#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৫
লিখা: Sidratul Muntaz
( এই পর্ব পড়ার আগে সবাই ৪ নাম্বার পর্বটা আবার দেখবেন। ওইটা কিন্তু এডিট করা হয়েছিল।)
বিছানায় মূর্তিরূপে শক্ত হয়ে বসে আছে তোহা। পূরবী জিজ্ঞেস করল,
” তোর কি হয়েছে রে? কাল থেকে ল্যাবার্টি অফ স্ট্যাচু হয়ে আছিস। আবার আজকে কলেজেও গেলি না। প্রবলেমটা কি?”
তোহা কলেজে যাবে কিভাবে? গতরাতে একফোঁটাও ঘুম হয়নি। মাথায় চিনচিন ব্যথা। রাতে জ্বরও এসেছিল। লাভলী আর পূরবী রাত তিনটা পর্যন্ত তোহার সাথে জেগে থাকে। তারপর ক্লান্ত হয়ে যে যার মতো ঘুমাতে চলে যায়। তোহার চোখে ঘুমেরা ধরা দেয়না। মস্তিষ্কে যন্ত্রণা হয়। চোখ বন্ধ করলেই অদ্ভুত সব ভয়ানক দৃশ্য চারিপাশ থেকে আকড়ে ধরে। তোহা যেন অচেনা কারো আত্মচিৎকার শুনতে পায়। প্রচন্ড নিদারুণ সেই চিৎকার। উত্তর না পেয়ে পূরবী একহাতে তোহাকে ধাক্কালো। আবার প্রশ্ন করলো,
” এই, কি হয়েছে তোর? আবার শরীর খারাপ লাগছে?তুই এমন মনমরা হয়ে থাকলে আমার ভালো লাগে না।”
তোহা ভাবমূর্তির মতো বলল,” আচ্ছা পূরবী, তুই কি জীবিত মানুষের বিগলিত রক্ত খেতে পারবি?”
পূরবী চোখমুখ কুচকে উচ্চারণ করল,” এ্যা!”
তোহা এবার ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকালো। একহাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
” আমি তো তোর বোন। তোর মা আর আমার মাও বোন। আমাদের সম্পর্কটা কি রক্তের?”
পূরবী ঠোঁট উল্টে বলল,” কি জানি? আমি তো শুনেছি শুধু চাচাতো বোন রক্তের হয়। তুই তো আমার খালাতো বোন।”
” যাই হোক, তুই আমার রক্ত খেতে পারবি?”
তোহা ডানহাতটা সোজা করে পূরবীর মুখের সামনে ধরল। পূরবী ধাক্কা মেরে হাত সরিয়ে রুক্ষ গলায় বলল,
” আমাকে কি তোর ডাইনি মনে হয়? নাকি মহিলা ড্রাকুলা মনে হয়? যে আমি তোর রক্ত চুষে খাবো?”
তোহা আগ্রহ সহিত বলল,” ড্রাকুলা কি পুরুষ হয়? রক্ত খায়?”
” শুনেছি রক্ত খায়। পুরুষ না মহিলা জানিনা।”
তোহা পূরবীর দিকে ঘুরে বলল,
” আচ্ছা পুরুষ ড্রাকুলা দেখতে কেমন হয়?”
” আমি কি পুরুষ ড্রাকুলার সাথে প্রেম করতে গিয়েছিলাম যে জানবো?”
” এমনি কোনো ধারণা নেই? ওরা কি মানুষের মতোই দেখতে হয়?”
পূরবী ভ্রু কুচকে কি একটা চিন্তা করতে করতে বলল,” একটা মুভির ট্রেইলার দেখেছিলাম। নাম ‘ ড্রাকুলা স্যার’। নায়কের নাম মনে পড়ছে না৷ কিন্তু ওই মুভিতে নায়কটা দিনের বেলা একদম মানুষের মতো থাকে।কিন্তু রাতের বেলা ড্রাকুলা হয়ে যায়। তখন বড় বড় দাঁত বের হয়। চেহারা বিশ্রী হতে থাকে। কি যে রোমহর্ষক! শরীরের প্রত্যেকটা লোম দাড়িয়ে যাওয়ার মতো। উফফ!”
পূরবী শরীর ঝাড়া দিল। তোহার চোখ মার্বেলের মতো বড় হয়ে যায়। খুব কষ্টে ঢোক গিলে সে ভাবতে থাকে, আমীর কি তাহলে কোনো ড্রাকুলা? তোহা আবার প্রশ্ন করল,
” আচ্ছা ড্রাকুলারা কি সুদর্শন হতে পারে?”
” দ্যাখ বোন, আমি জানিনা আদৌ ড্রাকুলা বলতে পৃথিবীতে কিছু আছে নাকি। যদি থাকে তাহলে সুদর্শন ড্রাকুলা বলতে কিছু নেই। ড্রাকুলা মানেই ভয়ানক,বিদঘুটে চেহারা। দেখার সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যাবি।”
” ওদের গলায় কি সবুজ শিরা ভেসে থাকে? ব্লেড ঝুলানো থাকে?”
” ড্রাকুলাদের ব্লেডের দরকার হয়না। ওদের দাঁতই ব্লেড।”
তোহা পূরবীর হাত খামচে ধরে বলল,” ভয় লাগছে।”
পূরবী একহাতে জড়িয়ে তোহাকে কাছে আনলো। সান্ত্বনা দেওয়ার মতো বলল,
” ভয়ের কিছু নেই। এসব কখনো সত্যি হয়না৷ যদি হতো তাহলে আমরা কোনোদিন দেখতাম না বল ?”
তোহা পূরবীর কাধে মাথা রেখে বলল,
” ওরা হয়তো মানুষের সামনে আসল রূপ নিয়ে আসেনা।”
” আরে ধূর, তেমন কিছু না। জ্বীন ছাড়া এ পৃথিবীতে অন্যকোনো ভূত নেই। জ্বীনকেই মানুষ ভূত ভাবে। কোরান শরীফে জ্বীনদের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু ভূতদের কথা কি উল্লেখ আছে? ড্রাকুলা ফাকুলার কথা উল্লেখ আছে?”
তোহা মাথা নাড়ে। নেই। পূরবী বলল,
” তাহলে খামাখা ভয় পাবি ক্যান? শোন তোকে একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দেই। যদি কখনো দেখিস একটা মানুষের পা দুটো উলটা আর তার সাথে ছায়া নেই, তাহলে ধরে নিবি ওইটা জ্বীন। কোনো মানুষ না।”
তোহা শিউরে উঠল,” জ্বীনদের পা উলটা থাকে?”
” হ্যা।”
” ছায়া থাকে না?”
” না।”
” কেন?”
” কারণ জ্বীনরা আগুনের তৈরি। আর আগুনের কোনো ছায়া নেই।”
” তুই কিভাবে জানলি আগুনের ছায়া নেই?”
” প্র্যাকটিক্যালি দেখাবো? দাঁডা দেখাই।”
পূরবী একটা ম্যাচের কাঠি নিয়ে আগুন ধরালো। তারপর সেটা দেয়ালের কাছে নিয়ে তোহাকে দেখালো। ছায়াতে শুধু কাঠি দেখা যাচ্ছে। কাঠির মাথায় জ্বলন্ত অগ্নিশিখা দেখা যাচ্ছে না। তোহার বুক কেঁপে উঠল। সে সিদ্ধান্ত নিল, পরেরবার আমীরের সাথে দেখা হলে সবার আগে দেখবে মানুষটার ছায়া আছে কিনা।
শপিংমলের করিডোরে দাড়িয়ে দাঁত দিয়ে নখ কাটছে নীলাভ্র। এখানে তার কোনো কাজ নেই। রিম্মিকে অনুসরণ করতে করতে এসেছিল। এখন তাকেও হারিয়ে ফেলেছে। একটা মেয়ে নীলাভ্রকে জিজ্ঞেস করছিল,” পার্টি লেহেঙ্গার কালেকশন কোথায় পাওয়া যাবে?”
নীলাভ্র শুধু বলেছে,” জানিনা।” এটুকু বলে সামনে ফিরতেই দেখল রিম্মি গায়েব। তারপর থেকে আর খুঁজে পাচ্ছে না। মেয়েটার উপর ভীষণ রাগ উঠছে। হঠাৎ টুং করে আওয়াজ হলো। ডানসাইডের লিফট থেমেছে। নীলাভ্র দেখল রিম্মি শপিং ব্যাগ হাতে বের হচ্ছে। মন অজান্তেই হেসে উঠল নীলাভ্রর। পকেটে হাত দিয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে আবার রিম্মিকে অনুসরণ করতে লাগল। সে জানেনা কিসের টানে এই মেয়েটার পিছনে ছুটছে। কিন্তু এই কাজ করতে তার আজ-কাল সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। রিম্মি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেও ভালো লাগে। চোখের ইশারায় ঝারি মারলেও ভালো লাগে। বুক পাজরে শিরশির অনুভূত হয়। রিম্মি যদি বিরক্ত হয়ে কখনো ওকে চড় মেরে দেয়, তাহলেও নীলাভ্রর ভালো লাগবে। রিম্মির হাতের জাদুময়ী স্পর্শ পাওয়া যাবে। রিম্মি কসমেটিকসের দোকানে ঢুকল। পিছু পিছু নীলাভ্রও ঢুকল। সেলস গার্ল নীলাভ্রকে দেখে বলল,
” স্যার, এটা লেডিস কালেকশন।”
নীলাভ্র রিম্মির দিকে চেয়ে উত্তর দিল,” আমিও লেডি দেখতে এসেছি।”
সেলস গার্ল বলল,” সরি স্যার?”
” মানে লেডিস কালেকশন দেখতে এসেছি।”
” ওকে স্যার।”
রিম্মি পেছন ফিরে একবার নীলাভ্রকে দেখে নিল। এরপর বিরক্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিল। নীলাভ্র হাসলো। ওর আশেপাশেই থাকলো। যেদিক থেকে রিম্মিকে ঠিকমতো দেখা যায় নীলাভ্র সেদিকে গিয়ে দাড়ালো। রিম্মির ভ্রু কুচকে জিনিস দেখা, মনে মনে চিন্তা করা, আনমনে ঠোঁট কামড়ানো, সামনের চুল পেছনে ঠেলে দেওয়া সবকিছু মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতে ইচ্ছে হয় নীলাভ্রর। রিম্মিকে দেখলে মনে হয় সে খুব পরিপাটি একটা মেয়ে। খুব পারফেক্ট। একদম যেমনটা নীলাভ্র চায়। খুব সুন্দর করে সাজে রিম্মি। হালকা সাজ,তবুও কোথায় জানি একটা বিশেষত্ব আছে। নীলাভ্র খুঁজে পায়না সেই বিশেষত্ব। বের করতে পারেনা ঘোর লাগার কারণ। শুধু ডুবে থাকে। রিম্মি হাতে ভাজ করা টিস্যু নিয়ে ঘুরছে। চোখের কাজল অথবা লিপস্টিক একটু নষ্ট হলেই আয়নায় দেখে ঠিক করে নেয়। নীলাভ্রর ইচ্ছে করে রিম্মির আয়না হতে। সেলস গার্ল নীলাভ্রর মুখের সামনে তুরি বাজিয়ে বলল,
” স্যার শুনতে পাচ্ছেন?”
নীলাভ্র কপালে গুরুতর ভাজ ফেলে বলল,
” কি?”
ওর কণ্ঠে রুক্ষতা। সেলস গার্ল চুপসে যাওয়া গলায় বলল,
” আপনি তো কিছুই দেখছেন না। আমি কি আপনাকে হেল্প করতে পারি? আমাকে বলুন কি লাগবে?”
নীলাভ্র কঠিনগলায় বলল,” আমার যা দেখার আমি দেখছি তো। আপনার বলতে হবে না।”
নীলাভ্র সামনে এগিয়ে গেল। রিম্মি আয়নায় দাড়িয়ে বড় একটা ঝুমকা কানে লাগানোর চেষ্টা করছে। নীলাভ্র আয়নার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। রিম্মি আয়নাতে দেখে নীলাভ্রকে। তারপর ঘুরে তাকায়। নীলাভ্র বলল,
” চমৎকার লাগছে।”
রিম্মি দৃষ্টি সরু করে ঝুমকাটা রেখে দিল। নীলাভ্রর মনে পড়ল, রিম্মি তো ওর কথা শুনতে পাচ্ছে না। কি জানি কি ভাবছে? এবার সাংকেতিক ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করল সে। কিন্তু নীলাভ্রর অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি দেখে দোকানের সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রিম্মি ওর কথায় এবারও সায় দিল না। নীলাভ্র সবাইকে বুঝানোর চেষ্টায় বলল,
” আসলে উনি কানে শুনতে পায়না। মুখে কিছু বলতেও পারেনা। তাই উনার সাথে এভাবে কথা বলছি। এটা সাংকেতিক ভাষা।”
রিম্মি আড়চোখে তাকালো। ওর দৃষ্টিতে যেন আগুনের ফুলকি। নীলাভ্র বুঝতে পারছে না সে ভুল কি বলল? রিম্মি পছন্দসই কসমেটিকস গুলো জমা দিতে ক্যাশ কাউন্টারে যায়। নীলাভ্র প্রবল আগ্রহ নিয়ে ওর সাথে যায়। সে দেখতে চায়, রিম্মি কাউন্টার ম্যানেজারের সাথে কিভাবে কথা বলে। তখনি সবাই বুঝবে। কিন্তু নীলাভ্রর ইচ্ছা পূরণ হলো না। রিম্মি কোনো কথাই বলল না। শুধু জিনিসগুলো কাউন্টারে জমা দিল। কাউন্টার ম্যানেজার রিম্মিকে একটা রিসিট দিল। রিম্মি সেটায় টাকার অ্যামাউন্ট দেখে টাকা জমা দিল। কাউন্টার ম্যানেজার বলল,
” থ্যাঙ্কস ম্যাম। আবার আসবেন।”
রিম্মি সৌজন্যতার হাসি দিয়ে বের হয়ে গেল। কেউ বুঝলোই না যে রিম্মি বাক প্রতিবন্ধী। তখন ওইভাবে হাতের ইশারায় কথা বলার জন্য এখন নিশ্চয়ই নীলাভ্রকে সবাই পাগল ভাবছে! নীলাভ্রর অস্বস্তিবোধ হয়। একহাতে মুখ ঢেকে জায়গা ত্যাগ করল সে। রিম্মি আবার একটা কাপড়ের দোকানে ঢুকছে। নীলাভ্র এবার দৌড়ে গিয়ে রিম্মি পথ আটকায়। কিন্তু অবাক হয়ে খেয়াল করল এটা রিম্মি না, তোহা। নীলাভ্র চোখ বন্ধ করে আবার তাকালো। দুজনের জামার রঙ এক। ফ্লোরাল প্রিন্টের গোলাপি কূর্তি। প্রিন্টে একটু ভিন্নতা আছে। কিন্তু হঠাৎ করে দেখলে বোঝা যায় না। নীলাভ্রও বুঝতে পারেনি। তোহা চমকিত গলায় বলল,
” আরে নীল ভাইয়া, তুমি এখানে কি করছো? চলো ভালোই হয়েছে। এতো শপিং ব্যাগ আমি একা ধরতে পারছি না। তুমি কিছু নাও তো।”
তোহা অসহায় মুখ করে নীলাভ্রর হাতে ব্যাগগুলো এগিয়ে দিল। নীলাভ্র উপায়ন্তর না পেয়ে ব্যাগ ধরল। তারপর ইতস্তত গলায় বলল,
” তোকে দেখে আমি অন্যকেউ ভেবেছিলাম।”
তোহা ভ্রু কুচকে হেসে বলল,
” মানে?”
” কিছুনা।”
ব্যাগ নিয়ে তোহার পেছনে হাটতে লাগল নীলাভ্র। কিন্তু মন অস্থির লাগছে। বেসামাল মস্তিষ্ক রিম্মিকে খুঁজছে। তোহার চুল ছোট, রিম্মির চুলে ঝুটি ছিল। তোহার কানে কোনো দুল নেই৷ রিম্মি কানে সাদা রঙের বড় বড় দুল ছিল। তাছাড়া রিম্মির গায়ের রঙ শ্যামলা। তোহার থেকে কিছুটা লম্বাও রিম্মি। তবুও নীলাভ্র এতোবড় একটা ভুল কিভাবে করল? তোহা ড্রেসের কালেকশন দেখতে ব্যস্ত। নীলাভ্র বলল,
” এখানে কি করিস?”
তোহা নিজের কাজ করতে করতে উত্তর দিল,
” পূরবীর জন্য এসেছি। গাঁধীটা ঘুরতে এসেছে অথচ ভালো কোনো জামা আনেনি। তাই ওর জন্য শপিং করলাম। এখন আমার জন্যও কিছু কিনবো।”
” ওহ। তাহলে আমি থেকে কি করবো?আমি মেয়েদের জামা-কাপড়ের বিষয়ে তেমন একটা জানিনা।”
” তোমাকে জানতে হবে না। তুমি খালি ব্যাগ নিয়ে আমার পেছন পেছন আসো।”
নীলাভ্র ধমকে উঠল,” চাকর পেয়েছিস?”
তোহা অবাক হয়ে বলল,” চাকরের কি আছে? বড়ভাই হিসেবে এইটুকু তো করতেই পারো।”
” না পারিনা। তোর জিনিস তুই রাখ। আমি গেলাম।”
” কোথায় যাচ্ছো?”
” জাহান্নামে।”
নীলাভ্র ঝড়ের বেগে চলে গেল। তোহা বিরক্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” অদ্ভুত তো!”
শপিংমলের পেছনের গেইট অনেকটা নিরিবিলি। তোহাকে এদিক দিয়েই বের হতে হবে। কারণ সামনের গেইটে যেতে আরও আধঘন্টার রাস্তা ঘুরতে হবে। তাছাড়া তোহা সবকিছু চিনেও না। রাস্তা হারিয়ে এদিকে চলে এসেছে। এখন পেছনের গেইট ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু ভয় লাগছে। ছোট্ট প্রাণপাখিটা উথাল-পাথাল করছে৷ যেন ঝড়ের পূর্বাভাস। দুপুরের প্রখর রোদে নিরিবিলি জায়গা পেরিয়ে মেইন রাস্তার মোড়ে যেতে হবে। তারপর রিকশা বা বাস পাওয়া যাবে। তোহা প্রাণ হাতে নিয়ে গুটি গুটি পায়ে হাটতে লাগল। তার আসলেই অনেক ভয় লাগছে। এইসময় নীলাভ্র ভাই থাকলে কত ভালো হতো। তোহা যখন হাটছিল তখন খেয়াল করল বড় গাছের পেছন দিকের রাস্তাটায় নীলাভ্র পকেটে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে হাটছে। ওর সামনে একটা সুন্দরী মেয়ে, নির্বিকার ভাবে হাটছে। নীলাভ্র কি মেয়েটাকে ফলো করছে? কিন্তু যতটুকু নীলাভ্রকে সে চিনে, নীলাভ্র এমন টাইপ ছেলে না। তবুও কৌতুহল মেটাতে তোহা ওদের পিছু নিল। তবে বেশিদূর যেতে পারল না। তোহার মনোযোগ ছিল নীলাভ্র আর রিম্মির দিকে। তাই আশেপাশে তাকানোর সুযোগ হয়নি। আচমকা পেছন থেকে কয়েকটা শক্ত হাত তোহাকে চেপে ধরে। তোহার মনে হয় দুনিয়া সমস্ত ভার নিয়ে তার উপর হেলে পড়েছে। সূর্য হারিয়ে গেছে। সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই তোহাকে বিশাল মাইক্রোবাসে উঠানো হয়। তড়িৎ গতিতে হাত-পা বেধে ফেলা হয়। চোখ মুখ আগে থেকেই বাধা ছিল৷ তোহা গলাকাটা মুরগির মতো ছটফট করে মিনিট পাচেক। শেষে একটা ভারী কণ্ঠ শুনতে পায়,” স্যার, মিশন কমপ্লিট। ”
সাথে একটা পরিচিত সুভাষও পায়। অনেকটা ওষুধের মতো। তোহা চিন্তা করার আগেই জ্ঞান হারায়।আমীর পেছনে ঘুরে একবার তোহার মুখটা দেখল। সাথে সাথেই ওর চেহারার ভাবভঙ্গি বদলে গেল। রাগে গলার রগ ফুলে উঠল। আওয়ানের মুখে উৎপটাং একটা ঘুষি মেরে কিড়মিড় করে বলল,
” কাকে এনেছো এটা? এই মেয়ে সেই মেয়ে না। শুধু ড্রেসের কালারটা এক। ওই মেয়েটার গায়ের রঙ শ্যামলা ছিল, চুলে লম্বা পনিটেইল ছিল, আর কানে সাদা দুল ছিল।”
ঘুষি খেয়ে আওয়ানের দুনিয়া ঘুরছে৷ মাথা ভনভন করছে। আমীর ধাক্কা মেরে বলল,
” বাস্টার্ড! এখনি এটাকে ফেলে আসলজনকে তুলে আনো।”
আওয়ান উত্তর দিতে পারেনা। তার নাক-মুখ ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। আমীর গাড়ির স্টেয়ারিং এ জোরে আঘাত করে বলল,” শিট!”
পেছনের সারিতে নিয়ন, রিজভী আর ডানা ছিল। কিন্তু এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী আর বুদ্ধিমান হলো আওয়ান। বাকিগুলো আমীরের কাছে গাঁধার বাচ্চার মতো। আওয়ানের সাহায্য ছাড়া ওরা কিছুই করতে পারবে না। এখন আহত অবস্থায় আওয়ান যেতেও পারবে না। আমীর পরিকল্পনার এতো কাছাকাছি এসেও সফল হতে পারছে না। রাগে সব ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে। মন চাইলো তোহাকে ধাক্কা মেরে গাড়ি থেকে ফেলতে। আমীরের তীক্ষ্ণ মেজাজ দেখে পেছনে জবুথবু হয়ে বসে থাকে তিনজন। একটা শব্দও করতে পারে না। আমীর ওদের নির্দেশ দিল তোহাকে বের করার জন্য। তখনি দেখল পেছনে র্যাবের গাড়ি। এ অবস্থায় তোহাকে নামাতে গেলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আমীর আর টু শব্দ করল না। গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল। অজ্ঞানরত তোহাকে সাথে নিয়েই।
চলবে