#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_২৪
লিখা: Sidratul Muntaz
ঘুম ভাঙতেই তোহার মনে হলো খুব শক্ত কিছুর উপর শুয়ে আছে। একটা পরিচিত মন মাতানো সুভাষ চারপাশ থেকে ওকে ঘিরে রেখেছে। তোহা চোখ খুলে তাকিয়ে বুঝলো সে এতোক্ষণ আমীরের বুকের উপর ঘুমাচ্ছিল। তাড়াহুড়ো করে উঠে বসলো। হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে গেছে। আমীর কপালে একহাত রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। হয়তো ঘুমিয়েই আছে। যে হাত কপালে দিয়ে রেখেছে, সেই হাতের মুষ্টিতে ওর চশমা। তোহা বিছানা থেকে নামলো। তার কেন জানি খুব লজ্জা লাগছে। চঞ্চল পায়ে বারান্দায় চলে গেল। এখন সন্ধ্যা। বাহিরে ঝুমাঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। পরিবেশ ঠান্ডা। তোহার শীত শীত লাগছে। বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটা মুখে এলোমেলো ভাবে পড়ছে। খুব আরাম লাগছে। তোহা বৃষ্টি দেখায় মনোযোগ দিল। ঝুম বৃষ্টিরএই শব্দটা তোহার খুব প্রিয়। মনে হয় প্রকৃতি যেন দুই পায়ে নুপুর পড়ে নৃত্য করে চলেছে অবিরাম। সেই নুপুরের শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে শহরজুড়ে। সাথে ছড়িয়ে দিচ্ছে শীতল আভা। বৃষ্টির গান তোহা শুনছে চোখ বন্ধ করে। হঠাৎ মনে পড়লো নিয়াজের কথা। সাথেই সাথেই কেঁপে উঠলো তোহার বুক। মনখারাপটা আবার জেঁকে বসলো। আনন্দ মিলিয়ে গেল। আচ্ছা? ছেলেটার এখন কি অবস্থা? সে ভালো আছে তো? পূরবী বলেছিল নিয়াজকে বাংলাদেশ মেডিকেলে ভর্তি করানো হয়েছে। তোহা কি একবার দেখা করে আসবে?
ফ্যানের শাই শাই আওয়াজ সারা ঘরজুড়ে। জানালা আটকানো থাকায় বৃষ্টির শব্দ অত্যন্ত ক্ষীণ শোনাচ্ছে। রিম্মি মস্তিষ্কের মাধ্যমে প্রশ্ন করল,
” বাহিরে কি বৃষ্টি হচ্ছে?”
নীলাভ্র চোখ বন্ধ রেখেই জবাব দিল,” জানিনা। হয়তো হচ্ছে।”
” জানালাটা খুলে দাও।”
নীলাভ্র রিম্মিকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিল। এবার জানালা খুলতে গেল। দমকা বাতাস সারা ঘরে প্রবেশ করে। রিম্মির লম্বা চুল এলোমেলো হয়ে উড়তে থাকে। নীলাভ্র চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
” তুমি অপশরী।”
রিম্মি মুচকি হাসলো। হাসিতে লজ্জার মিশ্রণ। নীলাভ্র চুমু দিল রিম্মির কপালে, ঠোঁটে, গালে,নাকে। তারপর একসময় গলায় মুখ গুঁজল। রিম্মির শরীরে শিহরণ বয়ে যায়। সে হঠাৎ কান্না শুরু করল। নীলাভ্র হতচকিত হয়ে গেল। মাথা উঠিয়ে বিস্মিত চোখে তাকায়। রিম্মি সত্যিই কাঁদছে। অসম্ভব সুন্দর হরিণী চোখ দুটি পানিতে টইটম্বুর। যেন পদ্মপুকুরে বৃষ্টি নেমেছে। নীলাভ্র অস্থির হয়ে জানতে চাইলো,
” কাঁদছো কেনো রিম্মি।”
রিম্মি উঠে হাটু ভাজ করে বসলো। দুইহাত ভাজ করে হাটুর উপর রেখে সেখানে মাথা ঠেকালো। নীলাভ্র কয়েক মুহুর্ত চুপ করে চেয়ে দেখলো। তারপর কাছে এসে রিম্মির পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
” কান্নার কারণটা কি আমাকে বলা যায়?”
রিম্মি কাঁদতে কাঁদতে বাচ্চাদের মতো মুখ করে বলল,
” আচ্ছা, তুমি যদি কখনো জানতে পারো তোমার খুব পছন্দের একটা কাজ করলে আমার মৃত্যু হতে পারে। তুমি কি সেই কাজটা করা ছেড়ে দিবে? নাকি আমার মৃত্যুর ঝুঁকি আছে জেনেও তুমি কাজটা করবে?”
” এইটা কোনো প্রশ্ন হলো? যে কাজে তোমার মৃত্যুর ঝুঁকি থাকবে সেই কাজ আমি কেন করবো? ইভেন মৃত্যু ঝুঁকি তো পরের ব্যাপার, তোমার গায়ে কোনো আঁচ লাগে এমন কাজ করতে গেলেও আমার বুক কাঁপবে। আমি কি তোমার কোনো ক্ষতি হতে দিতে পারি? তুমি যে আমার অপশরী। আর আমি তোমার রক্ষাকবচ। ”
নীলাভ্র রিম্মির হাতের উল্টো পিঠে চুমু দিল পরম আদর নিয়ে। রিম্মির কান্নার বেশ আরও বেড়ে যায়।নীলাভ্রর খুব খারাপ লাগছে। সে অধৈর্য্য গলায় বললো,
” তোমার কি হয়েছে? কেনো এভাবে কাঁদছো?”
” সবাই কেন তোমার মতো করে ভালোবাসেনা নীলাভ্র? কেন সবাই তোমার মতো হয়না?”
নীলাভ্র রিম্মির দুইগাল ধরে বললো,
” তোমার কিসের এতো কষ্ট রিম্মি? প্লিজ আমাকে বলো। আমি সব জানতে চাই। একবার বলে দেখো, মনের কষ্ট অর্ধেক কমে যাবে।”
নীলাভ্র এক আঙুল দিয়ে রিম্মির চোখ মুছে দিল। রিম্মি কান্না থামালো৷ তারপর গুটিশুটি হয়ে বসল। নীলাভ্র আরেকবার কাতর কণ্ঠে বললো,
” বলবে না?”
ঘটনা প্রায় ছয়বছর আগের। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরের বেড়ে উঠা এক দূরন্ত কিশোরী ছিল রিম্মি। তার বয়স তখন সবে ষোল। যাই দেখতো তাই রঙিন মনে হতো। তার মনটা ছিল প্রজাপতির ডানার মতো চঞ্চল। লেখাপড়ার চেয়ে সাইকেল নিয়ে মেইন রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো তার অধিক পছন্দের কাজ। প্রায়ই ক্লাস বাংক দিয়ে সাইকেল নিয়ে রোডট্রিপে বের হতো রিম্মি। সে ছিল স্বাধীনচেতা মেয়ে। যা মনে আসতো করে ফেলতো। এতো চিন্তা-ভাবনা করতো না। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই রিম্মির একমাত্র আতঙ্কের নাম মা। আপন মায়ের মুখ বাস্তবে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। সৎমায়ের কাছেই কোলে-পিঠে মানুষ হয়েছে। জীবনটা প্রায় বিতৃষ্ণাময়। এই আনন্দহীন জীবনেও রিম্মি নিজের আনন্দ উৎস খুঁজে নিয়েছে। রিম্মির কাছে আনন্দ মানেই মিউজিক, সাইকেল রাইডিং,পেইন্টিং। এছাড়াও অনেক গুণ আছে রিম্মির। গায়ের রঙের জন্য কেউ তাকে কখনো রূপবতী না ডাকলেও গুণবতী ডাকতে সবাই বাধ্য!
একদিন রিম্মি সাইকেলে করে রয়েল ন্যাশনাল পার্ক ক্রস করছিল। বড় মাপের একটা ব্ল্যাক ল্যাম্বোরগিণির সাথে তার ধাক্কা লাগে। দূর্ঘটনাটা অবশ্য রিম্মির অসাবধানতায় হয়েছিল। সে অন্যমনস্ক হয়ে আশেপাশের পরিবেশ দেখায় ব্যস্ত ছিল৷ হঠাৎ ল্যাম্বোরগিণিটা সামনে চলে আসে। তারপরই বিস্ফোরণ। এতে ল্যাম্বোরগিণির তো কিছুই হলো না। কিন্তু রিম্মি সাইকেল নিয়ে উল্টে পড়লো। বিশাল চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে রিম্মির সাইকেলের অগ্রভাগ ভেঙে চৌচির। হাটুও ছিলে গেছে। আহত অবস্থায় উঠে দাড়াতে গিয়েও ব্যর্থ হয় রিম্মি। আমীর গাড়ির কালো কাঁচ নামিয়ে মাথা বের করলো। বিরক্তচোখে রিম্মিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।
রিম্মি কতক্ষণ নির্বাক চেয়ে রইল। তার চোখে কি ছানি পড়েছে? নাকি সাইকেল থেকে পড়ে চোখ নষ্ট হয়ে গেছে? সামনের অপরিচিত পুরুষটিকে এতো সুন্দর দেখাচ্ছে কেন? রিম্মি ভুল দেখছে নাকি ঠিক?বুঝতে পারলো না। ছেলেটির মাথা ভর্তি ঝলমলে কালো চুল। সুগঠিত নাক, সুন্দর চোখ, পাতলা গোলাপি ঠোঁট, ধবধবে সাদা চেহারা। গায়ে অফ হোয়াইট পোলো টিশার্ট। সব মিলিয়ে চমৎকার দেখাচ্ছে। নাহ, বাস্তবে মানুষ এতো সুন্দর হতে পারেনা। রিম্মি নিশ্চয়ই রাস্তার মাঝখানে শুয়ে দিবাস্বপ্ন দেখছে। তার ভাবনার ঘোর কাটলো আমীরের তীক্ষ্ণ ধমকে। রূঢ় কণ্ঠে ইংরেজিতে বলল,
” হাউ ডেয়ার ইউ টেইক সাচ আ চিপ বাইক ডাউন দ্যা রোড? স্টুপিড গার্ল!”( তোমার সাহস কিভাবে হয় এমন সস্তা সাইকেল নিয়ে মেইনরোডে নামার?)
রিম্মি বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো। সে মানছে, ভুলটা তার। কিন্তু এজন্য ছেলেটা এভাবে বলবে? তার এতো শখের সাইকেলটা ভেঙে আবার বলছে চিপ সাইকেল? স্টুপিড গার্ল? কি আশ্চর্য! ছেলেটার চোখে অনুশোচনার লেশমাত্র নেই। অর্ধেক ভুল যদি তারই হয়ে থাকে তাহলে বাকি অর্ধেক ভুল তো ছেলেটারও। সে কেন সময়মতো গাড়ি থামায় নি? রিম্মি উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করার সুযোগটাও পেল না। এর আগেই ল্যাম্বোরগিণিওয়ালা উধাও। রাগে শরীর কাঁপতে থাকে রিম্মির। কান্না পেয়ে যায়। এখন এই ভাঙা সাইকেলটা নিয়ে সে যাবে কই? অতি পছন্দের সাইকেলের এই বেহাল দশায় প্রচন্ড মনখারাপ হলো রিম্মির। রাতে জ্বরও চলে আসে।
তিনদিন পর, রিম্মি ঘুম ভেঙে বারান্দায় দাঁড়াতেই দেখল তার বাসার নিচে প্রায় ত্রিশটার মতো বাইসাইকেল। সবকয়টা সাইকেলই আগের সেই ভাঙা সাইকেলটার মতো। সাথে একটা বিশাল ল্যাম্বোরগিণি। ল্যাম্বোরগিণির সাথে ঠেস দাড়িয়ে আছে সেই আশ্চর্য সুন্দর ছেলেটা। বিস্ময়ে রিম্মির হাত থেকে টুথব্রাশ পড়ে গেল।
চলবে
( আগামী কিছু পর্বে শুধু রিম্মি-আমীরের লাভস্টোরি থাকবে। মানে শুধু ফ্লেশব্যাক চলবে। তারপর আবার বর্তমান আসবে।)