#ধারাবাহিক
#ধূসর_রঙের_জলছবি
#অস্মিতা_রায়
(আঠারো)
ফাইলটা গুছিয়ে তুলে রাখছিলো মালবিকা নিজের আলমারিতে। যা সন্দেহ করেছিল, সেটাই সত্যি হয়েছে। এমন সময়ে সুধাদি এসে বলল, “দিদিমনি, তোমাকে একটা বাচ্চা মেয়ে ডাকছে।” সুধাদি ওর সঙ্গে সব সময়ে থাকে।অনেক বছর ধরেই আছে ওর সঙ্গে। খুব বিশ্বস্ত। মালবিকা বলল, “কোন বাচ্চা মেয়ে? নাম কী?”
-“নাম বলছে না। চলে যেতে বলবো?”
-“না। পাঠাও ওকে।“
একটু বাদেই মেয়েটা এলো। সুধাদি বাচ্চা মেয়ে বললেও মেয়েটা ততো বাচ্চাও নয়। বছর সতেরো আঠেরো হবে। তবে ঠিক চিনতে পারলো না মালবিকা মেয়েটাকে। মেয়েটা হাতজোড় করে বলল, “নমস্কার ম্যাডাম।আমি আপনার একজন ফ্যান।” মালবিকা বলল, “তোমার নাম কী?”
-“দেবাংশী রায়চৌধুরী।” মেয়েটা মিষ্টি করে হাসল।
চকিতে মনে পড়লো মালবিকার। এই মেয়েটাকেই তো সেদিন টুবলুর সঙ্গে দেখেছিলো ও। সেদিন অবশ্য নাচের সাজে ছিল। আজ শুধু জিন্স আর টপ পরে এসেছে। মুখে একটুও প্রসাধন নেই। এই জন্যই প্রথম দেখে চিনতে পারে নি মালবিকা।মালবিকা বলল, “বসো।“ দিয়া জিজ্ঞেস করল, “চিনতে পেরেছেন?” মালবিকা মাথা দোলাল, “পেরেছি। কী খাবে বলো।”
-“এমা! কিছু খাবো না।“
-“তা বললে কী করে হয়! দাঁড়াও।“ মালবিকা ঝট করে সুধাদিকে কিছু বলে এলো। তারপর সোফায় দিয়ার সামনে বসে বলল, “বলো।“ দিয়া লাজুকভাবে হেসে বলল, “আমি ভাবি নি আমি এসে আপনাকে পাবো। এত সহজে ঢুকতে পারবো।“ মালবিকা বলল,”আমি খুব সাধারণ মানুষ। আমার বাড়িতে আসার জন্য নিয়মের অতো কড়াকড়ি নেই। আর আজ আমার কোথাও কোনো কাজও নেই। তাই বাড়িতেই আছি।” দিয়া কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। ও হঠাৎ করেই এসে পড়েছে একলা একলা কাউকে কিছু না বলে। বুঝতে পারছে না কী বলবে এখন। মালবিকাই বলল, “তুমি কি টুবলুকে নিয়ে কিছু বলতে চাও?”
-“টুবলু! ওহ! অরণ্যদা?”
-“হ্যাঁ।“
দিয়া মাথা নিচু করে রইলো।মালবিকা বুঝতেই পারছে, এই মেয়েটির হঠাৎ করে এখানে এসে পড়ার কারণ টুবলুই।মালবিকাই কথা শুরু করল, “তুমি টুবলুর মুখে আমার কথা কতটা শুনেছো?”
-“শুনি নি তো কিছু!”
-“কিছু শোনো নি? তাহলে?”
-“আমি আন্দাজ করেছিলাম আপনাদের মধ্যে একটা ব্লাড রিলেসন আছে। সেটা ওকে জিজ্ঞেস করতেই ও ভীষণ রেগে গেল।”
-“রেগে গেল?”
-“হ্যাঁ। তারপর থেকে আমার সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে।“
-“তুমি কি ওকে ভালোবাসো?”
দিয়া একটু চুপ করে থেকে বলল, “হ্যাঁ। প্রায় তিন বছর ধরে।ও জানেও সেটা। তবে কোনোদিন এসব ব্যাপার পাত্তা দেয় নি।“
-“তোমার মতো একটা মিষ্টি মেয়েকে পাত্তা দিচ্ছে না? এত ভারী অন্যায়!”
দিয়া মুখ তুলে বলল, “ না না! অন্যায়ের কী আছে! ফিলিংস ব্যাপারটা বোথ সাইড ওয়ার্ক নাই করতে পারে। আই অ্যাম ওকে উইথ দিস।“
-“তাহলে তুমি কী চাইছো আমার কাছে?”
-“ ম্যাডাম, আমি আপনাকে খুব সন্মান করি। এদিকে অরণ্যদাকে আমি যতটুকু চিনি আমার মনে হয় ও মনের মধ্যে একটা ভীষণ অভিমান নিয়ে ঘুরছে। সেই অভিমানটা হয় তো আপনার ওপর।হয় তো ওর মনে কোনো ভুল ধারণাও আছে নিজের মতো করে। আপনি ওর সঙ্গে একবার কথা বলে ওর কষ্টটা দূর করে দিতে পারবেন না?”
-‘আমি! ও একবার এসেছিলো এখানে। কিছু কথাবার্তাও হয়েছে আমাদের। ও বলে নি তোমায়?”
-“না। ও এসব টপিক নিয়ে কিছু বলতেই চায় না। যাই হোক, ও না বললেও আমি আন্দাজ করেছিলাম, নিশ্চয়ই আপনাদের আলাদা করে মিট হয়েছে।“
-“দেন? ওকে তো আমি আমার দিক থেকে সব বক্তব্য খুলে বলেছিলাম।“
-“ম্যাডাম, একদিনের একটা সিটিং-এ তো সব কিছু বোঝা সম্ভব নয় একজনের পক্ষে। আপনারা একটু নিজেদের বেশি করে সময় দিন না! তবে প্লিজ আমার কথা অরণ্যদাকে বলবেন না। তাহলে ও খুব রেগে যাবে। আমার কোনো স্বার্থ নেই এর মধ্যে। আমি শুধু চাই ও ভালো থাকুক। সে ও আমাকে ভালোবাসুক, আর নাই বাসুক।”
মালবিকা ভালো করে মেয়েটাকে দেখলো। ভীষণ মায়াবী মুখখানা। কথাবার্তাও ভীষণ নম্র। তবু এক দৃঢ়তা রয়েছে চরিত্রে। কে বলে এখনকার ছেলে মেয়েদের মধ্যে গভীরতা কম? তারা নাকি ভালোবাসতে জানে না! মালবিকা জীবনে একলা চলার লড়াইতে অনেক পোড় খেয়েছে। ওর অভিজ্ঞ চোখ বলছে, ওর ছেলে এই মেয়েটির হাত ধরলে হয় তো সুখী হবে। মালবিকা বলল, “দেবাংশী, নিজের সন্তানের বড়ো হওয়াতেই আমি ওর পাশে থাকি নি। এখন আমি কিছু করার কে? ওর জীবনে আমি তো একজন নন-এনটিটি! বরং ওকে ভালো রাখতে পারো তুমি!”
-“আমি! আমি কে ম্যাডাম? যতই হোক আপনি ওর মা!”
-“জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না দেবাংশী। জীবনে আমি এক্সপেকটেশনের চেয়ে কিছুটা বেশি সাকসেস পেয়েছি ঠিকই, তবে অনেক কর্তব্যে ফাঁকি রয়ে গেছে। সারাজীবন আমি নিজের কথা ভেবেছি বলে ভগবান হয় তো আমাকে আজ শাস্তি দিচ্ছেন।“
-“শাস্তি!”
-“দাঁড়াও।“ মালবিকা উঠে গিয়ে বেডরুমের আলমারি থেকে ফাইলটা বের করল। ফিরে এসে দিয়ার সামনে মেলে ধরল কিছু মেডিকেল রিপোর্ট। একটা বিশেষ জায়গা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, “দেখো তো, পড়ে কিছু বুঝতে পারো নাকি!”
দিয়া রিপোর্টটা পড়ার পরে মালবিকার দিকে মুখ তুলে তাকাল। মালবিকার মুখে বিবর্ণ হাসি। তারপর…. তারপর দিয়া আর মালবিকার মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে অনেক কথা হল।সেদিন দিয়া কথায় কথায় জানিয়েছিল, এবার অরণ্য আর ওর বাবার সঙ্গে ওরা উত্তরাখন্ড ট্যুরে যাচ্ছে।অরণ্যর বাবাই ওদের এই বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাবটা দিয়েছিলো।দিয়ার কাছে মালবিকা ওদের ট্যুর প্ল্যানটা শুনলো।
তারপর থেকেই ওর মনটা ভারী উত্তরাখন্ডের দিকে টানছিল। জীবনে কোনোদিনই ঠাকুরদেবতা মানে নি ও। এবার ইচ্ছে করছে, কেদারনাথে মহাদেব দর্শন করে আসতে। মালবিকার জীবনে পরিবার বা খুব কাছের বন্ধু তেমন কেউ নেই। সারাজীবন অভিমান করে এক এক করে নিজের কাছের মানুষদের সরিয়ে রেখেছে নিজের জীবন থেকে। পরবর্তীকালে ওর বাবা-মা যোগাযোগ করেছিল। মালবিকা অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ওর খারাপ সময়ে যারা পাশে থাকে নি, জীবনে সাফল্য আসার পর তাদের কারোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চায় না ও। ওদিকে কৌস্তভ দুই ছেলে-মেয়ের বাবা হয়ে এখন পুরোদস্তুর সংসারী।মাঝে মাঝে বৌ বাচ্চা সমেত কৌস্তভ আসে মালবিকার বাড়ি। মালবিকাও যায়। তবে নিজে থেকেই কোথাও একটা গন্ডি টেনে রাখে ও। যদি বিদিশার খারাপ লাগে! নিজের আত্মসম্মানের চেয়ে বড়ো কিছুই নেই ওর কাছে।এছাড়া কাজের জায়গায় মালবিকার কিছু বন্ধু আছে। মাঝে মাঝে ওরা দল বেঁধে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে আসে। এবার আর কাউকে কিছু বলতে ইচ্ছে করল না মালবিকার। একাই বেরিয়ে পড়লো গারোয়াল, কুমায়ুনের উদ্দেশ্যে।
মুসৌরির রাস্তায় মালবিকাকে দেখে এগিয়ে গেল শুভেন্দু। “মালবিকা! তুমি এখানে?আমাকে চিনতে পারছো?” মালবিকা নরম হেসে বলল, “চিনবো না! অনেক রোগা হয়ে গেছো তুমি!কেমন আছো?”
-“কত বছর পরে তোমাকে সামনে থেকে দেখলাম। টিভিতে যদিও মাঝে মাঝেই দেখি।এখানে কি ঘুরতে এসেছো? নাকি কোনো কাজে?”
-“ঘুরতেই।“
-“সঙ্গে আর কাউকে দেখছি না!”
-“একাই এসেছি।“
অরণ্য মন দিয়ে দেখছিলো, এত বছর বাদে দেখা হওয়া দুজন মানুষের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে , দুজনেরই একে অপরের উপর কোনো রাগ নেই। স্নেহার সঙ্গে যদি ওর হঠাৎ দেখা হয়ে যায়, ও পারবে কি এত সহজভাবে কথা বলতে?হয় তো সময় সব তিক্ততাকে ভুলিয়ে দেয়।
এরমধ্যে প্রতাপ আর কাকলিও দোকান থেকে বেরিয়ে এসেছে। মালবিকা দাশগুপ্তকে দেখে ওরা বেশ অবাক হয়ে গেল। শুভেন্দু মুখ ফিরিয়ে ওদের বলল, “এই যে বিখ্যাত সিঙ্গার মালবিকা হল আমার স্ত্রী। আপনাদের অরণ্যর মা। আপনারা জানতেন আগে?” প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে প্রতাপ বলল, “আরে তাই নাকি! কী আশ্চর্য! আমরা তো জানতামই না! অরণ্য তুমি তো আমাদের কখনও বলো নি! তুমি খুব লাকি, তুমি এমন একজন গুণী মায়ের সন্তান।“ অরণ্য কিছু না বলে মুখ নামিয়ে নিল। মালবিকা অরণ্যর দিকে তাকিয়ে বলল, “ও লাকি নয়। ওর যখন এক বছর বয়স, তখন আমি ওকে ছেড়ে, সংসার ছেড়ে চলে গেছিলাম জানেন? আমার হাসব্যান্ডের সঙ্গে আমার বনিবনা হয় নি বলে।সে অনেক কথা।“
এই কথার উত্তরে কী কথা বলা উচিত, সেটা প্রতাপ আর কাকলি বুঝতে পারলো না। কোনোকিছুই বলতে গেলে অনধিকার চৰ্চা হবে। শুভেন্দুই জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখানে এসে কোন হোটেলে উঠেছো?” মালবিকা ওর হোটেলের নাম বলল। কাকলি বলল, “আপনি তো একাই আছেন, আমাদের হোটেলে চলে আসুন না! আপনার ট্যুর প্ল্যান কী আছে? কাল আমরা মুসৌরি ঘুরবো। আপনিও চলুন আমাদের সঙ্গে।“ মালবিকা বলল, “না না! এ হয় না!” শুভেন্দু জোর দিয়ে বলে উঠল, “ কেন হয় না? নিশ্চয়ই হয়।চলো আমি তোমার হোটেল থেকে তোমার লাগেজ নিয়ে আসছি। টুবলু, তোরা হোটেলে যা তো! আমি একটু পরে আসছি।”
হোটেলে ফেরার পরে বাথরুমে ফ্রেশ হতে হতে দিয়া শুনলো, ঘরে বাবা-মা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। প্রতাপ বলল, “ কী আশ্চর্য! মালবিকা দাশগুপ্ত অরণ্যর মা এতদিন জানতেই পারি নি!শুভেন্দুবাবুর সঙ্গে যে ক’বার কথা হয়েছে উনি কলকাতায় আসলে, তখন উনি দু-একবার আলগা ভাবে বলেছিলেন, ওনার স্ত্রীর সঙ্গে অনেকদিন আগেই নাকি ওনার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।”কাকলি বলল, “বেচারা অরণ্য! ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলে। এই জন্য আমি মাঝে মাঝে ওর মধ্যে একটা বিষন্নতা খেয়াল করতাম!”
-“হমম, বাবা-মায়ের ঝামেলায় মাঝখান থেকে ভুক্তভোগী হয় তাদের সন্তানরা।শুভেন্দুবাবুকে তো বেশ সজ্জন লোক বলেই মনে হয়। ওনার স্ত্রী কেন চলে গেলেন কে জানে!“
-“হ্যাঁ সেই তো! সবাইকে কি আর আমি পেয়েছো যে মুখ বুজে সব সহ্য করে যাবে!”
-“আরে এখানে তোমার কথা আসছে কোথা থেকে!”
-“তোমরা পুরুষমানুষরা সবাই একরকম! হাড়-বজ্জাত এক একটা।সজ্জন লোক তো সবাই তোমাকেও ভাবে গো! অথচ বিয়ের পর পর কম জ্বালিয়েছো আমাকে তোমরা! সবার মালবিকা দাশগুপ্তর মতো সাহস থাকে না, নাহলে আমিও কবে পালাতাম সব ছেড়েছুড়ে। মহিলার গাটস আছে। আমার রেস্পেক্ট আসছে ওনার প্রতি।“
-“আরে কী করেছি তোমার সাথে?”
-“জিজ্ঞেস করছো কী করেছো! বলো কী করো নি!”
দিয়ার কানে আসতে লাগলো বাবা, ঠাম্মা, পিসির উপর মায়ের ঝুলিতে যত অভিযোগ আছে, যেগুলো ও ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছে, সব আবার একে একে উপুড় হচ্ছে। দিয়া বাথরুম থেকে বেরিয়ে বলল, “মা, আমি বনফায়ারের ওদিকে যাচ্ছি। তোমরা কখন যাবে?” প্রতাপ তাড়াতাড়ি উঠে বলল, “এই তো, এখুনি যাবো।“ কাকলি প্রতাপের হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিল, “দাঁড়াও। পালাচ্ছ কোথায়? আমার কথা এখনও শেষ হয় নি।“ দিয়া দুদিকে মাথা নেড়ে মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল।
(ক্রমশ)
© Asmita Roy