#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৪৮
লিখা: Sidratul Muntaz
ফাঁকাস্থানে বুলেট হ্যালি প্রচুর শব্দ করে ক্রাশ হয়। হ্যালির সামনে বুলেটের মতো অংশটি একদম মাটি খুড়ে গেঁথে যায়। এ অবস্থাতেও নিজস্ব জায়গা থেকে কেউ এক অণু পরিমাণ সরেনি। তবে প্রচন্ড বেগে ধাক্কা লাগার ফলে ছাদ ফেটে কিছু ভারী পদার্থ তোহাদের মাথায় পড়ে। কিন্তু হেলমেট থাকার কারণে ওদের ক্ষতি হয়না। তোহার মনে হচ্ছে পৃথিবী ভস্ম করা এক ভয়ংকর ভূমিকম্প এইমাত্র বয়ে গেল। সে চোখমুখ খিচে থরথর করে কাঁপে। বুকে জোরালোভাবে ঢিপঢিপ শুরু হয়। রিম্মি তোহার বেল্ট, জ্যাকেট, হেলমেট এইসব খুলে দিল। তোহা চোখ খুলে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে ছেলে দু’টো নামছে। সবকিছু কালো কাপড়ের আড়াল থেকে স্পষ্ট দেখা যায় না। রিম্মি বললো,
” নামো। আর যা বলেছিলাম মনে আছে তো? কোনো কথা বলা যাবে না,মনে মনে চিন্তাও করবে না। শুধু আমার পেছন পেছন হাঁটবে৷ কোনো দিকে বেশি তাকানোরও প্রয়োজন নেই৷ এখানে অনেক বিস্ময়কর জিনিস আছে। তাছাড়া কেউ কেউ তোমাকে দাঁড় করিয়ে অনেক ধরণের প্রশ্নও করতে পারে। কিন্তু যাই হয়ে যাক, তুমি ভয় পাবে না। আর কথা বলবে না। আমি তোমার হয়ে যা বলার বলবো। যদি আমার কথা মেনে চলো তাহলে ভয়ের কিছু নেই। ভাববে আমি তোমার পাশেই আছি৷ কিন্তু যদি ভুল করো তাহলে বিপদ তোমারও হবে আমারও হবে। তখন কিন্তু চেষ্টা করলেও আমি তোমার পাশে থাকতে পারবো না। অতএব আমাদের দু’জনেরই জীবন এখন সংকটাপন্ন ধরা যায়। তাই খুব খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। স্পেশালি আমীরের সামনে গেলে। তাছাড়া আজকে তুমি এমন কিছু অভিজ্ঞতার সাথে পরিচিত হতে চলেছো যা হয়তো আগে কখনও দেখোইনি। এজন্য অবাক হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ো না যেন।”
রিম্মি কথা শেষ করে ঝাঁপ দিয়ে বুলেট হ্যালি থেকে নামে। তোহাকে হাত ধরে নামায়। তোহা এখনো বুঝতে পারছে না ওর অনুভূতি কি? শুধু মনে হচ্ছে আমীরের সামনে গেলেই সব ভয় কেটে যাবে। আমীরকে দেখার জন্য মনটা আকুল তৃষ্ণায় কাতরাচ্ছে। রিম্মি বলেছে আমীরের সাথে অনন্তকালে আর কখনো দেখা হবেনা৷ এটাই নাকি ওদের শেষ দেখা। কিন্তু তোহা এই কথা মানতে পারছে না। বললেই হলো নাকি? পৃথিবী উল্টে-পাল্টে গেলেও সে আমীরকে আবার পেলে আর কোথাও হারিয়ে যেতে দিবে না। অনন্তকালের জন্য তো একদমই না বরং এক মুহুর্তের জন্যও না। একবার শুধু আমীরের কাছে সে পৌঁছে নিক, ভালোবাসার পাগলামির ভয়ানক সংজ্ঞা কি জিনিস সবাই বুঝবে। চারদিকে সবুজ প্রান্তর। অনেক বড় বেলাভূমির ঠিক মধ্যিখানে একটা প্রকান্ড আকৃতির ভবন। ভবনটি ছাইরঙা, এতো লম্বা আর চওড়া যে দেখলেই গাঁ ছমছম করে উঠে। এ ধরণের ভবন ইংরেজি মুভিতে দেখেছে তোহা৷ কিন্তু বাস্তবে দেখতে যে এতোটা লোমহর্ষক তা ভাবতেও পারেনি। এই বহুতল ভবনটি কমপক্ষে ৩০/৩৫ ফুট লম্বা। দেখে মনে হয় বিশাল এক রোবট দাঁড়িয়ে আছে। যেকোনো সময় চলতে শুরু করবে। তখন পুরো বিশ্ব কেঁপে উঠবে। রোবটের এক পায়ের চাপে সে জায়গার মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। তোহারা হয়তো তখন আর স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়েও থাকতে পারবে না। হেলে-দুলে পড়ে যাবে। কারণ ভূপৃষ্ঠ তখন তুমুল গতিতে কাঁপবে। মেইনগেইটের সামনে দু’জন ডিটেকটিভের মতো মানুষ দাঁড়ানো। ওদের দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটা রোবটিক। গায়ে কোর্ট, মাথায় ক্যাপ, চোখে সানগ্লাস আর বগলে মেশিনগানের মতো যন্ত্র। সবকিছুই কালো রঙের। ইউজান আর হাসাদ সদর দরজার সামনে গিয়ে নিজেদের জ্যাকেটের পকেট থেকে আইডি কার্ড বের করলো। তারপর গোয়েন্দা দু’জনকে সেই কার্ড দেখালো। রিম্মিও সামনে গিয়ে ওর আইডি কার্ড বের করে দেখালো। তোহা এতোক্ষণে খেয়াল করে ওদের তিনজনের পোশাক সেইম। দাঁড়ানোর ভঙ্গিটাও একদম সেইম। গোয়েন্দা দু’জন আইডি কার্ড দেখে ডানহাত মুষ্টিবদ্ধ করে বুকের বামপাশে ঠেকায়। আর ডানপা উঠিয়ে এক কদম দেয়। অনেকটা আর্মি স্টাইলে সম্মান প্রদর্শনের মতো। আর্মিরা তো মাথায় হাত রেখে স্যালুট করে। ওরা স্যালুট করছে না, কি করছে তোহা জানেও না। এরপর লোক দুটো দরজা খুলে দিল। কেমন যেন শরীর শিউরে উঠার মতো একটা ভয়ানক আওয়াজ হয়। মাঝখান থেকে স্টিলের মতো মোটা পাতের দরজাটা খুলে যায়। তোহার মনে হলো ওরা কোনো এনিমেশন ইন্ডাস্ট্রিতে চলে এসেছে। সবকিছু অন্যরকম! পুরো জায়গা অন্ধকার, দিন নাকি রাত এই জায়গায় থাকলে বোঝা যাবে না। দুইপাশে অজস্র যন্ত্রপাতিতে ঠাসা আর মাঝখানে লম্বা রাস্তা, ফ্লোরের রঙ কালো। তোহার বুকে চাপ অনুভব হয়। এই জায়গায় তার খুব ভয় লাগছে৷ রিম্মি তোহার হাত ধরে ভিতরে যেতে যেতে বললো,
” এইটা আমাদের হেড অফিস। পৃথিবীর সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট সাইন্টিস্টদের নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে বলে এটা বিশ্বের বেস্ট সাইন্টিফিক রিসার্চ সেন্টার।আমাদের একজন প্রফেসর আছে। আমরা তাকে বলি প্রফেসর ট্রুডো। উনিই এখানকার মহাপরিচালক। আর আমরা সবাই সহকারী। তোমার কি এখানে ভয় লাগছে তোহা?”
তোহা মনে মনে উচ্চারণ করলো,” একদম না।”
রিম্মি তোহার মনের কথা জানে। তাও প্রশ্ন করছে। ওকে স্বাভাবিক রাখার জন্য। রিম্মি বললো,
” এতোকিছু করে তোমাকে এখানে কেনো আনলাম জানো?”
” না, কেনো?”
” কারণ তোমার অবস্থা দেখে আমার খুব খারাপ লাগতো। কালরাতে তুমি যেভাবে মিনতি করেছিলে তাতে আমার ফিরিয়ে কষ্ট হয়েছিল। তাছাড়া যাকে তুমি এতো ভালোবাসো, তাকে শেষবার দেখার অধিকার তোমার আছে। ”
তোহার মনটা বিষাক্ত বেদনায় জ্বলে উঠে। রিম্মি শেষবার দেখা হওয়ার কথা কেনো বলছে বারবার?তোহা মানতেই পারছে না। অসহ্য যন্ত্রণার মতো লাগছে। রিম্মির কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই একটা অদ্ভুত জিনিস সামনে এসে দাঁড়ায়৷ হাত-পা স্টিলের। হাইট চারফিটের মতো হবে। চোখগুলো স্টার আকৃতির, নীল রঙের। মাথাটা গোল। তোহা দেখেই ভয়ে এক কদম পিছিয়ে গেল। অদ্ভুত জিনিসটা কেমন মেশিনের মতো শব্দ করে বললো,
” মিস রিম্মি, প্রফেসর ট্রুডো ইজ কলিং ইউ ইন দ্যা পারসোনাল মিটিংরুম।”
এই একটি বাক্য রোবটটা তিনবার উচ্চারণ করে৷ রিম্মির বুকটা ধ্বক করে উঠলো, কয়েক মুহুর্তের জন্য কথা বলার শক্তিটাও হারিয়ে ফেলে। খুব কষ্টে কম্পিত গলায় প্রশ্ন করলো,
” প্রফেসর? কিন্তু স্যার না আমেরিকায় ছিলেন? এখানে কবে আসলেন? আমাকে কিছু জানানো হয়নি কেনো?”
রিম্মির গলায় প্রচুর অস্থিরতা। রোবট কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। একই বাক্য উচ্চারণ করতে থাকে। তোহা কৌতুহলী চোখে রিম্মির অবস্থা দেখছে। রিম্মি এতো ভয় পাচ্ছে কেনো? এই প্রথম সে ভয় পেতে বা অস্থির হতে দেখলো রিম্মিকে। আচ্ছা ওরা কি তাহলে ধরা পড়ে গেল? রিম্মি তোহার দিকে চেয়ে বললো,
” শোনো তোহা, তুমি এখান থেকে সোজা হেটে যাবে। ভালো করে আশেপাশে তাকিয়ে হাঁটবে আর যেদিকেই একটা ফাঁকা রুম পাবে, সাথে সাথে ঢুকে পড়বে। কেউ ডাকলে যাবে না, কথাও বলবে না। আর ভয় পেয়ো না। আমি জলদি আসবো তোমার কাছে।”
তোহার এখনি ভয় লাগছে। তবুও সে মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিল। এখন যদি কোথাও আমীরকে পাওয়া যেতো! আমীর কোথায় আছে? সে কি হাঁটতে হাঁটতে আমীরকে খুঁজবে? এতোবড় জায়গায় কিভাবে খুঁজে পাবে?
তোহা হাঁটছে। এই জায়গা এতো নিরব আর থমথমে যে ভয়ে গাঁয়ের রক্ত হিম হয়ে আসতে চায়। আমীরকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। সে কোথায় আছে? তোহার ইচ্ছে হয় চিৎকার করে আমীরকে ডাকতে। হঠাৎ তোহা শুনতে পেল একদল পায়ের শব্দ এদিকেই ভেসে আসছে৷ তোহা ভয়ে দেয়ালের পেছনে লুকিয়ে পড়ে। উঁকি মেরে দেখলো একদল রোবট ফোর্স। ওদের দেখতে এতোটাই ভয়ংকর যে তোহার মুখ দিয়ে শব্দ বেরিয়ে আসলো। সে দ্রুত চেপে ধরলো নিজের মুখ। রোবট ফোর্সের কানে সেই শব্দ পৌছাতেই ওরা শতর্ক হয়ে ডানদিকে তাকায়৷ তোহা যেই দেয়ালের উল্টো পিঠ ঘেষে দাঁড়ানো ওদের দৃষ্টি সেই দেয়ালেই। ওদের সচল মস্তিষ্ক বুঝে যায় এখানে বাহিরের কেউ ঢুকে পড়েছে৷ এখন ওদের দায়িত্ব হলো সেই অজ্ঞাত মানুষটিকে শ্যুট করে মেরে ফেলা। সবাই মেশিনগান তাক করে সমান তালে বলে,
” হু ইজ দেয়ার?”
তোহা কেঁপে উঠে। জবাব দেয় না৷ রোবট ফোর্স তোহার হার্টবিটের শব্দ অনুসরণ করতে করতে ওর পেছনে চলে আসে। সবাই একসাথে মেশিনগান তাক করে। তোহা যখন আরেকবার উঁকি দিল দেখলো কেউ নেই। জায়গাটা ফাঁকা। হাফ ছেড়ে পেছনে তাকাতেই তোহার হৃৎপিন্ড থমকে যায়। প্রায় দশটার মতো লম্বাকৃতির ভয়ংকর চেহারার রোবট ওর পেছনে জড়ো হয়ে আছে। প্রত্যেকের হাতে ভয়ানক মেশিনগান আর ওদের টার্গেট তোহা। তোহা খুব জোরে চিৎকার দেয়, তখনি পেছন থেকে কেউ টেনে নিয়ে যায় তাকে। রোবট ফোর্স এতোক্ষণে বুলেট ছুড়তে শুরু করেছে। কিন্তু একটা বুলেটও তোহার গায়ে লাগেনি।
রিম্মি প্রফেসর ট্রুডোর মিটিংরুমে যাওয়ার সময় ওর হাটু কাঁপতে থাকে। ভয়ে মাথার সাজানো চিন্তাগুলো জট পাকিয়ে যাচ্ছে। স্যার রিম্মিকে ডাকতেই পারেন। কিন্তু ও ভবনে প্রবেশের সাথে সাথেই কেনো ডাকলেন? তাছাড়া উনার তো আজ আমেরিকা থাকার কথা ছিল। উনি দেশে ফিরলেন অথচ তাকে কেউ কিছু জানালো না কেনো? অন্তত আমীর তাকে জানাতে পারতো! রিম্মি এসব ভাবতে ভাবতে মিটিংরুমের গেইট বরাবর চলে এসেছে। দরজা আপনা-আপনি খুলে গেল। রিম্মি বার কয়েক শ্বাস ছেড়ে বুকে সাহস সঞ্চয় করলো। মিটিংরুমে মৃদু বাতি জ্বলছে। পুরো রুম জুড়ে বাউন্ডারির মতো স্টিলের বিশাল টেবিলের একদম বরাবর বসে আছেন প্রফেসর ট্রুডো। উনার অবস্থানটা সবার কেন্দ্রে৷ তাকে ঘিরেই ডানে-বামে বসে আছে পচিশ থেকে শুরু করে ষাটোর্ধ বয়সের বিজ্ঞানীরা। এইখানে মেয়ে মাত্র দু’জন। আনাস্তাসিয়া ম্যাম আর টিজুয়ু ম্যাম। একজন আমেরিকান আরেকজন জাপানিজ। উনাদের বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। অতীতে এইখানের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সাইন্টিস্ট গ্রুপের মেম্বার ছিল আমীর, রিড, সানভী, হিরোশ,হাসাদ,ইউজান। এই ছয়জন ছোটবেলার বন্ধু। তাদের ভাব গলায় গলায়। কিন্তু এদেরকে টেক্কা দিয়ে কিছুদিন আগে তিরান নামের একটা ছেলে সেই স্থান দখল করে নিয়েছে। সে একাই একটা গ্রুপ। ছেলেটা খুবই ব্রিলিয়ান্ট। এক কথায় একটা প্রডিজি। সবাই তার মেধা দেখে তাক লেগে যায়। এতো আপগ্রেডেড চিন্তা-ভাবনা এর আগে কাউকে করতে দেখা যায়নি। ছেলেটির এতোই সাহস যা আমীরকেও হার মানায়। আগে সাহসিকতার জন্য অস্কার পাওয়ার যোগ্য ছিল আমীর। এখন সে স্থান তিরান দখল করেছে। অথচ ছেলেটার বয়স মাত্র ১৩/১৪। এতোটুকু একটা ছেলের এতো ক্ষমতা রিম্মির একদম পছন্দ না। সবাই তাকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় বলে রিম্মির ধারণা। আর তিরান কিছুদিন ধরে তার পেছনে লেগেছে। রিম্মি যে আজকে তোহাকে ছদ্মবেশে এই রিসার্চ সেন্টারে ঢুকিয়েছে এটা হয়তো তিরান এতোক্ষণে প্রফেসর ট্রুডোর কানে ঢেলে দিয়েছে। কিন্তু তিরান এসব জানলো কিভাবে? ছেলেটার সিক্সথ সেন্স অনেক হাই লেভেলের। সে আগে থেকেই কিভাবে যেন সব টের পায়। রিম্মির কাছে বিষয়টা গুসবাম্পসের মতো। সে মিটিংরুমে প্রবেশ করেছে এক সেকেন্ডও হয়নি, প্রফেসর ট্রুডো চেয়ার ছেড়ে উঠে একটা ভারী গোলক রিম্মির মুখ বরাবর আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ছুড়ে মারলেন। রিম্মি ছিটকে পড়ে যায়, দেয়ালে বারি খায়। সবাই হতচকিত হয় দেখে। আমীর উঠে আসলো রিম্মিকে তুলতে। তিরানও ছুটে আসে। কিন্তু রিম্মি তিরানের হাত ধরে না। আমীরের হাত ধরে। তার মাথাটা ভার লাগছে, নাকে প্রচুর ব্যথা। মনে হয় নাকের হাড় ভেঙে গেছে। প্রফেসর ট্রুডো তীব্র গর্জনে ইংরেজি ভাষায় বললেন,
” এতোবড় বিশ্বাসঘাতক তুমি? কিভাবে নিজের সংস্থার সাথে বেইমানি করলে? ওই সম্মানীয় জ্যাকেট তোমার জন্য না৷ ওটাকে এখনি ফেলে বের হয়ে যাও৷ তোমার মতো বেইমানকে আমাদের এখানে কোনো প্রয়োজন নেই।”
রিম্মি উঠে দাঁড়াতে চাইলো। কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না। প্রফেসর ট্রুডোর বিস্ফোরিত দৃষ্টি ওর দিকে। রাগে প্রফেসরের শরীর ব্লেন্ডার মেশিনের মতো কাঁপছে। আমীর মনে মনে রিম্মিকে বললো,
” তোহাকে এখানে আনার কি দরকার ছিল রিম্মি? আর ওকে তুমি কোথায় রেখে এসেছো? যদি ওর কোনো বিপদ হয় তোমাকে আমি ছাড়বো না। স্যার সব জেনে গেছেন। বাংলাদেশ থেকে তোমাকে ফলো করতে করতে এসেছেন।”
রিম্মি আরও চমকায়। সে এতোবড় বোকামি কিভাবে করলো? প্রফেসর ট্রুডো তাকে ফলো করেছে অথচ সে টেরও পায়নি! রিম্মি তীক্ষ্ণ চোখে তিরানের দিকে তাকিয়ে আমীরের উদ্দেশ্যে বললো,” এসব নিশ্চয়ই তিরানের প্ল্যান ছিল?”
আমীর এই প্রশ্নের উত্তর দেয় না।
রিম্মি তিরানের দিকে তাকালো।প্রফেসর ট্রুডো আমীর আর তিরানকে অর্ডার দেন রিম্মিকে ছেড়ে চলে আসার জন্য। আমীর আর তিরান নিজেদের জায়গায় এসে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। প্রফেসরের মুখের উপর কথা বলার সাধ্য কারো নেই। প্রফেসর বললেন,
” তুমি কি তোমার ভুল জানো?”
রিম্মির চোখে পানি জমছে। সে নত মাথায় জবাব দিল, জানে। প্রফেসর বললেন,
” এখন তুমিই ডিসাইড করো তোমার উপযুক্ত শাস্তি কি হওয়া উচিৎ? তুমি নিজের দন্ড নিজেই সিলেক্ট করবে পাঁচসেকেন্ডে। আর যদি তোমার ডিসিশন নিতে দেরি হয়, তাহলে আমার ইচ্ছামতো আমি দন্ড দিবো। আর সেটা অবশ্যই খুব ভয়ানক হবে।”
আমীর শান্তগলায় বললো,” স্যার, যদি কিছু মনে না করেন আমি কি একটু ইন্টারফেয়ার করবো?”
প্রফেসর ট্রুডো বললেন,” কি বলতে চাও?”
আমীর রিম্মির দিকে ঘুরে বললো,” ও নীলাভ্রর সামনে দাঁড়িয়ে সব ভুল স্বীকার করবে। এটাই হবে বেস্ট সলিউশন। ওর বেইমানির উপযুক্ত শিক্ষা।”
রিম্মি আঁতকে উঠা দৃষ্টি নিয়ে আমীরের দিকে তাকায়।আমীর তাকে এইভাবে ফাসাতে চাইছে কেনো? তাছাড়া নীলাভ্রকে রিম্মি কোথায় পাবে? সে তো বাংলাদেশে..!
তোহা আবিষ্কার করলো সে একটা অচেনা রুমে চলে এসেছে আর তাকে যে অজ্ঞাত ব্যক্তিটি উদ্ধার করেছে সে নীলাভ্র। তোহা শিহরিত হয়ে বললো,
” ভাইয়া তুমি?”
নীলাভ্রও একইভাবে অবাক হয়,” তুই এখানে কি করছিস?”
তোহা তার সাথে ঘটে যাওয়া সব বিস্ময়কর ঘটনা জানালো। এবার নীলাভ্র জানালো তার সাথে কি হয়েছিল। রিম্মি আর তোহাকে বিদায় দিয়ে নীলাভ্র স্বাভাবিকভাবেই বাসায় ঢুকে যাচ্ছিল। তখন একটা ১৩/১৪ বছরের বাচ্চা ছেলে ওর দিকে ফুটবল ছুড়ে দেয়। আর বলে,
” ভাইয়া, কিক ইট ফাস্ট।”
নীলাভ্র হেসে বল কিক করে। ছেলেটা আবার ছুড়ে দেয়। নীলাভ্র কিছুটা বিরক্ত হয়ে দ্বিতীয়বার কিক করে। ছেলেটা তৃতীয়বার বল ছুড়ে দিতেই নীলাভ্র ধমক দিয়ে ওকে কিছু বলতে গেল। তখনি পেছন থেকে কেউ একটা কালো কাপড়ের আবরণে ঢেকে নীলাভ্রকে বন্দী করে ফেলে। নীলাভ্রর এরপর আর কিছু মনে নেই৷ চোখ খুলে সে প্রচন্ড অবাক হয়ে যায়৷ তার মনে হয় সে দুঃস্বপ্ন দেখছে৷ এইরুম থেকে বের হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু সফল হতে পারেনা। একটু আগে একটা রোবট এসে দরজা খুলে দেয়। নীলাভ্র রোবটটিকে জিজ্ঞেস করে তাকে এখানে কেনো আনা হয়েছে। রোবট কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের মনে কি যেন বলতে বলতে চলে যায়। নীলাভ্র রোবটটির মাথায় জোরে আঘাত করতে গিয়ে নিজেই হাতে ব্যথা পেয়ে বসে থাকে। রোবটের টনকও নড়েনি তাতে। হাতের সেই ব্যথার চিহ্ন তোহাকে দেখালো নীলাভ্র।
প্রফেসর ট্রুডো আমীরের কথা পছন্দ করেছেন। তাই উনি আমীরের সাথে রিম্মিকে পাঠালেন। ওদের পিছন পিছন তিরানও আসছে। রিম্মি আমীরকে জিজ্ঞেস করলো,
” নীলাভ্র এখানে কিভাবে এসেছে? ওর কোনো ক্ষতি হলে তোমাকে জীবিত রাখবো না।”
তিরান আর আমীর সমান তালে বললো,” আর তোহার কোনো ক্ষতি হলে তোমাকেও জীবিত রাখবো না।”
আমীর নিজের কথার প্রতিধ্বনি শুনে থমকে দাঁড়ালো। আড়চোখে তিরানের দিকে তাকালো। রিম্মিও তাকায় বিস্ফোরিত চোখে। তিরান সরল দৃষ্টিতে বললো,
” হোয়াট হ্যাপেনড?”
আমীর কোনো উত্তর দেয়না। সামনে হাঁটতে থাকলো। রিম্মি বললো,
” তোমরা দুজন প্ল্যান করে নীলাভ্রকে তুলে এনেছো তাইনা?”
আমীর বললো,” হুম। ডিরেক্ট কিডন্যাপ করেছি।”
” কিডন্যাপ? হাউ ডেয়ার ইউ?”
” তুমি যদি আমাদের বোকা বানিয়ে নীলাভ্রর দাদী সাজিয়ে তোহাকে এখানে নিয়ে আসতে পারো তাহলে আমরাও পারি নীলাভ্রকে কিডন্যাপ করতে!”
” ঠিকাছে, আমি যদি নীলাভ্রর কাছে সব দোষ স্বীকার করতে পারি তাহলে তুমিও পারো তোহার কাছে সব স্বীকার করবে।”
” উহুম, আমি কেনো করবো? আমাকে তো শাস্তি দেওয়া হয়নি। শাস্তি হচ্ছে তোমার। ট্রুডো স্যারের পারমিশন ছাড়া ধোকাবাজি করে তোহাকে এখানে প্রবেশ করিয়েছো। কিন্তু আমি আর তির তো ট্রুডো স্যারের পারমিশন নিয়েই নীলাভ্রকে কিডন্যাপ করতে গিয়েছিলাম। আমার কিছু স্বীকার করার প্রশ্নই আসেনা। তুমিই সব স্বীকার করবে রিম্মি।”
রাগে রিম্মির শরীর থরথর করে কাঁপছে। সবাই তার বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে কেনো? সে কি অনেক বড় ভুল করেছে? শুধু আমীরের একটু ভালো চেয়েছিল। এটাই তার দোষ?
আমীর বললো,” তুমি কি জানো রিম্মি? তুমি যে অনেক বড় একটা ভুল করেছো?”
” কি ভুল?”
” এখানে আসার আগে তুমি নীলাভ্রদের বাসার গার্ড সাদ্দামের সাথে ফোনে কথা বলেছিলে। সবাই কিন্তু জানে ইউ আর ভয়েসলেস। এতোবড় ভুল কিভাবে করলে? এই কথা তো আমি আর তির ট্রুডো স্যারকে বলিইনি। বললে তোমার পানিশমেন্ট আরও ভয়াবহ হতো। ট্রুডো স্যার তোমাকে টপ ফ্লোরে নিয়ে মেশিনগান দিয়ে শ্যুট করে দিতেন।”
রিম্মির গলা শুকিয়ে আসছে। আসলেই তো, সে এতোবড় ভুল করলো অথচ তোহা বা সাদ্দাম কেউ ধরতে পারলো না কেনো? আমীর এই কারণটাও বলে দিল। এখানে সবাই সবার মনের কথা শুনতে পারে। আমীর বললো,
” সবাই জানতো তুমি কথা বলতে পারো না। শুধু মস্তিষ্কের মাধ্যমে সিগন্যাল পাঠাও। তাও কিন্তু তুমি মাঝে মাঝেই নীলাভ্র, তোহা, আরও অনেকের সাথেই শব্দ করে কথা বলে ফেলতে। কিন্তু কেউ সেটা ধরতে পারতো না। কারণটা হচ্ছে ব্রেইনওয়াশ। সবার ব্রেইনে আমি বিষয়টা এমনভাবে সেট করে দিয়েছিলাম যে তুমি ভয়েস দিয়ে কথা বললেও কেউ বুঝতো না। সবাই ধরে নিতো মস্তিষ্কের আলোড়ন। বুঝতে পেরেছো?”
রিম্মি কোনো উত্তর দেয়না। সে আতঙ্কিত। আমীর পেছনে হাত গুটিয়ে হাঁটছে। তিরানও একইভাবে হাঁটছে। দুজনই একটু পর পর চোখের চশমা নাড়াচ্ছে। তিরানকে দেখলে মনে হয় যেন জুনিয়র আমীর! আমীর নিজেও বুঝে না এই ছেলেটার সাথে তার এতো মিল কিভাবে? তোহা-নীলাভ্র যে ঘরে বন্দী সেখানে এসে থামলো তিনজন। আমীর দরজার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
” যাও।”
রিম্মি মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। চোখ বন্ধ করে ঘরের দিকে পা বাড়ালো। তোহা-নীলাভ্র হঠাৎ রিম্মিকে দেখে আতঙ্ক নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তোহা কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও নীলাভ্র অবাক হয়ে রিম্মিকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখতে থাকে। তার চিনতে অসুবিধা হচ্ছে। রিম্মিকে এ ধরণের পোশাকে আগে কখনো দেখেনি সে। তোহা বললো,
” রিম্মিআপু, এটা আমরা কোথায় এসেছি? নীলাভ্র ভাইয়াকে এখানে কেনো আনা হয়েছে? আমাদের সাথে এসব কি হচ্ছে?”
রিম্মি শান্ত কণ্ঠে বললো,” বসো, বলছি। আজকে সব প্রশ্নের উত্তর দিবো।”
রিম্মি একটা সাদা ডেস্ক চেয়ারে বসে। একই দেখতে আরও চেয়ার আছে এইরুমে। তোহা আর নীলাভ্রও চেয়ারে বসেছে। রিম্মি ক্লান্ত গলায় বললো,
” তোমরা কি একবারো খেয়াল করেছো,আমি যে তোমাদের সাথে ভয়েস দিয়ে কথা বলছি?”
নীলাভ্র আর তোহা চমকে উঠলো৷ ঘোর বিস্ময় নিয়ে চোখাচোখি করলো। নীলাভ্র বললো,
” আসলেই তো, কিভাবে বলছো?”
রিম্মি কিছুটা অবাক হয়। আমীর তাহলে ঠিকই বলেছিল, ব্রেইনওয়াশ! ওর ব্রেইনওয়াশের এতো পাওয়ার? আমীর সত্যিই জিনিয়াস।
রিম্মি বললো,” কারণ আমি আসলেই কথা বলতে পারি।”
নীলাভ্রর মাথাটা যেন ফাঁকা হয়ে গেল। মনে হয় স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্নেই হয়তো রিম্মি কথা বলতে পারছে। সে এর আগেও অনেকবার স্বপ্নে রিম্মিকে কথা বলতে শুনেছে। রিম্মি থেমে থেমে বললো,
” আজকে আমি তোমাদের কাছে অনেক বড় কিছু কনফেসন করতে চলেছি। যা কখনো তোমাদের জানার কথা ছিল না। কিন্তু আজকে তোমরা জানবে৷ তখন হয়তো স্বাভাবিক থাকা তোমাদের জন্য সম্ভব হবে না। তাই মানসিক প্রস্তুতি নাও। প্রথমেই কোনো প্রশ্ন করবে না, আগে মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনবে। আমাকে বোঝার চেষ্টা করবে।”
তোহা কোনো উত্তর দেয়না। বিস্ময় এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। নীলাভ্র ঢোক গিলে স্বাভাবিক থাকার অদম্য চেষ্টা করে বললো,
” ঠিকাছে, বলো।”
রিম্মি বললো,” আমি এতোদিন পর্যন্ত তোমার সাথে অনেক মিথ্যে বলেছি নীলাভ্র। আমাদের সম্পর্কে সত্যের কোনো ছিঁটেফোঁটাও ছিল না। সবকিছু পূর্ব পরিকল্পিত। আমাদের প্রথম দেখার কথা মনে আছে? তোমার গাড়ির গ্লাস দেখে লিপস্টিক ঠিক করা, তারপর ফ্লায়িং কিস দেওয়া, তোমাকে দেখে ভয়ে পালিয়ে যাওয়া, তারপর তোমারই ঘরের ডাইনিং টেবিলে বসে তোমার জন্য অপেক্ষা করা। তুমি কথা বলতে আসলে তোমার সাথে কথা বলিনি। ভয় পাওয়ার অভিনয় করেছি। তারপর তোমাদেরই পাশের ফ্ল্যাটে বাসা ভাড়া নিয়েছি। সবকিছু ছিল একটা ফাঁদ। এমনকি শপিংমলে তোহার কিডন্যাপ হয়ে যাওয়া এটাও কিন্তু এই প্ল্যানেরই অংশ। আমীর সেদিন ভুল করে আমার জায়গায় তোহাকে কিডন্যাপ করেনি। আমাদের ভুল এতো সহজে হয়না। আমীরের টার্গেট আগেই তোহা ছিল। বরং আমি প্ল্যান করে তোহার মতো একই ডিজাইনের জামা পড়েছিলাম। যেন পরবর্তীতে তোমাকে বুঝাতে পারি যে আমীর আমাকে কিডন্যাপ করতে এসেছিল।”
তোহার মুখ দিয়ে আপনা-আপনি উচ্চারিত হয়,” কিহ?”
নীলাভ্র কিছু বলে না। ধাক্কা সামলে একটু পর জিজ্ঞেস করলো,” তারপর?”
রিম্মি বললো,” আমার বিষয়ে তুমি যেটুকু জানো, পুরোটাই ভুল। মিথ্যা অভিনয়। মায়ের সাথে আমার বাংলাদেশে আসার উদ্দেশ্য আমীরের ভয় না, তুমি ছিলে নীলাভ্র। আর আমীরের বাংলাদেশে আসার উদ্দেশ্যও কিন্তু আমাকে খুঁজে বের করা না, তার মূল উদ্দেশ্য তোহা। এ পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে সব আমি আর আমীর একজোট হয়ে করেছি যেন তোমাদেরকে আমাদের প্রেমে ফেলতে পারি।”
তোহা চাপাস্বরে খুব কষ্টে প্রশ্ন করলো,” আমাদের প্রেমে ফেলে তোমাদের কি লাভ?”
রিম্মি বললো,” আগেই বলেছি, মাঝখানে প্রশ্ন করবে না। আমি সব বলছি তো। শুধু মনোযোগ দিয়ে শোনো।”
নীলাভ্র তোহার হাতের উপর হাত রেখে শান্ত থাকার ইশারা দিল। তারপর রিম্মিকে বললো,
” বলে যাও তুমি।”
রিম্মি বললো,” আমাদের প্রথম প্ল্যান ছিল আমি বোবা আর সহজ-সরল একটা মেয়ে হয়ে থাকবো৷ তুমি আমার অসহায়ত্ব, সৎমায়ের অত্যাচার, দুঃখের কাহিনি শুনে আমার প্রেমে পড়বে। আমরা তোমার সম্বন্ধে সব খুটিনাটি ইনফরমেশন আগেই কালেক্ট করে রেখেছিলাম। দীর্ঘ ছয়মাস তোমাকে আর তোহাকে ভালোভাবে অবজার্ভ করেছে আমাদের টিম। তুমি ঠিক কেমন ধাচের মানুষ, কি কি বিষয় তোমাকে আকর্ষিত করতে পারে_তোমার মধ্যে মায়া জিনিসটা খুব বেশি। এটা তোমার দূর্বলতাও বলা যায়। তাই প্রথমেই আমার জন্য তোমার মনে মায়া সৃষ্টি করেছি। আর তোহা সম্পর্কে আমাদের ধারণা ভুল ছিল। তোহার ডিবেট কম্পিটিশনের স্পিচ ভিডিও দেখে আমরা ভেবেছিলাম ও খুব সাহসী মেয়ে। তাই আমীর ওর সামনে সেরকম ভাবেই প্রেজেন্ট হয়েছিল। প্রথম দেখাতেই আমীর তোহার সাথে অসদাচরণ করে এমন এক ব্যক্তির কান কেটে দেয়। আমীর ভেবেছিল এইভাবে তোহার মনোযোগ আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু ঘটনা বিপরীত রূপ নেয়। তোহা আরও ভয় পেয়ে যায়। পরদিন তোহাদের কলেজে আমীর নিজেই এসেছিল প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন সিরিমনিতে। মূলত তোহার জন্যই এসেছিল। কিন্তু তোহা ওকে দেখে মাত্রাতিরিক্ত ভয় পায়। ভয়ে অজ্ঞানই হয়ে যায়। আমীর তখন বুঝে নেয় এভাবে ওকে কাবু করা সম্ভব না। তাই আমরা আমাদের প্ল্যান চেঞ্জ করি। যেদিন শপিংমলে তোহা কিডন্যাপ হওয়ার পর থেকেই কিন্তু আমি তোমাকে আমার অলৌকিক ঘটনাগুলো দেখানো শুরু করেছিলাম। এর আগে কিন্তু আমি সাধারণ ছিলাম। কারণ তখন আমাদের পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। তোহাকে কিডন্যাপ করার পর পরিকল্পনা অন্যরকম হয়ে যায়। আমি মিথ্যে গল্প বানাই যে আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আমীর আমার উপর এক্সপেরিমেন্ট করেছে, ওর ভয়ে আমি পালিয়ে এসেছি, আর মুনের পা ভেঙে দেওয়া, এটাও মিথ্যে ছিল৷ এই মিথ্যেটা আমি বলতাম না। কিন্তু ওইদিন মুন আমীরকে দেখে খুব ভয় পেয়েছিল। মুন আসলে এখানকার সবাইকেই ভয় পায়। আমাকেও এই গেটাপে দেখলে ভয় পায়। তাই আসল সত্যি ধামাচাপা দিতে আমি মিথ্যেটা বলেছিলাম। আর আমি যেকোনো কিছু করার আগে আমীরের সাথে আলোচনা করে নিতাম। তাই আমীর সব জানতো। যখন আমি তোমাকে বানানো গল্পটা বলতাম, তখন তোমার কাছে ভালো থাকার জন্য নিজেকে ইনোসেন্ট সাজাতাম। আর আমীর যখন তোহার কাছে মিথ্যে গল্প বলতো, তখন নিজেকে ইনোসেন্ট সাজাতো। এজন্য হয়তো আমাদের স্টেটমেন্ট মিলতো না। আর তোহাকে ঔষধ খাওয়ানো, পায়েল পড়ানো, এসব আমীর করতো যেন স্বাচ্ছন্দ্যে রাতের বেলা আমরা নিজেদের প্ল্যান নিয়ে আলোচনা করতে পারি। প্রতিদিন রাতে আমরা এজন্যই দেখা করতাম। কিন্তু শিউলি আসার পর আমাদের অসুবিধা হয়ে যায়। ও রাতে ঘুমাতো না। তাই শিউলিকে বাসা থেকে বের করার জন্য তোহাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তোহা রাজি হয়না। তারপর শিউলিকে দিয়ে আমীরের নামে মিথ্যে বলিয়েছিলাম আমি। আমীর আমাকে এটা করতে নিষেধ করেছিল। তাও আমি করেছি। তাই সে আমার উপর রেগে গিয়েছিল। এরপর যখন নিবরাস ভাইয়া মারা গেলেন আর নীলাভ্রর সাথে আমার বিয়ে ভেঙে যাচ্ছিল তখন আমীর খুশি হয় কারণ ওর সাথে আমি যা করেছি সেই শাস্তি প্রকৃতিগত ভাবে পাচ্ছি। আসলে তখনি আমরা আবিষ্কার করি,আমরা নিজেরাই তোমাদের প্রেমে পড়ে গেছিলাম৷ তাই নিজেরাই নিজেদের শত্রু হয়ে যাচ্ছিলাম। তোমরা আবার ভেবো না আমার আর আমীরের মধ্যে প্রেমের কোনো সম্পর্ক ছিল। আসলে এমন সম্পর্ক কখনও ছিল না। আমরা একই সংস্থার সদস্য। একই জায়গায় কাজ করি, এটাই আমাদের পরিচয়। আমরা বন্ধুর মতো। আর একদিন রাতে তোহার কাছে আমরা ধরা পড়ে গেছিলাম। তোহা যে তোমাকেও ডেকে আনলো। আমি আর আমীর একে-অপরকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। মনে আছে সেই রাতের কথা? আমার গায়ে সাদা চাদর ছিল। আসলে তখন আমরা ধরা পড়িনি। আমরা এতো সহজে ধরা পড়িনা। এটাও আমাদের একটা বিশেষ এক্সপেরিমেন্ট ছিল। আমরা আসলে পরীক্ষা করছিলাম তোমরা আমাদের প্রতি কতটুকু দূর্বল হয়েছো।”
তোহা মুখে হাত দিয়ে গুমরে কেঁদে উঠলো। নীলাভ্রর চোখ দিয়ে টপাটপ পানি পড়ছে। কিন্তু সে নিশ্চুপ। এতোবড় ধোকা! রিম্মি ভাঙা কণ্ঠে বললো,
” তোমরা আসলে খুব ভালো মানুষ। সহজেই মানুষকে পাগলের মতো ভালোবাসার ক্ষমতা তোমাদের আছে। আমাদেরকে তোমরা পাগলের মতোই ভালোবাসা দিয়েছো। বিনিময়ে আমরা শুধু ধোকা দিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমরা অপারগ ছিলাম। এসবকিছু ছিল আমাদের সংস্থার আদেশ। আমরা সংস্থার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম, পৃথিবীর যত কঠিন কাজই হোক জীবন বাজি রেখে করবো।”
চলবে
( বাকি উত্তরগুলো কালকের পর্বে পাবেন। এই গল্পের কনসেপ্ট যখন আমার মাথায় আসছিল, আমার মনে হয়েছিল খুব নরমাল একটা কাহিনি। পরে মনে হয়, এটাকে যদি ধৈর্য্য ধরে সাজানো যায় তাহলে ভালো কিছু হতে পারে। আর তিরান খুবই স্পেশাল একটা চরিত্র। এই চরিত্র দিয়ে আপনাদের হার্ট অ্যাটাক করানোর চ্যালেঞ্জ নিয়েছি।🥰)