#ধারাবাহিক
#ধূসর_রঙের_জলছবি
#অস্মিতা_রায়
(এক )
“শুভেন্দু , এই নিয়ে কতবার যে এই ঘটনাটা ঘটল, এখন আর কোনো হিসেব আমাদের কাছে নেই।বিয়ের আগে তুমি বলতে, যে পুরুষমানুষ বৌয়ের গায়ে হাত তোলে, তার নাকি নিজেকে মানুষ বলে পরিচয় দেওয়া উচিত না। অথচ, বিয়ের মাত্র দু’মাসের মাথায় একদিন ঝগড়ার সময়ে তুমি আমার গায়ে প্রথম হাত তুলেছিলে। সেদিন মাথা ঠান্ডা হওয়ার পর তুমি সারারাত অনুশোচনায় আমার পায়ে তোমার মাথা কুটেছিলে। আমি শুধু বলেছিলাম, এই ঘটনার আজই শেষ নয় শুভেন্দু।তোমার মতো রগচটা মানুষ ভবিষ্যতেও এই কাজটা করবে। জানি না আমার কথায় উৎসাহ পেয়েই নাকি তোমার নিজের স্বভাবেই তুমি এরকম কাজ বহুবার করেছো। প্রথমদিকে প্রত্যেকবার ক্ষমা চাইতে সবকিছুর পরে। পরবর্তীতে, হয় তো আর সেই ক্ষমা চাওয়ার মুখ থাকতো না বলেই, তুমি ক্ষমা চাওয়াটুকুও বন্ধ করে দিলে।দামি শাড়ি,ব্যাগ,জুতো সব কিছুই তুমি আমাকে অনেক ভরে ভরে দিয়েছো বরাবর। আমি কিছু না চাইতেই তুমি এনে এনে হাজির করেছো এক একটা জিনিস। আত্মতুষ্টিতে ভরেছো নিজেই।জিনিসগুলো আমার দরকার আছে কীনা, আমি ওগুলো সত্যি চাই কীনা সেটা কোনোদিন শোনার প্রয়োজন মনে করো নি। এসব জিনিস দেওয়ার বদলে আমি তোমার কাছে কোনো মাসে পাঁচশো টাকা হাত খরচ চাইলে তুমি বলেছো, টাকা কী গাছে ফলে!বাইরে বেরিয়ে কত পরিশ্রম করে রোজগার করতে হয়, তা জানো! আমি নীরব কান্নাগুলো গিলে ফেলেছি। বরাদ্দ তিনশো টাকার বেশি তুমি আমাকে কোনোমাসে দাও নি। অবশ্য এই টাকা রোজগার করতেই যে কতখানি পরিশ্রম করতে হয়, সেটা আমি হাড়ে হাড়ে জানি।তুমি প্রতিবার ঘুরতে নিয়ে গেছো তোমার পছন্দমতো জায়গায়, পাহাড়ে। আমার পছন্দের সমুদ্রে যাওয়ার কথা বললে প্রতিবারই তোমার একই উত্তর ছিল, এবার থাক, পরেরবার হবে। একবার গ্যাংটক যাওয়ার আগে আমার সেকি শরীর খারাপ! বলেছিলাম, আমি এবার যেতে পারবো না, টিকিট ক্যানসেল করে দাও। তুমি আমাকে চড় দেখিয়ে বলেছিলে, এক পয়সা রোজগারের মুরোদ নেই, আবার কাটা টিকিট ক্যানসেল করতে বলছো! আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছিলাম, আমার শরীরের কষ্টের চেয়ে তোমার কাছে টিকিটের দাম বড়ো হল! তুমি আর তোমার বাবা-মা মিলে নানা সময়ে আমার বসে বসে খাওয়া নিয়ে কত খোঁটাই না দিয়েছো! চাকরির পরীক্ষার জন্য বই খাতা নিয়ে বসতাম বলে, তোমরা কথা শোনাতে আমি সারাদিন নিজের ঘরে বসে থাকি। তোমরা আশা করেছো, আমি সারাদিন রেঁধেবেড়ে, ঘর গুছিয়ে, তোমাদের এক একজনের এক-একরকম বায়নাক্কা সামলে চলবো। আবার এইসবের মধ্যে ম্যাজিকের মতো বড়ো কোনো পরীক্ষা ক্র্যাক করবো। ফিনান্সিয়ালি তোমাদের পাশে দাঁড়াবো। মেয়েরা যে দশভুজা! তাদের কোনোকিছু পারবো না বলতেই নেই। আমার কান্না শোনার জন্য আমার বাবা মা-কেও আমি পাশে পাই নি। বিবাহিত মেয়েদের বাবা, মায়েরা সব সময়ে ভয়ে থাকে, এই বুঝি মেয়ের সংসারটা ভেস্তে গেল! একদিন তোমার হাতে মার খেয়ে, অপমানের জ্বালায় আর থাকতে না পেরে মা-কে ফোন করে বিষয়টা জানালাম। মা শুনে বলল, তাহলে আমাদের কথা বলতে হয় গিয়ে। আমি কী উত্তর দেবো না বুঝতে পেরে বললাম, বেশ, বলো। মা বলল, ওরা যদি ব্যাপারটা ডিভোর্সের দিকে নিয়ে যায়, তাহলে ডিভোর্স হওয়ার পর তোর দায়িত্ব কে নেবে! কে তোর পেছনে উকিল লাগাবে!দেখ আমাদের কিন্তু বয়স বাড়ছে। এখন কোনো এক্সট্রা ঝামেলা আমরা নিতে পারবো না।আমি বলেছিলাম, কিছুদিন সময় পেলে আমি একটা চাকরি জোগাড় করে নেবো। মা বলল, তাহলে আগে জোগাড় করে দেখা! বলে ফোনটা কেটে দিয়েছিলো।এরপর সাতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছিলাম আমি । আপনজন বলে এই দুনিয়ায় কিছু হয় না। সবটাই একটা ইলিউশন।যাই হোক, তোমরা সবাই আমার কাছে সন্তান চাইতে। সেই সন্তান আমি এনে দিয়েছি। টুবলুর বয়স এক বছর হল। তবে এখনও তোমার আমার গায়ে হাত তোলার স্বভাব গেল না। ভেবে দেখলাম, ওই ছোটো বাচ্চাটা যদি এসব দেখে বড়ো হয়, তাহলে ও কোনো সুস্থ পরিবেশ পাবে না। ও নিজেও এগুলোই শিখবে। তাই আমি চলে যাচ্ছি। তোমার ছেলের বড়ো হওয়ার জন্য ওর মা’কে না হলেও চলবে। অনেক বাচ্চার মা ছোটবেলাতেই মারা যায়। তোমার ছেলের কাছেও ওর মা মৃতই থাক। বেশি স্নেহের বন্ধনে আমাদের না জড়ানোই ভালো। কারোর স্ত্রী, কারোর মা ছাড়াও আমি সবার আগে একজন মানুষ। নিজেকে ভালোবাসার জায়গা আমি এক কণাও ছাড়বো না। তোমাদের কাছে আমি বরাবর স্বার্থপর তকমাই পেয়ে এসেছি। নিজেকে স্বার্থপর মেনে নিয়েই আমি চলে যাচ্ছি, এই শহর ছেড়ে। যদি তোমার ডিভোর্স দরকার হয়, আমাকে খুঁজে বের করে নিও। ডিভোর্সের পথটা আমি ইচ্ছে করেই তোমার জন্য মসৃণ করলাম না।
মালবিকা”
চিঠিটা পড়া শেষ করে শুভেন্দু ধপ করে সোফায় বসে পড়ল।সপ্তাখানেক আগে মালবিকার সঙ্গে কথা কাটাকাটিটা আবার চরম পর্যায়ে গেছিল। মেয়েটার মধ্যে সব সময় একটা নাকউঁচু ভাব। মেয়েদের অধিকার, মেয়েদের স্বাধীনতা সব সময় এসব নিয়ে বড়ো বড়ো কথা! সব সময় ওকে শুভেন্দুর সঙ্গে সমানে সমানে তর্ক চালাতে হবে। শুভেন্দুর মাঝে মাঝে মাথার ঠিক থাকে না এত তর্ক শুনলে। সেদিন রাতে মালবিকাকে আবার কয়েকটা চড় থাপ্পড় মেরেছিল। বলেছিল, অতো দেমাক থাকলে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাও। কথাটা সেদিনই যে প্রথম বলেছিল তা তো নয়। মালবিকা যে সত্যি সত্যি কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবে এটা কখনোই ভাবে নি ও। তবে মেয়েটা গেলোই বা কোথায়! মালবিকার বাপের বাড়িতে খোঁজ নিতে হবে। এছাড়া আর কোথায়ই বা যাবে!
**************************************
দিয়ার মনখারাপের কারণ ও কাউকে বলতে পারে না। প্রতিবার পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর সময়ে বাড়িতে একটা হুলুস্থূল বেঁধে যায়। বিশেষ করে ওর অংকের নাম্বার নিয়ে। সব সাবজেক্টেই ওর একটা গড়পড়তা নম্বর থাকে। তবে অংকের নাম্বার দিনের পর দিন খারাপ হয়েই চলেছে ওর। নাইন থেকে টেনে উঠল ও এবার। অংকে পঞ্চাশ পেয়েছে মোটে। বাড়িতে ওর সব দাদা দিদিরা তাবড় তাবড় রেজাল্ট করেছে। এবার সবাই দিয়ার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। ওর মায়ের প্রেসার ক্রমশ হাই হচ্ছে দিয়ার চিন্তায়। বাবার অবস্থাও তথৈবচ। আগের বছর ওকে সুবীর স্যারের অংকের কোচিং-এ দেওয়া হয়েছিল। সুবীর স্যারের খুব নামডাক। স্যার নিজে দারুন ছাত্র ছিলেন । খুব ভালো চাকরিও করতেন।তবে চাকরি ছেড়ে দশ বছর ধরে শুধুই টিউশন পড়ান। টিউশনের আয় অনেক বেশি।একেকটা ব্যাচে অন্তত পঞ্চাশজন করে স্টুডেন্ট ওনার।সেখানে পড়েও দিয়ার কোনো লাভই হল না। দিয়ার মা কাকলি বললেন, “ওর মাথায় গোবর ঠাসা গোবর!ওর দ্বারা কিস্যু হবে না।“ দিয়া বোঝে না অংক না পারলে কি জীবনে কিছুই হয় না! ও যে এত ভালো নাচ করে সেটা কি কিছু না! ওর তো ইচ্ছে ও নাচ নিয়েই এগোবে। মুখচোরা দিয়া একবার মাকে কথাটা বলেওছিল। মা বলেছিল, নাচ শিখলেই প্রফেশনাল ডান্সার হওয়া যায় না। ওসব লাইনে যেতে গেলে ট্যালেন্ট ছাড়াও আরো অনেক কিছু লাগে। ওসব বাদ দিয়ে পড়াশুনায় মনে দিতে। পড়াশুনার লাইনটাই সবচেয়ে ভালো। মায়ের বরাবর স্বপ্ন ওকে আইয়াইটিতে পড়ানোর। তবে ওর অংকের মাথা দেখে সে চিন্তা মাথা থেকে বাদ গেছে। ওর বাবা মা আজকাল বলছে,দিয়াকে শেষমেশ লোকের বাড়ি বাড়ি রান্না করে খেতে হবে। হ্যাঁ, রান্নাটাও দিয়ার একটা প্যাশন। মাত্র পনেরো বছর বয়সের মধ্যেই ও পোলাও মাংস,চিংড়ির মালাইকারি,চকোলেট কেক এসব রান্না শিখে নিয়েছে। এছাড়া টুকটাক রান্না তো আছেই। সময় পেলেই ও রান্নাঘরে গিয়ে এটা ওটা এক্সপেরিমেন্ট করে।ওর রান্নার স্বাদগুলোও খুব অন্যরকম ভালো হয়। যে কারো হাতে এমন স্বাদ খোলে না। ভগবান কাউকে কাউকে এমন রান্নার হাত দিয়ে পাঠান। তবে যতই যাই হোক, অংক না পারলে জীবনে কোনো কিছুরই কোনো মূল্য নেই।
সেদিন বিকেলে মন খারাপ করে বসেছিল দিয়া । ক্লাস টেনের পড়াশোনা সবে শুরু হয়েছে। এই বছরটা নাচ বন্ধ ওর। চুপচাপ বসে গান শুনছিল ও। ডিভিডি প্লেয়ারটা থেকে ভেসে আসছে এক আবেগময় কণ্ঠ “যা কিছু জীর্ণ আমার,দীর্ণ আমার জীবন হারা, তাহারি স্তরে স্তরে পড়ুক ঝরে সুরের ধারা… ”এমন সময় ঝিলম এলো। ঝিলম ওদেরই ফ্ল্যাটের পাঁচতলায় থাকে। দিয়াদের ফ্ল্যাটটা তিনতলায়। দিয়া আর ঝিলমের ভারী বন্ধুত্ব। ঝিলম এবার টুয়েলভে উঠেছে। ঝিলমকে দেখে দিয়া বলল, “আয় বোস।” ঝিলম বলল, “ আহা!গানটা শুনেই মনটা যেন জুড়িয়ে যায়।গলাটা চেনা চেনা লাগছে। কে গাইছে রে?”
-“মালবিকা দাশগুপ্ত। ওনার রবীন্দ্রসংগীতের নতুন অ্যালবাম বেরিয়েছে।”
(ক্রমশ )
© Asmita Roy
—————————————————————-
পরবর্তী পর্ব আসতে চলেছে খুব তাড়াতাড়ি। আপডেট পাওয়ার জন্য পেজের সঙ্গে যুক্ত থাকুন।