#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৫২
লিখা: Sidratul Muntaz
খুব অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা ঘরের ঠিক মাঝ বরাবর নীলাভ্রকে এনে দাঁড় করালো রিম্মি। এই ঘরে আসার আগে নীলাভ্রর চোখে কালো পট্টি বেধে দেওয়া হয়েছিল। বিরক্তিতে নীলাভ্রর কপাল কুচকে আছে। আর কিছুক্ষণ বাদেই তার মেমোরি ক্লিন করা হবে। তবুও কেনো এতো লুকোচুরি তার সাথে? এই সিকরেটরুমে আসার রাস্তা যদি নীলাভ্র জেনেও যায় তাহলে ক্ষতি কি? একটু পরেই তো তার আর কিছু মনে থাকবে না। তবুও কেনো তার চোখ বেধে রাখা হচ্ছে? এখন রিম্মি নীলাভ্রর সামনে খুব গোপনীয় একটা তথ্য ফাঁস করতে চলেছে। এই তথ্য নীলাভ্র কেবল কয়েক ঘণ্টার জন্য জানবে। তারপর সব ভুলে যাবে। কি অদ্ভুত! রিম্মি নীলাভ্রকে একটা চেয়ারে বসিয়ে হাত-পা বেধে দিচ্ছে। নীলাভ্র নড়াচড়া শুরু করলো। বললো,
” এসব কি করছো রিম্মি? আমাকে বেঁধে রাখা হচ্ছে কেনো?”
রিম্মির ফিসফিস কণ্ঠ শোনা যায়,”একটু শান্ত হয়ে বসো। এখনি বলছি।”
নীলাভ্র ধৈর্য্য ধরে চুপ থাকলো। একটু পরেই ওর চোখের পট্টি খুলে দেয় রিম্মি। চারদিকে অন্ধকার দেখতে পেল নীলাভ্র। রিম্মিকেও দেখা যাচ্ছে না। নীলাভ্রর মনে কিঞ্চিৎ ভীতি জন্মায়। শুকনো কণ্ঠে ডাকতে চাইলো রিম্মিকে। এর আগেই ওর সামনে বিশাল প্রজেক্টরে একটা থ্রিডি ভিডিও চালু হয়। ভিডিওটি দেখে কয়েক মুহুর্তের জন্য নীলাভ্রর মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে। ভিডিওর গতি কেমন যেনো, বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সুস্থ মানুষ অনায়াসে হিপনোটাইজ হয়ে যেতে পারে। মনে হচ্ছে কালো পর্দায় অজস্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বল একটা নিয়মিত গতিতে ছুটোছুটি করছে। নীলাভ্রর মাথাব্যথা শুরু হয়। সে দ্রুত চোখ বন্ধ করে নিল। অস্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
” এগুলো কি?”
রিম্মি ভিডিও বন্ধ করে লাইট জ্বালায়। তারপর একটা চেয়ার এনে নীলাভ্রর সামনে বসে। নীলাভ্র তার দৃষ্টিতে একঝাঁক কৌতুহল নিয়ে তাকালো। রিম্মি বললো,
” তোমাকে চেয়ারের সাথে কেনো আটকানো হয়েছে জানো? কারণ এই ভিডিওটা যদি তুমি স্বাভাবিক অবস্থায় দেখতে তাহলে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।”
” কিসের ভিডিও ছিল এটা?”
” তেমন কিছু না, এটা আমাদের অতি পরিচিত গ্যালাক্সি। ছায়াপথ গ্যালাক্সি।”
” গ্যালাক্সি? গ্যালাক্সিতে সবকিছু এতো দ্রুত কেনো ঘুরছে?”
” গ্যালাক্সি তার গ্যালাকটিক সেন্টারকে কেন্দ্র করে এরচেয়েও দ্রুত আবর্তন করে।”
” কিন্তু এগুলো আমাকে কেনো দেখানো হচ্ছে?”
” বলছি, ধৈর্য্য ধরে শোনো, ২০১১ সালের শেষদিকে আমাদের আমেরিকান জ্যাতির্বিজ্ঞানী স্যার বেঞ্জামিন ফ্লোরস উনার তৈরী বিশেষ টেলিস্কোপের সাহায্যে আমাদের এই পৃথিবীর অনুরূপ একটা গ্রহ আবিষ্কার করেছেন। নীলাভ্র তুমি কি জানো, এই ছায়াপথে অসংখ্য সৌরজগৎ আছে। পৃথিবীর মতো অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্র যেমন সূর্যকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত ঘুরছে তেমন প্রত্যেকটা সৌরজগৎ তাদের আপন গ্যালাক্সির ওই গ্যালাকটিক সেন্টারকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। ছায়াপথে আমাদের সৌরজগৎ এর মতো অগণিত সৌরজগৎ বিদ্যমান। তার মধ্যে একটা গ্রহে প্রাণের সন্ধান পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, ওই গ্রহটি হুবুহু আমাদের পৃথিবীর মতো। কিন্তু আমাদের পৃথিবী থেকে হাজার হাজার বছর পুরনো। কারণ সেখানে মানুষের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ডাইনোসরের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ওই গ্রহটিই আমাদের পৃথিবী। শুধু পার্থক্য সময়ের। এইখানে যেমন সৃষ্টিকুলের ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে মানুষের আবির্ভাব হয়েছে তেমন ওই পৃথিবীতে এখনো মানুষের আবির্ভাব হয়নি, ডাইনোসরদের রাজত্ব চলছে। এমনকি ওই গ্রহের বয়সটাও আমাদের পৃথিবী থেকে অনেকগুণ কম।”
নীলাভ্র ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে৷ মনোযোগ দিয়ে শুনছে বলে মনে হলোনা। কারণ সে একটুও অবাক হচ্ছে না৷ রিম্মি চেয়ারের হাতলে আঘাত করে উত্তেজিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
” নীলাভ্র তুমি কি ভাবতে পারছো এটা কতবড় আবিষ্কার? ”
নীলাভ্র অল্প চমকে উঠলো। বোকার মতো প্রশ্ন করলো,
” কতবড়?”
রিম্মি হতাশ। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। অতঃপর নিজেকে সামলে একহাত কপালে ঠেকিয়ে রিল্যাক্স মোডে বসলো। আস্তে-ধীরে বলতে লাগলো,
” এটা আমাদের বিজ্ঞানপ্রেমীদের জন্য একটা বিরাট সুখবর। এই এতোবড় সুখবর পাওয়ার পরেও আমরা এই আবিষ্কার গোপন রেখেছি। কোথাও প্রকাশ করিনি। কারণ কি জানো? আমাদের পরিকল্পনা এর চেয়েও অনেক বিপুল। যে গ্রহটির সন্ধান আমরা পেয়েছি সেটা আমাদের সৌরজগৎ এর বাহিরে। কিন্তু গ্যালাক্সির অভ্যন্তরে। আমরা ধারণা করছি, পৃথিবীর মতো এমন অনুরূপ গ্রহ আরও অসংখ্য আছে। ঠিক যতগুলো সৌরজগৎ ততগুলোই পৃথিবীর অনুরূপ গ্রহ। আর এই সবকয়টি গ্রহের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে সময়ের। এই যেমন ডাইনোসরের গ্রহটার কথাই চিন্তা করো, যদি আমরা ওই গ্রহে পৌছাতে পারি তাহলে হাজার হাজার বছর পুরনো জুরাসিক আমলে পৌছে যাবো।আর যদি আমরা এমন কোনো গ্রহের সন্ধান পাই, যেটা মিনিমাম দশ-বারো বছর পুরনো মানে পৃথিবীর বর্তমান সময় থেকে দশ-বারো বছর পিছিয়ে তাহলে আমরা আমাদের মৃত মা-বাবাকেও ফিরে পেতে পারি। আমাদের শৈশব সত্তার সাথে দেখা করতে পারি। আর যদি পৃথিবী থেকে দশ-বারো বছর এগিয়ে আছে এমন গ্রহের সন্ধান পাই তাহলে আমাদের ভবিষ্যত সত্তার সাথেও আমরা দেখা করতে সক্ষম হবো। এবার কি তুমি বুঝতে পেরেছো এটা কতবড় আবিষ্কার? ”
নীলাভ্র দ্বিধান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,” এতে লাভ কি?”
রিম্মি হতবাক হয়ে বললো,” গাধারাম নাকি তুমি? আচ্ছা ওয়েট, আমি আরও একটু এক্সপ্লেইন করছি। মনে করো, আমার মা তো মৃত। এখন আমি যদি সেই গ্রহটার সন্ধান পাই, যখন মা জীবিত ছিলেন আর আমার বয়স সাতবছর ছিল। তাহলে আমি সেই গ্রহে গিয়ে আমার মায়ের মৃত্যু আটকে দিতে পারি। ভবিষ্যৎ বদলে যাবে, আমার জীবনটাও বদলে যাবে। হয়তো তখন তোমার সাথে আমার পরিচয়টাই আর হবে না। কারণ মা বেঁচে থাকলে আমার ভবিষ্যৎটাই পাল্টে যেতো।”
নীলাভ্রর চোখেমুখে এবার বিস্ময়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। মনে হয় সে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। রিম্মি একমুঠো আশা নিয়ে তাকিয়ে রইল নীলাভ্রর দিকে। নীলাভ্র বললো,
” কিন্তু এটা কি আদৌ সম্ভব? তোমরা নির্দিষ্ট সময় কিভাবে বুঝবে? লক্ষ-কোটি গ্রহের মাঝে দশ-বারো বছর পুরনো গ্রহটি খুঁজে বের করা কি সম্ভব? তাছাড়া সৌরজগৎ এর বাহিরে যেতে পারে এমন গতির রকেট কি এ পৃথিবীতে আছে? তোমরা তো মাত্র একটা গ্রহের সন্ধান পেয়েছো। এমন গ্রহ সত্যিই আরও আছে কি-না তার নিশ্চয়তা কোথায়?”
রিম্মি বুদ্ধিমতীর মতো হাসি দিয়ে বললো,
” লক্ষ-কোটি গ্রহের মাঝে দশ-বারো বছর পুরনো গ্রহটি খুঁজে বের করা আমার জন্য কোনো ব্যাপার না। কারণ আমার মস্তিষ্ক সাধারণ মানুষের মতো না৷ আমার মস্তিষ্কের মাত্রা চার। অর্থাৎ আমি দৈর্ঘ্য, প্রস্থ,উচ্চতার পাশাপাশি চোখের আন্দাজে সময়ের পরিমাপটাও বের করতে পারি। শুধু এই রিসার্চের জন্যই আমার ব্রেইন ট্রান্সপ্লান্ট এক্সপেরিমেন্টটা করা হয়েছে। এবার বুঝতে পেরেছো? আর ঠিক তোমার মতো এই প্রশ্নগুলো সবার মাথাতেই এসেছিল যখন আমরা প্রথম এই থিউরি সম্পর্কে জানতে পারি। আমাদের রিসার্চ সেন্টার এমন গতির রকেটও তৈরী করে ফেলেছে। যে রকেটের মাধ্যমে আমরা শুধু সৌরজগৎ না গ্যালাক্সি পেরিয়েও অন্য গ্যালাক্সিতে চলে যেতে পারবো। কিন্তু সেটা খুব রিস্কি। ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এমনো হতে পারে, আমরা অনন্তকাল ধরে মহাশুন্যে ভেসে বেড়াবো। কোনোদিন আর ফিরে আসার পথ খুঁজে পাবো না। আমাদের মৃত্যু হলে আমাদের দেহটা পর্যন্ত আজীবন মহাশুন্যে ভাসতে থাকবে। আবার এটাও হতে পারে আমরা কাঙ্ক্ষিত গ্রহটি খুঁজে বের করতে সক্ষম হলাম, পুনরায় নিজগ্রহে ফিরে আসতে পারলাম। কিন্তু এতে কোটিবছরেরও বেশি সময় লেগে যাবে। তখন হয়তো পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার সময় চলে আসবে। তাই আমরা যদি ফিরেও আসি, এই পৃথিবীতে আসবো না। এমন কোনো গ্রহে যাবো যেখানে বর্তমান সময় চলছে। অর্থাৎ লক্ষ-কোটি বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও আমাদের বয়স, সময়, পরিস্থিতি, সব সেইম থাকবে। শুধু গ্রহ পরিবর্তন হবে।যদি সঠিক সময়ের গ্রহটি খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে এটা সম্ভব। কিন্তু সেই সম্ভাবনাও অত্যন্ত ক্ষীণ। আমাদের ফিরে না আসার পসিবলিটিই বেশি। নীলাভ্র তুমি কি বুঝতে পেরেছো?”
” কিছুটা।”
” এইটা আমাদের সংস্থার ড্রিম প্রজেক্ট। যদি সফল হতে পারি তাহলে পৃথিবীতে আমূল পরিবর্তন
আসতে চলেছে। অতীত, ভবিষ্যৎ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু যদি আমরা বিফল হই তাহলে সংস্থার শুধু একটাই ক্ষতি। বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা খরচ করে তৈরী মহাকাশযানটি ওরা হারাবে। কিন্তু আমাদের ক্ষতি এর চেয়েও ভয়ানক। আমরা আমাদের জীবন হারাবো। অথবা এর চেয়েও খারাপ কিছু হতে পারে আমাদের সাথে। হয়তো আমরা বেঁচেই থাকবো, অনন্তকাল ধরে মহাশুন্যে ভেসে বেড়াবো। আমাদের সন্ধান কেউ কখনো পাবে না। কিংবা আমরা ব্ল্যাকহোলে হারিয়ে যেতে পারি। অথবা অন্যকোনো গ্রহে পৌঁছে যেতে পারি। যেখানে ভয়ংকর এলিয়েনদের বসবাস। ওরা আমাদের খাদ্য মনে করে গ্রহণ করতে পারে। আবর্জনা মনে করে ছুড়ে ফেলতে পারে। অথবা আমাদের উলঙ্গ করে ওদের চিড়িয়াখানায় বন্দী রাখতে পারে। কারণ আমরা তখন ওদের কাছে হবো অদ্ভুত প্রাণী।”
রিম্মি খিলখিল করে হেসে উঠলো। নীলাভ্রর শরীর ত্রাসে কাটা দিয়ে উঠলো৷ হাত-পা শিরশির করছে। রিম্মি এগুলো কি শোনাচ্ছে ওকে? রিম্মি বললো,
” এতো এতো অনিশ্চয়তার মধ্যেও যারা সুন্দর পৃথিবী ফেলে মৃত্যুকূপে ঝাঁপ দিতে চায় তাদের কি বলা উচিৎ? ”
নীলাভ্র কিছু না ভেবেই উত্তর দিল,” কঠিন ডিপ্রেশনে আক্রান্ত রোগী বলা যেতে পারে।”
রিম্মি ফিক করে হেসে দিল। ওর চোখে জল চিকচিক করছে। রিম্মি গালে হাত দিয়ে বললো,
” ঠিকই বলেছো। প্রফেসর ট্রুডো যখন প্রথমবার আমাদের নিয়ে এ বিষয়ে আলোচনা করেন তিনিও এটাই ভেবেছিলেন। দীর্ঘ সাড়ে তিনঘণ্টার মিটিং শেষে উনি জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কয়জন সাহসী ব্যক্তি আছে যারা এই বিশাল প্রজেক্টে অবদান রাখতে ইচ্ছুক? তখন আমরা সাতজন হাত তুলেছিলাম। সবার আগে হাত তুলেছিল আমীর। প্রফেসর বলার সঙ্গে সঙ্গেই ও হাত তুলে ফেলে। যেনো ও এই প্রশ্নের অপেক্ষাতেই বসেছিল। সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল ওর মধ্যে। আমীরের দেখাদেখি আমিও হাত তুললাম। একজন মেয়েকে হাত তুলতে দেখে বাকি ছেলেরা লজ্জা পেল। তাই তারাও হাত তুললো। প্রফেসর ট্রুডোসহ অন্যান্য স্যাররা আমাদের দেখে খুব জোরে হেসে দিলেন৷ তারপর তারা জানালেন, আমাদের নিয়ে তারা একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে চায়। মানে ফাইনাল এক্সপেরিমেন্ট শুরু করার আগে সেমি ফাইনাল এক্সপেরিমেন্ট। আমরা যে কয়জন হাত তুলেছিলাম প্রায় সবাই দৃঢ় সংকল্প করেছিলাম, পরিণতি যত ভয়ংকরই হোক আমরা মহাকাশ ভ্রমণে যাবোই। আর আমার ব্রেইন ট্রান্সপ্লান্টের এক্সপেরিমেন্টটাও এজন্যই হয়েছিল। একমাত্র আমিই পারি সঠিক সময়ের হিসাব করে সঠিক গ্রহ খুঁজে বের করতে। এতে আমাদের কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যাবে। পৃথিবীতে ফিরে আসার সম্ভাবনাও বাড়বে। কিন্তু আমাদের কারোই এ পৃথিবীতে কোনো পিছুটান নেই। আমীর ছোটবেলা থেকেই অনাথ। সানাফ আঙ্কেল মারা গিয়েছিলেন আমীরের যখন বারোবছর। উনি খুব বিস্ময়কর একটা আবিষ্কার অসম্পূর্ণ রেখে মারা যান। যদি ওই আবিষ্কার আমরা পেতাম তাহলে চিকিৎসাবিজ্ঞানে একটা বড় পরিবর্তন আসতে পারতো। সানাফ আঙ্কেলের মৃত্যুর কিছুদিন পর আন্টিও মারা গেলেন খুব অদ্ভুত একটা রোগে। সেই রোগের নিরাময় আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। আর আমার ঘটনা তো জানোই। আমার মা-বাবা কেউই নেই। যারা আছে তারা সৎমা আর সৎ বোন। ওদের জন্য আমার তেমন একটা মায়া নেই বললেই চলে। এছাড়াও রিড,হিরোশ,হাসাদ,ইউজান,সানভী প্রত্যেকেই পিছুটানহীন। ওদের এ পৃথিবীতে কোনো আপনজন নেই। প্রফেসর ট্রুডোর ধারণা আমাদের পৃথিবীর প্রতি মায়া নেই বলেই আমরা এইরকম একটা প্রজেক্টে নিজেদের জীবন বাজি রাখতে যাচ্ছি। পৃথিবীতে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই জেনেও আমরা মহাকাশ ভ্রমণে যেতে রাজি হয়েছি এর চেয়ে বড় সাহসের পরিচয় আর কি হতে পারে? তবুও সিনিয়র স্যারদের মনের ঠুনকো শংকা, আমরা হয়তো কষ্টময় জীবন থেকে মুক্তি পেতে স্বেচ্ছায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছি। যদি সত্যিই পৃথিবীতে ফিরে আসা সম্ভব না হয় তাহলে আমাদের কিচ্ছু যায় আসে না। আমরা হয়তো পৃথিবীতে ফিরতেই চাইনা। এমনটা আমাদের না, সিনিয়র প্রফেসরদের ধারণা। তবে উনাদের ধারণা সত্যি হতেও পারে, আসলে আমরা কি চাই নিজেরাও হয়তো এখনো বুঝে উঠতে পারিনি।আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য শুধু সংস্থার জন্য জীবন বাজি রেখে কাজ করা। যত কঠিন পরিস্থিতিই আসুক আমরা কখনো পিছপা হবো না। কিন্তু আমরা যদি সত্যিই পৃথিবীতে ফিরে না আসতে পারি তাহলে এই প্রতিষ্ঠানের বিরাট লস হবে। প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত নাসাও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ যে রকেটের মাধ্যমে আমাদের পাঠানো হচ্ছে তার দাম কমপক্ষে এক বিলিয়ন ডলার। তাই আমাদের ফিরে আসা নিশ্চিত করতেই সেমি এক্সপেরিমেন্টটা করা হয়েছিল। আর সেই এক্সপেরিমেন্ট কি জানো? পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মোট সাতজন এক্সেস নোরিপিনাফ্রাইন ব্যক্তি খুঁজে বের করা। ”
নীলাভ্র চেহারায় প্রশ্নের ভাজ ফুটিয়ে বললো,” মানে?”
” মানে যাদের মধ্যে ভালোবাসার প্রবণতা অত্যাধিক। যারা মানুষকে খুব সহজেই গভীরভাবে ভালোবাসতে পারে। তোমার নোরিপিনাফ্রাইনের মাত্রা কত জানো? দশের মধ্যে সাড়ে আট। আর তোহার সাড়ে নয়। তোহারটা সবচেয়ে হায়েস্ট। এরচেয়ে বেশি সাধারণত মানুষের হয়না। তোমরা খুবই রেয়ার। এ পৃথিবীতে প্রতি একলক্ষ জনে মাত্র একজন তোমাদের মতো মানুষ পাওয়া সম্ভব। এজন্যই আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে তোমাদের বিশেষভাবে সিলেক্ট করা হয়েছিল। তোমাকে খুঁজে বের করতে সবচেয়ে কষ্ট হয়েছে। কারণ ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের ইমোশন বেশি। তার মেয়েদের নোরিপিনাফ্রাইনের মাত্রা বেশি হয়। তোমাকে পাওয়ার পরেই আমরা তোহার সন্ধান পেয়েছিলাম। বাংলাদেশ থেকে শুধু তোমাদেরকেই সিলেক্ট করা হয়েছে৷ আর বাকিরা অন্যান্য দেশের। আমাদের সাতজনের জন্য সাতটি ভিন্ন এক্সেস নোরিপিনাফ্রাইনের ব্যক্তি।আর আমরা সংস্থার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম তোমাদের সাথে কমপক্ষে ছয়মাসের প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করবো। যদি এই সময়ের মধ্যে আমরা তোমাদের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ি তাহলে হয়তো আমরা নিজেদের সিদ্ধান্ত বদলে ফেলবো আর যদি তখনো না বদলাই তাহলে আমাদের নাসা থেকে অনুমোদন দেওয়া হবে।কিন্তু যদি আমরা তোমাদের প্রতি দূর্বলই না হই, তাহলে আমাদের বাতিল করা হবে।”
” কেনো বাতিল করা হবে?”
” কারণ তখন আমরা সবচেয়ে শর্টেজ নোরিপিনাফ্রাইনের ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হবো। এইরকম মানুষদের স্বাভাবিক মানুষ বলা যায়না। সহজ ভাষায় নিকৃষ্ট পাষণ্ড বলা যেতে পারে। যাদের দয়া,মায়া কিংবা ভালোবাসার ক্ষমতাই নেই। এ ধরণের মানুষের হাতে যদি এতোবড় প্রজেক্ট দেওয়া হয় তাহলে সেটা অত্যন্ত বিপজ্জনক রূপ নিতে পারে। মহাবিশ্ব ধ্বংস হতে পারে।”
নীলাভ্র ক্ষীণ গলায় বললো,” তার মানে আমাদেরকে শুধু এই কারণে ব্যবহার করা হয়েছে?”
” শুধু তোমাদের না, আরও পাঁচজন আছে। ছেলেদের মধ্যে তুমিই একজন। আর মেয়ে তোহাসহ ছয়জন। প্রথম যেদিন আমীর তোহার বায়োডাটাসহ ছবি দেখেছিল ও পছন্দ করে ফেলেছিল তোহাকে৷ আর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাংলাদেশেই আসবে। আমি আমীরের কাছাকাছি থেকে কাজ করতে চেয়েছিলাম৷ তাই তোমাকে সিলেক্ট করেছি। নাহলে তোমার চেয়েও এক্সেস নোরিপিনাফ্রাইনের ব্যক্তি আরও একজন ছিল। সে ইন্ডিয়ান। আমীর যদি তোহাকে সিলেক্ট না করতো তাহলে আমিও তোমাকে সিলেক্ট করতাম না। তুমি বেঁচে যেতে। এখন এইটা তোমার গুডলাক হতো নাকি বেডলাক হতো তুমিই বলতে পারবে।”
নীলাভ্র চোয়াল শক্ত করে বললো,” অবশ্যই গুডলাক হতো। যদি তুমি আমাকে সিলেক্ট না করে অন্যকাউকে সিলেক্ট করতে সেটা অবশ্যই আমার জন্য গুডলাক হতো।”
রিম্মি আহত মনে কৃত্রিম হাসি দিল। নীলাভ্রর সত্যিই সহ্য হচ্ছে না। এতোবড় পরিকল্পনার মাত্র ক্ষুদ্র একটা অংশ ছিল তারা? এইটুকু কারণে তাদের পুরো জীবন তছনছ করে দিতে হলো? কিছুসময় নিরবতায় কেটে যায়। রিম্মি একধ্যানে কি যেনো ভাবছে। একটু পর নীলাভ্র গলা পরিষ্কার করে বললো,
” আচ্ছা, তখন তুমি কার সাথে যেন বলছিলে আমীর সর্বনাশের পথে হাঁটছে। ওকে আটকানো উচিৎ। সেটা কেনো বলছিলে? সর্বনাশের পথে তো তোমরা সবাই হাঁটছো৷ তাহলে আমীর আলাদা হলো কিভাবে?”
রিম্মি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” তুমি লুকিয়ে আমাদের কথা শুনেছো?”
” তোমরা যখন কথা বলছিলে আমি আশেপাশেই ছিলাম। তাই কানে এসেছে।”
” অর্ধেক যখন শুনেই ফেলেছো তাহলে পুরোটাই বলি। একমাস আগে আমীরের যে লাশ তোমাদের পাশের ফ্ল্যাটে খুঁজে পাওয়া গেছিল সেটা কিন্তু আমাদের সাজানো নাটক না। সবাই হয়তো ভাবছে এটা সুইসাইড। কিন্তু সত্যিটা কি জানো? ওইটা কোনো সুইসাইডও না, মার্ডার ছিল।”
নীলাভ্রর পিলে চমকে উঠলো,” হোয়াট?”
” হুম, আর এই ঘটনায় আমাদের কোনো হাত নেই। আমীর সেদিন আত্মহত্যা করেনি। আমাদের এমন কোনো পরিকল্পনাও ছিল না। আমীর শুধু ভেবেছিল তোহার ব্রেইন থেকে সব স্মৃতি মুছে সে অস্ট্রেলিয়া ফিরে আসবে। কারণ তোহার সাথে আমীর থাকতে পারছিল না। সে কয়েকদিনেই যথেষ্ট দূর্বল হয়ে পড়েছিল। প্রফেসর ট্রুডোই ওকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ফিরে আসতে। কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙার পর আমীর দেখলো ওর মৃতদেহ ফ্লোরে পড়ে আছে। আমীর ধরেই নিয়েছিল সে মারা গেছে। তার আত্মাটাই হয়তো তার লাশটা দেখতে পাচ্ছে। ওই মুহুর্তের সত্যতা যাচাই করতে আমীর কিন্তু আমাকেও ডেকে এনেছিল। আমিও দুটো আমীরকে দেখলাম। একজন মৃত, ফ্লোরে শয্যাশায়ী। আরেকজন জীবন্ত,আমার সামনে দাঁড়ানো। তখন আমরা ধারণা করে নেই এইটা আমাদের অদ্ভুত রিসার্চের পরিণাম। আমরা যেই মহাকাশ ভ্রমণে যাচ্ছি তার মাধ্যমেই হয়তো অন্যকোনো প্লেনেটের অন্য আমীর এখানে চলে এসেছে। কিন্তু সে কিভাবে মারা গেল সেই রহস্য এখনো জানতে পারিনি। তবে এটা বুঝা যাচ্ছিল যে ওটা মার্ডার কেস। আমরা অনেক কিছুই আশংকা করছি। আর এই বিষয়টা ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই আমীর তোহার কাছে ওইরকম চিঠি লিখেছিল। যেন পুরো বিশ্ব জেনে যায় ও মৃত। আর মৃত্যুটা আত্মহত্যার কারণে হয়েছে। এমনটা সে কেনো করেছে জানো? কারণ সে নিশ্চিত, এই পৃথিবীতে তার আর ফিরে আসা হবে না। আমীর নিয়তিকে মেনে নিয়েছে। মহাকাশ ভ্রমণে যাওয়ার পর যে আমীরের মৃত্যু হবে এইটা সে জানে। তখন হয়তো তার মৃতদেহ অন্য প্লেনেটে চলে যাবে। ঠিক যেমন অন্য প্লেনেট থেকে আমাদের প্লেনেটে ওর লাশটা এসেছে। এই অস্বাভাবিক ঘটনা যেন বিশ্বে প্রকাশ না পায় তাই হঠাৎ ওই আত্মহত্যার নাটক। সবাই জানবে আমীর মৃত, কিন্তু আসলে আমীর জীবিত৷ ও মরবে ভবিষ্যতে। ঠিক এইভাবেই। নীলাভ্র তুমি কি আমার কথা বুঝতে পেরেছো?”
নীলাভ্র ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। রিম্মি বললো,
” আমীর জানে, মহাকাশ ভ্রমণের মাধ্যমে ওর মৃত্যু হবে। ও সেই পরিণাম নিজের চোখেই দেখেছে। এছাড়া ওই লাশের অন্যকোনো উৎস আমরা ভাবতে পারছি না। আমরা কেউ আমাদের পরিণাম জানিনা। আমরা বাঁচতেও পারি আবার মরতেও পারি। কিন্তু আমীর যে মরবে এটা নিশ্চিত। তবুও সে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বদলায়নি। তার মতে, প্রকৃতির নিয়ম বদলানো যায়না। এইটা কি সর্বনাশের পথে স্বেচ্ছায় হেঁটে যাওয়া না? সে জানে তার মৃত্যু নিশ্চিত তবুও সেই মৃত্যুর পথেই হাঁটছে৷ সবাই ভাবছে ও সাহসী, কিন্তু আমি বলছি এটা সাহস না। এটা দুঃসাহস। আমীর যেন যেতে না পারে তাই ইচ্ছে করেই আমি তোহাকে এখানে এনেছিলাম। আমার ধারণা ছিল ওর মৃত্যুর পর তোহার কি অবস্থা হয়েছে তা নিজচোখে দেখে আমীর দূর্বল হয়ে পড়বে। আর হয়তো যেতে চাইবে না। তোহাকে নিয়ে হয়তো পৃথিবীতেই বাঁচতে চাইবে।”
” তাই কি হয়েছে?”
” জানিনা। আমীরের সিদ্ধান্ত এখনো অপরিবর্তিত। ও আমাদের সাথে অভিযানে যেতে চায়।”
চলবে
( মেইন থিমে চলে এসেছি। এখন থেকে খুব সাবধানে লিখতে হবে। একটা লাইন ভুল করলেই পুরো কাহিনি এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। তাই আমাকে সময় নিয়ে লিখতে দিন প্লিজ।)