#ধারাবাহিক
#ধূসর_রঙের_জলছবি
#অস্মিতা_রায়
(উনিশ)
বারান্দাটার মাঝখানে কাঠকয়লার আগুন জ্বালিয়ে আগুন সেঁকছে কয়েকজন। ওদের কথাবার্তা শুনে দিয়া বুঝলো সবাই অবাঙালি। সকালে আলাপ হওয়া অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জীকে দেখা গেলো না । মিউজিক সিস্টেমে গান বাজছে। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে দিয়া খেয়াল করল বারান্দার এক প্রান্তে অরণ্যর সুঠাম লম্বা চেহারাটা। এদিকে পেছন ফিরে একা একা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। হাতে সিগারেট। ওর মায়ের সঙ্গে দেখা হওয়াতে আবার মুড খারাপ হয়ে গেল নাকি! দিয়া এগোলো অরণ্যর দিকে। ঝাড় খাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
দিয়ার পায়ের শব্দে অরণ্যই আগে ঘুরে তাকালো। শান্তভাবেই বলল, “বল!” দিয়া অরণ্যর মুখটা দেখলো ভালো করে। তারপর বলল, “সিগারেট হবে?” অরণ্য সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিল দিয়ার দিকে। দিয়া বলল, “আমি তো ধরাতে জানি না!” অরণ্য বলল, “ঠোঁটে চেপে ধর, আমি জ্বালিয়ে দিচ্ছি।“ দিয়া বলল, “নাহ! তুমি যেটা খাচ্ছ সেটাই দাও। খেলে তোমার এঁটোটাই খাবো, নাহলে ওই বাজে জিনিসটা কেন খাবো?” অরণ্য ওর কথায় হাসল। তারপর বলল, “দিয়া, এই যে তোর এত প্রেম আমার জন্য, এটা কি সত্যি? আমার কেমন অদ্ভুত লাগে!আমি তো ভাবতাম, সাময়িক ভালোলাগা!দুদিনে কেটে যাবে।তবে ব্যাপারটা বেশ অনেকদিন ধরেই আছে দেখছি তোর মধ্যে!”দিয়া বলল, “আমাকে তোমার ফেক মনে হয়? তোমার মনে হয় আমি প্রিটেন করতে পারি!”
-“আরে আমার কাছে প্রিটেন করে তোর লাভই বা কী! তবে এসব ভালোবাসা-টাসা বড়ো জটিল জিনিস। যার প্রতি এক সময়ে তুমুল প্রেম থাকে, একদিন সেই দু’চক্ষের বিষ হয়ে যায়। বা সেটা না হলেও তার প্রতি একটা নির্লিপ্ততা চলে আসে।“
অরণ্যর হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে দিয়া বলল,“পরের কথা জানি না। তবে গত তিন বছর ধরে আমি চেষ্টা করেও তোমার থেকে আমার মন সরাতে পারি নি।“ অরণ্য বলল, “আমাকে বেশি ভালোবাসিস না দিয়া। খুব কষ্ট পাবি।“
-“দেখো, তুমি আমাকে গত কয়েকমাস ধরে এমনিতেই অনেক কষ্ট দিয়েছো। তুমি আমাকে ভালোবাসো আর না বাসো তাতে আমার কিছু যায় আসে না। তবে আমি কী করবো সেটা তোমায় ঠিক করে দিতে হবে না।“
-“জানিস দিয়া, বিয়ের পরে আমার বাবা মায়ের যখন ঝগড়া হতো তখন আমার বাবা নাকি কয়েকবার আমার মায়ের গায়ে হাতও তুলেছে। আমার মা সেই রাগে বাড়িছাড়া হয়েছিল। সেদিন ছাদে আমিও তোকে থাপ্পড় মেরে দিতাম, যদি ছাদে আর কেউ না থাকতো।“ কথাটা শুনে দিয়া অরণ্যর হাতটা ধরে নিজের নরম গালে ছোঁয়ালো।বলল, “মারো তুমি আমাকে যত জোরে ইচ্ছে!” অরণ্য শ্বশব্যস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি ওর হাতটা সরিয়ে নিতে চাইলো। দিয়া ছাড়লো না। অরণ্যর বলিষ্ঠ, রুক্ষ হাতের ছোঁয়াটা নিজের গালে অনুভব করতে করতে বলল, “তুমি আমাকে মারার কথা ভেবেছিলে বলে এত অপরাধবোধে ভুগছো, অথচ অতো রাগ করেও তো তুমি আমাকে পরীক্ষার আগে কত বেশি বেশি সময় দিয়েছো। এত তো কেউ কারুর জন্য করে না। বলতে গেলে তুমি আমাকে চামচে করে গিলিয়ে দিয়েছো পড়াগুলো। কেন এতটা দায় নিজের ঘাড়ে নিয়েছিলে? তুমি আমার জীবনে আসার আগে আমার নিজেকে নিয়ে কত কনফিডেন্সের অভাব ছিল তা জানো! তোমার খারাপটা শুধু মনে রাখবো! ভালোটা নয়!”
-“ওটুকু উপকার অতো বড়ো করে দেখার কিছু নেই। তুইও আমার অনেক উপকার করেছিস।আমার সেদিনের অসুস্থতায় অনেক সেবা করেছিলি আমার। তাছাড়া আমি যতই তোকে অঙ্ক শেখাই, ফিজিক্স কেমিস্ট্রি শেখাই, আমি তোকে মারতে পারি না।“
দিয়া বলল, “আমি তোমার উপকার করেছি! বেশ, ডায়রি পড়ার অপরাধের থাপ্পড়টা আগে মেরে দাও, তারপর না হয় সেই উপকারের জন্য কিছু…. “
-“উপকারের জন্য কী?”
দিয়া একথার জবাব দিল না। তবে ওর শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হচ্ছে। অরণ্যর হাতটা ও নিজের গালে আরো জোরে চেপে ধরল। দিয়ার চোখে না বলা এক তৃষিত আকুতি। অরণ্য ওর হাতটা ছাড়িয়ে নিল দিয়ার হাত থেকে। বলল, “হাত থেকে সিগারেটটা ফেল।“ দিয়া সচকিত হয়ে বলল, “কেন?”
-“তখন থেকে খামোখাই বাঁ হাতে ধরে রেখেছিস, বেকার পুড়ছে হাতে।“
-“না না, এই খাচ্ছি।“
-“না খেতে হবে না।“অরণ্যর গলায় এবার আদেশের সুর। “কেন?” দিয়া বলল।
-“ধূমপান করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তুই তো বলেছিলি!”
-“তুমি যে খাও!”
-“আমি আর খাবো না। আজ থেকে ছেড়ে দিচ্ছি।“
-“সেকি! কেন?”
-“তুই বারণ করেছিস যে!”
-“সত্যি?”
-“ইয়েস বেবি!”
দিয়া অরণ্যর মুখের দিকে খুশি হয়ে তাকালো। অরণ্য এবার বলল, “দিয়া সত্যি করে বল তো, আমার মায়ের এখানে আসার পেছনে তোর কোনো হাত আছে কিনা!” দিয়া আবার ভয় পেয়ে গেল। জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “আমি সত্যি কিছু জানতাম না উনি এই সময়ে এখানে আসবেন।“ অরণ্য ভালো করে দিয়ার মুখের দিকে তাকালো। বলল, “সত্যি?” দিয়া অরণ্যর চোখের দিকে তাকাতে পারছিলো না। অরন্যর এই দৃষ্টিটার সামনে ও বরাবরই নার্ভাস হয়ে যায়। ও মাথা নিচু করে বলল, “ না, উনি তো আমাকে ওইদিন কিছুই বলেন নি…. “
-“ওইদিন!কোনদিন?” অরণ্য ভুরু তুললো। দিয়া ততক্ষনে মনে মনে জিভ কাটছে। সেই আবার বেফাঁস কথা বেরিয়ে গেল তো!
এমন সময়ে অরণ্যর ফোনটা বেজে উঠল। শুভেন্দু ফোন করে জানালো, আজ রাতে আর ও এই হোটেলে ফিরবে না। মালবিকার সঙ্গেই থাকবে। অরণ্য ফোনটা রেখে দিয়ার দিকে তাকালো। অরণ্য কিছু বলার আগেই দিয়া কাঁদো কাঁদো ভাবে বলে উঠল, “ও অরণ্যদা…প্লিজ তুমি আমার উপর রেগে যেও না। আমি স্বীকার করছি, আমি একদিন গেছিলাম ওনার এড্রেস খুঁজে খুঁজে ওনার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে। ওনাকে বলতে গেছিলাম, উনি যেন তোমার সঙ্গে একটু কথা বলে মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিংটা একটু মিটিয়ে নেন।বিশ্বাস করো, আমার এর মধ্যে কোনোরকম স্বার্থ নেই।তবে উনি এখানে এই সময়ে চলে আসবেন, এটা আমায় বলেন নি।তবে সেদিন ওনার কথায় মনে হল ওনার মধ্যে একটা গিলটি কাহিনী করছে।“অরণ্য বলল, “কেন?” দিয়া বলল, “এই যে ছোটবেলাতেই তোমাকে ছেড়ে চলে আসা…তারপর এতগুলো বছর সম্পূর্ণ একলা কাটানো। ওইদিন উনি বলছিলেন, জীবনে যথেষ্ট টাকা রোজগার করলেও ইদানিং ওনার মনে হ্য়, পরিবার থাকাটাও প্রয়োজন।“ অরণ্য হঠাৎ বলল, “আচ্ছা দিয়া, বাবা বলল, আজ মায়ের সঙ্গে থাকবে! কী হচ্ছে বল তো?”
-“ভালো তো!”
-“এখানে তো আমরা কজন ঘুরতে এসেছি, তার মধ্যে বাবা হঠাৎ আলাদা কেন হয়ে গেল?”
-“নিশ্চয়ই কাল ফিরে আসবেন। লেট দেম টক।“
-“কী কথা হবে ওদের মধ্যে? ইগোর লড়াই? ঝগড়াঝাঁটি?”
-“মনে তো হচ্ছে না।“
অরণ্য চুপ করে রইলো। দিয়া বলল,“একটা কথা বলবো?”
-“বল!”
-“তোমার বাবা-মায়ের সম্পর্কটা নিয়ে তুমি এত কষ্ট কেন পাও? তোমার মা তো তাও তোমার অনেকটা ছোটবেলায় চলে গেছিলেন। তুমি চোখের সামনে ওনাদের ঝগড়া দেখো নি। অথচ, এমন কত ছেলে-মেয়ে আছে, যারা রীতিমতো চোখের সামনে বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখে। সেপারেশন হতে দেখে। তারা তো ওসব নিয়ে ভাবে না বড়ো হয়ে! তাছাড়া তোমার মা কত স্ট্রং একজন মহিলা ভাবো! ইন্টারভিউতে উনি নিজের পার্সোনাল লাইফ নিয়ে কথা কোনোদিন বলেন নি, তবে সেদিন আমাকে ওনার স্ট্রাগলটার গল্প করছিলেন। উনি নাকি প্রথম প্রথম কলকাতায় এসে লোকের বাড়ি বাড়ি রান্না করে নিজের পেট চালাতেন। আমি যতদিন অবধি অংক পারতাম না, আমাকে আমার বাবা-মা ব্যঙ্গ করতো আমাকে নাকি লোকের বাড়ি বাড়ি রান্না করে খেতে হবে! যেন সেটা খুব খারাপ কাজ! তোমার মা সেদিন বললেন, কোনো কাজ ছোট নয় দেবাংশী। জীবনে বিয়ে করো আর নাই করো, নিজের পায়ে অবশ্যই দাঁড়াবে যে করেই হোক।খুব ভালো লেগেছিলো কথাটা।“
-“বাইরে থেকে মোটিভেশন দেওয়া অনেক সোজা দিয়া। নিজের সন্তানকে যে মা ছেড়ে চলে যায় নিজে থেকে, সে বাইরে কাকে কী জ্ঞান দিয়ে বেড়াচ্ছে, সেটা তাকে এমন কিছু মহান করে তোলে না।“
-“আর বাবা চলে গেলে! অনেক সেপারেটেড হয়ে যাওয়া কাপলদের বেলায় দেখা যায় তাদের সন্তান বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মায়ের কাছেই বড়ো হয়। তাদেরও কি বাবার উপর অভিমান থাকে!”
-“অভিমান থাকবে কিনা সেটা ডিপেন্ড করে তার বড়ো হয়ে ওঠাটা কেমন হচ্ছে।“
-“তোমার বড়ো হয়ে উঠতে কোনো প্রবলেম হয়েছে?কাকু তো তোমাকে অনেক স্নেহ দিয়েই বড়ো করেছে। তোমার জীবনে কি স্নেহের অভাব ছিল?”
-“বাবাকে তো পেতাম একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। সারাদিন থাকতাম ঠাকুমার কাছেই । আমার যখন আট বছর বয়স তখন ঠাকুমা মারা গেলো। ঠাকুরদা ভীষণ উদাসীন হয়ে গেলো তখন থেকে।একজন কাজের মাসির কাছে বড়ো হতে লাগলাম। সে এসে সারাক্ষন টিভি ছেড়ে বসে থাকতো !কোনো বায়না করলে বিরক্ত হতো।বাবাও ফিরে এসে ক্লান্ত থাকতো। খুব ছোটবেলাতেই বুঝে গেছিলাম, নিজের প্রবলেমগুলো কাউকে বলা যাবে না, সব নিজেকেই হ্যান্ডেল করতে হবে।“
দিয়া কিছু না বলে অরণ্যর হাতটা ধরে চুপ করে রইলো। অরণ্য আবার বলল, “মালবিকা দাশগুপ্ত ভীষণ স্ট্রং, হার্ড ওয়ার্কিং, ক্যারিয়ারিস্ট একজন মানুষ। তার জার্নিটাকে আমি সন্মান করি। ওনার আত্মমর্যাদাবোধ প্রবল। সবই ভালো কথা। তবে ইন্ডিপেন্ডেন্ট, সেলফ মেড মহিলা কি আর কেউ নেই? তার জন্য কি নিজের সন্তানকে কেউ অবহেলা করে!ওদের বনিবনা হয় নি সেটা মানলাম।নাহয় আমি সব সুবিধা ভেবে বাবার কাছেই বড়ো হতাম, তাই বলে কি এতগুলো বছরে আমার সঙ্গে একবারও নিজে থেকে কোনো যোগাযোগ করতে নেই!অনেকেরই বাবা মায়ের কর্মক্ষেত্র আলাদা হয়। তাদের সন্তান তো স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয় না তাই বলে!উনি আসলে একবার স্বাধীনতা পাওয়ার পর আর কোনো দায়িত্বে জড়াতে নিজেকে ভয় পেয়েছেন।সন্তানের জন্ম দেওয়াটাও উনি দায় পড়েই করেছেন, একথা উনি নিজের মুখে স্বীকার করেছেন।এই পৃথিবীতে আমি হলাম একখানা বাড়তি বোঝা বুঝলি?“
দিয়া বলল, “ একথা বলো না। তুমি বাড়তি বোঝা নও, তুমি কতজনের কাছে কত মূল্যবান তা জানো! এই ধরো আমার কাছেই তোমার ভ্যালু কতখানি সেটা যদি তোমাকে আমি বোঝাতে পারতাম! আর তোমার মা হয় তো কম বয়সে এই ভুলগুলো করেছেন তোমার সঙ্গে। তবে তোমার কোনো ক্ষতি হয় নি সেভাবে। যদি তুমি বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখে বড়ো হতে, সেটার এফেক্ট আরো বাজে হত জানো?“
-“হম।“
-“এগুলো ভেবে কষ্ট পেও না আর। প্রতিটা মানুষের মধ্যেই কিছু না কিছু ভালো খারাপ থাকে। তুমি, আমি, তোমার বাবা-মা, আমার বাবা-মা.. আমরা সবাই কিছু না কিছু দোষেগুণে মানুষ।আমরা সবাই এক একজন ধূসর চরিত্র। বা বলা যেতে পারে আমরা আসলে এক একজন বর্ণময় চরিত্র। আমাদের ধূসর মস্তিষ্ক আশেপাশের বর্ণময় চরিত্র নিয়ে জীবনের ছবি তৈরি করে।এক একজন এক একরকম বলেই লাইফটা বোরিং হয়ে যায় না। জাস্ট ফরগিভ এভরিওয়ান।“
অরণ্য একটু হেসে দিয়ার গালে আলতো করে হাত ছোঁয়ালো।এর মধ্যে প্রতাপ আর কাকলি চলে এসেছে। আগুনের ওখানে চেয়ারে বসে কাকলি ডাকলো ওদের। সেদিকে যেতে যেতে দিয়া ফিসফিস করে বলল, “এমন ধারণা একদমই রেখো না, স্নেহা তোমার মায়ের কারণেই চলে গেছে। বাবা-মা থাকা সত্ত্বেও হাজার হাজার ছেলে মেয়ের ব্রেকাপ হচ্ছে। যে যাওয়ার সে এমনিও যাবে। যে থাকার সে, থেকে যাবে।“
(আগামী পর্বে সমাপ্য)
© Asmita Roy