#ধারাবাহিক
#ধূসর_রঙের_জলছবি
#অস্মিতা_রায়
(চোদ্দ)
ফোঁসফোঁস করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ফাঁকা ছাদে একাই পায়চারি করছিল অরণ্য।আবাসনের উঁচু ছাদ থেকে আলো ঝলমলে ব্যস্ত কলকাতা দেখতে ভারী ভালো লাগে।এমন সময় দেখলো, দিয়া আসছে। টকটকে লাল রঙের একটা টপ পড়েছে ও।সঙ্গে হলুদ স্কার্ট।গোধূলি লগ্নের শেষবেলার কমলাভ রঙ ওর লাল-হলুদ রঙের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছে যেন! দিয়া এসেই চোখ পাকালো, “ সিগারেট খাচ্ছ কেন?” অরণ্য ভুরু কুঁচকে বলল, “তাতে তোর কী!”
-“ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।জানো না?”
-“হুঁহ!”
-“হুঁহ আবার কী! ফেলো বলছি সিগারেট!”
অরণ্য ভুরু তুলে বলল, “আমাকে শাসন করা হচ্ছে!”
-“শাসন না, তবে তোমার কিছু হলে আমার যে খুব কষ্ট হবে!”দিয়া কাঁচুমাচু মুখ করে বলল।
-“তাই নাকি! কেন আমি কে হই তোর?”
একথায় দিয়ার মুখে আচমকা যেন লাল আবির ছড়িয়ে পড়লো। ও বলল, “জানি না।” অরণ্য আরেকটা রিং ধোঁয়া ছাড়ল । দিয়া আবার বলল, “তুমি সিগারেট খাও কেন?” অরণ্য বলল, “বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে অভ্যেস হয়ে গেছে। তুই একবার ট্রাই করবি নাকি?” দিয়া চোখমুখ কুঁচকে বলল, “ধুসসস!” অরণ্য বলল, “আরে একবার দেখই না। জীবনে সব কিছুর এক্সপেরিয়েন্স থাকা ভালো। আমি তোকে দীক্ষা দিচ্ছি। আমি হলাম তোর গুরুদেব বুঝলি? এতদিন পড়াশোনা শিখিয়েছি, আজ সিগারেট খাওয়াটাও শিখিয়ে দি।” নিজের আধ খাওয়া সিগারেটটা দিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিল অরণ্য।সেদিকে একবার তাকিয়ে দেখলো দিয়া। সিগারেটের গন্ধটা বড্ড নাকে লাগছে। তার সঙ্গে বাতাসে মিশে রয়েছে ওর প্ৰিয় পুরুষটির গায়ের গন্ধও। অরণ্য দিয়ার অনেকটা কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ছাদে আজ আর কেউ এখনও অবধি ওঠে নি। দিয়া কেমন সন্মোহিত হয়ে গেল। ওর হঠাৎ ইচ্ছে হল, অরণ্যর বুকে নিজের মুখটা গুঁজে দিতে। “কীরে কী হল? আরে এত ভয়ের কিছু নেই। জয় মা বলে একটা টান দিয়ে ফেল।” অরণ্যর কথায় দিয়ার সম্বিৎ ফিরল। সিগারেটটা নিয়ে নিজের ঠোঁটের ফাঁকে ধরল দিয়া। এতে অরণ্যর ঠোঁটেরও ছোঁয়া লেগে রয়েছে। অরণ্য বলল, “নে, এবার টান।” অরণ্যর কথামত ধোঁয়া টেনে খকখক করে কেশে উঠল দিয়া। চোখ দিয়ে জল বেরোচ্ছে ওর। অরণ্য ওর পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মুহূর্তগুলোকে দিয়ার ভীষণই ভালো লাগছে। এভাবে অরণ্যর ছোঁয়া পাওয়ার জন্য ও অনেকক্ষণ ধরে কাশতে রাজি আছে।
কাশির দমকটা কমলে দিয়া বলল, “এবার পুজোয় থেকে যাও না অরণ্যদা!কোনোবার কলকাতায় থাকো না তুমি।” অরণ্য বলল, “পুজোয় বাড়িতে যেতেই হবে। বাবা অপেক্ষা করে।”
-“কাকু, মানে তোমার বাবাও তো কলকাতায় আসতে পারেন পুজোয়। একসঙ্গে সবাই মিলে পুজো দেখবো।”
-“পুজোর সময় আমার বা বাবার, কারোরই বাড়ির বাইরে থাকতে ভালো লাগে না। ছোটোবেলার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা হয়।আর এই বছরটাই হয় তো শেষ আমার পুজোয় বাড়িতে যাওয়া হবে। পরের বছর কোথায় থাকবো না থাকবো তার তো ঠিক নেই।”
-“কেন?”
-“কলেজ শেষ হতে চলল। ক্যাম্পাসিং শুরু হবে। দেখা যাক, কোথায় যেতে হয় এরপর।হয় তো কলকাতার বাইরেই চলে যাবো।”
-“মানে তুমি আর এই ফ্ল্যাটেও থাকবে না তখন?”
-“না।”
দিয়ার বুকটা হঠাৎ মুচড়ে উঠল। ওর খুব কান্না পাচ্ছে। ও এতদিন নিশ্চিন্ত ছিল, অরণ্যর সঙ্গে ওর নিয়মিত দেখা হয়, কথা হয় । তবে এরপর?অরণ্য তো ওকে কোনোদিন ভালোবাসার কথা বলে নি! এখান থেকে চলে যাওয়ার পরে অরণ্য কী আর যোগাযোগ রাখবে ওর সাথে! আর কী কখনও দেখা হবে না ওদের?
-“পাগলী, কাঁদছিস কেন?” অরণ্য দিয়ার চিবুকটা ধরে ওর মুখটা নিজের দিকে তুলে ধরল। দিয়ার চোখে কখন জল চলে এসেছে ও বোঝে নি।অরণ্যর আচমকা ওর চিবুকে স্পর্শ আর ‘পাগলী’ বলে প্রথম এই স্নেহের সম্বোধনে দিয়ার গাল বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়লো। মনে মনে মিনতি করতে লাগলো ও, আমাকে এভাবে একা করে দিয়ে চলে যেও না তুমি!তোমাকে ছাড়া আমার দুনিয়া অন্ধকার!তোমার কাছে আগলে রাখো আমাকে।শক্ত করে জড়িয়ে ধরো আমাকে!শ্বাস বন্ধ করে দাও আমার!
দিয়ার কোনো কথাই অরণ্য শুনতে পেলো না। তবে ওর টুলটুলে মুখটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো ও। হাত দিয়ে চোখের জল মোছাতে গেল দিয়ার। পাখিরা ঘরে ফিরছে। নানারকম সুর তুলে ডাকতে ডাকতে ওদের মাথার উপরের আকাশ দিয়ে কয়েকটা পাখি উড়ে গেল।সন্ধ্যেবেলার গঙ্গার থেকে আসা মনোরম মিঠে হাওয়া বইতে শুরু করেছে। সারাদিন গরমে সেদ্ধ হওয়া পুরো কলকাতাকে এই সময় ভারী আরাম দেয় এই হাওয়া। এই হাওয়া সবার মনেই কমবেশি প্রেম জাগিয়ে তোলে।হয় তো আজ এই মুহূর্তে অরণ্য আর দিয়ার মধ্যেও এই সময় অনেক কথা হয়ে যেত। দিয়ার চোখের জল মোছাতে গিয়ে অরণ্য হয় তো ওকে কিছু বলতো। দিয়া শুনতো কান ভরে সেসব কথা। তবে এমন সময় ছাদের সিঁড়িতে কয়েকজনের পায়ের আওয়াজ আর হইহই শোনা গেল। অ্যাপার্টমেন্টের অনেকেই ছাদে আসছে এখন। এই সময়টায় ছাদে পায়চারি হবে, আড্ডা হবে। অরণ্য তাড়াতাড়ি ওর হাত সরিয়ে নিল। দিয়ার চোখের জল আর ওর মোছানো হল না। দিয়াকে কিছু বলাও হল না। দিয়ার পাশ থেকে তাড়াতাড়ি সরে গেল অরণ্য।
দিয়া পেছন থেকে আবার ডাকলো, “অরণ্যদা!” অরণ্য ঘুরে তাকিয়ে বলল, “কী?” দিয়া বলল,“মালবিকা দাশগুপ্তর সঙ্গে তোমার কথা হল পরে আলাদা করে?” অরণ্য স্থির দৃষ্টিতে তাকালো দিয়ার দিকে। দিয়ার হাত দিয়ে ও মালবিকার কাছে একটা কাগজে নিজের ফোন নম্বর লিখে পাঠিয়েছিল। দিয়া এখন ওকে এই প্রশ্নটা করতেই পারে। তবে ও কী জবাব দেবে! দিয়া আরেকটু এগিয়ে এসে বলল, “মালবিকা দাশগুপ্তই কী তোমার মা?” অরণ্য এবার সত্যি চমকে উঠল। দিয়া বলল, “তুমি আমাকে বিশ্বাস করে বলতে পারো।” অরণ্য বলল, “তুই কিভাবে জানলি?”
-“জাস্ট আন্দাজ। অনেক কিছু টুকরো-টাকরা ঘটনা জুড়ে মনে হল।”
-“কিরকম?”
-“ এই যেমন তোমার টাইটেল দাশগুপ্ত। উনিও নিজের টাইটেল দাশগুপ্ত ইউজ করেন। তাছাড়া মহালয়ার দিন তুমি ওনাকে একটা চিরকুট পাঠালে, তাতে তো মনে হলই, হয় তো তুমি ওনাকে পার্সোনালি কোনোভাবে চেনো। আর… ”
-“আর?”
-“ছাড়ো।”
-“বল!”
-“রাগ করবে না তো?”
-“রাগ করার মতো কী আছে?”
দিয়া কাঁচুমাচু মুখে অরণ্যর দিকে চেয়ে বলল, “ সেই যে সেদিন দুপুরে আমি তোমার ঘরে গেছিলাম, সেদিন তুমি ঘুমিয়ে পড়ার পরে আমি তোমার টেবিলের উপর রাখা ডাইরিটা পড়ে দেখেছিলাম। ওখানে দেখেছিলাম, তুমি অনেকবার লিখে রেখেছো, মালবিকা দাশগুপ্তর সঙ্গে দেখা করতে চাও।”
একথা শুনে অরণ্যর শান্ত, স্মিতহাস্য মুখটা বদলে গেল। কপালের শিরা ফুলে, মুখ রাগে লাল হয়ে গেল। অ্যাপার্টমেন্টের কয়েকজন এসে ছাদে হাঁটতে হাঁটতে ওদের দিকে বারবার তাকাচ্ছে। এখানে আর কেউ না থাকলে, অরণ্য হয় তো দিয়াকে একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিতো। অতিকষ্টে নিজেকে সংযত করে অরণ্য বলল, “তুই আমার ডায়েরী পড়েছিস! এত আস্পদ্ধা তোর! নিজের অধিকার বুঝিস না !” অরণ্যর মুখ দেখে দিয়া ভয় পেয়ে গেল। অরণ্যকে এতটা রেগে যেতে দিয়া আগে কখনও দেখে নি।
স্তিমিত গলায় দিয়া বলল, “তুমি সেদিন কষ্ট পাচ্ছিলে স্নেহার জন্য। বলেছিলে তোমার ফ্যামিলির কারণে স্নেহা নাকি তোমার সঙ্গে ব্রেকাপ করেছে। ফ্যামিলিতে কী সমস্যা সেটা তুমি আমাকে বলো নি। তবে আমার জানতে ইচ্ছে করছিল। তোমার ডাইরিটা দেখতে পেয়ে পড়েছিলাম।তাই থেকে তখনই আন্দাজ করতে শুরু করেছিলাম।” অরণ্য হাত তুলে বলল, “থাক, এসব ভুজুঙ ভাজুঙ কৈফিয়তের কোনো দরকার নেই। তোকে আমার ব্যাপারে সব জানার অধিকার কে দিয়েছে?” দিয়া বলল, “ কেউ দেয় নি। তবে তোমার ব্যাপারে না ভেবে আমি পারি না। আমাদের ক্লাবের মিটিং-এ মালবিকা দাশগুপ্তর নামটা আমিই রেকমেন্ড করেছিলাম প্রোগ্রামের জন্য। তোমার ওনার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছেটা আমি পূরণ করতে চেয়েছিলাম।”
(ক্রমশ)
© Asmita Roy