ধূসর_রঙের_জলছবি #অস্মিতা_রায় (দুই )

0
270

#ধারাবাহিক
#ধূসর_রঙের_জলছবি
#অস্মিতা_রায়
(দুই )
পার্কটা বাড়ি থেকে খুব একটা দুরে নয়। আজকাল এখানে প্রাতঃভ্রমণে আসাটা প্রতাপ রায়চৌধুরীর একটা অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডাক্তার বলেছেন সুগার বেড়েছে তার। খাওয়া দাওয়া নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে মর্নিং ওয়াক করারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। আর বারবার বলেছেন টেনশন কমাতে হবে। এই টেনশনটাই প্রতাপ কমায় কি করে! ওষুধের দোকান আছে তার।ব্যবসায় লাভ লোকসান লেগেই রয়েছে। কিছুদিন আগে এক কর্মচারী কিছু টাকা চুরি করে পালিয়েছে।ইদানিং তার আরেক চিন্তার কারণ হল দিয়া। সামনের বছর মাধ্যমিক মেয়েটার। তবে ওর নাম্বার দেখে কোনো ভালো ফল করার আশা দেখছে না প্রতাপ। মেয়েটা এমনিতে বড়ো শান্ত আর বাধ্য। নিজের সাধ্যমতো লেখাপড়াটা ঠিকই করে। ক্লাসে এক থেকে দশের মধ্যে থাকে ঠিকই, তবে ওর অংকের নম্বর বরাবর খুব কম ওঠে। সায়েন্স না পেলে তো আত্মীয়মহলে মুখ দেখাতে পারবে না ওরা। এই সব ভেবে আজকাল অনেক চিন্তায় থাকে প্রতাপ আর তার স্ত্রী।
পার্কটা দু’পা হেঁটে একটা বেঞ্চে বসল প্রতাপ।তাকে দেখে এগিয়ে এলো এক তরুণ। জিজ্ঞেস করল, “কাকু হাঁপিয়ে গেলেন নাকি?”প্রতাপবাবু হেসে বলল, “ এই একটু জিরিয়ে নিচ্ছি আর কি!তোমার কী খবর ইয়ং ম্যান?” ছেলেটিও পাশে এসে বসল তার। ছেলেটাকে চেনে প্রতাপ । নাম অরণ্য।তাদেরই আপার্টমেন্টের দোতলার ওয়ান বিএইচকে ফ্ল্যাটটায় এক বছর আগে ভাড়া এসেছে। ছেলেটার আসল বাড়ি ফারাক্কা শহরে। খুব ভালো ছাত্র। কোলকাতার নামকরা একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তে এসেছে। ছেলেটাকে বেশ লাগে প্রতাপের । যাওয়া আসার সময় এপার্টমেন্টের করিডোড়ে অরণ্যর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হতো তার। তবে কথাবার্তা হয় নি। আলাপ হল এই পার্কে মর্নিং ওয়াকে এসে। অরণ্য এখানে প্রতিদিন দৌড়োতে আসে সকালবেলা করে। একদিন হাঁটতে হাঁটতে প্রতাপের শরীরটা ভারী খারাপ লাগছিল। সারা গা ঘেমে উঠছিলো তার।প্রতাপ বুঝতে পারছিল রক্তে শর্করার মাত্রা নেমে যাচ্ছে। কোনোমতে একটা বেঞ্চে বসে পড়েছিল সে । তার অবস্থা দেখে দৌড়ে এসেছিলো অরণ্য। প্যান্টের পকেট থেকে বের করে দিয়েছিল চকোলেট। এগিয়ে দিয়েছিল জলের বোতলও। সেই প্রথম অরণ্যর সঙ্গে ভালোভাবে আলাপ তার। মাঝে মাঝেই মর্নিং ওয়াকে এসে অরণ্যর সঙ্গে গল্প করে সে । ঝকঝকে ছেলেটাকে বেশ লাগে তার। কেউ কেউ থাকে যারা যে কোনো বয়সের মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। অরণ্য হচ্ছে তেমনই একটা ছেলে। দিনকাল, রাজনীতি, খেলাধুলা, সাহিত্য, বিজ্ঞান সব কিছু নিয়েই ছেলেটার সঙ্গে গল্প করা যায়। বয়সের তুলনায় অরণ্য অনেক বেশি পরিণত। তবে ওর মধ্যে কোনো জ্যাঠামো ভাব নেই। প্রাণশক্তিতে ভরপুর ছেলেটির সঙ্গে কথা বলতে বলতে প্রতাপও যেন ফিরে যায় নিজের সেই তারুন্যের দিনগুলোতে।
আজ অরণ্যকে দেখে প্রতাপের মাথায় হঠাৎ একটা ভাবনা ঝিলিক দিয়ে উঠল। একবার চেষ্টা করে দেখাই যাক না! গলাটা খাঁকড়ে প্রতাপ বলল, “অরণ্য তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল।” অরণ্য বলল, “হ্যাঁ বলুন।”
-“তুমি বলেছিলে না যে তুমি দুটো ছেলেকে জয়েন্টের জন্য ফিজিক্স পড়াও?”
-“হ্যাঁ।”
-“তুমি কি একটু সময় বের করে আমার মেয়েটাকে একটু পড়িয়ে দিতে পারবে? দিয়ার এবার ক্লাস টেন হল। সায়েন্স গ্রুপ, স্পেশালি অংকে ওর অবস্থা খুব খারাপ। যদি তুমি একটু ওর উন্নতি করে দিতে পারো, তাহলে খুব ভালো হয়।”
অরণ্য কথাটা শুনে চটজলদি কোনো জবাব দিল না। একটু ভেবে বলল, “ঠিক আছে। আপাতত আমি সপ্তাহে একদিন গিয়ে দেখছি। যদি মনে হয় উন্নতি হচ্ছে তাহলে দুদিন যাবো।” প্রতাপ বলল, “আচ্ছা তাই হোক।”
বাড়ি ফিরে প্রতাপ অরণ্যর কথাটা স্ত্রী কাকলিকে বলল। দিয়া তখন বাড়িতে ছিল না।কাকলি শুনে বলল , “সুবীর স্যারের কোচিং-এ দিয়ার কোনো উন্নতি হল না। আর অরণ্য তো দুদিনের ছেলে। ও কি পারবে দিয়ার কোনো উন্নতি ঘটাতে!মাঝখান থেকে কোনো উল্টোপাল্টা কিছু না হয়। দিয়া কিন্তু উঠতি বয়সের মেয়ে। আগুন আর ঘি পাশাপাশি থাকলে কি হয় তা জানো তো!” প্রতাপ আশ্বস্ত করল, “না গো অরণ্য ছেলেটা ভালো। এই বয়সেই যথেষ্ট পার্সোনালিটি আছে।ভালো ঘরেরও ছেলে। আর সুবীর স্যারের কাছে তো দিয়া পড়বেই। অরণ্যকে একমাস রেখে দেখাই যাক না। যদি দিয়ার উন্নতি না হয় তাহলে না হয় ওকে বারণ করে দেওয়া যাবে। ছেলেটার নিজেরও তো পড়াশুনা আছে।” এরপর কাকলি আর কিছু বলল না।
দিয়া বাড়ি ফেরার পরে প্রতাপ দিয়াকে জানাল এখন থেকে অরণ্য ওকে সপ্তাহে একদিন করে পড়াতে আসবে। কথাটা শুনে দিয়ার মুখ কেমন আচমকাই রক্তবর্ণ হয়ে গেল। ঢোক গিলে দিয়া বলে বসল, “আমি ওর কাছে পড়বো না।”একটু অবাক হয়ে প্রতাপ জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

*************************************

-“একটা চাকরি পেতে দে। তারপর তোর বাড়িতে গিয়ে আমি বিয়ের কথা বলবো। ”
-“অসম্ভব!”
-“কেন?”
-“আমি তোকে কিছুতেই বিয়ে করবো না।”
-“কেন তুই এভাবে বলছিস? আমি কি তোর যোগ্য নই? ”
-“যোগ্যতা বিচার করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না কৌস্তভ । আর তুই চাকরি পেয়েও যতই রোজগার করিস না কেন, আমাদের বিয়ে হওয়াটা ঠিক নয়। বিয়ে করলে আমাদের সম্পর্কটা শুধু তোর আমার মধ্যেই থাকবে তা তো নয়! আরো অনেকে এসে যাবে আমাদের মধ্যে।অনেক জটিলতা আসবে জীবনে। দরকার কি এসবের?”
-“ কথাগুলো তুই ঠিকই বলছিস, তবু আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তোকে না পেলে আমি থাকবো কি করে!”
-“আরে কষ্ট তোর দুদিন পরেই ঠিক হয়ে যাবে। ওসব নিয়ে ভাবিস না। এখন তুই মন দিয়ে পড়। নিজের পরিবারের পাশে দাঁড়া।”
-“শুধু নিজের পরিবার নয় মালবিকা। তোর জন্যও আমি সবসময় আছি। যেকোনো রকম দরকারে আমাকে তুই সব সময় পাশে পাবি।”
কথাগুলো মনে পড়ে চোখদুটো ঝাপসা হয়ে গেল মালবিকার। কী দেখেছে কৌস্তভ ওর মধ্যে কে জানে! ও তো অতি সাধারণ একটা মেয়ে সব দিক থেকেই!একই পাড়ায় বাড়ি মালবিকা আর কৌস্তভের । ছোটো থেকেই বন্ধুত্ব ওদের। একই স্কুলে পড়েছে দুজন ছোটবেলায়। এরপর কলেজ আলাদা হলেও ওদের বন্ধুত্ব অক্ষুন্ন ছিল বরাবর।বন্ধুত্ব থেকে কখন যে কৌস্তভ মালবিকার প্রেমে পড়ে গেল এতখানি, সেটা ওরা কেউই বোঝে নি। কৌস্তভের বাড়ির অবস্থা বিশেষ ভালো না। ওর বাবা একটা মুদির দোকানের কর্মচারী। মালবিকার বাবা একজন স্কুলের টিচার। সামাজিক উচ্চনিচের ভেদাভেদকে উপেক্ষা করে লড়াই করার মতো ক্ষমতা ছিল না মালবিকার।আর ওর নিজের যে কৌস্তভের প্রতি বিরাট কিছু টান ছিল তাও নয়। তবে কৌস্তভের ওকে পাওয়ার জন্য আকুল আর্তি ওকে অবাক করেছে বারবার। কী এমন দেখেছে ছেলেটা ওর মধ্যে! দেখতে মালবিকা অতি সাধারণ। গায়ের রঙ কালো।পড়াশুনাতেও তেমন কিছু আহামরি নয়। ছোটবেলায় কিছু বছর গান শিখেছিল মালবিকা । গানের জন্য কিছু প্রাইজ পাওয়া ছাড়া আর কী বা তেমন করতে পেরেছে ও! কৌস্তভকে এসব কথা বললে ও বলে, “তুই নিজেকে এত তুচ্ছ ভাবিস কেন? তোর মধ্যে একটা স্পার্ক আছে। আমার মন বলে তুই জীবনে অনেক বড়ো কিছু করবি। নিজের যে গুণটাকে তুই খাটো করে দেখছিস সেটা কজনের মধ্যে থাকে বল তো। আর তোর গায়ের রঙের কথা বলছিস? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে কৃষ্ণকলিকে মনে নেই? সেই যে কাজল কালো চোখ যার!তোর চোখগুলোও তেমন। একটা অদ্ভুত দীপ্তি আছে তোর টানা টানা চোখদুটোয়।” এসব কথা শুনে মালবিকা আয়নায় দেখতো নিজেকে বারবার। সত্যি কী ওর মধ্যে আছে সেই দীপ্তি?
শুভেন্দুর সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে আর কৌস্তভের সঙ্গে সেভাবে কথা হয় নি। শ্বশুরবাড়ির ফোন নম্বরটা এমনি দিয়ে রেখেছিল কৌস্তভকে। বিয়ের পর এক বছরের মাথায় কৌস্তভ একদিন ফোন করে জানালো যে ও চাকরি পেয়েছে ব্যাংকে। পোস্টিং কলকাতায়। কলকাতায় গিয়ে নিজের নতুন ঠিকানার ফোন নম্বরটা মালবিকাকে দিয়েছিল কৌস্তভ। এর আরো একবছর বাদে টুবলু এলো। মালবিকা আর শুভেন্দুর ছেলে। তবে আজ নিজের নাড়িছেঁড়া ধনকে ছেড়ে রেখে মালবিকাকে বেরিয়ে পড়তে হয়েছে এক অনিশ্চয়তার পথে। কৌস্তভকেই ফোন করে সবটা জানিয়েছিল মালবিকা। প্রথমটায় থমকে গেছিল কৌস্তভ।বলেছিল, “হুট করে সিদ্ধান্ত নিস না। ভাবার জন্য নিজেকে সময় দে।”
-“গত তিনবছর ধরে ভেবেছি।মনে হয় না আর ভাবার মতো কিছু আছে।”
-“টুবলুর জন্য কষ্ট হবে না? ”
একটু থেমে মালবিকা বলেছিল, “টুবলু ভালো থাকবে ওর বাবার কাছে। ওর ঠাকুরদা, ঠাম্মা, দাদু, দিদা সবার আদরে ও খুব ভালোভাবে বেড়ে উঠবে। ও ভালো থাকলেই আমি খুশি। ”
-“তোকে কিন্তু অনেক চাপ নিতে হবে।”
-“জানি। তুই থাকবি না আমার পাশে? বেশিদিন আমি তোর বোঝা বাড়াবো না। শুরুতে কটাদিন যদি একটু হেল্প করিস.. ”
-“আমার হেল্প করা নিয়ে তোকে কোনো চিন্তা করতে হবে না। কবে আসবি তাহলে বল।”
-“যত তাড়াতাড়ি টিকিট পাবো।”
-“বেশ। আমি নিয়ে আসবো তোকে।”
সেই কথা মতো আজ বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে মালবিকা। ও জানে না এর পরিণতি কী। আসার সময়ে শুভেন্দুর উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখে এসেছে ও। ট্রেন এগিয়ে চলেছে কলকাতার দিকে। পাশে বসা কৌস্তভের দিকে তাকালো মালবিকা। আলতো করে একবার ওর হাতটা ছুঁয়ে দিল কৌস্তভ। সেই ছোঁয়ায় রয়েছে অনেকখানি ভরসার আশ্বাস।

(ক্রমশ )

© Asmita Roy

—————————————————————–

পরবর্তী পর্ব আসতে চলেছে খুব তাড়াতাড়ি। আপডেট পাওয়ার সুবিধার জন্য এই পেজটি ফলো করে সঙ্গে থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here