ধূসর_রঙের_জলছবি #অস্মিতা_রায় (পনেরো)

0
206

#ধারাবাহিক
#ধূসর_রঙের_জলছবি
#অস্মিতা_রায়
(পনেরো)
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলো দিয়া। আগত যৌবনের লাবণ্য ওর শরীরকে আসতে আসতে আলিঙ্গন করে নিচ্ছে। ওর ধারালো মুখশ্রী, ওর লম্বা ঘন চুল, ওর নির্মেদ স্বাস্থ্য সব মিলিয়ে ওর রূপের খ্যাতি পরিচিত এলাকায় ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। ফুল ফুটলে যেমন পতঙ্গ আসে, তেমনই আজকাল অনেক অনেক ছেলের কাছ থেকে প্রেমের প্রস্তাব পাচ্ছে দিয়া। ছেলেদের মুগ্ধ দৃষ্টি ঘোরাফেরা করে ওর দিকে।এদিকে গত বছর তিনেক ধরে ও একজনকেই মন দিয়ে বসে আছে। আশেপাশের কোনো ছেলেকে ওর তেমন স্মার্ট লাগে না, ব্যক্তিত্বপূর্ণ মনে হয় না যতটা অরণ্যকে মনে হয়। তবে ইদানিং ও ভাবছে, অরণ্যই পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ভালো ছেলে তা তো আর নয়! যে ছেলে আলটিমেটলি ওকে পাত্তাই দেয় না, তার থেকে দিয়াও নিজের মন সরিয়ে নেবে। দিয়া নিজেও ফেলনা নয়। সেদিন ছাদে অরণ্যর সঙ্গে দাঁড়িয়ে ও একটু বেশি ইমোশনাল হয়ে গেছিল। অরণ্য ওকে স্পষ্ট ভাষায় বলেছে সেদিন, দিয়া নাকি অরণ্যর জীবনে অতিরিক্ত নাক গলাচ্ছে। নেহাত অভদ্র ব্যবহার করে না মানে এই নয় যে ও দিয়াকে অতো অধিকার দিয়ে রেখেছে। দিয়া যেন নিজের বাউন্ডারী ক্রস না করে। দিয়ার ক্লাস টুয়েলভের এক্সাম হওয়া অবধি দিয়ার সঙ্গে অরণ্যর সম্পর্ক।
এসব শুনে কষ্ট পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুব অপমানিতও হয়েছে দিয়া। ছাদ থেকে নেমে ঘরে এসে গোপনে অবিরাম চোখের জল ফেলেছিল ও সেদিন। সারারাত বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছটফট করছিল। প্রেমের অনুভূতি এতদিন ওর মনটাকে খুশিতে ভরিয়ে রেখেছিল। এক তরফা প্রেম হলেই বা কী! তবে সেদিন বুঝেছিল, প্রেম থেকে মানুষ এত কষ্ট কেন পায়!
এরমধ্যে অরণ্য বাড়ি চলে গেল পুজোয়। পুরো পুজোটা দিয়ার এত বাজে কাটলো, যে আর বলার নয়। ভেবেছিল, পুজোর দিনগুলোও পড়াশোনা করেই কাটিয়ে দেবে। তবে পড়াশুনাতেও মন বসে না আর! সারাক্ষন অরণ্যর বলা কথাগুলোই কানে বাজছে।ভয়ে ভয়ে অরণ্যকে একবার ফোন করেছিলো দিয়া। অরণ্য ফোন কেটে দিয়েছে। এতটা অ্যাভয়েড কোনোদিন অরণ্য করে নি দিয়াকে।দিয়ার বাবা-মা ওর ভাবভঙ্গি দেখে কিছু আন্দাজ করে ওকে বারবার জিজ্ঞেস করেছে, ওর কী হয়েছে। দিয়া এড়িয়ে গেছে।
কলেজে গিয়ে ঝিলমের একখানা বয়ফ্রেন্ড হয়েছে। সারাক্ষন দুজনে যেন ফেভিকলের মতো চিপকে থাকে। সিনেমাহল, গঙ্গার ধার, ভিক্টোরিয়া, কেএফসি সমস্ত জায়গা সারাক্ষন দুজনে মিলে চষে বেড়ায়। বাড়ি এসেও সারাক্ষন ফোনে কথা তো আছেই। দিয়ার সঙ্গে গল্প করতে গিয়েও নিজের বয়ফ্রেন্ডের ফোন রিসিভ করে ওর সঙ্গেই বিজি হয়ে যায় ঝিলম। মাঝে মাঝে দিয়া বিরক্ত হয়ে বলে, “এত কী বকিস সারাক্ষন! মাথা ব্যথা করে না রে!” ঝিলম বলে, “তুই নিজে যখন প্রেম করবি তখন বুঝবি।” দিয়া বলে, “আমি কোনোদিন এত বকবক করতে পারবো না।”
-“তোর প্রেম তাহলে কেমন হবে? নির্বাক প্রেম ?”
-“ হুঁহ! আমার আবার প্রেম!আদৌ কোনোদিন হবে কিনা!”
-“কেন রে? কদিন বাদে কলেজে যাবি, প্রেম তো হবেই।“
-“কলেজে গেলেই প্রেম হবে বুঝি!”
-“হ্যাঁ, কত ভালো ভালো ছেলে আসবে লাইফে। যে কোনো একজনের সঙ্গে প্রেম করে নিবি।”
একথার উত্তর না দিয়ে দিয়া শুধু হাসল। ঝিলম ওকে ঠেলা দিল, “তুই আবার ওয়ান ম্যান ওম্যান থিওরি আঁকড়ে রাখিস না কিন্তু! ওসব বোগাস কনসেপ্ট! অরণ্য পাত্তা দেয় না তো কুছ পরোয়া নেহি, ওর থেকে ভালো কাউকে জোগাড় করে ওকে দেখিয়ে দিবি।”দিয়া বলল, “এর মধ্যে অরণ্যর কথা কোথা থেকে এলো!আমি তো তোকে কিছু বলি নি!” ঝিলম বলল, “বুঝি রে বুঝি! তুই কিছু না বললেই বা কী! তোর মুখ দেখে যদি তোকে এটুকুও না বুঝি, তাহলে আর কিসের বন্ধু এতদিনের।অরণ্য আমাদের দুজনেরই ক্রাশ ছিল ঠিকই,তারপর অরণ্য তোর প্রেম হয়ে গেছে।” দিয়া ঝরঝর করে ঝিলমের হাত ধরে কেঁদে ফেলল। বলল, “ও কেন আমাকে বোঝে না রে, যে আমার কত কষ্ট হয়! কেন এত অ্যাভয়েড করে যায় আমাকে সব সময়? আমি কি এতই খারাপ?”
-“তোকে কেউ কখনও খারাপ বলতে পারে! দেখ, অরণ্য ইজ অলসো ভেরি গুড লুকিং, ব্রিলিয়ান্ট এন্ড ডাশিং। ওকে দেখে যে কোনো মেয়ে প্রেমে পড়বে। তা’বলে নিজেকে পুরোপুরি ভাসিয়ে দিস না প্রেমে। জোর করে প্রেম হয় না।”দিয়া হতাশ ভাবে মাথা নেড়ে বলল, “পড়াশুনায় একদম মন বসছে না। এক্সাম ভীষণ খারাপ হবে।”
লক্ষীপুজোর এক সপ্তাহ পেরোনোর পরে অরণ্য পড়াতে এলো দিয়াকে। মুখ ভীষণ গম্ভীর। দিয়ার অবস্থা সেই প্রথম দিনের মতো। কিছুই মাথায় ঢুকছিল না ওর।যা পড়েছিল, সেসব মাথা থেকে উড়ে গেছে।শূন্য দৃষ্টিতে দিয়া বইখাতার দিকে তাকিয়ে ছিল । এমন সময় কাকলি ঘরে ঢুকে বলল, “অরণ্য আর চার-পাঁচ মাস পরেই তো দিয়ার পরীক্ষা। কেমন বুঝছো ওকে?”অরণ্য ওর ঘন কালো ভুরু দুটো কুঁচকে তাকালো দিয়ার দিকে। কাকলিকে বলল, “অবস্থা খুব একটা ভালো বলবো না। কয়েকটা দিন ওকে নিয়ে একটু বেশি বসতে হবে মনে হচ্ছে।” কাকলি বলল, “তোমার কি সময় হবে?” অরণ্য বলল, “যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে, তাহলে আমিও নিজের বইখাতা নিয়ে আসবো। দিয়ার সঙ্গে আমিও পড়বো।” “ না না! কোনো আপত্তি নেই, তুমি তো আমাদের ঘরেরই ছেলে!” বলে উঠল কাকলি।
সেদিনের পর থেকে প্রায় রোজ কলেজের পর সন্ধ্যাবেলা করে অরণ্য চলে আসতে লাগলো দিয়ার কাছে। এতদিন অবধি দিয়ার সঙ্গে অনেক কিছু নিয়ে গল্প করতো পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে অরণ্য। তবে এখন সেসব সম্পূর্ণ বন্ধ। কঠিন মুখ করে রাত দশটা সাড়ে দশটা অবধি অরণ্য দিয়ার সামনে বসে থাকায় দিয়া ক্রমশ হাঁফিয়ে উঠতে লাগলো। তবে দিয়াকে অন্যমনস্ক হওয়ার সুযোগও আর দেয় না অরণ্য। একটু অন্যমনস্ক বুঝলেই এমন বড়োবড়ো চোখ করে তাকায় যে দিয়ার পেটের ভিতর নাড়িভুঁড়ি লাফাতে থাকে।
দিয়াকে পড়িয়ে, নিজে পড়ে অরণ্য যখন নিজের ঘরে ফেরে, তখন দিয়ার মা প্রায়দিনই বলে রাতে খেয়ে নিতে। তবে অরণ্য কোনোদিনই রাজি হয় না। এদের সঙ্গে সে আর নিজেকে জড়াবে না। তবে ও চায় না, ওর কারণে কোনোরকম মানসিক চাপের জন্য দিয়ার পড়াশোনার কোনো ক্ষতি হোক। এই বয়সটা বড্ডো স্পর্শকাতর। দিয়ার যেন কোনো ক্ষতি না হয় কোনোদিক থেকেই। তাই দিয়ার দিকে ও একটু বেশিই সজাগ দৃষ্টি রাখে। নিজের সামনে বসেই দিয়াকে পড়া তৈরি করায়, প্র্যাক্টিস করায়।
এক এক করে দিয়ার পরীক্ষা হল। পরীক্ষার রেজাল্টও বেরোলো।যথারীতি ক্লাস টেনের মতো টুয়েলভের রেজাল্টও খুব ভালো হল দিয়ার। বাড়িতে খুশির আমেজ। দিয়া কাকলিকে বলল, “আমি আইয়াইটিতে পড়ার যোগ্য নই মা। আমি এবার ফিজিক্স নিয়ে পড়তে চাই।” কাকলি বলল, “ তুই আরেকবার জয়েন্টে বসে দেখ। আইয়াইটি না হোক, ভালো কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ তো হতে পারে।“ দিয়া বলল, “আমি ফিজিক্স নিয়ে পড়ে টিচার হতে চাই। আমার মতো যারা ছোট থেকে সায়েন্সকে ভয় পেয়ে এসেছে, তাদের ভয় আমি ভাঙাতে চাই।” প্রতাপ বলল, “ যে ভাবে অরণ্য তোর ভয় কাটিয়েছে, তুই এখন অন্যদের ভয় কাটাতে চাস?” অরণ্যর নামটা শুনে দিয়া একটু উদাস হয়ে গেল। কোনো উত্তর দিল না। যতই অরণ্যকে ও ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করুক, ও মন থেকে বিশ্বাস করে অরণ্য আসলে ওর পিলারের মতো। অরণ্যকে ছাড়া ও চলতে পারবে তো! কেন যে সেদিন বোকার মতো ডায়েরি পড়ার কথাটা অরণ্যকে বলতে গেল! অরণ্য যে এতটা বিগড়ে যাবে সেটা দিয়া বোঝে নি।
প্রতাপ আবার বলল, “তোর রেজাল্ট বেরোলো, তাও অরণ্য আসলো না তো? তোর পরীক্ষা অবধি তো এত সময় দিল!তোদের মধ্যে কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?” দিয়া বলল, “না, সমস্যার কী আছে!” প্রতাপ বলল, “আচ্ছা শোন, তোর কলেজ শুরু হওয়ার আগে কোথাও একটা ঘুরতে যাবো ভাবছি। অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয় নি।তুইই বল, কোথায় যাবি?”দিয়া বলল, “ভেবে জানাচ্ছি।”
একদিন দুপুরবেলা পাড়ার দোকান থেকে ফিরছিলো দিয়া। রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাঁকাই ছিল। এমন সময়ে ঝিলম ডাকলো পেছন থেকে। দিয়া ঘুরে তাকিয়ে দেখলো, ঝিলমের পাশে ওর বয়ফ্রেন্ড রাতুল আর রাতুলের বন্ধু আবির দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের সঙ্গেই ভালোমতো আলাপ আছে দিয়ার। আবিরের যে দিয়ার প্রতি একটা ব্যাথা আছে, সেটা দিয়া ভালোই বোঝে । আবির ছেলেটা বেশ ভালো।
ঝিলম বলল, “আবির তোকে কিছু বলতে চায়।” দিয়া আবিরের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো। ঝিলম বলল, “তোরা কথা বল, আমরা একটু দুরে যাচ্ছি।” দিয়া কিছু বলার আগেই রাতুল আর ঝিলম সরে গেল। আবির আমতা আমতা করে বলল, “ দেখ দিয়া, তুই হয় তো বুঝিস যে আমি…মানে আমার তোকে খুব ভালো লাগে, মানে এটাই বলতে চাইছি যে..”
আবিরকে তোতলাতে দেখে দিয়া ফিক করে হেসে ফেলল। দিয়াকে হাসতে দেখে আবির একটু সাহস করে দিয়ার হাতটা ধরল। বলল, “ তোর অ্যানসারটা কী?” হঠাৎ করে এরকম হাত ধরে নেওয়াটা দিয়ার মোটেই পছন্দ হল না। একটু হাসলেই কি সেটা গ্রিন সিগন্যাল মনে করতে হবে নাকি! দিয়া বিরক্তির সঙ্গে কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে দেখলো একটু দূরেই অরণ্য দাঁড়িয়ে ওদের দেখছে। ওর মুখের ভাব দেখে মনের ভাব বোঝার উপায় নেই। দিয়ার হঠাৎ অরণ্যর উপরে ক্ষোভ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। কী মনে করে কী অরণ্য নিজেকে! এত কথা শোনানো, এত দিন ধরে এড়িয়ে চলা, উদাসীন ব্যবহার…এমনকি রেজাল্ট বেরোনোর পরেও দিয়ার সঙ্গে দেখা করতে আসে নি ও। বাইরে বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তখনই নাকি শুকনো দু’একটা কথা বলেছে। ওকে অনেকবার করে বাড়িতে আসতে বলা হয়েছে, ও এড়িয়ে গেছে।
আবিরের হাতটা নিজের হাতের উপর থেকে সরাতে গিয়েও সরালো না দিয়া। হাসি মুখে তাকিয়ে রইল আবিরের দিকে।

(ক্রমশ)

© Asmita Roy

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here