#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৪৭
লিখা: Sidratul Muntaz
তোহা কালো বোরখা আর নিকাব পড়ে বাসা থেকে বের হয়। শিউলি আর পূরবীকে জড়িয়ে ধরে বিদায় দেয়। লাভলী আর জাবিদ সাহেব পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারা তোহাকে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন কারণ রিম্মিকে সবাই খুব পছন্দ আর বিশ্বাস করে। তাই রিম্মির সাথে তোহা যেখানেই যাক কারো কোনো আপত্তি থাকে না। মেয়েটা যদি অস্ট্রেলিয়া ঘুরে এসেও স্বাভাবিক হতে পারে তাহলে ক্ষতি নেই। তোহা মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছে। আমীরের কবর নিজচোখে দেখলে হয়তো বাস্তবতা মেনে নিতে পারবে। রিম্মি আর নীলাভ্র নিচে তোহার জন্য অপেক্ষা করছিল। সে নিচে নামতেই দেখলো নীলাভ্র রিম্মির হাতের উল্টো পিঠে চুমু দিয়ে কাতর গলায় বলছে,
” জলদি ফিরে এসো।”
তোহার বুক টনটন করে উঠে। আমীরের কথা মনে পড়ে যায়। শপিংমলের গলিতে আমীর এভাবেই তোহার হাতে চুমু দিয়ে বলেছিল,আমাকে বিদায় দাও।
আর নীলাভ্র বলছে জলদি ফিরে এসো। একদিকে বিচ্ছেদের তীক্ত যন্ত্রণা অন্যদিকে নতুন জীবন শুরু করার আনন্দময় প্রত্যাশা। প্রকৃতির নিয়ম কেনো এতো বৈচিত্রময়? রিম্মি নীলাভ্রকে মনে মনে কি যেন বলছে। নীলাভ্র খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো। তারপর রিম্মির কপালে চুমু দিয়ে বললো,
” আজকে সন্ধ্যায় আমাদের বিয়ে। আর তুমি সাতঘণ্টার জন্য চলে যাচ্ছো। এখন এই সাতঘণ্টাও আমার জন্য অনন্তকাল অপেক্ষার সমান মনে হচ্ছে। কি যে করি! আরেকটু আগে কি ফিরে আসা যায়না?”
রিম্মি হাসি দিয়ে কি জানি বলে। তোহা শোনেনা, নীলাভ্র শোনে।
” সাতঘণ্টাও অনেক কম সময়। চোখের পলকে কেটে যাবে। তুমি রুমে গিয়ে চারঘণ্টার জন্য ঘুম দাও। আর বাকি তিনঘণ্টা তো অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে করতেই কেটে যাবে। এরপর আমি ফিরে আসবো। এর মাঝখানে অনেক বার ফোনও করবো। চিন্তার কিছু নেই।”
নীলাভ্র রিম্মির ডানহাতটা বুকে নিয়ে বললো,
” সত্যিই আমাদের বিয়ে হচ্ছে? এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। এতো সুখ সত্যিই আমার কপালে আছে? কেনো জানি ভয় লাগে৷ যদি হঠাৎ করে সব আবার পাল্টে যায়?”
” পাগল, কিচ্ছু পাল্টাবে না। আমি পাল্টাতে দিবোই না। পৃথিবী ভেসে গেলেও আমি তোমার কাছে ফিরে আসবোই। ওয়াদা! আর একটা কথা কি জানো? এই নীলকে ছাড়া তার অপশরী কখনো থাকতে পারবে না। মরে যাবে একদম।”
” অপশরীকে ছাড়াও এই নীল বাঁচবে না। মরে যাবে।”
দুজনই আকুলদৃষ্টে কতক্ষণ একে-অপরের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ একসাথে হেসে দিলো। নীলাভ্র রিম্মিকে জড়িয়ে ধরতে নিলে রিম্মি বাধা দিয়ে বললো,
” উহুম, একদম সাতঘণ্টা পর।”
নীলাভ্র ফ্যাকাশে মুখে বললো,” কেনো?”
” অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়।”
নীলাভ্র মজা করে বললো,” ঠিকাছে, তাহলে একদম রাতেই?”
রিম্মি লজ্জায় চোখ বড় করে নীলাভ্রকে একটা চড় মারতে চাইলো। নীলাভ্র একপাশে মুখ সরিয়ে হাসতে লাগলো। তোহা হালকা একটু কাশি দিতেই ওরা তাকালো। রিম্মি বললো,
” তোহা এসো। গাড়িতে বসো।”
নীলাভ্র তোহাকে দেখে বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
” একি, তুই এমন বুড়ি দাদীমা সেজেছিস কেনো?”
তোহা কালো বোরখার সাথে নিকাব পড়েছে শুধু তাই নয়, নিকাবের উপরে একটা কালো পর্দাও পড়েছে। যেন চোখ দুটিও দেখা না যায়।
রিম্মি বললো,” ওকে এভাবে বোরখা পড়তে আমি বলেছি।”
রিম্মি যে উত্তর দিয়েছে তোহা জানেনা। তাই সে নিজের মতো বললো,
” বোরখা না পড়লে মানুষ ইন্টারভ্যু নিতে ছুটে আসে, তাই সেফটির জন্য এভাবে পড়েছি। ”
নীলাভ্র ভ্রু কুচকে বললো,” ইন্টারভ্যু নিতে আসে মানে?”
রিম্মি বুঝিয়ে দিল,” আমীরের মৃত্যুর পর সবাই তো ওকে চিনে ফেলেছে। তাই রাস্তাঘাটে দেখলেই দাঁড় করিয়ে অনেকে অনেক ধরণের প্রশ্ন করে। এজন্য এই বোরখা টেকনিক।”
নীলাভ্র হাত ভাজ করে বললো,” ওহ, বুঝেছি।”
রিম্মি আসলে এইমাত্র মিথ্যে বললো। তোহাকে মানুষ চিনে ফেলবে এজন্য বোরখা পড়ানো হয়নি। আসলে রিম্মি ওকে বোরখা পড়িয়েছে যেন ও যে কাজে যাচ্ছে সেখানে’র কেউ ওকে না চিনতে পারে।
তোহা রিম্মির সাথে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিল তখন নীলাভ্র তোহার হাত ধরে টেনে ওকে সামনে দাঁড় করিয়ে দুই কাধে হাত রেখে উপদেশ দেওয়ার মতো বললো,
” শোন, যাচ্ছিস যা, কিন্তু স্বাভাবিক থাকবি। ওখানে গিয়েও ছেলেমানুষী শুরু করিস না। কল্পনায় আমীরকে দেখে আবার খোলা রাস্তায় পেছন পেছন দৌড়াতে শুরু করিস না। সিডনি অনেক বড় শহর,ওখানে এক্সিডেন্টও বেশি হয়। তাছাড়া একবার হারালে আর কুল-কিনারা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ”
রিম্মি বললো,” এতো চিন্তার কিছু নেই। আমার সাথে থাকলে ওর কোনো ক্ষতি হবে না।”
নীলাভ্র রিম্মির দিকে চেয়ে বললো,” সেটা তো জানি, তবুও ওকে বুঝাচ্ছি। মৃত মানুষের জন্য আর কত পাগলামী করবে? আমীর মারা গেছে, এই বাস্তবতা ওকে বুঝতে হবে না?”
তোহার চোখ টলমল হয়ে আসলো। রিম্মি বললো,
” এখন এসব বলার কি দরকার?”
নীলাভ্র বললো,” এখনি দরকার। ওকে তোমার সাথে পাঠানোর উদ্দেশ্য একটাই। আমীরের কবর চাক্ষুষ দেখে ওকে বিশ্বাস করতে হবে যে আমীর মারা গেছে৷ আর মরা মানুষ কখনো ফিরে আসে না।”
নীলাভ্রর কথাগুলো খুব কঠিন লাগছে। তোহা উদাসী মুখে চেয়ে থাকে৷ রিম্মি তোহাকে কাঁধে ধরে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসায়। নীলাভ্র বললো,
” এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আমি কি তোমাদের সাথে আসবো?”
রিম্মি বললো,” দরকার নেই, থাক। তুমি বরং ঘরে গিয়ে ঘুমাও। সারারাত এমনিই ঘুমাওনি৷ ঘুম কভার না হলে তোমার শরীর খারাপ হবে। আমি চাইনা তুমি ঘুমের ঘোরে টলতে টলতে আমাকে কবুল বলো। ”
নীলাভ্র হেসে ফেললো। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,” আচ্ছা।”
তোহা যে পাশে বসেছে রিম্মি গাড়ির দরজা সেই পাশ থেকে আটকে দিয়ে নীলাভ্রর দিকে ঘুরে তাকায়। সিরিয়াস মুখ করে বলে,
” মেয়েটাকে বারবার আমীরের মরার কথা কেনো মনে করিয়ে দিচ্ছো?
” তো আর কি করবো? আমীরের ফিরে আসার বিষয়টা ও যতদিন বিশ্বাস করে থাকবে ততদিন ওকে কাঁদতে হবে আর এভাবে কষ্ট পেতে হবে। কি ভয়ংকর অবস্থাটা হয়েছে ওর। একবার যদি মৃত্যুটা মেনে নেয় তাহলেই কিন্তু সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। আশা দিয়ে অপেক্ষা করানোর চেয়ে আশাটা একেবারে ভেঙে দেওয়াই ভালো নয় কি?এতে কষ্টও অনেক কম।”
” আচ্ছা বুঝলাম, আসি তাহলে।”
নীলাভ্র রিম্মির হাত মুঠোয় নিয়ে বললো,” সাবধানে যেও। আর তোহাকে দেখে রেখো। তোমার নিজের খেয়ালও রেখো।”
” তুমি এমনভাবে বলছো যেন কত বছরের জন্য চলে যাচ্ছি।”
” সত্যি বলতে আমার তাই মনে হচ্ছে। কেন মনে হচ্ছে বুঝতে পারছি না।”
দুজন দুজনের দিকে আবার চেয়ে থাকে। কেমন যেন একটা ঘোর কাজ করছে। নীলাভ্রর একটুও ছাড়তে ইচ্ছে করছে না রিম্মিকে। রিম্মি বললো,
” যাই?”
” যাও।”
রিম্মি মুচকি হেসে জানালো,
” হাত না ছাড়লে যাবো কিভাবে?”
নীলাভ্র একটু লজ্জা পেয়ে হাত ছেড়ে বললো,” সরি।”
রিম্মি বললো,” যত জলদি যাবো, ততই জলদি ফিরে আসবো। আসি?”
” ওকে।”
রিম্মি গাড়ির অপর পাশে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে। তারপর গাড়ি চালানো শুরু করলো।বেশ কিছুক্ষণ পর গাড়িটা এক নিরব জায়গায় থামে। তোহা রিম্মিকে ভালোমতো পরখ করছে। এতোক্ষণ রিম্মি সাধারণ একটা সেলোয়ার কামিজ পড়া ছিল। ঝটপট সেগুলো খুলে ব্যাগ থেকে কালো ল্যাগিংস, টপ, জ্যাকেট, বেল্ট আর কি কি যেন বের করে পড়ে ফেললো। লম্বা চুলগুলো দ্রুত হাতে কিভাবে যেন ঝুঁটি করে ফেললো। পায়ে পড়লো ব্ল্যাক হিল। রিম্মির গেটাপ সম্পূর্ণ চেঞ্জ হয়ে গেছে। ওকে এখন দেখে মনে হচ্ছে ভয়ংকর কোনো মিশনে যাচ্ছে। আর এই কাজগুলো ও এতোই দ্রুত করেছে যে তোহার মনে হয় রিম্মি একটা মেশিন। তোহার বিস্মিত মুখের দিকে চেয়ে রিম্মি অতি স্বাভাবিক বার্তা দিল,
” গাড়ি থেকে নামো তোহা।”
তোহার মাথায় প্রশ্ন আসে, এখানে কেনো নামবো? তাও সে প্রশ্ন করেনা। চুপচাপ নামে। রিম্মি বের হয়ে গাড়ির সামনের ইঞ্জিনে কি যেন একটা করতে থাকে। তোহা দাঁড়িয়ে শুধু দেখছে। গাড়িটা কি নষ্ট হয়ে গেল? নষ্ট তো হয়নি। তোহা খেয়াল করেছিল রিম্মি ইচ্ছে করেই গাড়ি থামিয়েছিল। রিম্মি কাজ শেষ করে ওর প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে কাউকে ফোন দিল,
” হ্যালো সাদ্দাম ভাই, গাড়িটা তো নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা মেইনরোডে দাঁড়িয়ে আছি। আপনি এসে গাড়িটা নিয়ে যান? না না, নীলাভ্রকে জানানোর দরকার নেই। ও এই ভোরবেলা ঘুমিয়ে থাকে। আপনি গাড়িটা নিয়ে যান আর আমরা ট্যাক্সি করে এয়ারপোর্ট চলে যাবো।”
সাদ্দামকে তোহা চেনে। নীলাভ্রদের ফ্ল্যাটের দাড়োয়ান। আবার নীলাভ্রর সাথে উনার খুব ভালো সম্পর্কও। উনি একইসাথে নীলাভ্রদের ফ্ল্যাটের ড্রাইভার আবার দাড়োয়ান। নীলাভ্রর যেকোনো কাজে উনাকে পাওয়া যায়। আর রিম্মি যেহেতু নীলাভ্রর ঘনিষ্ট মানুষ তাই তার ইন্সট্রাকশন সাদ্দাম আনুগত্যের সাথেই পালন করে। বিশমিনিটের মধ্যে সাদ্দাম চলে আসে। রিম্মি সাদ্দামকে গাড়ির চাবি দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। এরপর তোহাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে৷ তোহা রিম্মির মতিগতি কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। শুধু রিম্মির পাশাপাশি হাঁটছে। রিম্মি এসব কেনো করছে তোহার ধারণাও নেই। কিন্তু প্রশ্নও করতে ইচ্ছে করেনা। রিম্মি যেটাই করুক, তার কিছু যায় আসেনা। তার উদ্দেশ্য শুধু অস্ট্রেলিয়া যাওয়া। আমীরকে দেখা। তোহার মনে হচ্ছে আমীরের কবর না, সরাসরি আমীরের সাথেই দেখা হবে অস্ট্রেলিয়াতে।
রিম্মির সাথে হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটা ফাঁকা মাঠের মতো জায়গায় এসে পড়লো। এখন ভোর সাতটা বাজে। জায়গাটা প্রচুর নিরব। কয়েকজন এসেছে যোগিং করতে। সকালের ব্যায়াম। কিন্তু সবাই অনেক অনেক দূরে অবস্থান করছে। দূর থেকে স্পষ্ট মানুষজন দেখা যায়না। তোহা আরেকটু সামনে যেতেই ভয়ে থমকে দাঁড়ায়। দেখলো একটা সবুজ হেলিকপ্টার। সামনে দুজন লম্বা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের হাতে কোকের ক্যান। ওরা একসাথে দাঁড়িয়ে নিজেদের মতো আলাপ করছে। দুইজনই বেশ সুদর্শন। একজনকে দেখতে টার্কিশদের মতো। আরেকজন কোরিয়ান ছেলেদের মতো। ওরা আড়চোখে রিম্মি-তোহার দিকেও তাকায়। বোঝাই যায় ওদের জন্যই দাঁড়িয়ে আছে। তোহা ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইল। রিম্মি তোহার হাত ধরে ওদিকেই নিয়ে যাচ্ছিল। তোহা দাঁড়িয়ে পড়ায় রিম্মি তাগাদা দিল,
” তাড়াতাড়ি চলো তোহা, এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যাবে না। কেউ দেখে ফেলার আগে আমাদের বুলেট হ্যালিতে উঠতে হবে।”
তোহা চোখ বড় করে ফেলে। এই এতোবড় হেলিকপ্টারটার নাম বুঝি বুলেট হ্যালি? আসলে হেলিকপ্টারটা আহামরি বড় না। মনে হচ্ছে কেবল ওদের চারজনের জন্যই বানানো হয়েছে। রিম্মি তোহাকে টেনে টেনে নিয়ে যায়। তোহা নিজস্ব শক্তিতে হাঁটছে না। রিম্মির টানে হাঁটছে। টার্কিশদের মতো দেখতে ছেলেটা রিম্মিকে ইশারায় কি যেন বলে। ওরা আসলে ইশারায় অনেক কথা বলতে শুরু করেছে। রিম্মির মুখ হাসিখুশি হলেও ছেলে দুটোর মুখ গম্ভীর। যেন রিম্মির প্রতি ওদের জন্মগত ক্ষোভ আছে। রিম্মি তোহার দিকে ইশারা করেও কি যেন বলে। হয়তো তোহার পরিচয় দিচ্ছে ওদের। কিন্তু কি পরিচয় দিল তোহা জানেনা। টার্কিশদের মতো দেখতে ছেলেটা তোহার দিকে বড় গোলকের মতো কিছু একটা ছুড়ে দিল। তোহা নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে ক্যাচ ধরে ফেলে। তারপর হকচকিয়ে যায়৷ সে-ই ভালো ক্যাচ ধরলো নাকি ছেলেটাই ভালো ঢিল ছুড়লো বুঝতেই পারলো না। রিম্মি তোহাকে বললো,
” এটা হেলমেট। মাথায় পড়ো।”
তোহা অবাক হয়ে জিনিসটার দিকে তাকায়। কাচের গোলক, নিচে ফাঁকা। মাথা ঢোকানোর জন্য পর্যাপ্ত জায়গা আছে। আর মাথা ঢুকানোর পর এটা যেন গলায় লাগানো যায় সেজন্য হলুদ রঙের বেল্টও আছে। কোরিয়ান ছেলেটা হেলিকপ্টারের ভেতর থেকে দুইটা বিরাট সাইজের জ্যাকেট এনে দেয়। রিম্মি তোহার দিকে ছুড়ে দিল। রিম্মি তো আগেই হেলমেট পড়ে নিয়েছিল। এবার জ্যাকেটটাও প্রফেশনালদের মতো ক্যাচ ধরে দক্ষহাতে পড়ে নেয়। তোহা জ্যাকেট আর হেলমেট হাতে নিয়ে গাধার মতো চেয়ে থাকে। হেলিকপ্টারে উঠার জন্য এইসব কেনো দরকার বুঝতে পারে না সে। লম্বা ছেলে দু’টো হেলিকপ্টারে উঠে যায়। ওরা সামনের জোড়া সিটে বসে। টার্কিশ ছেলেটা পাইলটের জায়গায় বসে। রিম্মি তোহাকে হেলমেট আর জ্যাকেট পড়িয়ে দিল। তারপর খুব সাবধানে বললো,
” আমার কথা মন দিয়ে শোনো তোহা, ওদের সামনে তুমি একদম মুখ খুলবে না। আমি ওদের বলেছি তুমি নীলাভ্রর দাদীমা। অস্ট্রেলিয়ায় তোমাকে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হচ্ছে। তুমি খুবই অসুস্থ। তাই অসুস্থ মানুষের মতো থাকবে। ওরা যদি একবার তোমাকে চিনতে পেরে যায় তাহলে অনেক বিপদ। আকাশ থেকে ধাক্কা দিয়ে হয়তো নিচে ফেলে দিতে পারে। তোমাকে বাঁচানোর ক্ষমতা আমার থাকবে না তখন। কারণ আমার নিজেকেই বাঁচানোর ক্ষমতা নেই।”
তোহা এতোক্ষণে কিছু বলতে নেয়, রিম্মি ওকে থামিয়ে বললো,
” একদম কথা বলবে না। ওরা তোমার কণ্ঠ শুনলে তো বুঝে যাবে তুমি বৃদ্ধা না। আচ্ছা, তুমি যদি আমাকে কিছু বলতে চাও তাহলে মনে মনে সেটা উচ্চারণ করো। আমি বুঝে নিবো।”
তোহা মনে মনে বললো,” আমরা এতো রিস্ক নিয়ে কোথায় যাচ্ছি? ওরা কারা?”
রিম্মি এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তোহাকে নিয়ে বুলেট হ্যালিতে উঠলো। চারিদিক থেকে সব বন্ধ হয়ে যায়। ফরসা ছেলে দুটো রিম্মিকে বললো সিট বেল্ট পড়ে নিতে। এইটা ওরা অজ্ঞাত ভাষায় বলে ঠিকই, কিন্তু তোহা বুঝতে পারে। আর ওরা নিজেরা নিজেদের ভাষায় কথা বলছে। যেই ভাষাটা তোহার বোধগম্য নয়। রিম্মি তোহাকে বেল্ট পড়িয়ে দেয়। কিন্তু এই বেল্ট একদম অন্যরকম। সিটের সাথে শরীরটা আষ্টেপৃষ্টে ক্রস আকারে বেধে ফেলতে হয়। আর নড়াচড়া করা যায় না। একই জায়গায় রোবটের মতো বসে থাকতে হয়। তোহাকে বেধে দেওয়া শেষ হলে রিম্মি নিজেও সিট বেল্ট বেধে নেয় এরপর আস্তে-ধীরে বললো,
” শোনো তোহা, এইযে দুজনকে দেখছো। ওরা হচ্ছে আমীরের খুব খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড। আর ওরাও কিন্তু সাইন্টিস্ট। একজন হলো তুরস্কের। ওর নাম হাসাদ। আরেকজন সাউথ কোরিয়ান। ওর নাম ইউজান। ওরা আমীরের ছোটবেলার সহচর। আর আমরা এখন আমীরের কাছেই যাচ্ছি৷ তোমার আমীরের সাথে দেখা হতে চলেছে, তোহা। খুশি হও। কিন্তু বেশি খুশি হওয়ার দরকার নেই। কারণ তুমি শুধু ওকে লুকিয়ে দেখতে পারবে। ওর সামনে গিয়ে একদম কথা বলতে পারবে না। শুধু দেখবে,ছুঁতেও পারবে না। ও যদি তোমাকে প্রশ্ন করে, তুমি উত্তর দিবে না। মনে মনে কিছু চিন্তাও করবে না। তোমার উত্তর আমি দিবো। জানি আমীরকে সামনে দেখেও এতোটা নিয়ন্ত্রিত থাকা তোমার জন্য অনেক কষ্টের। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই বিশ্বাস করো। দেখা যে হচ্ছে এটাই অনেক। ওর সাথে কিন্তু তোমার আরেকবার দেখা হওয়ার কথা কখনোই ছিল না। তাও হচ্ছে। তুমি নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করো। এরপর থেকে ওকে আর কোনোদিন তুমি দেখবে না। অনন্তকালেও না! সারাজীবনের শেষ দেখা একেবারেই দেখে নিও। আর এখন কোনো প্রশ্ন করোনা। কয়েক মিনিট পর আমরা অস্ট্রেলিয়া পৌছে যাবো।”
বিস্মিত তোহা আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগই পেল না। বুলেট হ্যালি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে বুলেটের গতিতে ছুটে গেল। বাংলাদেশের মাটি পেরিয়ে প্রাসের গতিতে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে পতিত হয়। এজন্যই এর নাম বুলেট হ্যালি!
চলবে
( এই গল্পটা আমার ড্রিম প্রজেক্ট। জীবনে কখনো কোনোকিছুতে এতো শ্রম দেইনি। যতটা এইটার জন্য দিচ্ছি।🥺)