#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৫১
লিখা: Sidratul Muntaz
নীলাভ্র বদ্ধ রুমটায় ক্রমাগত পায়চারী করছে। এক মুহুর্তের জন্যেও স্থির হয়ে বসতে পারছে না। তোহার জন্য ওর দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আচ্ছা, তাদের মতো সাধারণ দুইজন মানুষকে নিয়ে এতো বড় একটা প্রতিষ্ঠানের কি এমন পরিকল্পনা থাকতে পারে? কেনো এতোদিন ধরে ওদের সাথে এমন জঘন্য প্রতারণা করা হলো? আর এখনি বা কেনো ওদের বন্দী রাখা হয়েছে? একটু আগে রোবট পাঠিয়ে আমীর তোহাকে ওইভাবে উঠিয়ে নিয়ে গেল কেনো? ওরা এখন তোহার সাথে কি করবে? ওরা আসলে কি চাইছে? এতো টেনশনে নীলাভ্রর মাথার সব কয়টি শিরায় টনটনে ব্যথা শুরু হয়। মাথায় অদ্ভুত যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়। দুইহাতে মাথা খামচে চেয়ারে বসলো নীলাভ্র৷ এক পা দিয়ে সামনের একটা চেয়ার জোরে লাথি মারলো। তাও শান্তি লাগছে না। কিছুতেই লাগছে না। দরজাটা হঠাৎ খুলে যায়। খুব বিছরি দেখতে স্টিলের কঙ্কালের মতো একটা রোবট বড় কাচের পাত্রে খাদ্য-পানীয় নিয়ে ভিতরে ঢুকছে। রোবটটার দুইহাতে দুইজনের খাবার। মানে তোহার জন্যও খাবার আনা হয়েছে। অর্থাৎ যে বা যারা খাবার পাঠিয়েছে তারা জানেই না তোহা যে এখানে নেই। আমীর তাহলে তোহাকে কার আদেশে নিয়ে গেল?কোথায় নিয়ে গেল? রুমের এক কোণায় সাদা রঙের একটা টেবিলে রোবট খাবারগুলো সাজিয়ে রাখছে। সে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে সব কাজ করছে। মনে হয় অন্ধ। নীলাভ্রর মাথায় বুদ্ধি এলো সুযোগের সদ্ব্যবহার করে এই রুম থেকে পালানোর। দ্রুত উপায় খুঁজতে থাকে কিভাবে সেটা করা যায়। রোবটটাকে দেখতে ভয় লাগছে। নীলাভ্র ডাকার চেষ্টা করলো,
” হ্যালো, শুনছেন?”
রোবট ওর দিকে তাকায়ও না। কিছু বলেও না। নীলাভ্র ধীরে ধীরে দরজার কাছে গেল। কিন্তু ওর দৃষ্টি রোবটের দিকে নিক্ষিপ্ত ছিল। নীলাভ্র যখন রুমের সীমারেখা পেরিয়ে বাহিরে যেতে নিবে তখনি রোবট এক আঙুল বন্দুকের মতো উঠিয়ে নীলাভ্রর বাম পায়ে তাক করলো। বজ্রপাতের মতো লাইট বেরিয়ে এলো। নীলাভ্র ছিটকে পড়লো ফ্লোরে। বামপাটা ঝা ঝা করে উঠে। কয়েক মুহুর্তের জন্য মনে হয় পা অবশ হয়ে গেছে। চোখে তীব্র ক্রোধ ফুটিয়ে রোবটটির দিকে ঘুরে তাকায় নীলাভ্র। রোবটটা এখনো সেই দেয়ালেই তাকিয়ে আছে। নীলাভ্রর মেজাজ তুঙ্গে উঠে যায়। এই বেটাকে শিক্ষা দিতে না পারলে আজ ওর শান্তি নেই। কিন্তু এগুলোকে আঘাত করতে গেলে নিজের হাতেই ব্যথা লাগে অথচ ওদের কিছু হয়না। তাই খুব শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করতে হবে। কি দিয়ে আঘাত করা যায় এটা ভাবতে ভাবতে চট করে উঠে দাঁড়ায় নীলাভ্র। এদিক-ওদিক তাকিয়ে রুমের দরজার পেছনে একটা পাশ ব্রুম খুঁজে পেল। এগুলো সাধারণত প্লাস্টিকের হয়। মানুষের বাসা-বাড়িতে থাকে। কিন্তু এই পাশ ব্রুমটা স্টিলের। স্টিলের রোবটকে স্টিলের জিনিস দিয়ে আঘাত করা নিশ্চয়ই বোকামি হবে না! নীলাভ্র পাশ ব্রুমটা নিয়ে পেছনে লুকিয়ে রাখলো। রোবটটা যখন দরজা দিয়ে বের হতে যায় তখন নীলাভ্র তীব্র বেগে ব্রুমটা দিয়ে রোবটের মাথায় প্রচন্ড আক্রোশে আঘাত করে।’ টং’ টাইপ দীর্ঘ শব্দ হলো। রোবটটা ঝনঝন করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। নীলাভ্র পাশ ব্রুম হাত থেকে ফেলে দেয়। রোবটকে পাশ কাটিয়ে দরজার কাছে চলে যায়। কিন্তু দরজার বাহিরে পা রাখতেই ওই আহত রোবট মাথা উঠিয়ে আঙুল তাক করে নীলাভ্রর পায়ে আবার আক্রমণ করলো। কিন্তু এইবার লাইটের পাওয়ার খুবই নগন্য ছিল। তাই নীলাভ্র তেমন ঘায়েল হয়নি। গাঢ় ব্যথা পায় ঠিক, কিন্তু ওই অবস্থাতেও খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে যেতে পারে।
নীলাভ্র বামপায়ে হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে দাঁড়ায়। আশেপাশে অনেকগুলো পায়ের পায়চারী শোনা যাচ্ছে। নীলাভ্র দেয়ালের পেছনে লুকিয়ে পড়লো। অনেক রোবট একসাথে আসা-যাওয়া করছে। মেইনগেইটের সামনে প্রকান্ড মাপের একটা গাড়ি৷ সেই গাড়ি থেকে মালপত্র আনা-নেওয়ার কাজ চলছে। রোবটরা অনেক বড় বড় কার্টুন, ব্যাগ নিয়ে একটা খালি রুমে রাখছে। ওইসব ব্যাগে বেশিরভাগ খাবারের জিনিস। বড় বড় বোতল, প্যাকেটজাত কেক, চকলেট, চিপস আর অদ্ভুত ধরণের পোশাক। এগুলো কেনো আনা হচ্ছে নীলাভ্র জানেনা। তার মনে হয়, সে চাইলেই এখন সবার চোখে ধুলো দিয়ে মেইনগেইটের বাহিরে চলে যেতে পারে। কিন্তু তোহা? আগে তোহাকে খুঁজতে হবে। অথচ নীলাভ্র জায়গা থেকে নড়তেও পারছে না। ডানে-বামে,সামনে-পেছনে যেখানেই যাবে ধরা খাবে। এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকাও আর সম্ভব না। নীলাভ্রর এতোক্ষণে ধারণা হয়ে গেছে যে সবগুলো রোবট অন্ধ। ওদের সামনে দিয়ে গেলে ওরা দেখবে না। কিন্তু কোনো একটা সিগন্যাল পেলেই বুঝে ফেলবে কেউ আছে। তাই নীলাভ্র নিঃশ্বাস বন্ধ করে পা টিপিয়ে টিপিয়ে হাঁটতে লাগলো। টু শব্দটাও করলোনা। আরেকটু দূরে গিয়েই ওকে থামতে হয়। রিম্মির কণ্ঠ ভেসে আসছে। একটা বিদেশী ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে রিম্মি কি যেন আলাপ করছে। ছেলেটাও রিম্মির মতো কালো জ্যাকেট পড়া। ওদের কথাবার্তার ধরণ দেখে মনে হয় খুব জরুরী বিষয়ে আলাপ চলছে। নীলাভ্র নিজেকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে রইল। কান খাড়া করে শুনলো রিম্মি বলছে,
” আমীর অনেক বড় সর্বনাশের পথে হাঁটছে। আমার ওর জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে রিড। ওকে কি কোনোভাবে আটকানো যায় না? তুমি অন্তত পারো ওকে বুঝাতে। কেনো বুঝাচ্ছো না?”
” আমীর কার কথা কবে শুনেছে? নিজের মর্জি ছাড়া ও চোখের পলকও ফেলে না। আর এতোবড় সিদ্ধান্ত বদলে ফেলবে? আমার তো মনে হয় না। তাছাড়া তোমার এতো চিন্তা থাকলে যাও ওর সাথে! সেটা তো করবে না। শুধু পারবে বিশ্বাসঘাতকতা করতে।”
রিম্মি চুপ করে রইল। কিছু একটু ভেবে হঠাৎ শক্তগলায় বলে উঠলো,
” আমি ওর সাথে যেতে চাই। তুমি প্রফেসরের সাথে কথা বলো। সব ব্যবস্থা করে দাও। আমি রাজি।”
” আর ইউ সিউর?”
” হ্যা, সিউর।”
” তাহলে তোহা, নীলাভ্র ওদেরকে কি করবো আমরা? ওরা কিন্তু অনেক কিছুই জেনে গেছে।”
” প্রফেসর ট্রুডোর নির্দেশ, ওদের এখান থেকে বের করার আগে মেমোরি ক্লিন করে দিতে হবে। ওদের কিছু মনে থাকবে না, কাউকে কিছু জানাতেও পারবে না।”
কথাটা বলার সময় রিম্মির কণ্ঠ কেমন যেন হয়ে যায়। রিড বললো,
” এটাই ভালো বুদ্ধি। কিন্তু এতোবড় সেক্রিফাইস তুমি সংস্থার জন্য করতে পারবে? বিশ্বাস হচ্ছে না।”
রিডের গলায় উপহাস। রিম্মি আহত কণ্ঠে বললো,
” আমাকে তোমার কি মনে হয়?”
ওদের কথোপকথন এ জায়গাতেই থামে। কোথ থেকে একটা রোবট এসে রিম্মির সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন বলতে শুরু করলো। নীলাভ্র খেয়াল করে একটু আগে যে রোবটটাকে আঘাত করে সে পালিয়ে এসেছিল এটাই সেই রোবট। এখন রিম্মির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও প্রায় সব রোবট দেখতে একইরকম। কিন্তু নীলাভ্র এই রোবটটিকে যখন আঘাত করেছিল তখন ওর মাথা থেকে ছেড়া তার বেরিয়ে আসে। সেই তারগুলো থেকে অবাঞ্চিত আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল। এখনো হচ্ছে। রোবটটা মেশিনের মতো আওয়াজ করে বললো,,
” রুম নং. 344, আ ম্যান হিট মি এন্ড রান এওয়্যে।”
এই একটি বাক্যই রোবট বারবার উচ্চারণ করতে থাকে। রিম্মি চোখ বড় করে বললো,
” নীলাভ্র!”
রিড বললো,” পালিয়ে গেছে নাকি? সর্বনাশ!”
রিম্মি বললো,” আমি এখনি দেখে আসছি।”
রিম্মি ছুটে গেল তিনশো চুয়াল্লিশ নম্বর রুমে। নীলাভ্র-তোহা কোথাও নেই। রিম্মির হাত-পা কাঁপতে শুরু করে। ওরা চাইলেও কোথাও পালাতে পারবে না এটা সে জানে। কিন্তু কোনো রোবট ফোর্সের সামনে পড়লেই মৃত্যু অবধারিত। ওদেরকে সেইফ রাখার জন্যই রিম্মি রুমে আটকে রেখেছিল। তোহা-নীলাভ্র সারাদিন কিছু খায়নি তাই রোবটের মাধ্যমে রিম্মিই ওদের জন্য খাবার পাঠিয়েছিল। কিন্তু ওর মাথায় একবারও এটা আসেনি যে ওরা পালানোর চেষ্টা করতে পারে। এবার কি হবে? ওরা কোথায় গেল? রিম্মি বিচলিত হয়ে কপালে একহাত ঠেকায়, অন্যহাত কোমড়ে রাখে। নীলাভ্র-তোহাকে কিভাবে খুঁজবে সেই চিন্তায় ওর মন অস্থির। তখনি নীলাভ্র রিম্মির পেছনে এসে দাঁড়ালো আর কাটছাট গলায় বললো,
” আমাদের প্রয়োজন কি তাহলে শেষ? এবার মেমোরি ক্লিন করে দিবে? তোমাদের সব স্মৃতি ভুলে যাবো? নামটাও কি ভুলে যাবো?”
রিম্মি চকিতে পেছনে তাকালো। নীলাভ্রকে দেখে ওর মুখ দিয়ে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসলো। পুলকিত হয়ে বললো,
” নীল, আর ইউ ওকে? পায়ে ব্যথা কিভাবে পেয়েছো? আর তোহা কোথায়?”
” শাট আপ। আমার পা নিয়ে তোমার চিন্তা করার দরকার নেই। আচ্ছা রিম্মি, কি এমন মহান উদ্দেশ্য ছিল যে আমাদের সাথে এতো প্রতারণা করলে? আমাদের এভাবে কেনো ব্যবহার করলে? প্লিজ বলে দাও। জানি মেমোরি যখন ক্লিন করে দিবে তখন সব ভুলে যাবো। তাও জানতে খুব ইচ্ছে করছে। অন্তত বলো। কিছুসময়ের জন্য হলেও জানতে চাই।”
রিম্মি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হতাশমুখে মৃদু হাসলো,” তুমি সহ্য করতে পারবে না।”
” এতোকিছু যখন সহ্য করতে পেরেছি, এটুকুও পারবো। বলো।”
” ঠিকাছে, তাহলে আমার সাথে এসো।”
রিম্মি নীলাভ্রর হাত ধরে কোথায় যেন নিয়ে যেতে লাগলো। নীলাভ্র খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে।
চলবে