#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_৫৬
লিখা: Sidratul Muntaz
রিম্মি আমীরের মাথাটা কোলে নিয়ে বসে আছে। রিড আর সানভী পাগলের মতো ছুটোছুটি করছে। জীবন-মরণের এই সন্ধিক্ষণে এসে সবাই আতঙ্কে আড়ষ্ট, ভয়ে তটস্থ! শরীরের শক্তি কমে আসছে ক্রমশ। নিঃশ্বাস বন্ধ রাখা ক্ষণে ক্ষণে কঠিন হয়ে পড়ছে। অথচ বুক ভরে শ্বাস নিতে গেলেই বিষাক্ত গ্যাস ফুসফুসে ঢুকে তাৎক্ষণিক মৃত্যু নিশ্চিত। যেকোনো অবস্থাতেই ওদের মৃত্যু হবে। সকলের চোখ-মুখ অতি জলদি লালবর্ণ ধারণ করছে। রিম্মির শুধু কান্না পাচ্ছে। তাদের এই অসহায় অবস্থা থেকে উত্তরণের কি কোনো পথ নেই? আর মাত্র কয়েক মিনিট পর সবাইকে মরে যেতে হবে? কেউ বাঁচবে না? তাদের এতোবড় অভিযান, পরিকল্পনা, স্বপ্ন, কিচ্ছু সফল হবে না? রিম্মি দুইহাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো। আমীরের অবস্থা একটু একটু করে বেগতিকের দিকে যাচ্ছে। দুইহাতে নাক-মুখ চেপে রাখার মতো অবস্থাতেও সে নেই। মাথার আঘাতে অনেকটাই দূর্বল হয়ে পড়েছে। তাই বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাব ওর শরীরে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। আমীরের ঠোঁট নীল হয়ে যাচ্ছে। রিম্মি গোঙানীর মতো শব্দ করে আমীরকে ডাকতে লাগলো। রিম্মির আওয়াজ শুনে সানভী আর রিড থেমে দাঁড়ালো। আমীরকে পরোখ করে ওরা বুঝলো সে ভয়ানক এক মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিন্তু আপাতত অসহায় চোখে চেয়ে থাকা ছাড়া কারো কিচ্ছু করার নেই। ধীরে ধীরে আমীরের চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসে..
আমীর চোখ মেলতেই আবিষ্কার করলো একটা দূরপ্রসারিত মাঠে সে শুয়ে আছে। মাঠের রঙ কালচে সোনালী। যতদূর চোখ যায় শুধু ফাঁকা আর ফাঁকা। কোথাও কিছুই দেখা যাচ্ছে না। রিম্মি, রিড, সানভী সবাই কোথায়? তাদের রকেট কোথায়? আচ্ছা আমীর কি মারা গেছে? অসংখ্য দুশ্চিন্তা মাথায় দানা পাকাচ্ছে। খুব শীত শীত লাগছে। তিরান এসে আমীরের কপালে হাত ছুঁইয়ে বললো,
” হিরো, তুমি ঠিকাছো?”
আমীর ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। হুট করে তিরান কোথ থেকে আসলো?সে কি তাহলে পৃথিবীতে চলে এসেছে? কিন্তু এ জায়গাটা দেখে তো পৃথিবী মনে হচ্ছে না। পৃথিবীর কোথাও এমন জায়গা আছে বলেও মনে হয়না। আমীর ভীষণ সন্দিহান চোখে দুই ভ্রু সংকুচিত করে বললো,
” এটা কোথায়? কোন জায়গা?”
তিরান দুইহাত সামনে গুটিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। যথেষ্ট বাধিত গলায় বললো,
” আমরা এখন পৃথিবীতে নেই। এটা লিয়াম ওয়ানওয়ানজিরো। আকারে পৃথিবী থেকেও দশগুণ বড়। তাপমাত্রা সহনীয় আর কাছাকাছি হওয়ায় এখানেই ল্যান্ড করতে হয়েছে। এই গ্রহে কমপক্ষে আটঘণ্টা বেঁচে থাকার মতো জিনিস আমাদের কাছে আছে। এই আটঘণ্টার মধ্যে আমাদের রকেটও ঠিক হয়ে যাবে। আমরা আবার জার্নি শুরু করতে পারবো।”
” রিম্মি, রিড, সানভী? ওরা কোথায়?”
” ওরা নেই।”
” নেই মানে? কোথায়?”
” হারিয়ে গেছে। খুঁজে পাইনি। শুধু তোমাকেই পেয়েছি।”
” তুই কিভাবে পেলি আমাদের? আর তুই এখানে আসলি কিভাবে? আঠারো বছরের আগে নাসা নভোচারী হওয়ার অনুমোদন কাউকে দেয়না। তাহলে তুই স্পেসে কি করিস?”
” আমি স্পেসে কি করি সেটা বড় কথা না। তোমাকে বাঁচাতে পেরেছি এটাই বড় কথা। তুমি কিছুক্ষণ রেস্ট নাও। আমি খাবারের আয়োজন করছি। আর এখানে বসে খাবারের টেস্ট পাবে। রকেটে উঠার পর আর পাবে না। তাই যত খুশি খেয়ে নিও।”
তিরান একটা চাতুরী হাসি দিল। আমীর উদ্ভট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে, তার মাথায় কিছুই আসছে না। রিম্মি, রিড, সানভীকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? এ কেমন কথা? তিরান দুটো প্লেটে ভাত, কোয়েল পাখির মাংস আর পেঁয়াজ আনলো। আমীরের সামনে একটা প্লেট দিয়ে খুব আয়েশী ভঙ্গিতে বললো,
” খাও হিরো।”
আমীর হতবাক হয়ে বললো,” তুই এসব খাবার কোথায় পেলি? ভাত কোথায় পেলি?”
” সব নিয়ে এসেছি। এতো ছোটখাটো বিষয় নিয়ে কেনো ভাবছো? রিম্মিকে ছাড়া সঠিক টাইমলাইনের পৃথিবী কিভাবে খুঁজে বের করবে সেটা নিয়ে ভাবো। আমাদের মেইন মোটিভ তো এটাই।”
” রিম্মি, রিড, সানভী কোথায়?”
তিরান দায়সারাভাবে ভাত খেতে খেতে বললো,
” খাও। পরে বলছি।ও”
আমীর পুনরায় আগের চেয়েও ভারী কণ্ঠে প্রশ্নটি করলো। তিরান একটু থেমে খুব জোরে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর আমীরের দিকে চেয়ে সোজা-সাপটা উত্তর দিল,” হারিয়ে গেছে।”
আমীর আবারও এক উত্তর পেয়ে রেগে-মেগে তিরানের কলার চেপে ধরে হিংস্র কণ্ঠে বললো,
” হারিয়ে গেছে মানে কি?”
তিরান একটু থতমত খেয়ে গেল। নিম্নকণ্ঠে বললো,
” কাম ডাউন। ওদের খুঁজে বের করা সম্ভব। কিন্তু আমরাও বিপদে আছি। রকেট নিয়ে টেক অফ করা যাচ্ছে না। আগে এই প্রবলেমটা ফিক্সড করি৷ তারপর ওদের খুঁজে বের করবো।”
আমীর তিরানের কলার ঝাঁকিয়ে গজগজ করে বললো,
” ওরা হারালো কিভাবে?”
” বলছি, আগে ঠান্ডা হও। কুল!”
আমীর তিরানকে ছাড়লো। সারা মাথায় কয়েকবার মালিশ করে ধৈর্য্যশীল গলায় বললো,” বল।”
তিরান ঘটনার যে বর্ণনা দিল তা অনেকটা এরকম, আমীরদের স্পেসশীপের মতোই ডুপ্লিকেট আরেকটা স্পেসশীপ নিয়ে তিরান ওদের উদ্ধার করতে এসেছিল। প্রথম রকেট থেকে ওদের অক্সিজেন মাস্ক পড়িয়ে উদ্ধার করার সময় একা আমীরকেই দ্বিতীয় রকেটে তুলতে সফল হয় সে। বাকিরা ব্ল্যাকহোলের ঘূর্ণিপাকে আটকা পড়ে হারিয়ে যায়। আওয়ান আর রোবট রায়ান এখন বেঁচে নেই। ওদের রকেট তিরান বোম মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। ওরা রকেটের ভেতরেই ছিল। যদি কোনোভাবে বেঁচে যায় তাও ওদের খোঁজ পাওয়া যাবে না। ওরা আজীবন গ্যালাকটিক সেন্টারকে কেন্দ্র করে চক্রাকারে ঘুরতে থাকবে। আমীর বললো,
” তুই তাহলে হাসাদের বেইমানীর কথা আগে থেকেই জানতি? আমাদের আগে কেনো বললি না?”
তিরান হেসে বললো,
” আগে কেনো বলবো? তোমাদের সাথে যখন আমি আসতে চেয়েছিলাম আমাকে নিয়েছিলে? আমি কেনো আগ বাড়িয়ে তোমাদের হেল্প করবো?”
” তাহলে এখন কেনো আগ বাড়িয়ে হেল্প করলি?”
” দরকার আছে।”
” কি দরকার?”
” বলা যাবে না।”
” তুই ডুপ্লিকেট রকেট কোথায় পেলি? এখানে কিভাবে আসলি এটা বলে আগে?”
” আমি এখানে কিভাবে আসলাম এটা কোনো ফ্যাক্ট না। দ্যা ফ্যাক্ট ইজ, আমাদের অতি দ্রুত স্পেসশীপ ঠিক করে মহাকাশে রওনা দিতে হবে। আটঘণ্টার বেশি আমরা এখানে টিকতে পারবো না।”
আমীর আবারও অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়। ভ্রু কুচকায়৷ তিরান বললো,
” তুমি জলদি খেয়ে নাও।”
আমীরের চোখেমুখে শুধু বিভ্রান্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে। কোনো হেলদোল নেই। তিরান বাধ্য হয়ে নিজেই আমীরকে খাইয়ে দিতে লাগলো। একপর্যায়ে তিরান বললো,
” তুমি বললে আমরা পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারি৷ এখন বললে এখনি মহাকাশ স্টেশনে খবর পাঠাবো। নরমাল একটা রকেট চলে আসবে। আমরা সহজেই পৃথিবীতে ফিরে যাবো।”
” তাহলে রিম্মি, রিড, সানভী ওদের কে খুঁজবে?”
” ওদের চিন্তা করলে আমরা বাঁচতে পারবো না। আগে নিজেরা বাঁচি, তারপর ওদেরটা দেখা যাবে। তোহা ইজ অলসো ওয়েটিং।”
তিরান একচোখ টিপলো। আমীর চোয়াল শক্ত করে বললো,
” ওদের না নিয়ে আমি পৃথিবীতে ফিরবো না।”
তিরান কাধ ঝাকিয়ে বললো,
” এজ ইউর উইশ।”
একটু পর আমীর দেখলো একজন রিকশাওয়ালা মনের সুখে বাংলা গান গাইতে গাইতে ওদের সামনে দিয়েই চলে যাচ্ছে। আমীর প্রগাঢ় বিস্ময় নিয়ে বললো,
” এটা কি?”
তিরান বললো,” হোয়াট হ্যাপেনড? ”
” রিকশা। এখানে আমরা ছাড়াও আরও মানুষ আছে? রিকশা আছে?”
” থাকার তো কথা না। তুমি যা দেখছো তা ভুল। আশেপাশে তাকানোর দরকার নেই। যতক্ষণ এখানে থাকবো আমরা এইসব ভুল-ভাল জিনিসই দেখবো। হাইপার হওয়ার কিছু নেই। এসবে পাত্তা দিও না।”
তিরান একটা ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করলো। আমীরকে পানি দিল। মোটা চাদর বের করে আমীরের গায়ে জড়িয়ে দিল। তারপর বললো,
” আমি আশেপাশেই আছি। দরকার লাগলে ডাকবে। আর আজে-বাজে জিনিস দেখে ঘাবড়ানোর কিছু নেই।”
তিরান কোথায় জানি চলে গেল। আমীর তখন তিরানের ব্যাগটা খুলে সব জিনিসপত্র ঘেটে-ঘুটে দেখলো। অনেক দরকারী জিনিস আছে। মহাশূন্যে বেঁচে থাকার জন্য তাদের সবই প্রয়োজন। তিরানের হাল-চাল দেখে মনে হচ্ছে সে আগে থেকেই সব জানতো! সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিয়েই এখানে এসেছে। কিন্তু কে এই তিরান? ও এসব কেনো করছে? আমীর আবার একটা আজব জিনিস দেখলো। অত্যন্ত কালো কুৎসিৎ চেহারার একজন মহিলা, তার একচোখ কোকড়া চুল দিয়ে ঢাকা। গায়ে টকটকা লাল কামিজ। সেলোয়ার নেই। কালচে পা দৃশ্যমান। তবে একপা দেখা যাচ্ছে, দ্বিতীয় পা অনুপস্থিত। তার হাতে একটা আধখাওয়া বাচ্চা। খোলা একচোখ দিয়ে আমীরকে দেখতে দেখতে মহিলাটি এগিয়ে আসছে। আমীর নিষ্পলক সেদিকে তাকিয়ে রইল। তার অনেকটা পাশ ঘেঁষেই অদ্ভুত দেখতে মহিলাটি চলে যায়। আমীর চিৎকার করে ডাকলো,” তির, তিরান!”
তিরান ছুটে আসলো। ওকে দেখে মনে হলো দৌড়াতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তিরান বললো,
” কি হিরো?”
” আমি এইমাত্র একটা জিনিস দেখলাম। একটা মহিলা আর একটা বাচ্চা। বাচ্চাটার শরীর অর্ধেক। রক্তে লাল। আর মহিলাটি খুব ভয়ংকরভাবে…”
তিরান আমীরকে থামিয়ে বললো,” বললাম তো, ভুল-ভাল দেখেছো৷ চশমাটা পড়ো। আর এসব দেখবে না।”
আমীর চশমা পড়লো। তিরান বললো,
” কাধে খুব ব্যথা করছে। অনেকক্ষণ আমার কাধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছো তুমি। ব্যথায় টনটন করছে জায়গাটা। এবার একটু রেস্ট নিতে দাও।”
আমীর আশেপাশে কি যেন খুঁজছে। হয়তো আরও আজব জিনিস দেখার চেষ্টা করছে। তিরান বললো,
” ভয় নেই। এসব শুধু দেখা দিবে। ওরা তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমি থাকতে তোমার কিচ্ছু হতে দিবো না।”
আমীর হঠাৎ করে তিরানের দুইহাত ধরলো। একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,” কে রে তুই? আমার জন্য কিসের এতো টান? আমি তোর কে?”
তিরান মৃদু হেসে বললো,” তুমি আমার সুপার হিরো।”
আমীর দ্বিতীয়বার যখন ঘুম থেকে জাগলো, সে তিরানকে আর পেল না। এবার সে দেখলো একটা ছোট্ট বাগানের মতো জায়গায় শুয়ে আছে। উঠে বসতেই আবিষ্কার করলো এটা তার খুব পরিচিত একটা বারান্দা। সেই ফ্ল্যাটের বারান্দা যেখানে তোহাকে নিয়ে সে একসময় থাকতো। বারান্দা থেকে বের হতেই আমীর দেখলো বিছানায় তোহা ঘুমিয়ে আছে। না চাইতেও আমীরের মুখে এক চিলতে হাসি চলে আসলো। সে কি তবে পৃথিবীতে ফিরে এসেছে? নতুন জীবন পেয়েছে? আমীর তোহার বিছানার কাছে গিয়ে হাটু গেড়ে বসলো। এটাই তো তাদের পরিচিত রুমটা! এখানেই ছিল তার আর তোহার ছোট্ট সংসার। কত দুষ্টমি, খুনশুটি, মিষ্টি স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই রুমটি ঘিরে। আমীর আলতো হাতে তোহার কপাল স্পর্শ করতে চাইলো। কিন্তু ব্যর্থ হলো। কেউ একজন পেছন থেকে খুব শক্ত করে তার গলা চেপে ধরেছে। আমীর নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু যে ব্যক্তি তাকে আক্রমণ করেছে সে এতোই শক্তিশালী যে আমীর নড়াচড়া অবধি করতে পারছিল না। আমীরের হুট করেই মাথায় আসলো, যে ওকে আক্রমণ করেছে সে হাসাদ। তোহার উপর তো এখন হাসাদের কবজা সবচেয়ে বেশি থাকার কথা। আমীরের শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটতে লাগলো। সে একহাতে মানুষটিকে পেছন থেকে ধরে বামপা দিয়ে লাথি মারলো। অজ্ঞাত মানুষটি মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। তোহা সেই শব্দে ঘুমের মধ্যেই কেঁপে উঠলো। ওর ঘুমের যাতে ব্যঘাত না ঘটে তাই আমীর অজ্ঞাত ব্যক্তিটিকে তুলে অন্যঘরে নিয়ে গেল। ওদের মধ্যে কঠিন ধস্তাধস্তি শুরু হয়। একপর্যায়ে আমীর অজ্ঞাত মানুষটির গলার শিরা কেটে ফেলে। তারই গলার ঝুলন্ত ব্লেড দিয়ে। মানুষটি হালকা চিৎকার দিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। আমীর লাইট জ্বালিয়ে দেখলো মেঝেতে যে পড়ে আছে সে আমীর নিজেই। কাচের জানালার আয়নায় তাকালো। দুজন মানুষকে দেখা যাচ্ছে। একজন সে, অন্যজনও সে নিজেই। কিন্তু রক্তাক্ত, নিহত, তোহার উপহার দেওয়া পাঞ্জাবী পরিহিত। কে এই ব্যক্তি? আমীর নিচু হয়ে ভালোমতো দেখলো। নিজেকে চিনতে কারো ভুল হয়না। এটা সে নিজেই! দেয়ালঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো ভোর চারটা বাজে। একটু পরেই আযান দিবে। পাশেই কেলেন্ডার ঝুলছে, এটা সেই মাস যেই মাসে আমীর তোহাকে ছেড়ে চলে গেছিল। কিন্তু কয়তারিখ? তারিখ জানতে পিসি’র দিকে তাকালো আমীর। দ্রুতহাতে পিসি অন করে দেখলো তারিখও সেইম। সেই একই দিন, একই সময়, একই মুহূর্ত। অর্থাৎ সে নিজেই নিজের খুনী হয়ে গেছে!খট করে একটা শব্দ হলো। আমীর দরজার পেছনে লুকিয়ে পড়লো। কেউ একজন ভেতরে আসছে। সে তো এখনি লাশটা দেখে ফেলবে! কি করা যায়? আমীর কিছু করতে পারলো না। ঘরে প্রবেশ করলো তৃতীয় আমীর। এবার যেন আমীরের মাথায় বাজ পড়লো। আসল আমীর,যদি দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে মেঝেতে যে পড়ে আছে সে কে? এদিকে নিজের লাশ দেখে তৃতীয় আমীর স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমীরের মনে পড়ে যায় এই দিনটির কথা। সে এখন গিয়েছিল তোহার জন্য লেখা চিঠিগুলো প্রিন্ট আউট করতে। আমীরের হাতে দুইটা চিঠি আছে। লাশটা দেখে চিঠিগুলো ওর হাত থেকে পড়ে গেল। কিছুক্ষণ হতবিহ্বলের মতো পায়চারী করলো সে। তারপর কোথায় যেন চলে গেল। আমীর জানে সে এখন রিম্মিকে ডাকতে যাচ্ছে৷ আমীর এই সুযোগে চিঠিগুলো তুলে দেখলো। এই সেই চিঠি যেগুলো আমীর যাওয়ার আগে তোহার জন্য লিখেছিল। কিন্তু এই চিঠি তো অদল-বদল হয়ে যাওয়ার কথা। আমীর এখনি চিঠিগুলো অদলবদল করে রাখল। নিচেরটা উপরে রাখলো আর উপরেরটা নিচে। যেন পরবর্তীতে চিঠি বদলে গেলেও আর কোনো সমস্যা না হয়। তৃতীয় আমীর রিম্মিকে নিয়ে আসছে। আমীর দ্রুত ড্রয়িংরুমে ঢুকে গেল। শিউলি ঘুমাচ্ছে। আমীর ড্রয়িংরুমের দরজার আড়ালে লুকিয়ে রইল। বেশ কিছুসময় এভাবেই কেটে যায়। ভোর হতে শুরু করে। তৃতীয় আমীর তোহার কাছে চিঠি রেখে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে। আমীর বের হতে নিয়ে দেখলো শিউলির ঘুম ভেঙে গেছে। সে মৃত আমীরের লাশ দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। একটু পরেই মেয়েটার জ্ঞান ফিরবে। তার আগে তোহার ঘুম ভেঙে যাবে। আমীর ধরা পড়ার আগেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। আর কিছুক্ষণ পর পুরো দুনিয়ার কাছে সে মৃত ঘোষিত হবে। এখন তার কি করা উচিৎ? কারো সামনে যাওয়া একদমই উচিৎ না। কারণ এখন সে মরে গেছে। আমীরের হঠাৎ করেই মনে হলো, চিঠি অদল-বদলের জন্যে সে হয়তো নিজেই দায়ী। বিস্ময়ে চারিপাশ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো। আমীর তৃতীয়বার চোখ খুলতেই দেখলো সে যমুনা শপিংমলের পেছনের করিডোর লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। ওর গায়ে কালো কোর্ট। চোখে সানগ্লাস। মুখে কৃত্রিম গাঢ় দাড়ি৷ এটা তার ছদ্মবেশী রূপ। কিন্তু হঠাৎ ছদ্মবেশ ধারণ করলো কেনো সে? তৎক্ষণাৎ আমীরের মনে পড়ে, এ দুনিয়ার কাছে সে মৃত। তাই আসল রূপ নিয়ে কারো সামনে যাওয়া যাবে না। এজন্যই হয়তো ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়েছে। আমীর উঠে দাঁড়াতেই কাচের দরজা দিয়ে বাহিরের দৃশ্য দেখতে পেল। পেছনের গেইটের নিরিবিলি জায়গায় বোরখা পড়া একটা মেয়ে হাটাহাটি করছে। আমীরের চিনতে বেশি সময় লাগলো না তোহাকে। কতদিন পর তোহাকে সে দেখছে! দৌড়ে যেতে ইচ্ছে করলো। তারপর হঠাৎ মনে হলো, এ অবস্থায় গেলে তোহা ওকে চিনবে না। আমীর তার কোর্ট, সানগ্লাস,কৃত্রিম দাড়ি, সব খুলে সাধারণ চশমা পড়ে নিল। এবার কি তোহার সামনে যাওয়া যায়? দীর্ঘসময় মহাকাশে অবস্থানের দরুন আমীরের উচ্চতায় পরিবর্তন এসেছে। আগে ওর উচ্চতা ছিল পাঁচ ফুট এগারো৷ এখন ছয় ফুট তিনের কাছাকাছি চলে এসেছে। দেহের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটেছে। এ অবস্থায় তোহা ওকে দেখলে কি ভয় পাবে? অবশ্যই ভয় পাবে, ভয়ে চিৎকারও করতে পারে। কারণ তোহা এখন জানে আমীর মৃত। হুট করে মৃত আমীরকে দেখলে ওর ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু তোহার কাছে যাওয়ার লোভটাও সামলানো যাচ্ছে না। আমীর এসব চিন্তা করতে করতে কখন যেন করিডোর থেকে বেরিয়ে তোহার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, নিজেও টের পায়নি। তোহা হঠাৎ পেছনে ঘুরে আমীরকে দেখে ফেললো। আমীর খুব অপ্রস্তুত হয়ে যায়। একবার তার ইচ্ছে হয় চলে যেতে। তারপর ভাবলো একটু দাঁড়িয়ে দেখা উচিৎ তোহা কি করে। তোহা ভয় তো পেলই না বরং আগ্রহ সহিত এক-পা দুপা করে এগিয়ে আসতে লাগলো। আমীর আতঙ্কে কিছুটা পিছিয়ে গেল। তোহা অবাক হয়ে আমীরকে দেখছে, পাগলের মতো স্পর্শ করছে। ওর চোখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। কিন্তু চেহারায় বিষণ্ণতার ছাপ। কি অবস্থা হয়েছে মেয়েটার! এসবকিছুর জন্য আমীর নিজেই দায়ী। সে যদি নিজেকে খুন না করতো, চিঠি বদলে না দিতো, তাহলে এসব কিছুই হতো না। সে নিজেই নিজের ভবিষ্যৎ কবর দিয়েছে। সাথে জীবন্ত তোহাকেও কবর দিয়েছে। আমীর হাত ধরে তোহাকে একটা গলিতে নিয়ে গেল। ওর কাছে ক্ষমা চাইলো। তোহাকে বুঝিয়ে বলতে চাইলো তাদের মিলন আর কখনো সম্ভব না। নিজেকে নিজের হাতে সে যেভাবে হত্যা করেছে তাকেও সেভাবেই মরতে হবে। অন্যকোনো ভিন্ন জগতের আমীরের হাতে। এটাই নিয়তি। কিন্তু তোহা কিচ্ছু বুঝতে চাইছে না। পাগলের মতো প্রলাপ বকে যাচ্ছে। এসব দেখে আমীরের খুব কষ্ট হচ্ছিল। হঠাৎ শিউলির গলা ভেসে আসে। আমীর অতি দ্রুত তোহাকে রেখে চলে যায়। তোহা চিল্লিয়ে কাঁদে। আমীর একবার ফিরেও তাকায় না।
চলবে
( আমীর যেটা করসে সেটাকেই বলে আসল আত্মহত্যা! মানে নিজেকেই নিজে হত্যা।😅)