#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৪৬
লিখা: Sidratul Muntaz
তোহা রিম্মির ঘরে এসেই হাটু গেড়ে ওর সামনে বসে পড়েছে। রিম্মি বিছানায় পা ঝুলিয়ে চুপচাপ বসে তোহাক দেখছে।। মেয়েটার এলোমেলো চুল সারামুখে মুখে লেপ্টানো। লাইটের আলোর চিকচিক করছে কালো,মোটা চুলগুলো। ফরসা গাল ঝলক দিচ্ছে, চোখের পানিতে দুই গাল ভেজা। দুইচোখের চারিপাশ ঘন কালোয় আবৃত। মনে হয় বিরাট কোনো অসুখে ভুগছে। ওই দৃষ্টি দিয়ে রিম্মির দিকে এক বালতি আশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে সে। শুকিয়ে চিমসে যাওয়া দুইহাত ক্ষমা চাওয়ার মতো জোড় করে রেখেছে। শরীর কিছুটা কাঁপছে। ওর একবাক্য, অস্ট্রেলিয়া ওকে নিয়ে যেতেই হবে। তোহা উদ্বেজিত হয়ে বলতে থাকলো,
” প্লিজ, রিম্মিআপু। আমাকে নিষেধ করো না। ফিরিয়ে দিও না প্লিজ। আমি শুধু একবার অস্ট্রেলিয়া যেতে চাই। আমীরের কবরটা দেখবো। নীলাভ্র ভাইয়া নিজে আমাকে পাঠিয়েছে তোমার কাছে। তাও কি নিয়ে যাবে না?”
কত আকুলতা তোহার কণ্ঠে! রিম্মি জানে তোহা কিজন্য অস্ট্রেলিয়া যেতে চায়। সে সব জানে। কিন্তু তোহাকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যাওয়া অন্তত রিম্মির দ্বারা সম্ভব না। এতে তোহার বিপদ হবে কিনা সে জানে না। কিন্তু তার নিজের বিপদ হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না। রিম্মি থমথমে মুখে বার্তা দিল,
” এটা সম্ভব না তোহা। আমি অস্ট্রেলিয়া যেই কাজে যাচ্ছি সেই কাজে তোমাকে নেওয়া যায় না। আর তুমি আমীরকে কেনো এখনো ভুলে যাচ্ছো না? ও একটা প্রতারক। তোমার সাথে কতবড় প্রতারণা করেছে৷ তাও কেনো সেই প্রতারকের কথা মনে করে কেঁদে ভাসাচ্ছো?এতো উতলা কেনো হচ্ছো? নিজের জীবন নষ্ট করে ফেলছো। এ বড্ড ছেলেমানুষী! ”
তোহা ভ্রু কুচকে খুব অবাক হওয়ার মতো বললো,” আমীর কি প্রতারণা করেছে?”
” যে কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ করে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় সে প্রতারক না? প্রিয়জনের ভালোবাসা যার কাছে তুচ্ছ, যার দুনিয়ার কোনো মায়া নেই এমনকি নিজের জীবনের প্রতিও মায়া নেই, সে অবশ্যই প্রতারক। ও অত্যন্ত পাষাণ হৃদয়ের মানুষ। ওর মন ইস্পাতের চেয়েও একশো গুণ কঠিন। তোমার এই চোখের পানি ওর মনকে ছুঁতেও পারবে না৷ তাহলে কি লাভ?”
” আমীর কি বেঁচে আছে?”
” না, ওর মৃত্যুর একমাস ছয়দিন কেটে গেছে। ও মৃত। নিজের কাছে যেমন মৃত, পৃথিবীর সবার কাছেও মৃত।”
” তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না।”
” বুঝতে হবে না। তুমি এখন বাসায় ফিরে যাও। আমি কাল তোমাকে অস্ট্রেলিয়া নিতে পারবো না।”
” প্লিজ রিম্মিআপু, আমাকে তাড়িয়ে দিও না।”
” তাড়িয়ে দিচ্ছি না। শুধু বলেছি কাল নিয়ে যেতে পারবো না। আমি বরং তোমাকে অন্য একদিন নিয়ে যাবো। প্রয়োজনে অস্ট্রেলিয়া শহর, আমীরের বাড়ি, বন্ধু-বান্ধব সবার সাথে তোমাকে পরিচয় করাবো। সবাই তোমার কথা জানে। ওরা তোমাকে দেখার জন্য ব্যাকুল। তাই তুমি না বললেও আমি একদিন তোমাকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যেতাম। তাই একটু ধৈর্য্য ধরো। কালকে যাওয়ার আবদার করোনা। আমরা অন্য একদিন যাবো। তখন নীলাভ্রও থাকবে।”
” আমি অস্ট্রেলিয়ায় ঘুরতে যেতে চাইছি না রিম্মিআপু।”
” তাহলে কেনো যেতে চাও?”
” আমীরের কবর দেখবো৷ নাহলে আমার মন শান্ত হবে না।”
” যেদিন নিয়ে যাবো সেদিন দেখবে। কিন্তু কাল না।”
তোহার ছোট্ট মন ছটফট করে লাফিয়ে বলতে চায়, আমি কালকেই যাবো। নাহলে সর্বনাশ হবে। তোহা জানেনা তার কেনো এমন লাগছে, কেনো কালকেই অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার জন্য মন উথাল পাথাল করছে। তোহার মনে হচ্ছে জীবনের বিনিময়ে হলেও কাল তার অস্ট্রলিয়া যাওয়া উচিৎ। তোহা অস্থির হয়ে এদিক-ওদিক তাকায়। রিম্মিকে কিভাবে রাজি করানো যায়? তোহার নজর গেল রিম্মির ড্রেসিংটেবিলে রাখা ফলের ঝুঁড়ির দিকে। সেখানে একটা ছুড়ি দেখা যাচ্ছে। তোহা খপ করে গিয়ে ছুড়িটা হাতে নিয়ে ফেললো। তারপর বামহাতের শিরায় লাগিয়ে বললো,
” আমাকে যদি কালকেই নিয়ে না যাও তাহলে আমি এখনি নিজেকে শেষ করে দিবো। আমার রক্তে তোমার ঘরের ফ্লোর ভেসে যাবে৷ এই মৃত্যুর দায়ভার নিতে পারবে তো?”
তোহা কঠিন মুখে বলছে। ওর হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। যেকোনো সময় ছুড়ি চালিয়ে দিতে পারে। মৃত্যুর জন্য মানসিকভাবেও প্রস্তুত সে। কেননা তার কাছে বেঁচে থাকার কোনো ইচ্ছাই নেই। রিম্মির মেজাজ গরম হয়। এই মেয়েটা আমীরকে এতো ভালোবাসবে কেনো? আমীরের মতো মানুষ এমন ভালোবাসার যোগ্য না৷ এইটা তোহার বোঝা উচিৎ। কিন্তু মেয়েটা বুঝে না, নিছক অবুঝ। তোহার এই ছেলেমানুষী পাগলামি রিম্মি প্রশ্রয় দিলো না। ওর হাত ধরে টেনে ওকে ঘর থেকে বের করে দিল। কটমটে দৃষ্টিতে বললো,
” আমার বাসা থেকে বেরিয়ে যাও। মরার এতো শখ থাকলে রাস্তায় গিয়ে মরো।”
তোহা হতবাক হয়ে যায়৷ রিম্মি এভাবে বলতে পারলো? রিম্মি তোহার মনের কথাটার উত্তরও দিয়ে দিল,
” যদি তোমার এই ছেলেমানুষীর যথাযথ কারণ থাকতো তাহলে আমার মায়া লাগতো তোমার জন্য। কিন্তু তুমি যেটা চাইছো সেটা খুব অর্থহীন চাওয়া। তাই আমার একটুও মায়া লাগছে না। প্লিজ বের হয়ে যাও।”
রিম্মি দরজা আটকে দিল। তোহা এখনো ছুড়ি শিরায় লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু গাঢ় একটা টান দেওয়ার অপেক্ষা। এটুকু অপেক্ষারই বা দরকার কি? একটান দিয়ে সরাসরি আমীরের কাছে চলে গেলে কেমন হয়? আমীর যেমন আত্মহত্যা করেছে, সেও করুক। তাহলে মৃত্যুর পর কি তাদের এক জায়গায় রেখে শাস্তি দেওয়া হবে? তাহলে সেই শাস্তিও তোহার জন্য শান্তির। সে চোখ বন্ধ করে বললো,
” আমি আসছি আমীর।”
কেউ একজন তোহার হাত শক্ত করে ধরলো। তোহা তাকিয়েই চমকে যায়। মুখ দিয়ে ভয়ংকর শব্দ বের হয়। আমীর, আমীর তার সামনে দাঁড়ানো। ঝাপসা হয়ে আসা চশমার আড়াল থেকে তোহাকে দেখছে৷ আমীরের ঠোঁটগুলো থরথরিয়ে কাঁপছে। যেন প্রচন্ড কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে তার৷ তোহা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে উচ্চারণ করলো,
” আমীর!”
আমীর ভাঙা গলায় বললো,” কেনো এতো ভালোবাসো তোহা? এতো ভালোবাসা ডিজার্ভ করিনা আমি। ”
তোহা তাকিয়ে দেখে শুধু আমীরের মুখ। নেশাতুর দৃষ্টিতে চেয়েই থাকে, অসীম তৃষ্ণা নিয়ে। তারপর হঠাৎ আমীরের দুইগাল চেপে ধরে। ওর গলায়, কাধে, গালে, চশমায় হাত বুলিয়ে বলতে থাকলো,
” আপনি কি সত্যি বেঁচে আছেন? নাকি শুধুই আমার কল্পনায়? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
তোহা মুখ ভেঙে কেঁদে উঠলো৷ আমীর বললো,
” বেঁচে আছি। কিন্তু তোমার জন্য বেঁচে নেই। এ পৃথিবীর কারো জন্য বেঁচে নেই। আমি বেঁচে আছি আমার নিজের জন্য। তোহা শোনো, তুমি আমাকে খুশি দেখতে চাও?”
” অবশ্যই চাই, নিশ্চয়ই চাই। আমি শুধু আপনাকে পেতে চাই।”
আমীর অসহনীয় কষ্ট নিয়ে করুণ দৃষ্টিতে বললো,
” তোমার কাছে ভালোবাসা মানেই কি শুধু পাওয়া? ভালোবাসলেই পেতে হবে? আমি যে ভুল করেছি তারপর তোমাকে চাওয়ার অধিকার আমার নেই। আমাদের একসাথে থাকা কখনও সম্ভব না। প্লিজ এই সত্যিটা মেনে নাও৷ আমার জীবনের শুধু একটাই চাওয়া কি জানো? তোমাকে একটু খুশি দেখবো।মরার আগে আমার শেষ ইচ্ছাটুকু পূরণ করবে না?”
” আপনি মরবেন? আবার কেনো মরবেন?আমি মরতে দিবো না।”
” তুমি আটকাতেও পারবে না। এটাই তো নিয়তি। প্রকৃতির নিয়ম এমনি। আমাকে বারবার মরতে হবে। তোমাকে চাওয়ার সাধ্য যেহেতু নেই, আমার সর্বোচ্চ চাওয়া তুমি খুশি থাকো৷ এটুকুও কি পূরণ করবে না তোহা?”
” এভাবে কেনো বলছেন? আমার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে দেখুন৷ এতো কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছি না৷ এর চেয়ে মৃত্যু ভালো। আমাকে মৃত্যু দিন।”
” জানি খুব কঠিন বাস্তব, কিন্তু তবুও তোমাকে বাঁচতে হবে। এই কঠিন বাস্তব মেনেই অন্তত আরও চল্লিশ বছর বাঁচতে হবে। আমার জন্য বেঁচে থাকো। যদি সত্যিই ভালোবাসো, তাহলে এইটা করে দেখাও। কথা দাও, তুমি আমার জন্য আনন্দে বাকি জীবন কাটাবে। তোমার মধ্যেই আমি থাকবো। তোমার হাসিতে আমি খুশি থাকবো। কিন্তু যখন তোমার কান্না আসবে, বুঝে নিবে আমার কষ্ট হচ্ছে। প্রচুর কষ্ট হচ্ছে। তখন সাথে সাথে কান্না মুছে ফেলবে। আমাকে একদম কষ্ট দিবে না। মনে থাকবে?”
তোহা এবার আর আগের মতো ভুল করলো না। আমীরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফেললো। ওর বুকে মাথা ঠেকিয়ে শুনতে পেল সেই মহিমান্বিত সুর,’ ঢিপঢিপ, ঢিপঢিপ।’ এইতো শুনতে পাচ্ছে। এক জীবনে এর চেয়ে বেশি আর কিছু চাওয়ার নেই। এই বুকে সে মরতেও রাজি। কিন্তু এই বুক ছেড়ে বাঁচতে রাজি না। সে পারবেই না, কিছুতেই পারবে না। আমীর এতো কঠিন শাস্তি কেনো দিচ্ছে তাকে? আমীর বললো,
” হয়েছে তোহা ছাড়ো, মায়া বাড়িও না৷ তুমি সহ্য করতে পারবে না। আমাকে বিদায় দাও৷ এখন তো তাও তোমার কাছে আসার সুযোগ আছে। একটা সময় এই সুযোগটুকুও থাকবে না। তখন আমার কথাগুলো মনে রাখবে৷ আর সবসময় হাসবে। আমার প্রচুর কষ্ট হচ্ছে তোহা৷ যাওয়ার আগে তোমার হাসি মুখটা একবার দেখাবে? এই বিষাদসিক্ত মুখ দেখে তোমাকে বিদায় দিতে চাই না। প্লিজ একবার হাসো।”
তোহা চোখের পানি মুছে জলদি করে হাসলো। আমীরের আদেশ তার কাছে সর্বদা শিরধার্য। আমীরের জন্য সে শুধু মরতেই পারে না। মৃত্যুর চেয়ে কঠিন যন্ত্রণা হলো আমীরকে ছাড়াই আনন্দে বেঁচে থাকা। তার ভালোবাসায় যদি সেই জোর থাকে, সে অবশ্যই পারবে। তোহা হাসলো। আমীর তোহার মাথায় হাত বুলিয়ে একটা তৃপ্ত শ্বাস ছাড়লো৷ ওর মুখ হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেলো। হয়তো প্রচন্ড কষ্ট পাচ্ছে৷ এতো কষ্ট কেনো পাচ্ছে সে? তোহা ভিতর থেকে দুমড়ে-মুষড়ে গেলেও উপরে হাসার চেষ্টা করে বললো,
” এইতো আমি খুশি, তাহলে আপনি কেনো কষ্ট পাচ্ছেন?”
” কষ্ট পাচ্ছি না। সয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।”
তোহার মন চূর্ণ বিচূর্ণ হতে থাকে।সে আবিষ্কার করলো, হঠাৎ বিচ্ছেদের চেয়ে স্বেচ্ছায় বিচ্ছেদের কষ্ট অনেক গুণ বেশি। আমীর পিছিয়ে যেতে যেতে মুচকি হেসে বললো,
” ভালো থেকো কোমলমতি, আহ্লাদী আমার!”
ওর ওই হাসি কোনো হাসি ছিলনা। ছিল অসহ্য বেদনার গাঢ় ছাপ। তোহা আর সহ্য করতে না পেরে হু হু করে কেঁদে দিল। আমীর দ্রুত চলে যায়। তোহা মেঝেতে বসে চিল্লিয়ে কেঁদে উঠে। পরমুহূর্তেই মনে হয়, আমীরকে আর কষ্ট দেওয়া যাবে না । কাঁদা যাবে না। মুখ বন্ধ করে রাখে৷ দুইহাতে চেপে মুখ বন্ধ। চোখের জল আটকাতে পারেনা, বারবার মুছে৷ আমীর কি আবার আসবে? আবার কবে আসবে? একদিন হঠাৎ এসে হয়তো বলবে, এইটাই ওর শেষ আসা৷ তখন তোহা কিভাবে হাসিমুখে বিদায় দিবে? প্রকৃতির নিয়ম এতো নিষ্ঠুর কেনো? তোহা গুমড়ে গুমড়ে উঠে৷ হাসার চেষ্টা করে। কান্নার বিরুদ্ধে হাসি আনা যুদ্ধের মতো। আমীর কিভাবে পারে? রিম্মি হঠাৎ দরজা খুললো। তোহা আওয়াজ পেয়েও তাকায় না। সিড়ির দিকে চেয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেও আমীর এখানে দাঁড়িয়ে ছিল৷ তোহা কল্পনা করছে আমীর এখনো দাঁড়িয়ে আছে৷ রিম্মি তোহার মস্তিষ্কে সিগন্যাল পাঠালো,
” আমরা কালকেই অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছি তোহা। কিন্তু তোমাকে নিজের পরিচয় গোপন রাখতে হবে। ছদ্মবেশে আমার সাথে যাবে। কিন্তু সাবধান! ধরা খেলে আমরা কেউই বেঁচে ফিরতে পারবো না।”
চলবে
( এ পৃথিবী অনেক সুন্দর।❣️)