ধূসর_রঙের_জলছবি #অস্মিতা_রায় (সতেরো)

0
219

#ধারাবাহিক
#ধূসর_রঙের_জলছবি
#অস্মিতা_রায়
(সতেরো)
দিল্লী থেকে নন্দাদেবী এক্সপ্রেস দেরাদুন শহরে পৌঁছনোর পর বাসস্ট্যান্ডের একটু কাছে দাঁড়িয়ে সকালের চা বিস্কুট খাচ্ছিলো সবাই মিলে।একটা আর্টিগার সঙ্গে দরদাম করছিল প্রতাপ। এমন সময়ে অরণ্য বাসস্ট্যান্ড থেকে খবর আনলো, একটা বাস এখুনি ছাড়বে। কাকলি বলে উঠল,”আমি বাসে যেতে পারবো না বাপু!” অরণ্য বলল, “পাহাড়ে বাসে চড়ার কিন্তু আলাদাই মজা। দেখবেন, বাঁকগুলো যখন নেবে, খুব থ্রিলিং লাগে!”
শেষমেষ ঠিক হল সবাই মিলে বাসে করেই যাওয়া হবে। বাসটার ভেতরে সমান্তরাল ভাবে দুই সারিতে সিট বিন্যস্ত। একদিকের সারিতে তিনটে করে সিট, আরেকদিকে দুটো করে। কাকলির মাথা ঘুরবে বলে সে জানালার ধারেই বসতে চাইলো। তাই তিনটে সিটের জানলার ধারে বসল কাকলি, মাঝখানে দিয়া, তার পাশে অরণ্য। তার পাশেই টু সিটারে পাশাপাশি শুভেন্দু আর প্রতাপ। এখানে এসেও দিয়া আর অরণ্যর মধ্যে গুমোট ভাব কাটে নি। পাশাপাশি বসেও দুজনে চুপ করে রইলো। একটা জিনিস বুঝছে অরণ্য, দিয়া আর ওর মধ্যে যাই হয়ে থাকুক, ওদের দুজনের বাবার ওদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য বেশ আগ্রহ আছে।ইচ্ছে করেই ওদের দুজনকে পাশাপাশি বসানো হল।ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে কিনা বোঝে না অরণ্য। ওর নিজের বাবা-মায়ের সম্পর্কে কোনো গভীরতা ছিল না। ওরা দুজনেই ওকে আলাদা আলাদাই ভাবে একই কথা বলেছে, বর্তমানে বাঁচতে। কোনো সম্পর্কের ভবিষ্যত কী সেটা কেউই আগে থেকে বলতে পারে না। এদিকে দিয়ার বাবা-মা আর পাঁচটা স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর মতোই ঝগড়া, মান-অভিমান, ভালোবাসা, বোঝাপড়া সব কিছু মিলিয়েই এত বছর একসঙ্গে জার্নি করে এসেছে ।ওরা সম্পর্ক ধরে রাখায় বিশ্বাসী। একথা অনস্বীকার্য,অরণ্য দেখতে যেমন সুন্দর , তেমনই ওর ক্যারিয়ারও প্রমিসিং। সেই কারণেই মেয়ের ভবিষ্যত চিন্তা করে অরণ্যকে হয় তো সুপাত্র হিসেবে ওরা হাতে রাখতে চাইছে।
এদিকে দিয়ার ব্যবহার খুব আরষ্ট হয়ে রয়েছে। অরণ্যর সঙ্গে কথা বলছে না কোনো। অরণ্যও নিজে থেকে কোনো কথা বলে নি। অরণ্য বুঝতে পারছে, চোরা চোখে বারবার ওকেই দেখছে দিয়া। আবার ওর সঙ্গে চোখাচোখি হলেই চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। এর থেকে অরণ্যর কাছে স্পষ্ট, দিয়ার ওর প্রতি ফিলিংস এখনও পুরোদস্তুর আছে। সেদিনের সেই ছেলেটা জাস্ট ভাঁওতা। এবার, দিয়ার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা হওয়ার পরে কোনোভাবে হয়ে যদি ভেঙে যায়, তাহলে তো এরা সবাই কষ্ট পাবে! নিজের ভেতরের কালো স্বত্তাটাকে অরণ্য চিনতে পেরেছে অনেকদিন আগেই।
বাস চলতে শুরু করল। উত্তরাখন্ডে এসে ওদের প্রথম গন্তব্য মুসৌরি। দেরাদুন শহর তাও অনেকটাই সমতল, তবে মুসৌরির দিকে বাস যত উঠতে শুরু করল, ততই রাস্তা খাড়াই, আর তেমন বাঁক। ড্রাইভারটার বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। তবে স্ট্যামিনা সাংঘাতিক। সামনের দিকের যাত্রীদের সঙ্গে বকবক করতে করতে কী স্পিডে চালাচ্ছে গাড়ি! ফোনটা বের করে স্পিডোমিটার অ্যাপটা দেখলো অরণ্য। স্পিড লেভেল সত্তরের কাছাকাছি। পাহাড়ের বাঁকগুলোতেও স্পিড কম করার কোনো নাম নেই। বাসের গতির তালেতালে যাত্রীরাও ক্রমশ এদিক ওদিকে হেলে পড়ছে। দিয়া খুব মজা পেয়েছে।বাঁক নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দিয়া শিশুর মতো উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠছে। অরণ্য আর দিয়ার ধাক্কাধাক্কি হচ্ছে বারবার। এমন সময়ে ঘটল একখানা কান্ড। দিয়া হঠাৎ কিছুটা ওয়াক তুলে পেট থেকে কিছুটা জল বের করে দিল ওর সামনের দিকে। অরণ্য রেডিই ছিল। পাহাড়ে উঠলে একখানা প্লাস্টিকের প্যাকেট ও নিজের প্যান্টের পকেটে রেখেই দেয়। অপ্রস্তুত, লজ্জিত দিয়ার দিকে ও প্লাস্টিকটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এটা হাতে নে। বমি হলে করে ফেল।” দিয়া প্লাস্টিকটা হাতে নিতেই গাড়িটা আবার বাঁক নিল। দিয়ার মাথাটা এসে ধাক্কা খেল অরণ্যর বলিষ্ঠ কাঁধে। তার সঙ্গে দিয়ার পেট থেকে আগের রাতে খাওয়া রুটি তরকারি বমি হয়ে বেরিয়ে এসে অরণ্যর জ্যাকেটে পড়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে প্লাস্টিকের ব্যাগে বাকি বমিটা সারলো দিয়া। এর মধ্যেই বাস মুসৌরির বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে গেল।
বাস থেকে নেমে সবার আগে দিয়ার দিকে জলের বোতল এগিয়ে দিল অরণ্য। বলল, “মুখটা ভালো করে ধুয়ে নে।“ দিয়া ভীষণ লজ্জিতভাবে অরণ্যর জ্যাকেটের দিকে তাকালো। ওর এমন কাজের জন্য কী বলবে ভেবে পেলো না। অরণ্য সেটা বুঝতে পেরেই বলল, “এমনটা হতেই পারে। লজ্জার কিছু নেই। আমিও তোর গায়ে বমি করে দিতে পারতাম। তুই মুখটা ধুয়ে নে। আমিও জ্যাকেটটা ধুয়ে নিচ্ছি।” গা থেকে জ্যাকেটটা খুলল অরণ্য। কাকলি বলল, “জ্যাকেটটা তুমি দিয়ার হাতে দাও। ওর বমিটা ওই নিজে হাতে পরিষ্কার করে দিক।” প্রতাপ বলল, “মাথা ঘোরার ভয় তুমি পাচ্ছিলে কাকলি, আর বমি হল দিয়ার?”
নিজে পরিষ্কার হয়ে অরণ্যর জ্যাকেটটা হাতে নিল দিয়া। অরণ্য জিজ্ঞেস করল, “এখন শরীর ঠিক লাগছে? নাকি মাথা ঘুরছে?” অরণ্যর জ্যাকেট থেকে নিজের বমিটা পরিষ্কার করে দিতে দিতে দিয়া বলল, “না, ঠিক আছি। বাসটা থামতেই ঠিক হয়ে গেল।“
-“হম, জাস্ট মোশন সিকনেস। ড্রাইভারটা গাড়িও চালিয়েছে বিশাল জোরে। বাস হওয়ায় আরো প্রবলেমটা হয়েছে। আর্টিগাটায় এলে এতটা অসুবিধা হত না।আমার কথাতেই বাসে ওঠা হল।সরি।“
-“আমি তোমার জ্যাকেটটা কেচে দিই?”
-“এমা! নানা!কাচার কী আছে? ধুয়ে দিয়েছিস তো! ওতেই হবে। শুকোনোরই বা টাইম কখন!”
-“যেটুকু নোংরা হয়েছে, সেটুকুই একটু সাবান ঘষে দেবো। ফ্যানের হাওয়ায় একটু রেখে দিলে শুকিয়ে যাবে।”
এর মধ্যে কিছু কুলি এগিয়ে এসেছে। শুভেন্দু দরদাম করে দুজনকে নিল। ওরা জিনিসপত্র কাঁধে মাথায় তুলে নিতে ওরা সবাই হোটেলের দিকে এগোলো। হোটেলটা বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছুটা দূরই আছে। চড়াইউৎরাই বেয়ে হোটেলে পৌঁছতে ওদের প্রায় মিনিট কুড়ি মতো লেগে গেল।মুসৌরিতে আজ রোদ ওঠে নি। মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া নিয়ে পাহাড়ের রানীর আজ মুখ ভার।
হোটেলের লাউঞ্জে পা রাখতেই দিয়ার মনটা ভারী ভালো হয়ে গেল। এমন হোটেল ছবিতেই দেখেছে আগে।ইংরেজদের বানানো শহরের সঙ্গে মিল রেখে ইংরেজ ধাঁচেই হোটেলখানা বানানো।কাঠের তৈরি ডিজাইনার সব ফার্নিচার।এক পাশে একটা খুব সুন্দর দোলনা ঝুলছে।রিসেপশন টেবিলটার মুখোমুখি বিরাট বড়ো জায়গাটায় একখানা বিলিয়ার্ডের কোর্ট রাখা আছে। দিয়া এগিয়ে গিয়ে বিলিয়ার্ডের স্টিকটা তুলে একটা বল কোর্টে পাঠানোর চেষ্টা করল। যতটা সহজ মনে হয় খেলাটা, ততটা একদমই নয়। বল কিছুতেই জায়গা মতো ফেলা যায় না। এদিক ওদিক সরে যাচ্ছে বলগুলো।স্টিকটা নামিয়ে রেখে সামনে তাকিয়ে দেখলো দিয়া। একটা বোর্ডে লেখা আছে এই হোটেলে থাকার ফেসিলিটি কী কী। ও দেখলো, এক জায়গায় লেখা রয়েছে বন ফায়ার হবে রাত আটটা থেকে। মনটা খুশিতে নেচে উঠল ওর। রাতের পাহাড়ি ঠান্ডা। তার মধ্যে বাইরে সবাই মিলে গোল হয়ে বসে কাঠ-কয়লার আগুন তাপানো, আড্ডা, গান। আচ্ছা অরণ্যদা কি গান গাইতে পারে? ওর মা তো একজন সিঙ্গার। ওর জিনে কি গান থাকবে না?
তখনও ওদের আইডি চেকিং আর রুম নিয়ে কথাবার্তা চলছে। দিয়া হোটেলের একজন কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করল, “ভাইসাব, আপকা ইঁহা বন ফায়ার কাঁহা হোতা হ্যায়?” ছেলেটা ওকে আঙুলের ইশারায় একটা দিক দেখালো। রিসেপশন রুমটার পাশেই একখানা চওড়া বারান্দা। দিয়া এসে দেখলো, এখান থেকে মেঘে আছন্ন পাহাড়ের চূড়াগুলো দেখা যাচ্ছে। অদুরে একজন লোক স্ট্যান্ডের উপর বড়ো একটা ক্যানভাস বিছিয়ে তুলি টেনে টেনে জলরঙে এই পাহাড়ি দৃশ্যখানা আঁকছে। প্রকৃতির মতো তার ক্যানভাসেও ধূসর রঙের ছোঁয়াই বেশি। এর মধ্যে অরণ্য আর শুভেন্দুও পায়ে পায়ে এসে ওর পাশে দাঁড়িয়েছে। শুভেন্দু বলল, “মেঘে চারপাশটা অনেক ঢেকে আছে। রোদ উঠলে আরো ভালো লাগবে।” অরণ্য বলল, “গুগলের ওয়েদার ফোরকাস্ট দেখাচ্ছে কাল রোদ উঠবে।“ ওদের কথাবার্তা শুনে সেই লোকটি আঁকতে আঁকতে ওদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালো। তারপর বাংলায় বলে উঠল, “আপনারা বাঙালি? নমস্কার। আমার নাম অনিরুদ্ধ।চ্যাটার্জি।” শুভেন্দুও প্রতি নমস্কার করল।অনিরুদ্ধ নামের লোকটির বয়স বছর চল্লিশ হবে। সে আবার বলল, “বাইরে বেড়াতে এসে বাঙালি পেলে কিন্তু খুব ভালো লাগে। সেই জটায়ুর মতোই লাফিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, আপনারা বাঙালি?গত তিনদিন ধরে রয়েছি এখানে। গুজরাটি, রাজস্থানি, জাঠ এদের সঙ্গে আলাপ হল। বাঙালি ফ্যামিলি আপনারাই প্রথম এলেন।” শুভেন্দু বলল, “তিনদিন ধরে এখানে কেন? মুসৌরিতে কি অনেক বেশি কিছু দেখার আছে?”
-“মুসৌরিতে যা আছে সেগুলো আপনাদের দুদিনে দেখা হয়ে যাবে। আমি আসলে এসেছি একটু একা সময় কাটাতে আর ছবি আঁকতে।ছবি আঁকা আমার প্যাশন।”
-“হ্যাঁ, আপনার ছবি তো দেখছি। আপনি মনে হয় এখানকার ল্যান্ডস্কেপটাই আঁকছিলেন তাই না?”
-“হ্যাঁ, এখানে এসে থেকে ওটাই আঁকছি।”
দিয়া বলে উঠল, “আপনার ছবিতে গ্রে কালারটাই বেশি দেখছি। পাহাড় কি তিনদিন ধরেই মেঘে ঢাকা?”
-“হ্যাঁ।”
অনিরুদ্ধর সঙ্গে আরো দু’চারটে কথা বলে ওরা যে যার নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলো।
সবাই মিলে স্নান করে, যখন লাঞ্চ সারা হল, তখন বেলা গড়িয়ে গেছে। সেদিন সাইট সিইং হবে না। সন্ধ্যেবেলা সবাই মিলে হাঁটতে বেরোনো হল কাছের ম্যাল রোডে। গা শিরশিরে একটা ঠান্ডা। পাহাড়ের গা বেয়ে দূরের বাড়িগুলোর আলো ঝিকমিক করছে।পাহাড়ের রানী যেন কালো ল্যাহেঙ্গা পরে তার সঙ্গে মানানসই হিরে খচিত গয়নায় নিজেকে সাজিয়ে তুলেছে। শহরটা বেশ আধুনিক। দোকানে দোকানে কাঠকয়লার আগুন তাপানোর ব্যবস্থা আছে। একটা খাবারের দোকানে ঢুকে সবাই মিলে চিকেন তন্দুরি খেতে খেতে বেশ আড্ডা হল। তারপর আবার হাঁটা। বিভিন্ন দোকানে নানারকম পশরা সাজিয়ে বসে আছে দোকানিরা। একটা দোকানে ঢুকে জ্যাকেট দেখছিলো কাকলি। দোকানটার বাইরে কিছু উলের কুর্তি সাজানো আছে। দিয়া বেরিয়ে এসে সেগুলো দেখছিলো। শুভেন্দু এসে ওকে জিজ্ঞেস করল, “কোনোটা পছন্দ হচ্ছে দিয়া?” দিয়া সলজ্জ ভাবে হেসে বলল, “না আমি এমনি দেখছি। কিছু নেওয়ার জন্য নয়।” শুভেন্দু বলল, “পছন্দ হলে নিয়ে নাও না! আমি দেবো তোমাকে।” অরণ্যও পায়ে পায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রতাপ আর কাকলি দোকানের ভেতরে তখনও। এমন সময়ে শুভেন্দুর চোখ গেল পাশের দোকানে।সেই দোকানের বাইরেও এরকম কিছু কুর্তি ঝুলছে। একজন মহিলা সেই দোকানদারের সঙ্গে দরদাম করছে। মহিলাটির চেহারা আর গলার আওয়াজ খুব চেনা চেনা ঠেকছে! শুভেন্দু আচমকা জোরেই ডেকে ফেলল, “মালবিকা!” শুভেন্দুর ডাক শুনে মালবিকাও ফিরে তাকিয়েছে।
মালবিকা দাশগুপ্ত এখানে! এটা কি কোইন্সিডেন্স! নাকি…অরণ্যর কেমন সন্দেহ হল। দিয়ার দিকে তাকালো ও। দিয়া তখন মুখ নিচু করে খুব মনোযোগ দিয়ে নিজের পায়ের জুতো দেখছে। পাওয়ারের একজোড়া শু কারোর এত মনোযোগ টানতে পারে হঠাৎ করে?

(ক্রমশ)

© Asmita Roy

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here