না। সারাজীবন নিঃসন্তান থাকতে হবে। এই প্রতিশ্রুতি দিয়েই রিম্মিকে বিয়ে করতে হবে। কিন্তু এটা কি আদৌ সম্ভব?
চলবে